মুকুট/প্রথম অঙ্ক/প্রথম দৃশ্য

প্রথম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

ত্রিপুরার সেনাপতি ইশা খাঁর কক্ষ। ত্রিপুরার কনিষ্ঠ রাজকুমার রাজধর ও ইশা খাঁ। ইশা খাঁ অস্ব পরিস্কার করিতে নিযুক্ত

 রাজধর। দেখো সেনাপতি, আমি বারবার বলছি, তুমি আমার নাম ধরে ডেকো না।

 ইশা খাঁ। তবে কী ধরে ডাকব? চুল ধরে, না কান ধরে?

 রাজধর। আমি বলে রাখছি, আমার সম্মান যদি তুমি না রাখ তোমার সম্মানও আমি রাখব না।

 ইশা খাঁ আমার সম্মান যদি তোমার হাতে থাকবার ভার থাকত তবে কানাকড়ার দরে তাকে হাটে বিকিয়ে আসতুম। নিজের সম্মান আমি নিজেই রাখতে পারব।

 রাজধর। তাই যদি রাখতে চাও তাহলে ভবিষ্যতে আমার নাম ধরে ডেকো না।

 ইশা খাঁ। বটে!

 রাজধর। হাঁ।

 ইশা খাঁ। হা হ হা হা। মহারাজাধিরাজকে কী বলে ডাকতে হবে? হুজুর, জনাব, জাঁহাপনা।

 রাজধর। আমি তোমার ছাত্র বটে কিন্তু আমি রাজকুমার সে-কথা তুমি ভুলে যাও।

 ইশা খাঁ। সহজে ভুলি নি, তুমি যে রাজকুমার সে-কথা মনে রাখা শক্ত করে তুলেছ।

 রাজধর। তুমি আমার ওস্তাদ সে-কথাও মনে রাখতে দিলে না দেখছি।

 ইশা খাঁ। বস্। চুপ।

দ্বিতীয় রাজকুমার ইন্দ্রকুমারের প্রবেশ

 ইন্দ্রকুমার। খাঁ সাহেব, ব্যাপারখানা কী।

 ইশা খাঁ। শোনো তো বাবা। বড়ো তামাশার কথা। তোমাদের মধ্যে এই যে ব্যক্তিটি সকলের কনিষ্ঠ এঁকে জাঁহাপনা, শাহানশা বলে না ডাকলে ওঁর আর সম্মান থাকে না— ওঁর সম্মানের এত টানাটানি।

 ইন্দ্রকুমার। বল কী। সত্যি নাকি। হা হা হা হা।

 রাজধর। চুপ করো দাদা।

 ইন্দ্রকুমার। তোমাকে কী বলে ডাকতে হবে। জাঁহাপনা। হা হা হা হা। শাহানশা।

 রাজধর। দাদা, চুপ করো বলছি।

 ইন্দ্রকুমার। জনাব, চুপ করে থাকা বড়ো শক্ত—হাসিতে যে পেট ফেটে যায় হুজুর।

 রাজধর। তুমি অত্যন্ত নির্বোধ।

 ইন্দ্রকুমার। ঠাণ্ডা হও ভাই, ঠাণ্ডা হও। তোমার বুদ্ধি তোমারই থাক, তার প্রতি আমার কোনো লোভ নেই।

 ইশা খাঁ। ওঁর বুদ্ধিটা সম্প্রতি বড়োই বেড়ে উঠেছে।

 ইন্দ্রকুমার। নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না— মই লাগাতে হবে।

অনুচরসহ যুবরাজ চন্দ্রমাণিক্য ও মহারাজ অমরমাণিক্যের প্রবেশ

 রাজধর। মহারাজের কাছে আমার নালিশ আছে।

 মহারাজ। কী হয়েছে।

 রাজধর। ইশা খাঁ পুনঃপুন নিষেধসত্ত্বে আমার অসম্মান করেন। এর বিচার করতে হবে।

 ইশা খাঁ। অসম্মান কেউ করে না— অসম্মান তুমি করাও। আরও তো রাজকুমার আছেন— তাঁরাও মনে রাখেন আমি তাঁদের গুরু, আমিও মনে রাখি তাঁরা আমার ছাত্র—সম্মান-অসম্মানের কোনো কথাই ওঠে না।

 মহারাজ। সেনাপতি সাহেব, কুমারদের এখন বয়স হয়েছে, এখন ওঁদের মান রক্ষা করে চলতে হবে বই কি।

 ইশা খাঁ। মহারাজ যখন আমার কাছে যুদ্ধ শিক্ষা করেছেন তখন মহারাজকে যে-রকম সম্মান করেছি রাজকুমারদের তা অপেক্ষা কম করি নে।

 রাজধর। অন্য কুমারদের কথা বলতে চাই নে, কিন্তু—

 ইশা খাঁ। চুপ করে। বৎস। আমি তোমার পিতার সঙ্গে কথা কচ্ছি। মহারাজ, মাপ করবেন, রাজবংশের এই কনিষ্ঠ পুত্রটি বড়ো হলে মুন‍্শির মতো কলম চালাতে পারবে কিন্তু তলোয়ার এর হাতে শোভা পাবে না (যুবরাজ এবং ইন্দ্রকুমারকে দেখাইয়া) চেয়ে দেখুন মহারাজ, এঁরাই তো রাজপুত্র, রাজগৃহ আলো করে আছেন।

 মহারাজ। রাজধর, খাঁ সাহেব কী বলছেন! তুমি অস্ত্র শিক্ষায় ওঁকে সন্তুষ্ট করতে পার নি?

 রাজধর। সে আমার ভাগ্যের দোষ, অস্ত্রশিক্ষার দোষ নয়। মহারাজ নিজে আমাদের ধনুর্বিদ্যার পরীক্ষা গ্রহণ করুন, এই আমার প্রার্থনা।

 মহারাজ। আচ্ছা উত্তম। কাল আমাদের অবসর আছে, কালই পরীক্ষা হবে। তোমাদের মধ্যে যে জিতবে তাকে আমার এই হীরেবাঁধানো তলোয়ার পুরস্কার দেব।

[ প্রস্থান

 ইশা খাঁ। শাবাশ রাজধর, শাবাশ। আজ তুমি ক্ষত্রিয়সন্তানের মতো কথা বলেছ। অস্ত্রপরীক্ষায় যদি তুমি হারে। তাতেও তোমার গৌরব নষ্ট হবে না— হারজিত তো আল্লার ইচ্ছা, কিন্তু ক্ষত্রিয়ের মনে স্পর্ধা থাকা চাই।

 রাজধর। থাক্ সেনাপতি, তোমার বাহবা অন্য রাজকুমারদের জন্য জমা থাক্; এতদিন তা না পেয়েও যদি চলে গিয়ে থাকে তবে আজও আমার কাজ নেই।

 যুবরাজ। রাগ কোরো না ভাই রাজধর। সেনাপতি সাহেবের সরল ভর্ৎসনা ওঁর সাদা দাড়ির মতো সমস্তই কেবল ওঁর মুখে। কোনো একটি গুণ দেখলেই তৎক্ষণাৎ উনি সব ভুলে যান। অস্ত্রপরীক্ষায় যদি তোমার জিত হয় তাহলে দেখবে, খাঁ সাহেব তোমাকে যেমন মনের সঙ্গে পুরস্কৃত করবেন এমন আর কেউ নয়।

 রাজধর। দাদা, আজ পূর্ণিমা আছে, আজ রাত্রে যখন গোমতী নদীতে বাঘে জল খেতে আসবে তখন শিকার করতে গেলে হয় না?

 যুবরাজ। বেশ কথা। তোমার যদি ইচ্ছে হয়ে থাকে তো যাওয়া যাবে।

 ইন্দ্রকুমার। কী আশ্চর্য। রাজধরের যে শিকারে প্রবৃত্তি হল। এমন তো কখনও দেখা যায় নি।

 ইশা খাঁ। ওঁর আবার শিকারে প্রবৃত্তি নেই! উনি সকলের চেয়ে বড়ো জীব শিকার করে বেড়ান। রাজসভায় দুই-পা-ওয়ালা এমন একটি জীব নেই যিনি ওঁর কোনো না কোনো ফাঁদে আটকা না পড়েছেন।

 যুবরাজ। তোমার তলোয়ারও যেমন তোমার জিহ্বাও তেমনি, দুই-ই খরধার— যার উপর গিয়ে পড়ে তার একেবারে মর্মচ্ছেদ না করে ফেরে না।

 রাজধর। দাদা, তুমি আমার জন্যে ভেবো না। খাঁ সাহেব জিহ্বায় যতই শান দিন না কেন আমার মর্মে আঁচড় কাটতে পারবেন না।

 ইশা খাঁ। তোমার মর্ম পায় কে বাবা। বড়ো শক্ত।

 ইন্দ্রকুমার। যেমন, হঠাৎ আজ রাত্রে তোমার শিকারে যাবার শখ হল, এর মর্ম ভালো বোঝা যাচ্ছে না।

 যুবরাজ। আহা ইন্দ্রকুমার, ইন্দ্রকুমার, প্রত্যেক কথাতেই রাজধরকে আঘাত করাটা তোমার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।

 রাজধর। সে-আঘাতে বেদনা না পাওয়াও আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।

 ইন্দ্রকুমার। দাদা, আজ রাত্রে শিকারে যাওয়াই তোমার মত না কি?

 যুবরাজ। তোমার সঙ্গে, ভাই. শিকার করতে যাওয়াই বিড়ম্বনা। নিতান্ত নিরামিষ শিকার করতে হয়। তুমি বনে গিয়ে বড়ো বড়ো জন্তু মেরে আন, আর আমরা কেবল লাউ কুমড়ো কচু কাঁঠাল শিকার করেই মরি।

 ইশা খাঁ। (ইন্দ্রকুমারের পিঠ চাপড়াইয়া) যুবরাজ ঠিক বলেছেন, পুত্র। তোমার তীর সকলের আগে ছোটে এবং নির্ঘাত গিয়ে লাগে— তোমার সঙ্গে পেরে উঠবে কে।

 ইন্দ্রকুমার। না দাদা, ঠাট্টা নয়। তুমি না গেলে কে শিকার করতে যাবে।

 যুবরাজ। আচ্ছা চলো। আজ রাজধরের ইচ্ছে হয়েছে, ওঁকে নিরাশ করব না।

 ইন্দ্রকুমার। কেন দাদা, আমার ইচ্ছে হয়েছে বলে কি যেতে নেই?

 যুবরাজ। সে কী কথা ভাই, তোমার সঙ্গে তো রোজই যাচ্ছি।

 ইন্দ্রকুমার। তাই বুঝি পুরোনো হয়ে গেছে।

 যুবরাজ। আমার কথা অমন উলটো বুঝলে বড়ো ব্যথা লাগে।

 ইন্দ্রকুমার। না দাদা, ঠাট্টা করছিলুম,— চলো প্রস্তুত হই গে।

 ইশা খাঁ। ইন্দ্রকুমার বুকে দশটা বাণ সইতে পারে কিন্তু দাদার সামান্য অনাদরটুকু সইতে পারে না।

[অনুচরগণ ব্যতীত সকলের প্রস্থান

অনুচরগণ

 প্রথম। কথাটা তো ভালো ঠেকছে না হে। আমাদের ছোটো কুমারের ধনুর্বিদ্যার দৌড় তো সকলেরই জানা আছে— উনি মধ্যম কুমারের সঙ্গে অস্ত্রপরীক্ষায় এগোতে চান এর মানে কী?

 দ্বিতীয়। কেউ বা তীর দিয়ে লক্ষ্য ভেদ করে, কেউ বা বুদ্ধি দিয়ে।

 প্রথম। সেই তো ভয়ের থা। অস্ত্রপরীক্ষায় অস্ত্র না চালিয়ে যদি বুদ্ধি চালাও সেটা যে দুষ্টবুদ্ধি।

 তৃতীয়। দেখো, বংশী, অস্ত্রই চলুক আর বুদ্ধিই চলুক মাঝের থেকে তোমার ঐ জিভটিকে চালিও না, আমার এই পরামর্শ। যদি টিকে থাকতে চাও তো চুপ করে থাকো।

 দ্বিতীয়। বনমালী ঠিক কথাই বলেছে। ঐ ছোটো কুমারের কথা উঠলেই তুমি যা মুখে আসে তাই ব’লে ফেল। রাজার ছেলে কে ভালো কে মন্দ সে-বিচারের ভার আমাদের উপর নেই। তবে কিনা, আমাদের যুবরাজ বেঁচে থাকুন আর আমাদের মধ্যম কুমার ভাই লক্ষ্মণের মতো সর্বদা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থেকে তাঁকে রক্ষে করুন, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করো। ছোটো কুমারের কথা মুখে না আনাই ভালো

 প্রথম। ইচ্ছে ক’রে তো আনি নে। আমাদের মধ্যম কুমার সরল মানুষ—মনে তাঁর ভয়ডরও নেই, পাক্‌চক্রও নেই’ সর্বদাই ভয় হয়, ঐ যাঁর নামটা করছি নে তিনি কখন তাঁকে কী ফেসাদে ফেলেন।

 দ্বিতীয়। চল্‌ চল্‌, ঐ আসছেন।

 প্রথম। ঐ যে সঙ্গে ওঁর মামাতো ভাই ধুরন্ধরটিও আছেন, শনির সঙ্গে মঙ্গল এসে জুটেছেন।

[প্রস্থান

রাষ্ট্রধর ও ধুরন্ধর

 রাজধর। অসহ্য হয়েছে।

 ধুরন্ধর। কিন্তু সহ্য করতেও তো কসুর নেই। ইন্দ্রকুমারের সঙ্গে তো প্রায় জন্মাবধিই এইরকম চলছে, কিন্তু অসহ্য হয়েছে এমন তো লক্ষণ দেখি নে।

 রাজধর। লক্ষণ দেখিয়ে লাভ হবে কী। যখন দেখাব একেবারে কাজে দেখাব। একটা সুযোগ এসেছে। এইবার অস্ত্রপরীক্ষায় আমি লক্ষ্য ভেদ করব।

 ধুরন্ধর। ইন্দ্রকুমারের বক্ষে না কি।

 রাজধর। বক্ষে নয়, তার হৃদয়ে। এবারকার পরীক্ষায় আমি জিতব, ওঁর অহংকারটাকে বিঁধে এফোঁড় ওফোঁড় করব।

 ধুরন্ধর। অস্ত্রপরীক্ষায় ইন্দ্রকুমারকে জিতবে, এইটেকেই সুযোগ বলছ?

 রাজধর। সুযোগ কি তীরের মুখে থাকে। সুযোগ বুদ্ধির ডগায়। তোমাকে কিন্তু একটি কাজ করতে হবে।

 ধুরন্ধর। কাজ তো তোমার বরাবরই করে আসছি, ফল তো কিছু পাই নে।

 রাজধর। ফল সবুরে পাওয়া যায়। কোনোরকম ফন্দিতে ইন্দ্রকুমার-দাদার অস্ত্রশালায় ঢুকে তাঁর তূণের প্রথম খোপটি থেকে তাঁর নামলেখা তীরটি তুলে নিয়ে আমার নামলেখা তীর বসিয়ে আসতে হবে। তাঁর সঙ্গে আমার তীর বদল করতে হবে, ভাগ্যও বদল হবে।

 ধুরন্ধর। সবই যেন বুঝলুম কিন্তু আমার প্রাণটি? সেটি গেলে তো কারও সঙ্গে বদল চলবে না।

 রাজধর। তোমার কোনো ভয় নেই, আমি আছি।

 ধুরন্ধর। তুমি তো বরাবরই আছ, কিন্তু ভয়ও আছে। সেই যখন ইন্দ্রকুমারের রুপোর পাত দেওয়া ধনুকটার উপরে তুমি লোভ করলে আমিই তো সেটি সংগ্রহ করে তোমার ঘরে এনে লুকিয়ে রেখেছিলুম— শেষকালে যখন ধরা পড়লে, ইন্দ্রকুমার ঘৃণা করে সে-ধনুকটা তোমাকে দান করলেন কিন্তু আমার যে-অপমানটা করলেন সে আমার জীবন গেলেও যাবে না। তখনো তো, ভাই, তুমি ছিলে—রক্ষা যত করেছিলে সে আমার মনে আছে।

 রাজধর। এবার তোমার সময় এসেছে- সেই অপমানের শোধ দেবার জোগাড় করো।

 ধুরন্ধর। সময় কখন কার আসে সেটা যে পরিষ্কার বোঝা যায় না। দুর্বল লোকের পক্ষে অপমান পরিপাক করবার শক্তিটাই ভালো; শোধ তোলবার শখটা তার পক্ষে নিরাপদ নয়। ঐ যে ওঁরা সব আসছেন। আমি পালাই। তোমার সঙ্গে আমাকে একত্রে দেখলেই ইন্দ্রকুমার যে কথাগুলি বলবেন তাতে মধুবর্ষণ করবে না —আর ইশা খাঁও যে তোমার চেয়ে আমার প্রতি বেশি ভালোবাসা প্রকাশ করবেন এমন ভরসা আমার নেই।

[প্রস্থান