মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/প্রথম খণ্ড/পাঁচ

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ৩৬-৪২)

—পাঁচ—

 নিকোলাই কিছু মিথ্যা বলেনি,—পেভেলের বাড়িটা সমস্ত পল্লির ভীতি, আতঙ্ক এবং সন্দেহের কেন্দ্র হ’য়ে পড়লাে। চারপাশে সময়ে-অসময়ে নানান প্রকৃতির লােক নিঃশব্দে ঘু’রে বেড়ায়—বাড়ির গােপন রহস্য ভেদ করবে ব’লে। তাড়িখানার মালিক··· বুড়ো একদিন মাকে পথে পেয়ে বললাে, কেমন আছাে গাে? তােমার ছেলের খবর কি? বিয়ে দিচ্ছ না কেন? বিয়ে দিয়ে দিলেই তােমাদের পক্ষে মঙ্গল। আর বিয়ে হলে মানুষ ও সামাল থাকে। আমি হ’লে কবে বিয়ে দিয়ে দিতুম। কী দিন-কাল পড়েছে বােঝতো···‘মানুষ’ নামধেয় পশুটির ওপর এখন কড়া নজর রাখা দরকার। মানুষ এখন মগজ খাটিয়ে বাঁচতে চায়, চিন্তা ক’রে ক’রে তারা উচ্ছৃঙ্খল হ’য়ে উঠেছে। এমন-সব কাজ করছে, যা দস্তুরমতাে অন্যায়। গির্জায় যায় না, মেলায়-মহোৎসবে যােগ দেয় না, খালি আনাচে-কানাচে ব’সে দল পাকায় আর ফিস-ফাস করে। এতে ফিসফাস কেন বাপু?

 ফিস-ফাস না করে খােলাখুলি তাড়িখানার লােকেদের সামনে দাঁড়িয়ে বলুক না—সে সাহস নেই। আমি জানতে চাই, কি এ? গােপনীয়? গােপনীয় স্থান একমাত্র পবিত্র গির্জা···অন্য-সব কোনায় ব’সে কানাঘুষ্ ঘুষি ভ্রান্তি, মায়া, বুঝলে···

 লম্বা বক্তৃতা শেষ করে বুড়াে চলে গেলাে। মা বিব্রত হ’য়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এরপরে সাবধান করে গেলাে এক পড়শী বুড়ি। মা বাড়ি এসে ছেলেদের সব খুলে বললেন—তোরা বিয়ে করছিস না, মদ খাচ্ছিস না, অথচ সন্দেহজনক মেয়েদের সঙ্গে মিশছিস···তাই পাড়ার সব, বিশেষত, মেয়েরাও তোদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

 পেভেল বিরক্ত হ’য়ে বললো, বেশ, যাক।

 এণ্ড্রি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে বললো, আস্তাকুঁড়ে সব-কিছুতেই পচা গন্ধ। বোকা মেয়েগুলোকে তুমি কেন বুঝিয়ে দিলে না, মা, যে, বিয়ে কী চিজ। তা’হলে তারা হাড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেবার জন্য এতো ব্যস্ত হ’য়ে উঠতো না।

 মা বললেন, তারা সবই দেখে, বাবা, সবই জানে, জানে তাদের ভবিষ্যত কতো দুঃখময়! কিন্তু কি করতে পারে তারা? আর কোন পথ নেই তাদের।

 পেভেল বললো, বুদ্ধিই তাদের মোটা, নইলে পথ তারা খুঁজে পেতো।

 মা বললেন, তোরাই কেন তাদের বুদ্ধি শোধরাস না, বাবা? বুদ্ধিমতী যারা তাদের ডেকে দুটো কথা বল্‌না!

 কিছু হ’বে না তাতে—পেভেল জবাব দিল।

 এণ্ড্রি বললো, আচ্ছা, চেষ্টা ক’রেই দেখা যাক না।

 খানিকক্ষণ চুপ থেকে পেভেল বললো, হাঁ, আজ কাজের নাম ক’রে মেয়েদের সঙ্গে মিশবে, কাল হাত ধরাধরি ক’রে জোড়ায় জোড়ায় বেড়াবে, তারপর হবে বিয়ে। বাস্‌···সব শেষ জীবনের।

 মা ছেলের এই বিবাহ-বিমুখতার চিন্তিত হ’য়ে উঠলেন।

 একদিন মা শুয়েছেন ঘুমুবেন ব’লে—ও কামরায় এণ্ডি-পেভেল কি কথা বলছে শুনতে পেলেন।

 এণ্ডি বলছে, তুমি জানো ন্যাটাশাকে আমি পছন্দ করি?

 জানি।

 ন্যাটাশা কি এটা লক্ষ্য করেছে?

 পেভেল নিরুত্তরে ভাবতে লাগলো। এণ্ডি স্বর আরো নীচু ক'রে বললো, কি মনে হয় তোমার?

 লক্ষ্য করেছে, আর সেই জন্যই সে মজলিসে আসা ছেড়ে দিয়েছে।

 এণ্ড্রি, নীরব উদ্বেগে খানিকক্ষণ পায়চারি করে বললো, যদি আমি তাকে একথা বলি?

 কি কথা?...বন্দুকের গুলির মতো পেভেলের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে পড়লো।

 চাপা গলায় এণ্ড্রি বললো—যে আমি…।

 পেভেল বাধা দিয়ে বললো, কেন?

 এণ্ড্রি, বাধা পেকে মুহূর্তে স্তব্ধ থেকে একটু হেসে বললো, দেখো বন্ধু, কোন মেয়েকে যদি তুমি ভালোবাসো, তাকে সেটা বলা চাই; নইলে ভালোবাসাটাই বৃথা। ...

 সশব্দে পাঠ্য বইখানা বন্ধ ক’রে পেভেল বললো, কিন্তু তাতে ফয়দা হ’বে কি বলতে পারো?

 “অর্থাৎ?” এণ্ড্রি জিজ্ঞাসুনয়নে পেভেলের দিকে চাইলো।

 পেভেল ধীরে ধীরে বললো, এণ্ড্রি, কি তুমি করতে যাচ্ছ, সে সঙ্গন্ধে তোমার মনে পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই। ধরে নিলুম, সেও তোমাকে ভালোবাসে, যদিও আমি তা’ বিশ্বাস করিনা, তবু ধ’রে নেওয়া গেলো। তারপর বিয়ে হ'ল। চমৎকার মিলন—পণ্ডিতের সঙ্গে মজুরানির সংযোগ। তারপর এলো। পুত্রকন্যর বন্যা…পরিবারের জন্যই তোমাদের ব্যস্ত থাকতে হবে…সংসারের শতকরা নিরানব্বুই জন যেমন ক’রে জীবন কাটায়, তোমারও তেমনি কাটবে। তোমাদের এবং ছেলে-মেয়েদের জন্য আহারের রুটি এবং বাসের কুটিরের সংস্থান করতে করতে জীবন কাটাবে। যে ব্রত নিয়ে আমরা নেবেছি, তার পক্ষে তোমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকবেনা—তোমার এবং ন্যাটাশার!

 এণ্ড্রি চুপ ক’রে রইলো। পেভেল এবার সুর নরম করে বললো, এসব, ছেড়ে দ্বাও এণ্ড্রি। একটা মেয়েকে নিয়ে মজে যেয়োনা, স্থির হও,—এই হচ্ছে একমাত্র শ্রেয় পথ।

 এণ্ড্রি বললো, কিন্তু আলেক্‌সি আইভানোভিচ কি বলেছিলেন মনে আছে? মানুষকে পরিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে হ’বে···দেহের এবং আত্মার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ ক’রে, —মনে আছে পেভেল!

 পেভেল সোজা জবাব দিলো, সে আমাদের জন্য নয়, এণ্ড্রি? পরিপূর্ণ জীবন কি করে লাভ করবে তুমি···তা যে তোমার নাগালের বাইরে। এণ্ড্রি, যদি ভবিষ্যৎকে ভালোবাসো, ভবিষ্যৎকে চাও, তবে বর্তমানের সব-কিছু তোমায় ত্যাগ করতে হ’বে—সব কিছু।

 মানুষের পক্ষে তা’ শক্ত—এণ্ড্রি বললো।

 কিন্তু আর কি করার আছে? ভেবে দেখো।

 এণ্ড্রি আবার চুপ···ঘড়ির টিক টিক শব্দে যেন জীবন থেকে এক একটা মুহূর্ত কেটে নিচ্ছে।···শেষে এণ্ড্রির কথা ফুটলো, আদ্দেক প্রাণ বাসে ভালো, আদ্দেক করে ঘৃণা!—এই কি প্রাণ?

 আমি জিগ্যেস করি, তোমার আর কি করার আছে?···ব’লে পেভেল বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলো।

 তা হ’লে আমার চুপ করে থাকতে হবে?

 হাঁ, তাই উচিত।

বেশ, তাই হবে। এই পথেই চলবো আমরা, কিন্তু পেভেল তোমার যখন এদিন আসবে তখন তোমার পক্ষে শক্ত হ’বে এ আদর্শ।

 শক্ত এখনই হয়েছে, এণ্ড্রি।

 বলো কি!

 হ্যাঁ!

এণ্ড্রি চুপ করে গেলো, বুঝলো পেভেলও কোন মেয়েকে ভালোবেসেছে···কিন্তু ব্রতের খাতিরে প্রেমকে সে দমন করে রেখেছে। পেভেল যা’ পেরেছে, সে কেন তা’ পারবে না! নিশ্চয়ই পারবে।


 পল্লিময় হুলস্থুলু—সোসিয়ালিস্টরা লাল-কালিতে-ছাপা ইস্তাহার ছড়াচ্ছে মজুরদের মধ্যে। তাতে কারখানার মজুরদের শোচনীয় অবস্থা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো ক’রে লেখা, কোথায় কোন্ ধর্মঘট হচ্ছে তার ফিরিস্তি,···সর্বশেষে মজুদের সংঘবদ্ধ হ’য়ে স্বার্থরক্ষাকরে লড়াই করবার জন্যে উত্তেজনাপূর্ণ আবেদন।

 মোটা মাইনে যারা পায়, তারা সোশিয়ালিস্টদের গাল দিয়ে ইস্তাহার নিয়ে কর্তাদের কাছে জমা দেয়। তরুণরা সাগ্রহে প্রত্যেকটি কথা গেলে, উত্তেজনার চঞ্চল হ’য়ে বলে, সত্যিই তো তাই! কিন্তু বেশির ভাগই শ্রমক্লান্ত—নিরাশ হৃদয়। ঘাড় নেড়ে বলে, হুজুগ, হুজুগ—এতে কিছু হ’বে না, হবার জো নেই। সে যা’ বলুক সবার প্রাণেই কিন্তু একটা চাঞ্চল্য···একদিন যদি দেরি হ’ল ইস্তাহার বের হ’তে অমনি আলোচনা আজো বেরুলোনা, ছাপা বন্ধ হয়ে গেলো বুঝি! তারপর সোমবারে ইস্তাহার বেরুলে আবার আন্দোলন।

 মা জানতেন, এসবের মূলে তাঁরই ছেলে। তাঁর আনন্দও হ’ত, শঙ্কাও হ’ত। একদিন সন্ধ্যায় এসে সেই পড়শী বুড়ি খবর দিয়ে গেলো, নাও এইবার, ঠ্যালা সামলাও; আজ রাতেই পুলিস আসছে, তোমাদের বাড়ি আর নিকোলাইদের বাড়ি, আর মেজিনদের বাড়ি...

 মা ধপ্ ক’রে চেয়ারে বসে পড়লেন,—তাঁর মাথা ঘুরছে, সমস্ত শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। কিন্তু ছেলের আসন্ন বিপদের কথা মনে পড়তেই সাহসে তাঁকে বুক বেঁধে উঠতে হল। প্রথমেই তিনি মেজিনকে খবরটা দিয়ে এলেন, মেজিন বলে দিলো, তুমি যাও, মা, ওদের আমি খবর পাঠাচ্ছি। পুলিস বেড়ায় ডালে ডালে, আমরা বেড়াই পাতায় পাতায়।

 মা বাড়ি ফিরে এসে সমস্ত কাগজপত্র বই বুকে গুঁজে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন...মনে করলেন, পেভেল এক্ষুণি কাজ ফেলে ছুটে বাড়ি আসবে। কিন্তু পেভেল এলো না। মা অবসন্ন হ’য়ে রান্নাঘরের বেঞ্চের ওপর বসে পড়লেন—পেভেল ও এণ্ড্রি কারখানা হ’তে ফিরে এলো...মা তখনো সেই অবস্থায় ব’সে। জিগ্যেস করলেন, জানো সব?

 হাঁ। তোমার কি ভয় হচ্ছে, মা?—পেভেল জিগ্যেস করলো।

 এণ্ড্রি বললো, ভয় করে লাভ কি? ভয় করলে কি বিপদ উদ্ধার হয়? হয় না, তবে?

 পেভেল বললো, উনুনটিও বুঝি ধরাওনি, মা!

 মা বইগুলি চেপে বসেছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তা’ দেখিয়ে বললেন, ঐগুলো নিয়েই তো ব্যস্ত ছিলাম, সারাক্ষণ...

 এণ্ড্রি পেভেল হেসে উঠলো...মা যেন এতে আশ্বস্ত হলেন। পেভেল খানকয়েক বই বেছে নিয়ে উঠানে লুকিয়ে রাখলো। এণ্ড্রি মাকে সাহস দেবার জন্য গল্প জুড়ে দিলো, কিছু ভয় নেই, মা। ওদের জন্য আমার আপসোস হয়, মা, ইয়া হোমরা চোমরা প্রবীণ অফিসার, তলোয়ার ঝুলিয়ে, ঘোড়া ছুটিয়ে এসে কাজটা কি করেন? এ কোণ খোঁজেন, ও কোণ খোঁজেন, বিছানাটা ওলটান, মুখে কালি-ঝুল মাখেন...তারপর বিজয়ী বীরের মতো চ’লে যান। একবার ওদের পাল্লায় পড়েছিলুম, মা। জিনিসপত্র তছনছ ক'রে আমার ধ’রে নিয়ে গেলো। তারপর জেলে রাখলো চার মাস। সে কী জীবন...কেবল বসে থাকা, আল্‌সে হয়ে...তারপর ডেকে রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেলো। দু’দিকে পাহারা...আদালতে গেলুম...যা-তা জিগ্যেস করলো...তারপর আবার জেলে পাঠালো। তারপর এ জেল থেক সে জেল, এখান থেকে সেখানে। এমনি ধারা। কি করবে? মাইনে খায়, বেচারীদের যা হ’ক একটা-কিছু ক’রে দেখাতে হবে তো!

 মার মনে যতটুকু ভয় জমে উঠেছিল তা’ নিঃশেষে মিলিয়ে গলো।