মিষ্টান্ন-পাক/উপক্রমণিকা

মিষ্টান্ন-পাক।

উপক্রমণিক।

থিবীর মধ্যে ভারতবর্ষে যত প্রকার সুমিষ্ট উপাদেয় খাদ্য-দ্রব্য প্রস্তুত হইয়া থাকে, অন্য কোন দেশে সে প্রকার দেখা যায় না। কি ব্যঞ্জনাদি রন্ধন, কি মিষ্টান্নপাক, সর্ব্বপ্রকার রন্ধন-কার্য্যে ভারত সর্ব্ব-শ্রেষ্ঠ। এ দেশে ঘৃত, ময়দা, সুজি, দুগ্ধ, সর, ছানা এবং ক্ষীর প্রভৃতি দ্বারা যেরূপ রসনা-তৃপ্তি-কর উপাদেয় মিষ্ট-দ্রব্য পাক হইয়া থাকে, তাহা আহার করিলে, অমৃতাস্বাদনের ন্যায় বোধ হয়। সুতরাং, এরূপ উপাদেয় খাদ্য-দ্রব্যের পাক সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ নিতান্ত প্রয়োজন।

 হিন্দু-জাতির আচার ব্যবহার এবং খাদ্যাদি সমুদয় ব্যাপার-ই পবিত্রতাময়; এজন্য দেখা যায়, যে সকল উপকরণ লইয়া মিষ্টদ্রব্য পাক হইয়া থাকে, তৎসমুদয় পবিত্রতা-বিহীন নহে। বিশেষতঃ ঐ সকল দ্রব্য দেব-সেবায় ব্যবহৃত হইয়া থাকে, এজন্য মিষ্টান্নে অধিক পরিমাণে পবিত্রতা রক্ষিত হইতে দেখা যায়। দুঃখের বিষয়, এমন পবিত্র, খাদ্য-দ্রব্যে-ও নানা প্রকার অপবিত্রতা! সঞ্চারিত হইতেছে, কারণ ঐ সকল দ্রব্যের পাক সম্বন্ধে অধিকাংশ গৃহস্থ-ই অনভিজ্ঞ; সুতরাং তাঁহাদিগকে দোকানের প্রস্তুত খাদ্য-দ্রব্যের উপর নির্ভর করিতে হয়। দোকানে যে সকল খাদ্য প্রস্তুত হইয়া থাকে, তৎসমুদায় দ্রব্য আহার করিলে, নানা প্রকার পীড়া হইবার গুরুতর সম্ভাবনা। কারণ, ব্যবসায়ীরা লাভের অনুরোধে, প্রায় শস্তা দ্রব্য দ্বারা মিষ্টান্ন-পাক করিয়া থাকে; সুতরাং ভাল মন্দ অর্থাৎ তাহা স্বাস্থ্য-কর কি না, তদ্বিষয়ে আদৌ দৃষ্টি রাখে না। কোন দ্রব্য দূষিত হইলে, তাহারা তাহা পরিত্যাগ না করিয়া, উহা খাদ্য-দ্রব্যে মিশাইয়া বিক্রয় করিয়া থাকে। দোকানে যে সকল দ্রব্য সজ্জিত থাকে, তৎসমুদায় আ-ঢাকা থাকায়, ধূলাকুটা প্রভৃতি অপরিষ্কৃত ময়লা পতিত হইয়া, স্বাস্থ্যের অনিষ্ট করিয়া তুলে। এতদ্ভিন্ন আর একটী ভয়ানক অনিষ্ট হইয়া থাকে, অর্থাৎ নানা প্রকার কীট ও পতঙ্গাদি সর্ব্বদা-ই খাদ্য-দ্রব্যে বসিয়া থাকে। তাহারা যে, কেবলমাত্র বসিয়া-ই ক্ষান্ত হয়, এরূপ নহে; উপবেশন-সময়ে ডিম্ব প্রসব করিয়া-ও থাকে; সুতরাং ঐ সকল খাদ্য আহার করিলে, উদরের কৃমি প্রভৃতি নানা প্রকার রোগ হইরার কথা। আজিকালি দোকানের দ্রব্য আহার করিলে, প্রায়-ই অম্বলের পীড়া হইতে দেখা যায়। দোকানের দূষিত খাদ্য-ই যে, সেই পীড়ার একমাত্র কারণ, তাহা অনেকে-ই লক্ষা করেন না।

 নানা কারণে যে, দোকানের দ্রব্য দূষিত হইয়া থাকে, তাহা বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিমাত্রে-ই স্বীকার করিয়া থাকেন; অথচ তাঁহারা-ই আবার দোকানের পীড়া-দায়ক দ্রব্য আহার করিতে ত্রুটি করেন না। অন্ন-ব্যঞ্জনের ন্যায় যদি গৃহে মিষ্ট-দ্রব্য পাকের ব্যবস্থা করা যায়, তবে কোন প্রকার অনিষ্টাশঙ্কা থাকে না। রন্ধন-কার্য্যের ন্যায় মিষ্টান্ন-পাক-ও অতি সহজ। এরূপ সহজ কার্য্যে অবহেলা করা যার-পর-নাই দুঃখের বিষয়!

 যে কোন মিষ্ট-দ্রব্য পাক করিবার পূর্ব্বে, তাহার উপকরণগুলি নির্ব্বাচন করিয়া লওয়া উচিত। উপকরণ যে পরিমাণে উৎকৃষ্ট হইবে, তদ্বারা যে কোন দ্রব্য পাক কর না কেন, তাহা-ও যে, উপাদেয় হইয়া উঠিবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি? এস্থলে ইহা-ও জানা আবশ্যক, কেবলমাত্র উপকরণ ভাল হইলে-ই যে, উহা উত্তম হইবে তাহা নহে; কারণ, পাক সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। ভাগ, পরিমাণ, এবং কতক্ষণ জ্বালে রাখিতে হয়, এই সকল বিষয়ে জ্ঞান না থাকিলে, কখন-ই সুখাদ্য দ্রব্য প্রস্তুত করা যায় না। অতএব, মিষ্ট দ্রব্য পাক করিতে হইলে, কোন্ কোন্ বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা আবশ্যক, তৎসমুদায় অগ্রে লিখিয়া, পরে পাকের বিষয় লিখিত হইল।

উনান ও জ্বাল।

 নান ও জ্বালের দোষে অনেক সময় খাদ্য-দ্রব্য নষ্ট হইয়া থাকে। অতএব, উনান এরূপ নিয়মে প্রস্তুত হওয়া আবশ্যক যে, পাক-পাত্রের চতুর্দ্দিকে যেন জ্বাল বা আঁচ সমান পরিমাণে লাগিতে পায়। কারণ, জ্বাল সমানরূপ না পাইলে, ভাল রকম সুপক্ক হয় না। আঁচ কম হইলে পক্ক দ্রব্য কাঁচা থাকিয়া যায়, এবং কড়া পাক হইলে, দ্রব্যাদি আঁকিয়া বা চুইয়া উঠে। এজন্য উনান ও জ্বালের প্রতি বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।

পাক-পাত্র।

 মিষ্ট দ্রব্য পাক করিতে মাটির খুলি অথবা কটাই অর্থাৎ কড়া ব্যবহৃত হইয়া থাকে। এজন্য উহা মাজিয়া ঘসিয়া পরিষ্কার করিতে হয়। মিষ্ট-দ্রব্য পাক করাকে সাধারণতঃ ‘ভিয়ান’ করা কহে। প্রত্যেক দ্রব্য ভিয়ানের পর, পাক-পাত্র উত্তমরূপ ধৌত করা কর্ত্তব্য। পাক-পাত্রের ন্যায় যে সকল পাত্রে ঐ সকল দ্রব্য রাখা যায়, তৎসমুদয়-ও পরিষ্কৃত হওয়া উচিত। প্রত্যেক দ্রব্য অতি যত্ন-সহকারে উত্তম স্থানে ঢাকিয়া রাখা আবশ্যক। পাক-পাত্রের ন্যায় তক্তা (অর্থাৎ যাহাতে লুচি প্রভৃতি বেলিতে হয়), বেল্‌না, খুন্তি, তাড়ু, ঝাঁজরি প্রভৃতি-ও পরিষ্কৃত রাখিতে হয়। ফলতঃ, যে পরিমাণে পরিষ্কৃত রাখিতে পারা যায়, তাহাতে অবহেলা করা উচিত নহে। কারণ, যে কোন প্রকারে অপরিষ্কৃত হইলে-ই, তাহা স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষরূপে অনিষ্ট-জনক হইয়া উঠে

পরিচ্ছন্নতা।

 পাকের উপকরণ ও পাক-পাত্রাদি পরিষ্কার সম্বন্ধে যেমন দৃষ্টি রাখিতে হয়, পাচক ও পাচিকাকে-ও সেইরূপ পরিষ্কারের সহিত ঐ সকল দ্রব্য লইয়া পাক করা আবশ্যক। অপরিষ্কৃত ব্যক্তির হস্তে আহার করিতে কাহার-ও রুচি জন্মে না। পবিত্র দ্রব্য পবিত হস্তে প্রস্তুত হওয়া-ই উচিত। পাক-কালে ঘর্ম্ম প্রভৃতি যাহাতে পাক-দ্রব্যে পতিত না হয়, তদ্বিষয়ে সাবধান হওয়া আবশ্যক। যে সকল দ্রব্য বা উপকরণ লইয়া পাক করিতে হইবে, তৎসমুদায় বিশেষরূপ যত্ন সহকারে পরিষ্কার করিতে চেষ্টা পাওয়া বিধেয়। যখন খাদ্য-দ্রব্যের উপর স্বাস্থ্য অর্থাৎ মানুষের পরমায়ু নির্ভর করিতেছে, তখন তাহাতে অবহেলা করিলে যে, জীবন নাশের মহাপাপ বর্ত্তিবে, তাঁহাতে আর সন্দেহ কি? বরং সমুদায় দ্রব্য ফেলিয়া দেওয়া উচিত, তত্রাপি স্বাস্থ্যের বিরোধী কোন প্রকার পীড়া-জনক দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া, আহার করিতে দেওয়া উচিত নহে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা যে, খাদ্য-দ্রব্য পাকের একটি প্রধান অঙ্গ, তাহা যেন প্রত্যেক পাচক ও পাচিকার মনে থাকে।

উপকরণ।

 মিষ্ট দ্রব্য পাক করিতে হইলে দুগ্ধ, ছানা, ক্ষীর, ঘৃত, ময়দা, সুজি, আটা, বেসম, চিনি প্রভৃতি উপকরণ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য পাকে যে, ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করিতে হয়, তাহা বোধ হয়, সকলে-ই অবগত আছেন। কোন্ কোন্ উপকরণে কোন্ কোন্ দ্রব্য পাক করিতে হয়, তাহা পাক-প্রকরণে লিখিত হইবে। এক্ষণে উপরি-উক্ত-উপকরণগুলি সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য বিষয় কয়েকটি লিখিত হইতেছে।

 দুগ্ধ।—দুগ্ধ খাঁটি অর্থাৎ নির্জ্জলা হওয়া আবশ্যক। বাসী দুধ ব্যবহার না করা-ই ভাল; কারণ, তাহাতে খাদ্য-দ্রব্য সুস্বাদু হয় না; এবং নানা প্রকার রোগ জন্মে। যে গাভী অধিক দিন প্রসব করিয়াছে, সেই গাভীর দুগ্ধ অধিক সুমিষ্ট। কাঁচা দুধ গরম করিয়া না রাখিলে নষ্ট হইয়া যায়। যে মৃত্তিকা-পাত্রে দুধ রাখিতে হয়, তাহা উত্তমরূপে ধুইয়া গরম করিয়া রাখা-ই ব্যবস্থা। মৃদু অর্থাৎ ধিকি ধিকি জ্বাল-ই দুগ্ধ-পাকের পক্ষে উত্তম। কাষ্ঠ অপেক্ষা ঘুঁটের জ্বালে দুধের সুমিষ্ট আস্বাদ হইয়া থাকে। জ্বালের অবস্থায় সর্ব্বদা ঘুঁটিয়া দেওয়া আবশ্যক।

 ছানা।—ভিয়ানের পক্ষে টাট্‌কা ছানা-ই উত্তম। বাসী হইলে, উহা বিকৃত অর্থাৎ অম্ল-আস্বাদনের হইয়া থাকে, সুতরাং তদ্দ্বারা কোন দ্রব্য প্রস্তুত করিলে, তাহার-ও, আস্বাদন খারাপ হইয়া উঠে। থস্‌থসে ছানা থাকের পক্ষে সুবিধা-জনক নহে। শক্ত গোছের ছানা ভিয়ানের পক্ষে ভাল।

 সন্দেশ ও রসগোল্লা প্রভৃতি প্রস্তুত করিতে হইলে, ছানা অগ্রে একখানি কাপড়ে বাঁধিয়া ঝুলাইয়া রাখিয়া, অথবা উহার উপর কোন ভারি দ্রব্য চাপাইয়া, সমুদায় জল নিঃসারণ করিতে হয়। ছানায় কোন দোষ ঘটিলে, তদুৎপন্ন দ্রব্য-ও বিস্বাদ হইবে, তাহা যেন মনে থাকে।

 সর বা মালাই।—নির্জ্জলা দুধে উত্তম সর জমিয়া থাকে। আবার দুই এক বলকের দুধ অপেক্ষা, ঘন আওটান দুধে উত্তম সর পড়িতে দেখা যায়। সর দ্বারা সর-ভাজা, সরপুরিয়া প্রভৃতি মিষ্ট-খাদ্য এবং উৎকষ্ট ঘৃত প্রস্তুত হইয়া থাকে। পুরাতন অর্থাৎ বাসী সরে দুর্গন্ধ হয়; দুর্গন্ধ হইলে তদ্বারা কোন দ্রব্য পাক করা উচিত নহে।

 ঘৃত।—ঘৃত যে পরিমাণে উত্তম হইবে, ঘৃত-পক্ক দ্রব্য-সমূহ-ও যে, সেই পরিমাণে উপাদেয় হইবে, তাহা প্রত্যেক পাচক ও পাচিকার যেন মনে থাকে। গব্য অর্থাৎ গাওয়া এবং ভাঁইসা ঘৃতে মিষ্টান্ন পাক হইয়া থাকে। ভাঁইসা অপেক্ষা গাওয়া ঘৃত উৎকৃষ্ট, কিন্তু মিষ্টান্ন পাকের পক্ষে ভাঁইসা ঘৃত ভাল; কারণ, গাওয়া ঘৃতে লুচি প্রভৃতি ভাজিলে, তাহার বর্ণ কিছু লাল্‌ছে এবং উহা কিছু কড়া হয়। আর ভাঁইসা ঘৃতে প্রস্তুত করিলে, বর্ণ শাদা ও নরম হয়। এজন্য মিষ্টান্ন-পাকের পক্ষে ভাঁইসা ঘৃত-ই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। আর এক কথা, গব্য ঘৃত অপেক্ষা ভাঁইসা ঘৃতের মূল্য অপেক্ষাকৃত শস্তা।

 ঘৃতের বর্ণ, ঘ্রাণ এবং আস্বাদনানুসারে উহার ভাল-মন্দ পরীক্ষিত হুইয়া থাকে। এজন্য প্রতারক বিক্রেতৃগণ জাফরাপ ও হরিদ্রার ছোপ দিয়া, উহার রং উজ্জ্বল করিয়া ঠকাইয়া থাকে। আবার খারাপ ধৃত দাগ করিয়া-ও লোকদিগকে প্রতারিত করিতে দেখা যায়। মন্দ ঘৃত জ্বালে চড়াইয়া, তাহাতে দধি কিংবা পান অথবা লেবুর পাতা দিয়া পাক করিলে ঘৃতের ‘দাগ’ করা হয়।

 নরম পাকে ঘৃত জালে মরিয়া অর্থাৎ কমিয়া যায়। আর অধিক দিন রাখিলে খারাপ হইয়া উঠে। এজন্য পাকের পূর্ব্বে ঘৃত পরীক্ষা করিয়া লওয়া আবশ্যক। এক্ষণে ঘৃতে চর্ব্বি প্রভৃতি নানা প্রকার অস্বাস্থ্য-কর দূষিত পদার্থের ভেজাল আরম্ভ হইয়াছে। অতএব, বিশেষরূপে পরীক্ষা না করিয়া, তদ্বারা কোন প্রকার খাদ্য-দ্রব্য প্রস্তুত করা উচিত নহে।

 ময়দা।—জাঁতা এবং কল দ্বারা ময়দা প্রস্তুত হইয়া থাকে। জাঁতা-ভাঙ্গা ময়দা বেশ সুমিষ্ট। জাঁতার ময়দা অপেক্ষা কলের ময়দা, পরিষ্কৃত। কলের ময়দা অত্যন্ত মিহি অর্থাৎ খুব চূর্ণ, কোন প্রকার খিচ থাকে না; লুচি প্রভৃতির জন্য তাহা-ই প্রশস্ত। কলের একের নম্বরের ময়দা সর্ব্বাপেক্ষা ভাল। ময়দা অধিক দিনের অর্থাৎ পুরাতন হইলে, তাহার আস্বাদন আতিক্ত হয়। এজন্য টাট্‌কা ময়দা লইয়া পাক করা উচিত।

 আটা।—ময়দার ন্যায় আটা-ও টাট্‌কা হওয়া আবশ্যক। পুরাতন হইলে উহা বিস্বাদু হইয়া থাকে। রুটী ও পরোটায় আটা মিশাইয়া প্রস্তুত করিলে, তাহা অতিশয় নরম এবং খাইতে ভাল লাগে। মোটা ময়দাকে আটা কহে। ময়দা অপেক্ষা আটা পুষ্টি-কর।

 সুজি।—অধিক দিনের হইলে, সুজির দানায় চাপ বাঁধিয় যায় এবং বিস্বাদু হইয়া উঠে। ময়দা, আটা এবং সুজি মধ্যে মধ্যে রৌদ্রে দিয়া রাখা ভাল। অন্য সময় অপেক্ষা বর্ষাকালে অধিক দিন রাখিলে, উহা নষ্ট হইয়া থাকে। সুজি দ্বারা রুটী, পাঁউরুটী এবং নানা প্রকার খাদ্য-দ্রব্য প্রস্তুত হয়। সুজি ভাঙ্গিয়া যে ময়দা হয়, তাহাকে “খাসা” কহে। উহা খাজা প্রভৃতি খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। সুজির রুটী প্রভৃতি করিতে হইলে, তাহা জল দিয়া অধিকক্ষণ ভিজাইয়া রাখিলে ভাল হয়। সুজি লঘু-পাক, এজন্য রোগীদিগের পথ্যে সুজির রুটী ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

 বেসম।—মিঠাই প্রভৃতি মিষ্টান্ন পাকের জন্য বেসম ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ছোলা বা বুটের দাইলের বেসম সমধিক ব্যবহৃত হয়। ভাল দানাদার টাট্‌কা ছোলার বেসমে যে সকল দ্রব্য প্রস্তুত করা যায়, তাহা সমধিক সুস্বাদু হইয়া থাকে। বেসমের দোষে অনেক প্রকার মিষ্টান্ন নষ্ট হইতে দেখা যায়। অধিক দিনের পুরাতন বেসম ব্যবহার না করাই ভাল। কোন কোন মিষ্টান্ন ছোলার বেসমে প্রস্তুত না করিয়া, বরবটির বেসমে পাক করিলে, অতি উপাদেয় হইয়া থাকে। কলাই দাইলের বেসম-ও কোন কোন মিষ্টান্নে ব্যবহার করিলে ভাল হয়। বুট, কলাই এবং বরবটির ন্যায় পাণিফল প্রভৃতি দ্বারাও বেসম বা আটা প্রস্তুত হইয়া থাকে ৷

 গুড়।—গুড়, চিনি এবং মিছিরি প্রভৃতি নানা প্রকার দ্রব্য মিষ্টান্নে ব্যহৃত হইয়া থাকে। গুড়ের মধ্যে নলেন গুড়-ই উত্তম। নলেন গুড়ের মুড়কি, সন্দেশ এবং পায়স প্রভৃতি অতি সুস্বাদু হইয়া থাকে। ইক্ষু-গুড় পুরাতন হইলে, তাহাতে অম্লরস অধিক হয়। খাঁড়, দো’লো এবং দোবরা প্রভৃতি চিনির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা। পরিষ্কৃত চিনিতে যে সকল দ্রব্য প্রস্তুত করা যায়, তাহার রং ভাল হয়। চিনি যত পরিষ্কৃত হইবে, তদ্দ্বারা প্রস্তুত দ্রব্য-ও সেই পরিমাণে উৎকৃষ্ট হইয়া উঠিবে। এজন্য পরিষ্কৃত শাদা চিনি লইয়া ভিয়ান করা উচিত। এক্ষণে কলে চিনি প্রস্তুত হইতেছে, তাহার বর্ণ অতি উজ্জ্বল শুভ্র; তদ্দ্বারা যে কোন দ্রব্য প্রস্তুত করা যায়, তাহার বর্ণ-ও অতি উজ্জ্বল হইয়া থাকে। ফলতঃ, ভোক্তৃগণের রুচি অনুসারে, যে কোন চিনি দ্বারা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা বিধেয়।

 সফেদা।—ময়দা ও বেসমের ন্যায় সবেদাও টাট্‌কা হওয়া আবশ্যক। সিদ্ধ চাউল অপেক্ষা আতপ চাউলের সবেদা অতি উৎকৃষ্ট। ময়দার ন্যায় চাউল জাঁতায় ভাঙ্গিয়া যে গুঁড়া বা চূর্ণ করা যায়, তাহাকে সফেদা বা সবেদা কহে। চাউলের দোষে সবেদা খারাপ হইয়া থাকে। অত্যন্ত মোটা গুমা চাউলের যে সবেদা, তদ্দ্বারা কোন দ্রবা প্রস্তুত করিলে, তাহা ভাল ফুলে না। ব্যবসাদারগণ অনেক সময় ময়দার পরিবর্ত্তে সবেদা ব্যবহার করিয়া থাকে। টাট্‌কা-ভাঙ্গা কামিনী চাউলের আটা অতি উৎকৃষ্ট।