বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্‌মিদের কবচ/দশম পরিচ্ছেদ

দশম পরিচ্ছেদ

কথাটা শ্রীগোপালকে বলবার জন্যে তার বাড়ীর দিকে চল্লাম।

রাস্তাটা বাড়ীর পেছনের দিকে—শীগ্‌গির হবে বলে ‘শর্ট-কাট’ করতে গেলাম বনের মধ্যে দিয়ে। সেই বন—যেখানে আমি সেদিন মিস্‌মি-জাতির কবচ ও দাঁতনকাঠির গোড়া সংগ্রহ করেছিলাম।

অন্ধকারেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা সাদা-মত কি কিছুদূরে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। জিনিসটা নড়চে-চড়চে আবার। অন্ধকারের জন্যে ভয় যেন বুকের রক্ত হিম ক’রে দিলে।

এই বনের পরেই গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ী—গাঙ্গুলিমশায়ের ভূত নাকি রে বাবা!

হঠাৎ একটা টর্চ জ্বলে উঠলো—সঙ্গে সঙ্গে কে কড়া-গলায় হাঁকলে, কে ওখানে?

—আমিও তো তাই জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম—কে আপনি?

—ও।

আমার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো একটা মনুষ্যমূর্ত্তি এবং টর্চের আলো-আঁধার কেটে গেলে দেখলাম, সে জানকীবাবু ডিটেক্‌টিভ!

বিস্ময়ের সুরে বল্লাম—আপনি কি করছিলেন অন্ধকারে বনের মধ্যে?

জানকীবাবু অপ্রতিভ সুরে বললেন—আমি এই—এই—

—ও, বুঝেছি। মনে কিছু মনে করবেন না। হঠাৎ এসে পড়েছিলাম এখানে।

—না না, কিছু না।

তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলি এগিয়ে। ভদ্রলোক শুধু অপ্রতিভ নয়, যেন হঠাৎ ভীত ও ত্রস্তও হয়ে পড়েচেন। কি মুশকিল! এসব পাড়াগাঁয়ে শহরের মত বাথরুমের বন্দোবস্ত না থাকাতে সত্যিই অনেকের বড়ই অসুবিধে হয়।

জানকী বড়ুয়া প্রাইভেট-ডিটেক্‌টিভ্‌কে এই অন্ধকারে গাঙ্গুলিমশায়ের ভূত ব’লে মনে হয়েছিল ভেবে আমার খুব হাসি পেলো। ভদ্রলোককে কি বিপন্নই ক’রে তুলেছিলাম!

সেদিন সন্ধ্যার পরে শ্রীগোপালের বাড়ী ব’সে চা খাচ্ছি, এমন সময় জানকীবাবু আমার পাশে এসে বসলেন। তাঁকেও চা দেওয়া হোলো। জানকীবাবু দেখলাম বেশ মজলিসি লোক, চা খেতে-খেতে তিনি নানা মজার-মজার গল্প বলতে লাগলেন। আমায় বল্লেন—আমি তো মশায় গাঁয়ের জামাই, আজ চোদ্দ বছর বিয়ে করেচি, কাকে না চিনি বলুন গ্রামে, সকলেই আমার আত্মীয়।

আমি বল্লাম—আপনি এখানে প্রায়ই যাতায়াত করেন? তাহলে তো হবেই আত্মীয়তা!

—আমার স্ত্রী মারা গিয়েচে আজ বছর তিনেক। তারপর আমি প্রায়ই আসি না। তবে শাশুড়ীঠাকরুণ বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন, আমার আসার জন্যে চিঠি লেখেন, না এসে পারিনে।

—ছেলেপুলে কি আপনার?

—একটি ছেলে হয়েছিল, মারা গিয়েচে। এখন আর কিছুই নেই।

—ও।

হঠাৎ জানকীবাবু আমার মুখের দিকে চেয়ে আমায় জিগ্যেস করলেন—আচ্ছা, গাঙ্গুলিমশায়ের খুন সম্বন্ধে পুলিস কোনো সূত্র পেয়েচে ব’লে আপনার মনে হয়?

—কেন বলুন তো?

—আমার বিশেষ কৌতূহল এ-সম্বন্ধে। গাঙ্গুলিমশায় আমার শ্বশুরের সমান ছিলেন। বড় স্নেহ করতেন আমায়। তাঁর খুনের ব্যাপারের একটা কিনারা না হওয়া পর্য্যন্ত আমার মনে শান্তি নেই। আমার মনে কোনো অহঙ্কার নেই মশায়। আমি এ খুনের কিনারা করি, বা আপনি করুন, বা পুলিসই করুক, আমার পক্ষে সব সমান। যার দ্বারা হোক কাজ হলেই হোলো। নাম আমি চাইনে।

—নাম কে চায় বলুন? আমিও নয়।

—তবে আসুন-না আমরা মিলে-মিশে কাজ করি? পুলিশকেও বলুন।

—পুলিশ তো খুব রাজী, তারা তো এতে খুব খুশী হবে।

—বেশ, তবে কাল থেকে—

—আমার কোনো আপত্তি নেই।

—আচ্ছা, প্রথম কথা—আপনি কোনো কিছু সূত্র পেয়েচেন কিনা আমায় বলুন। আমি যা পেয়েচি আপনাকে বলি।

—আমি এখানে এখন বলবো না। পরে আপনাকে জানাবো।

—ননী ঘোষের ব্যাপারটা আপনি কি মনে করেন?

—সেদিন তো আপনাকে বলেচি। ওকে আমার সন্দেহ হয়। আপনি ওকে সন্দেহ করেন?

—নিশ্চয় করি।

—আপনি ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেয়েচেন?

—সেই গহনা ব্যাপারটাই তো ওর বিরুদ্ধে একটা মস্ত বড় প্রমাণ।

—তা আমারও মনে হয়েচে, কিন্তু ওর মধ্যে গোলমালও যথেষ্ট।

—মহীন্ সেকরাকে নিয়ে তো? আমি মহীন্‌কে সন্দেহ করিনে।

—কেন বলুন তো?

—মহীন্ তো খাতা লিখতো না গাঙ্গুলিমশায়ের। ভেবে দেখুন কথাটা।

—সে-সব আমিও ভেবেচি। তাতেও জিনিসটা পরিষ্কার হয় না।

—চলুন না, দু’জনে একবার ননীর কাছে যাই।

—তার কাছে আমি গিয়েছিলাম। তাতে কোন ফল হবে না।

—হিসাবের খাতাখানা কোথায়?

—পুলিসের জিম্মায়।

—আপনি ভালো ক’রে দেখেচেন খাতাখানা?

—দেখেচি বলেই তো ননীকে জড়াতে পারিনে ভালো ক’রে।

—কেন?

—শুধু ননীর হাতের লেখা নয়, আরও অনেকের হাতের লেখা তাতে আছে।

—কার কার?

জানকীবাবু ব্যগ্রভাবে এ-প্রশ্নটা ক’রে আমার মুখের দিকে যেন উৎকণ্ঠিত-আগ্রহে উত্তরের প্রতীক্ষায় চেয়ে রইলেন। আমি মৃত-মুসলমান ভদ্রলোকটির ও স্কুলের ছাত্রটির কথা তাঁকে বললাম। জানকীবাবু বললেন—ও, এই! সে তো আমি জানি—শ্রীগোপালের মুখে শুনেচি।

—যা শুনেচেন, তার বেশি আমারও কিছু বলবার নেই।

পরদিন সকালে ননী ঘোষ এসে আমার কাছে হাজির হোলো। বল্লে—বাবু, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।

—কি?

—জানকীবাবু এ গাঁয়ের জামাই ব’লে খাতির করি। কিন্তু উনি কাল রাতে আমায় যেরকম গালমন্দ দিয়ে এসেচেন, তাতে আমি বড় দুঃখিত। বাবু, যদি দোষ ক’রে থাকি, পুলিসে দিন—গালমন্দ কেন?

—তুমি বড় চালাক লোক ননী। আমি সব বুঝি। পুলিসে দেবার হোলে, তোমাকে একদিনও হাজতের বাইরে রাখবো ভেবেচো।

—বাবুও কি আমাকে এখনও সন্দেহ করেন?

লোকটা সাংঘাতিক ধূর্ত্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ-খুন যে-ই করুক, ননী তার মধ্যে নিশ্চয়ই জড়িত। অথচ ও ভেবেচে যে, আমার চোখে ধূলো দেবে!

বল্লাম—সে-কথা এখন নয়। এক মাসের মধ্যেই জানতে পারবে।

—বাবু, আপনি আমাকে যতই সন্দেহ করুন, ধর্ম্ম যতদিন মাথার উপর আছে—

ধূর্ত্ত লোকেরাই ধর্ম্মের দোহাই পাড়ে বেশি! লোকটার উপর সন্দেহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।


সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।

সন্ধ্যার পরে আহারাদি সেরে অনেকক্ষণ বই পড়লাম। তারপর আলো নিবিয়ে দিয়ে নিদ্রা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেন জানি না—অনেক রাত পর্য্যন্ত ঘুম হোলো না এবং বোধহয় সেইজন্যই সেই রাত্রে আমার প্রাণ বেঁচে গেল।

ব্যাপারটা কি হোলো খুলে বলি।