মৃণালিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
বাতায়নে।

 হেমচন্দ্র কিছু দিন উপবনগৃহে বাস করিলেন। জনার্দ্দনের সহিত প্রত্যহ সাক্ষাৎ হইত; কিন্ত ব্রাহ্মণের বধিরতা প্রযুক্ত ইঙ্গিতে আলাপ হইত মাত্র। মনোরমার সহিতও সর্ব্বদা সাক্ষাৎ হইত, মনোরমা কখন তাঁহার সহিত উপযাচিকা হইয়া কথা কহিতেন; কখন বা বাক্যব্যয় না করিয়া স্থানান্তরে চলিয়া যাইতেন। বস্ততঃ মনোরমার প্রকৃতি তাঁহার পক্ষে অধিকতর বিস্ময়জনক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। প্রথমতঃ তাঁহার বয়ঃক্রম দুরনুমেয়, সহজে তাঁহাকে বালিকা বলিয়া বোধ হইত, কিন্তু কখন কখন মনোরমাকে অতিশয় গাম্ভীর্য্যশালিনী দেখিতেন। মনোরমা কি অদ্যাপিও কুমারী? হেমচন্দ্র এক দিন কথোপকথনচ্ছলে মনোরমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনোরমে, তোমার শশুর বাটী কোথা?” মনোরমা কহিল, “বলিতে পারি না।” আর এক দিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “মনোরমা। তুমি কয় বৎসরের হইয়াছ?” মনোরমা তাহাতেও উত্তর দিয়াছিলেন, “বলিতে পারি না।”

 মাধবাচার্য্য হেমচন্দ্রকে উপবনে স্থাপিত করিয়া দেশ পর্য্যটনে যাত্রা করিলেন। তাঁহার অভিপ্রায় এই, যে এ সময় বঙ্গদেশীয় অধীন রাজগণে যাহাতে নবদ্বীপে সসৈন্য সমবেত হইয়া বঙ্গেশ্বরের আনুকূল্য করেন, তদ্বিষয়ে তাঁহাদিগকে প্রবৃত্তি দেন। হেমচন্দ্র নবদ্বীপে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু নিষ্কর্ম্মে দিনযাপন ক্লেশকর হইয়া উঠিল। হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন। এক এক বার মনে হইতে লাগিল যে দিগ্বিজয়কে গৃহরক্ষায় রাখিয়া অশ্ব লইয়া একবার গৌড়ে গমন করেন। কিন্তু তথায় মৃণালিনীর সাক্ষাৎ লাভ করিলে তাঁহার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইবে, বিনা সাক্ষাতে গৌড় যাত্রায় কি ফলোদয় হইবে? এই সকল আলোচনায় যদিও গৌড়যাত্রায় হেমচন্দ্র নিরস্ত হইলেন, তথাপি অনুদিন মৃণালিনী চিন্তায় হৃদয় নিযুক্ত থাকিত। একদা প্রদোষ কালে তিনি শয়নকক্ষে, পর্য্যঙ্কোপরি শয়ন। করিয়া মৃণালিনীর চিন্তা করিতে ছিলেন। চিন্তাতেও হৃদয় সুখলাভ করিতেছিল। মুক্ত বাতায়ন পথে হেমচন্দ্র প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করিতে ছিলেন। নবীন শরদুদয়। রজনী চন্দ্রিকাশালিনী, আকাশ নির্ম্মল, বিস্তৃত, নক্ষত্রখচিত, ক্কচিৎ স্তর-পরম্পরা-বিন্যস্ত শ্বেতাম্বুদমালায় বিভূষিত। বাতায়ন পথে অদূরবর্ত্তিনী ভাগিরথীও দেখা যাইতে ছিল; ভাগিরথী বিশলোরসী, বহুদূরবিসর্পিণী, চন্দ্রকর প্রতিঘাতে উজ্জ্বলতরঙ্গিণী, দূরপ্রান্তে ধূমময়ী, নববারি-সমাগম-প্রমাদিনী। নববারি সমাগম জনিত কল্লোল হেমচন্দ্র শুনিতে পাইতেছিলেন। বাতায়ন পথে বায়ু প্রবেশ করিতেছিল, বায়ু গঙ্গাতরঙ্গে নিক্ষিপ্ত জলকণা-সংস্পর্শে শীতল, নিশাসমাগমে প্রফুল্ল বন্যকুসুম সংস্পর্শে সুগন্ধী; চন্দ্রকর-প্রতিঘাতী-শ্যামলোজ্বল বৃক্ষ পত্র বিধূত করিয়া, নদীতীরবিরাজিত কাশকুসুম আন্দোলিত করিয়া, বায়ু বাতায়ন পথে প্রবেশ করিতেছিল। হেমচন্দ্র বিশেষ প্রীতিলাভ করিলেন।

 অকস্মাৎ বাতায়ন পথ অন্ধকার হইল—চন্দ্রালোকের গতিরোধ হইল। হেমচন্দ্র বাতায়ন সন্নিধি একটী মনুষ্য মুণ্ড দেখিতে পাইলেন। বাতায়ন ভূমি হইতে কিছু উচ্চ—এজন্য কাহারও হস্ত পদাদি কিছু দেখিতে পাইলেন না—কেবল এক খানি মুখ দেখিলেন। মুখ খানি অতি বিশাল শ্মশ্রুসংযুক্ত, তাহার মস্তকে উষ্ণীষ। সেই উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে, বাতায়নে, নিকটে, সম্মুখে, শ্মশ্রুসংযুক্ত উষ্ণীযধারী মনুষ্য মুণ্ড দেখিলেন। দেখিয়া হেমচন্দ্র শয্যা হইতে লম্ফ দিয়া নিজ শাণিত অসি গ্রহণ করিলেন।

 অসি গ্রহণ করিয়া হেমচন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন যে বাতায়নে আর মনুষ্য মুণ্ড নাই।

 হেমচন্দ্র অসি হস্তে দ্বারোদঘাটন করিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। বাতায়নতলে আসিলেন। তথায় কেহ নাই।

 গৃহের চতুঃপার্শ্বে, গঙ্গাতীরে, বনমধ্যে হেমচন্দ্র ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিলেন। কোথাও কাহাকে দেখিলেন না।

 হেমচন্দ্র গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। তখন রাজপুত্র পিতৃদত্ত যোদ্ধৃবেশে আপাদমস্তক আত্মশরীর মণ্ডিত করিলেন। অকাল-জলদোদয় বিমর্ষিত গগনমণ্ডলবৎ তাঁহার সুন্দর মুখকান্তি অন্ধকারময় হইল। তিনি একাকী সেই গভীর নিশাতে শস্ত্রময় হইয়া যাত্রা করিলেন। বাতায়ন পথে মনুষ্য মুণ্ড দেখিয়া তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন যে বঙ্গে যবন আসিয়াছে।