মৃণালিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ।


চৌরোদ্ধরণিক।

 মহম্মদ আলি বাহির হইয়া দৃষ্টি পথাতীত হইলে অন্য একজন গুপ্ত-দ্বার নিকটে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “প্রবেশ করিব?”

 পশুপতি কহিলেন, “কর।”

 একজন চৌরোদ্ধরণিক প্রবেশ করিল। সে প্রণত হইলে পশুপতি আশীর্ব্বাদ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন শান্তশীল! মঙ্গল সম্বাদ ত?”

 চৌরোদ্ধরণিক কহিল, “আপনি একে একে প্রশ্ন করুন—আমি ক্রমে সকল সম্বাদ নিবেদিতেছি।”

 পশু। “যবনদিগের অবস্থিতি স্থানে গিয়াছিলে?”

 শান্ত। “সেখানে কেহ যাইতে পারে না।”

 পশু। “কেন?”

 শান্ত। “অতি নিবিড় বন, দুর্ভেদ্য।”

 পশু। “কুঠার হস্তে বৃক্ষচ্ছেদন করিতে করিতে গেলে না কেন?”

 শান্ত। “ব্যাঘ্র ভল্লূকের দৌরাত্ম্য।”

 পশু। “সশস্ত্র গেলে না কেন?”

 শান্ত। “যে সকল কাঠুরিয়ার ব্যাঘ্র ভল্লূক বধ করিয়া বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল তাহারা সকলেই যবনহস্তে প্রাণত্যাগ করিয়াছে—কেহই ফিরিয়া আইসে নাই।”

 পশু। “তুমিও না হয় না আসিতে?”

 শান্ত। “তাহা হইলে কে আসিয়া আপনাকে সম্বাদ দিত?”

 পশুপতি হাসিয়া কহিলেন, “তুমিই আসিতে।”

 শান্তশীল প্রণাম করিয়া কহিল, “আমিই সম্বাদ দিতে আসিয়াছি।”

 পশুপতি আনন্দিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি প্রকারে গেলে?”

 শান্ত। “প্রথমে উষ্ণীষ, শস্ত্র ও তদুপযোগী বসন সংগ্রহ করিলাম। তাহা লুক্কায়িত করিয়া বাঁধিয়া পৃষ্ঠে সংস্থাপিত করিলাম। তৎপরে কাঠুরিয়ার বেশ ধরিয়া কাঠুরিয়াদিগের সঙ্গে বনমার্গে প্রবেশ লাভ করিলাম। পরে যখন যবনেরা কাঠুরিয়াদিগের দেখিতে পাইয়া তাহাদিগের বধে প্রবৃত্ত হইল— তখন আমি অপসৃত হইয়া বৃক্ষান্তরালে বেশ পরিবর্ত্ত করিলাম। পরে মুসলমান হইয়া যবনশিবিরে সর্ব্বত্র পর্য্যটন করিলাম।”

 পশু। “প্রশংসনীয় বটে। যবন সৈন্য কত দেখিলে?”

 শান্ত। “সে বৃহৎ অরণ্যে যত ধরে। বোধ হয় বিংশতি সহস্র হইবে।”

 পশুপতি ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। পরে কহিলেন “তাহাদিগের কথাবার্ত্তা কি শুনিলে?”

 শান্ত। “বিস্তর শুনিলাম—কিন্তু তাহার কিছুই আপনার নিকট নিবেদন করিতে পারিলাম না।”

 পশু। “কেন?”

 শান্ত। “যাবনিক ভাষায় পণ্ডিত নহি।” পশুপতি হাস্য করিলেন। শান্তশীল তখন কহিলেন, “মহম্মদ আলি এখানে যে আসিয়াছিলেন, তাহাতে বিপদ্ আশঙ্কা করিতেছি।”

 পশুপতি চমকিত হইয়া কহিলেন, “কেন?”

 শা। “তিনি অলক্ষিত হইয়া আসিতে পারেন নাই। তাঁহার আগমন কেহ কেহ জানিতে পারিয়াছে।”

 পশুপতি অত্যন্ত শঙ্কান্বিত হইয়া কহিলেন, “কিসে জানিলে?”

 শান্তশীল কহিলেন, “আমি শ্রীচরণ দর্শনে আসিবার সময় দেখিলাম যে বৃক্ষতলে এক ব্যক্তি লুক্কায়িত হইল। তাহার যােদ্ধৃবেশ। তাহার সহিত কথােপকথনে বুঝিলাম যে সে মহম্মদ আলির গৃহপ্রবেশ দৃষ্টি করিয়া তাহার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে, অন্ধকারে তাহাকে চিনিতে পারিলাম না।”

 প। “তার পর।”

 শা। “তার পর দাস তাহাকে চিত্রগৃহে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিয়া আসিয়াছে।”

 পশুপতি চৌরােদ্ধরণিককে সাধুবাদ করিতে লাগিলেন। এবং কহিলেন, যে “কল্য প্রাতে উঠিয়া সে ব্যক্তির প্রতিবিহিত করা যাইবেক। আজি রাত্রে সে কারারুদ্ধই থাক। এক্ষণে তােমাকে অন্য এক কার্য্য সাধন করিতে হইবে। যবনসেনাপতির ইচ্ছা অদ্য রাত্রে তিনি মগধরাজপুত্রের ছিন্ন মস্তক দর্শন করেন। তাই এখনই সংগ্রহ করিবে।”

 শা। “কার্য্য নিতান্ত সহজ নহে। রাজপুত্র পিপীলিকা নহেন।”

 প। “আমি তােমাকে একা যুদ্ধে যাইতে বলিতেছি না। কতকগুলি লােক লইয়া তাঁহার গৃহ আক্রমণ করিবে।”

 শা। “লােকে কি বলিবে?”

 প। “লােকে বলিবে দসুতে তাঁহাকে হত্যা করিয়া গিয়াছে।”

 শা। “যে আজ্ঞা। আমি চলিলাম।”

 পশুপতি শান্তশীলকে পুরস্কার করিয়া বিদায় করিলেন। পরে গৃহাভ্যন্তরে যথা বিচিত্র সূক্ষ্ম কারুকার্য্য খচিত মন্দিরে অষ্টভুজামূর্ত্তি স্থাপিতা আছে, তথায় গমন করিয়া প্রতিমাগ্রে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। পরে গাত্রোত্থান করিয়া যুক্ত করে ভক্তিভাবে ইষ্টদেবের স্তুতি করিয়া কহিলেন, “জননি! বিশ্ব-পাত্রি! আমি অকূল সাগরে ঝাঁপ দিলাম—দেখিও মা! আমায় উদ্ধার করিও। আমি জননী স্বরূপা জন্মভূমি কখন দেবদ্বেষী যবনকে বিক্রয় করিব না। কেবল মাত্র এই আমার পাপাভিসন্ধি যে অক্ষম প্রাচীন রাজার স্থানে আমি রাজা হইব। যেমন কণ্টকের দ্বারা কণ্টক উদ্ধার করিয়া পরে উভয় কণ্টককে দূরে নিক্ষিপ্ত করে—তেমনি আমি যবন সহায়তায় রাজ্য লাভ করিয়া রাজ্য সহায়তায় যবনকে নিপাত করিব। ইহাতে পাপ কি মা! যদি ইহাতে পাপ হয়, যাবজ্জীবন প্রজার সুখানুষ্ঠান করিয়া সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিব। জগৎপ্রসবিনি! প্রসন্ন হইয়া আমার কামনা সিদ্ধ কর।”

 এই বলিয়া পশুপতি পুনরপি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন। প্রণাম করিয়া গাত্রোথান করিলেন— শয্যাগৃহে যাইবার জন্য। ফিরিলেন, ফিরিয়া দেখিলেন—অপূর্ব্ব দর্শন:—

 সম্মুখে, দ্বারদেশ ব্যাপিত করিয়া, জীবনময়ী প্রতিমারূপিণী তরুণী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

 পশুপতি প্রথমে চমকিত হইলেন—শিহরিয়া উঠিলেন। পরক্ষণেই উচ্ছ্বাসোন্মুখ সমুদ্রবারিবৎ আনন্দে স্ফীত হইলেন।

 তরুণী বীণানিন্দিত স্বরে কহিলেন, “পশুপতি!”

 পশুপতি দেখিলেন——মনোরমা!