শক্তসিংহ।

 প্রতাপসিংহের পিতা উদয়সিংহের সর্ব্বশুদ্ধ চতুর্বিশতি পুত্র ছিল, তন্মধ্যে প্রতাপ সর্ব্ব জ্যেষ্ঠ ও শক্তসিংহ দ্বিতীয়। যখন শক্ত নিতান্ত শিশু তখনই তিনি এমন সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন যে, কালে যে তিনি একজন মহাবীর হইবেন, তাহা সকলেই অনুমান করিয়াছিলেন। কথিত আছে, শক্তের কোষ্ঠীপত্রিকায় লিখিত ছিল যে, তিনি উত্তর কালে মিবারের কলঙ্কস্বরূপ হইবেন। এই কারণে প্রথম হইতেই উদয়সিংহ পুত্রের উপর নিতান্ত বীতরাগ ছিলেন; এবং শক্ত যত বয়ঃপ্রাপ্ত হইতে লাগিলেন ততই পিতার এই ভাব দুরীভূত না হইয়া বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। এমন কি শক্ত যেন তাঁহার চক্ষুশূল হইয়া উঠিল। শক্ত যখন নিতান্ত বালক তখন একদিন তিনি রাজসভায় পিতার নিকট খেলা করিতেছিলেন | সেই সময় একজন অস্ত্রকার একখানি তরবারি লইয়া রাণার নিকট উপস্থিত হইল। অস্ত্রের তীক্ষ্ণতা সম্বন্ধে নানারূপ কথা হইতেছে, এমন সময় বালক শক্ত তাড়াতাড়ি আসিয়া পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“পিতঃ এই অস্ত্র দিয়া অস্থি মাংস কি কাটা যাইবে?” এই বলিয়া আপনার সুকোমল বাহুতে সজোরে তরবারি দিয়া এক আঘাত করিলেন; তৎক্ষণাৎ রক্তস্রোতে রাণার আসন ও সভাস্থল ভাসিয়া গেল। রাণা বিস্ময়ে পুত্রের মুখের দিকে চাহিলেন। মুহূর্ত্তের মধ্যে তাঁহার মুখ ক্রোধে রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি ভাবিলেন, দৈবজ্ঞ ঠিক বলিয়াছেন, কি ভয়ানক ব্যাপার! নিশ্চয় এই সন্তান বাঁচিয়া থাকিলে মিবারের সর্ব্বনাশ করিবে; এমন পুত্রের মৃত্যুই ভাল। এইরূপ স্থির করিয়া তখনই ঘাতককে বলিলেন, “যাও, এখনই ইহাকে বধ কর, এই কালসর্প বাঁচিয়া থাকিতে আমার আর শান্তি নাই।” অমনি রাণার আদেশ পালিত হইবার উদ্যোগ হইতে লাগিল। ঘাতক শক্তকে বধ্যভূমিতে লইয়া গেল এমন সময়ে একজন সর্দ্দার রাণার নিকট করযোড়ে নিবেদন করিলেন, “মহারাজ, আপনি অনেকবার আমার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া বরদান করিতে চাহিয়াছিলেন, আমি এতদিন লই নাই; আজ যদি কৃপা করিয়া কর্ণপাত করেন তবে একটি প্রার্থনা করি।”

 রাণ বলিলেন, “কি প্রার্থনা বলুন, আমি এখনই তাহা পূর্ণ করিতেছি।” সর্দ্দার কহিলেন “আমার সন্তান নাই, শক্তকে আমায় দান করুণ” রাণা প্রার্থনা পূর্ণ করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। কাজেই শক্ত সে যাত্রা রক্ষা পাইলেন, এবং সেইদিন হইতে সেই সর্দ্দারের পোষ্যপুত্ররূপে তাঁহার নিকট বাস করিতে লাগিলেন। শক্ত বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে, প্রতাপ তাঁহাকে আপনার নিকট অনিয়া রাখিলেন; কিন্তু দুই বীর ভ্রাতায় শান্তি-সুখে অধিক দিন বাস করা ঘটিল না। একদিন দুই জনে মিলিয়া মৃগয়া করিতে গিয়াছেন। পথে লক্ষ্য সম্বন্ধে কথা লইয়া দুই ভ্রাতায় মহা তর্ক বিতর্ক হইল। কিছুতেই আর মীমাংসা হয় না, শক্তও নিরস্ত হইবার পাত্র নহে, অবশেষে প্রতাপ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া হস্তের শেল উদ্যত করিয়া এই বলিয়া হুঙ্কার করিয়া উঠিলেন, “এস, তবে দেখি কার লক্ষ্য অব্যর্থ।” অমনি শক্ত ও মহাতেজে বলিয়া উঠিলেন, “আচ্ছা, তবে আসুন দেখি।” সর্ব্বনাশ! ভ্রাতৃদ্বয় শেল হস্তে পরস্পরকে বিনাশ করিতে উদ্যত।—বীরপ্রথা অনুসারে তখনই শক্ত প্রতাপের পদধূলি লইলেন, প্রতাপও তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। উপস্থিত সকলে এই ব্যাপার দেখিয়া অবাক হইয়া রহিল। সামান্য কথা লইয়া মিবারে রাজকুলের সর্ব্বনাশ!! দুই বীর বুঝি চিরদিনের মত বিদায় গ্রহণ করেন। তথাপি সকলে নির্ব্বাক, সকলে যেন বজ্রাহত। অগ্রসর হইয়া একটা কথা বলে, এমন শক্তি কাহারও নাই। কিন্তু নিমেষের মধ্যে মহাবেগে ঐ কে দুই হস্ত তুলিয়া “মহারাজ, করেন কি, করেন কি, ক্ষান্ত হউন” বলিয়া ছুটিয়া আসিলেন। সকলে বিস্ময়ে চাহিয়া দেখে, রাজপুরােহিত স্বয়ং মধ্যে পড়িয়া বিবাদভঞ্জনার্থ উভয় ভ্রাতাকে হস্তে ধরিয়া অনুনয় বিনয়, করিয়া তাঁহাদিগকে প্রকৃতিস্থ করিবার চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু হায়! তাঁহার এত অনুনয় বিনয় এত আয়াস সকলই বিফল হইল। কিছুতেই তাঁহাদিগকে শান্ত করিতে পারিলেন না। ব্রাহ্মণ আর কোন উপায় না দেখিয়া তীক্ষ্ণ ছুরিকা আপনার হৃদয়ে বিদ্ধ করিলেন। “সর্ব্বনাশ! সর্ব্বনাশ! ব্রহ্মহত্যা!” বলিয়া সকলে চীৎকার করিয়া উঠিল। ভ্রাতৃদ্বয়ের চরণতলে পড়িয়া পরমমিত্র কুলপুরােহিত প্রাণত্যাগ করিলেন। ভ্রাতৃদয়ের হস্তের শেল ভূমিতে পড়িয়া গেল। যুদ্ধ থামিয়া গেল। এখন কোথায় বা ক্রোধ আর কোথায় বা জিঘাংসা! দুই জনেরই জ্ঞানােদয় হইল। তাই ত, কি সর্ব্বনাশ হইল! লজ্জায় দুঃখে দুইজনে অধােবদন হইলেন। প্রতাপ যথাবিধি পুরোহিতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শ্রাদ্ধাদি করিলেন এবং যেখানে তিনি প্রাণত্যাগ করেন, সেখানে তাঁহার পবিত্র স্মৃতি চিরজাগ্রত রাখিবার জন্য একটি স্তম্ভ নির্ম্মাণ করাইলেন। সেই স্তম্ভটি আজও সেখানে দাঁড়াইয়া পুরোহিতের আশ্চর্য্য রাজভক্তি ও অপূর্ব্ব আত্মত্যাগের জ্বলন্ত সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। সেইদিনই প্রতাপ শক্তসিংহকে মিবার রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া যাইতে আদেশ করিলেন। তেজস্বী শক্ত “যে আজ্ঞা” বলিয়া প্রতাপের চরণধূলি লইয়া, তাঁহার রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিবার জন্য শত্রুদিগের সহিত মিলিত হইলেন। হলদিঘাটের যুদ্ধের পর ভ্রাতৃদ্বয়ের মিলন হইল। সেইদিন হইতে তাঁহাদিগের মিলন চিরদিন অক্ষুণ্ণ ছিল।