মিবার-গৌরব-কথা/হামিরের বিবাহ

হামিরের বিবাহ

 মুসলমানদিগের সহিত স্বাধীনতার যুদ্ধে হামিরের পিতা, পিতামহ, পিতৃব্যগণ সকলেই রণক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। তখন বালক হামির মাতামহের গৃহে বাস করিতেছিলেন, এবং তখন হইতে অতি দীনভাবেই তাঁহার জীবন অতিবাহিত হইয়াছিল। কিন্তু অগ্নিকে যেমন ভস্মাচ্ছাদিত রাখা যায় না, সিংহ শাবককে যেমন দুখা হারে প্রতিপালন করা যায় না, এবং করিলেও সে যেমন আপনার প্রকৃতি বিস্বৃত হয় না; হামিরের তাহাই হইয়াছিল। রাজসম্পদ তাঁহার ভাগ্যে ঘটে নাই; পর্ব্বতে জঙ্গলে আজন্ম অতি দুঃখে দিনপাত করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি একদিনের জন্যও ভুলিতে পারেন নাই যে বীর বাপ্নারাওয়ের বংশে তাঁহার জন্ম হইয়াছে এবং চিতোরের রাজপদে তাঁহারই অধিকার। পিতৃপুরুষের লীলাভূমি বীরত্বের নিকেতন চিতোর, অধিকার করিবার জন্য তাঁহার প্রাণ সর্ব্বদা ব্যাকুল হইত, এবং নিয়ত তাহার সুযোগ অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেন। এমন সময় হঠাৎ একদিন মালদেব দিল্লীর সম্রাটের আশ্রয়ে চিতোরের রাণা হইয়া ছিলেন ও হামিরের পরম শক্র) নিজ কন্যার সহিত হামিরের বিবাহের সম্বন্ধ করিয়া একজন দূত হামিরের নিকট প্রেরণ করিলেন। নারিকেল ফল হস্তে করিয়া দূত হামিরের নিকট আসিয়া উপস্থিত। নারিকেল ফল দেখিয়া বুঝিলেন তাঁহার বিবাহেয় সম্বন্ধ আসিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিয়া সকল কথা শুনিলেন। হামির এবং তাঁহার বন্ধুগণ সকলেই এ ঘটনায় আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। মালদেব শত্রুকে কন্যাদান করিবেন, ইহার অর্থ কি? নিশ্চয় ইহার ভিতর কোন গৃঢ় অভিসন্ধি নিহিত আছে। হামিরের বন্ধুগণ হামিরকে এ বিবাহ অস্বীকার করিবার জন্য বারম্বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। হামির কিছুতেই শুনিলেন না। বলিলেন, “বন্ধুগণ, বিবাহ সম্বন্ধ লইয়া উপস্থিত হইলে অস্বীকার করা ক্ষত্রিয় তনয়ের অনুচিত কার্য্য, তাহা কি আপনারা জানেন না? আমি আজ কাপুরুষের মত এই চিরপ্রচলিত নিয়মের অন্যথা করি কিরূপে? মালদেব আমার বিনাশের জন্য চাতুরী করিয়াছেন! ভালই! একদিনের জন্যও যদি আমি আমার পিতৃপুরুষের লীলাভূমি পবিত্র চিতোরে পদার্পণ করিতে পারি, সার্থক জীবন আমার! আমার অদৃষ্টে যাহাই হউক, আমি এ সম্বন্ধ স্বীকার করিতে বাধ্য।” শুভদিনে শুভলগ্নে হামিরের বিবাহ স্থির হইল। হামির পাঁচশত অশ্বারোহী বরযাত্র লইয়া চিতোর যাত্রা করিলেন। কিন্তু তাঁহার মন সন্দেহ দোলায় দুলিতে লাগিল, মুখে কিছুই প্রকাশ করিলেন না। চিতোরের দ্বারে উপস্থিত হইয়া দেখেন, বিবাহ-তোরণ নাই, সন্দেহ কিঞ্চিৎ দৃঢ়ীভূত হইল। কিন্তু মালদেবের পঞ্চ পুত্র চিতোরের দ্বারে সমারোহে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিলেন। সহরে প্রবেশ করিলেন, কোন প্রকার আনন্দের চিহ্ন দেখিলেন না। ক্রমে প্রাসাদে প্রবেশ করিলেন, দেখিলেন গীতবাদ্য নাই, লোক সমাগম নাই, ভাবিলেন, “এ কি বিবাহ?” মালদেব এবং তাঁহার পুভ্রগণ বরকে আদর অভ্যর্থনা করিতে ত্রুটী করিলেন না। কিন্তু বিবাহ বাটীর আর কোন চিহ্নই হামির দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার মন সন্দেহে অস্থির হইয়া উঠিল এবং আসল কার্য্যের কিরূপ ব্যবস্থা হয় দেখিবার জন্য তিনি অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। ক্রমে বিবাহের লগ্ন উপস্থিত হইল। বিবাহ মণ্ডপে বর নীত হইল। কিন্তু বিবাহ সভা শূন্য, কেহ কোথাও নাই,— হামির তখনও নীরব। ক্রমে পুরোহিত, কন্যা, কন্যার পিতা, ভ্রাতা সকলেই উপস্থিত হইলে বিধিপূর্ব্বক বিবাহ হইল। হামির তখনও ভাবিতেছেন কাহাকে বিবাহ করিলাম, একি মালদেবের দুহিতা! একি পুরুষ না নারী। কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না—ইহারই হস্তে কি আমার প্রাণ যাইবে? বিবাহান্তে হামির বাসর গৃহে গিয়া বসিলেন। সে স্থানও নির্জ্জন এবং নিরানন্দ। নববধু তাঁহার পার্শ্বে বসিয়া রহিয়াছেন, হামির সন্দেহের সহিত একবার বধূর দিকে, একবার গৃহের চারিদিকে চাহিয়া দেখিতেছেন, কিন্তু একেবারে নীরব। কে যেন তাঁহার জিহ্বাকে অবশ করিয়া দিয়াছে। নববধু স্বামীর মনের ভয়ানক অবস্থা বুঝিতে পারিয়া আস্তে আস্তে বলিলেন, “যেরূপ ভাবে বিবাহ হইল, তাহাতে নিশ্চয়ই আপনি মনে নানা প্রকার সন্দেহ করিয়া কষ্ট পাইতেছেন। এইরূপ বিবাহ হইবার প্রকৃত কারণ আপনাকে বলিব, আপনি কিরূপ ভাবে গ্রহণ করিবেন জানি না। মহারাজ! আমি বাল-বিধবা ছিলাম,কবে যে আমার বিবাহ হইয়াছিল আমার স্মরণ হয় না। পিতা এই কারণেই লুকাইয়া আমাকে আপনার সহিত বিবাহ দিলেন, এবং এই কারণেই বিবাহের কোন আয়োজন হয় নাই। প্রার্থনা করি আপনি আমাকে ঘৃণা পূর্ব্বক পরিত্যাগ করিবেন না।” হামির কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, “রাজকুমারি, তোমার অপরাধ কি? আমি বিধিপূর্ব্বক তোমার পাণিগ্রহণ করিয়াছি, তুমি আমার ধর্ম্মপত্নী, তোমাকে আমি পরিত্যাগ করিব না; কিন্তু তোমার পিতা আমার পিতার শত্রু, আমার পরম শত্রু। তিনি ছলনা পূর্ব্বক আমার অবমাননা করিয়াছেন, আমি তাহার প্রতিশোধ লইব। তোমার পিতাকে আমি কখনও ক্ষমা করিব না। তুমি ইচ্ছা কর, আমার সহিত যাইতে পার। আমি তোমাকে অকৃতজ্ঞের মত তাকে পরিত্যাগ করিতে বলিতে পারি না, কিন্তু জানিও তোমার পিতার শত্রুকে তুমি বরণ করিয়াছ। এখন বল, আমি আমার সহিত যাইতে সম্মত আছ কি না? মালদেবদুহিতা যে কেবল ইহাতে সম্মত হইলেন তাহা নহে, কিন্তু স্নামীর সহায়তার জন্য বিশেষ ভাবে প্রস্তুত হইলেনা; বলিলেন, “পিতা যখন আপনাকে যৌতুক; দিতে চাহিবেন, তখন আর কিছু না চাহিয়া পিতার প্রধান কর্ম্মচারী জালকে যৌতুক সরূপ চাহিবেন। জালের অসাধারণ শক্তি আছে, ইহার সাহায্যে আপনি সিদ্ধকাম হইবেন।” পত্নীর পরামর্শমত হামির জালকে যৌতুক স্বরূপ চাহিলেন। মালদেব সাগ্রহে জামাতার প্রার্থনা পূর্ণ করিলেন। হামির নববধু লইয়া স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন।

_______