মা (ম্যাক্সিম গোর্কি, বিমল সেন)/প্রথম খণ্ড/বারো

বিমল সেন অনূদিত
(পৃ. ৭০-৭৪)

—বারো—

 পরদিন কারখানার গেটে যেতেই রক্ষীরা বেশ রুক্ষভাবে মাল মাটিতে নাবিয়ে মাকে ভালো করে পরীক্ষা করলো।

 মা বললেন, আমার খাবার জুড়িয়ে যাবে, বাবা!

 চোপ রও—একজন রক্ষী বললো।

 আর একজন বললো, ইস্তাহারগুলো নিশ্চয়ই বেড়ার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হয়।

 মা রেহাই পেলেন।

 বুড়ো শিজভ্ এসে বললো চাপা গলায়, শুনেছো তো, মা?

 কি?

 ইস্তাহারগুলো আবার দেখা দিয়েছে। রুটির ওপর চিনির মতো ক’রে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে ওরা। অথচ শাস্তি হ’ল এর জন্য আমার ভাইপোর, তোমার ছেলের। এখন পরিষ্কার দেখা গেলো, ওরা নিরপরাধ।

 তারপর দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললো, বাবা, এ মানুষ নয় যে হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখবে। এ ভাবধারা—একে পোকার মতো টিপে মারা চলেনা।

 মা খাবার হাঁকতে লাগলেন। কারখানায় সেদিন সে কী উত্তেজনা! মজুররা আলাপ-আলোচনা আনন্দে উতলা। একজন বলছে, বাছাধনরা সত্য কথা সইতে পারেন না।

 কর্তারা ক্রুদ্ধ বিব্রত হ’য়ে ছুটাছুটি করছেন। একজন বলছেন, ব্যাটারা হাসছে দেখো। হাসবার মতো বিষয় কিনা—ম্যানেজার বা বলেন ঠিক—আমূল ধ্বংস করতে চায় ওরা। ব্যাটাদের শুধু আগাছার মতো ওপড়ালে হবে না, একেবারে চষে একশা করে দিতে হবে।

 আর এক কর্তা বীর দর্পে অদৃশ্য দুশমনের উদ্দেশে আস্ফালন করে বলে, যা’ খুশি ছাপা, ব্যাটা বজ্জাত, কিন্তু খবর্দার আমার বিরুদ্ধে একটা কথা বলেছিস কি মরেছিস।

 গুসেভ এসে মাকে বললো, আজ আবার তোমার কাছে খেতে এসেছি, মা। ওঃ যা খাবার তুমি দিয়েছ, মা, চমৎকার, অতি চমৎকার!

 মা খুশি হলেন, ভাবলেন, আমাকে না হ’লে এদের চলবে কি করে?

 অদূরে একজন মজুর বলছে, আমি পেলুম না একখানা কোথাও।

 আর একজন বলছে, শুনতে বেশ লাগে কিন্তু। পড়তে না পারলেও এটা বুঝি, বাছাধনদের আঁতে বেশ এক্‌টু ঘা লেগেছে।

 তৃতীয়জন বল্‌লো, বয়লার ঘরে চলো, পড়ে শোনাচ্ছি।

 গুসেভ ইঙ্গিত ক’রে বললো, দেখছ না, মা, কেমন কাজ করছে?

 মা খুশি হ’য়ে বাড়ি ফিরে এলেন। এণ্ড্রিকে বলেন, ওরা দুঃখ করছিল পড়তে জানেনা ব’লে। আমিও তো তাই—সেই ছোটবেলা যতটুকু যা’ শিখেছিলুম, স্রেফ ভুলে ব’সে আছি।

 আবার শেখো, মা।

 মরতে বসেছি, এখন শেখবো? ঠাট্টা করিসনি, বাছা!

 এণ্ড্রি কিন্তু শেল্‌ফ থেকে একটা বই নিয়ে মাকে বর্ণ-পরিচয় করাতে লেগে গেলো। ছুরির ডগা দিয়ে একটা অক্ষর দেখিয়ে বললো, এটি কি?

 আর।

 এটা?

 এ।

 এম্‌নিভাবে মার শিক্ষা শুরু হয়।

 পড়তে পড়তে এক সময় মা হঠাৎ ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন, এক পা যখন কবরে, তখন বসলুম বই নিয়ে।

 এণ্ড্রি সান্ত্বনা দিয়ে বললো, কেঁদোনা, মা, তোমার দোষ কি? জীবন তো আর তুমি ইচ্ছে ক’রে অমন ভাবে কাটাও নি। তুমি তবু বুঝতে পাচ্ছ, কী শোচনীয় জীবন তোমাদের। অনেকে কিন্তু এই কথাটাই বুঝতে পারেনা। হাজার হাজার লোক গরু-বাছুরের মতো বেঁচে থেকে বড়াই করে, তোফা আছি। কিন্তু কোথায় তোফা তাদের জীবন! আজ কাজ শেষ হলে খাওয়া, কালও কাজ শেষ হ’লে খাওয়া, পরশুও তাই—দিনের পর দিন, বছরের পর বছর···ঐ একই রুটিন···কাজ আর খাওয়া, কাজ আর খাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে কাচ্চা-বাচ্চার দল আমদানি, দু’দিন তাদের নিয়ে আমোদ···তারপরে রুটিতে টান পড়লে তাদেরই ওপর রাগের ঝাল ঝাড়া, ‘খালি গোগ্রাসে গেলা, বড়োও হয় না যে, কাজ ক’রে একটু সাহায্য করবে।’ ছেলেমেয়েদের তারা ভারবাহী করে তোলে। ছেলেমেয়েরা পেটের জন্য খাটে, জীবনটাকে টেনে নিয়ে চলে একটা চুরি-করা পচা ঝাড়নের মতো। প্রাণ তাদের চঞ্চল হয়ে ওঠেনা আনন্দের সাড়ায়, কখনো দ্রুত তালে বেজে ওঠেনা হৃদয়দ্রাবী ভাবের আবেগে। কেউ বাঁচে ফকিরের মতো ভিক্ষার ঝুলি সম্বল ক’রে, কেউ জীবন কাটায় চোরের মতো পরের জিনিস নিয়ে। কর্তারা চোরের আইন তৈরি করেছে, লাঠিধারী রক্ষীদল মোতায়েন করে তাদের বলছে, ‘আমাদের তৈরি আইন রক্ষা কর! ভারি সুবিধার আইন এগুলো—জনসাধারণের রক্ত শুষে নেওয়ার অধিকার আমাদের দিয়েছে।’ বাইরে থেকে মানুষকে চেপে পিষে নিঙরে নিতে চায় ওরা, কিন্তু মানুষ বাধা দেয়। তাই ভেতরে এই আইন চালানো— যুক্তি-শক্তিও যাতে তাদের লোপ পেয়ে যায়। মানুষ একমাত্র তারাই যারা মানুষের দেহের শৃঙ্খল নষ্ট করে, মানুষের মনের শৃঙ্খল অপসারিত করে। তুমিওতো তাই করতে চলেছো, মা—তোমার সাধ্যমত।

 আমি! আমি কী করতে পারব, এণ্ড্রি!

 কি করতে পারবে না, মা? কেন পারবে না? বর্ষা-ধারার মতো আমাদের কাজ—এর প্রত্যেকটি ফোঁটা পরিস্ফুট করে বীজকে। যখন তুমি পড়তে শিখবে, মা, তখন···হাঁ, তোমায় শিখতেই হবে···ভাবো দেখি, পেভেল ফিরে এসে কতটা অবাক্ হবে!

 মা মনোযোগী ছাত্রীর মতো বই নিয়ে উঠে পড়ে লেগে গেলেন।