মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/একাদশ পরিচ্ছেদ
একাদশ পরিচ্ছেদ।
পূর্ব্ব পরিচয়।
প্রভাতে হেমচন্দ্র মাধবাচার্য্যের অনুসন্ধানে যাত্রা করিলেন। গিরিজায়া আসিয়া মৃণালিনীর নিকট বসিল।
গিরিজায়া মৃণালিনীর দুঃখের ভাগিনী হইয়াছিল, সহৃদয় হইয়া দুঃখের সময়ে দুঃখের কাহিনী সকল শুনিয়াছিল। আজি সুখের দিনে সে কেন সুখের ভাগিনী না হইবে? আজি সেইরূপ সহৃদয়তার সহিত সুখের কথাকেন না শুনিবে? গিরিজায়া ভিখারিণী—মৃণালিনী মহাধনীর কন্যা—উভয়ে এতদূর সামাজিক প্রভেদ। কিন্তু দুঃখের দিনে গিরিজায়া মৃণালিনীর একমাত্র সুহৃৎ, সে সময়ে ভিখারিণী আর রাজপুরবধূতে প্রভেদ থাকে না; আজি সেই বলে গিরিজায়া মৃণালিনীর হৃদয়ের সুখের অংশাধিকারিণী হইল।
যে আলাপ হইতেছিল তাহাতে গিরিজায় বিস্মিত ও প্রীত হইতেছিল। মৃণালিনীকে জিজ্ঞাসা করিল।—“তা এত দিন এমন কথা প্রকাশ কর নাই কি জন্য?”
মৃ। “এত দিন রাজপুত্রের নিষেধ ছিল এজন্য প্রকাশ করি নাই। এক্ষণে তিনি প্রকাশে অনুমতি করিয়াছেন এজন্য প্রকাশ করিতেছি।”
গি। “ঠাকুরাণি! যদি আদ্যোপান্ত প্রকাশ করিতে অনিচ্ছা না হয়, তবে আমার শুনিয়া বড় তৃপ্তি হয়।”
তখন মৃণালিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন।
“আমার পিতা একজন বৌদ্ধমতাবলম্বী শ্রেষ্ঠী। তিনি অত্যন্ত ধনী ও মথুরারাজের প্রিয়পাত্র ছিলেন। মথুরার রাজকন্যার সহিত আমার সখীত্ব ছিল।
আমি একদিন মথুরার রাজকন্যার সহিত নৌকারোহণে যমুনায় জলবিহারে গিয়াছিলাম। তথায় অকস্মাৎ প্রবল ঝটিকারন্ত হওয়ায়, নৌকা জলমধ্যে নিমগ্ন হইল। রাজ কন্যা প্রভূতি অনেকেই রক্ষক এবং নাবিকদিগের হস্তে রক্ষা পাইলেন। আমি ভাসিয়া গেলাম। দৈবযোগে এক রাজপুত্র সেই সময়ে নৌকারোহণে ছিলেন। তাঁহাকে তৎকালে চিনিতাম না—তিনিই হেমচন্দ্র। তিনিও বায়ুর প্রবলতার কারণ নৌকা তীরে লইতে ছিলেন। জলমধ্যে আমার চুল দেখিতে পাইয়া স্বয়ং জলে পড়িয়া আমাকে উঠাইলেন। আমি তখন অজ্ঞান। হেমচন্দ্র আমার পরিচয় জানিতেন না। তিনি তখন তীর্থ দর্শনে মথুরায় আসিয়াছিলেন। তাঁহার বাসার্থ একটি স্বতন্ত্র গৃহ ছিল। তথায় আমায় লইয়া গিয়া শুশ্রুষা করিলেন। আমি জ্ঞানপ্রাপ্ত হইলে, তিনি আমার পরিচয় লইয়া আমাকে আমার পিতৃভবনে পাঠাইবার উদ্যোগ করিলেন। কিন্তু তিন দিবস পর্য্যন্ত ঝড় বৃষ্টি থামিল না। এরূপ দুর্দ্দিন হইল যে কেহ বাটীর বাহির হইতে পারে না। সুতরাং তিন দিন আমাদিগের উভয়ে এক গৃহে সহবাস হইল। উভয়ে উভয়ের পরিচয় পাইলাম। কেবল কুল পরিচয় নহে—উভয়ের অন্তঃকরণের পরিচয় পাইলাম। তখন আমার বয়স পঞ্চদশ বৎসর মাত্র। কিন্তু সেই বয়সেই আমি তাঁহার দাসী হইলাম। সে কোমল বয়সে সকল বুঝিতাম। হেমচন্দ্রকে দেবতার ন্যায় চক্ষে দেখিতে লাগিলাম। তিনি যাহা বলিতেন, তাহা পুরাণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তিনি বলিলেন “বিবাহ কর।” সুতরাং আমারও বোধ হইল, ইহা অবশ্য কর্ত্তব্য। চতুর্থ দিবসে, দুর্য্যোগের উপশম দেখিয়া উপবাস করিলাম; দিগ্বিজয় উদ্যোগ করিয়া দিল। তীর্থ পর্য্যটনে রাজপুত্রের কূলপুরোহিত সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাদিগকে পরিণীত করিলেন।”
গি। “কন্যা সম্প্রদান করিল কে?”
মৃ। অরুন্ধতী নামে আমার মাতার এক প্রাচীন কুটুম্বিনী ছিলেন। তিনি সম্বন্ধে মাতার ভগিনী হইতেন। আমাকে বাল্যাবধি লালন পালন করিয়াছিলেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, এবং আমার সকল দৌরাত্ম সহ্য করিতেন। আমি তাঁহার নামোল্লেখ করিলাম। দিগ্বিজয়, কোন ছলে পুরমধ্যে তাঁহাকে সম্বাদ পাঠাইয়া দিয়া ছলক্রমে হেমচন্দ্রের গৃহে তাঁহাকে ডাকিয়া আনিল। অরুন্ধতী মনে জানিতেন আমি যমুনায় ডুবিয়া মরিয়াছি। তিনি আমাকে জীবিতা দেখিয়া এতই আহ্লাদিতা হইলেন, যে আর কোন কথাতেই অসন্তুষ্ট হইলেন না। আমি যাহা বলিলাম তাহাতেই স্বীকৃতা হইলেন। তিনিই কন্যা সম্প্রদান করিলেন। বিবাহের পর মাসীর সঙ্গে পিতৃভবনে গেলাম। সকল কথা সত্য বলিয়া কেবল বিবাহের কথা লুকাইলাম। আমি, হেমচন্দ, দিগ্বিজয়, কুলপুরোহিত, আর অরুন্ধতী মাসী ভিন্ন এ বিবাহ আর কেহ জানিত না। অদ্য তুমি জানিলে। গি। “মাধবাচার্য্য জানেন না?”
মৃ। “না। তিনি জানিলে সর্ব্বনাশ হইত। মগধরাজ তাহাহইলে অবশ্য শুনিতেন। আমার পিতা বৌদ্ধ, মগধরাজ গুরুতর বৌদ্ধবিদ্বেষী।”
গি। “ভাল তোমার পিতা যদি তোমাকে এপর্য্যন্ত কুমারী বলিয়া জানিতেন, তবে এত বয়সেও তোমার বিবাহ দেন নাই কেন?”
মৃ। “পিতার দোষ নাই। তিনি অনেক যত্ন করিয়াছেন। কিন্তু বৌদ্ধ সুপাত্র পাওয়া সুকঠিন; কেন না বৌদ্ধধর্ম্ম প্রায় লোপ হইয়াছে। পিতা বৌদ্ধ জামাতা চাহেন অথচ সুপাত্রও চাহেন। এরূপ একটি পাওয়া গিয়াছিল, সে আমার বিবাহের পর। বিবাহের দিনস্থির হইয়া সকল উদ্যোগও হইয়াছিল। কিন্তু আমি সেই সময়ে জ্বর করিয়া বসিলাম। পাত্র অন্যত্র বিবাহ করিল।”
গি। “ইচ্ছাপূর্ব্বক জ্বর করিয়াছিলে?”
মৃ। “হাঁ ইচ্ছাপূর্ব্বক। আমাদিগের উদ্যানে একটা কূপ আছে তাহার জল কেহ স্পর্শ করে না। তাহার পানে বা স্নানে নিশ্চিত জ্বর। আমি রাত্রে গোপনে সেই জলে স্নান করিয়াছিলাম।”
গি। “পুনশ্চ সম্বন্ধ হইলে, সেই রূপ করিতে?”
মৃ। “সন্দেহ কি? নচেৎ হেমচন্দ্রের নিকট পলাইয়া যাইতাম।”
গি। “মথুরা হইতে মগধ এক মাসের পথ। স্ত্রীলোক হইয়া কাহার সহায়ে পলাইতে?”
মৃ। “আমার সহিত সাক্ষাতের জন্য হেমচন্দ্র মথুরায় এক বাণিজ্যাগার স্থাপন করিয়া আপনি তথায় রত্নদাস বণিক্ বলিয়া” পরিচিত হইলেন। বৎসরে এক বার করিয়া তথায় বাণিজ্য করিতে আসিতেন। যখন তিনি তথায় না থাকিতেন, তখন দিগ্বিজয় তথায় তাঁহার বাণিজ্যাগার রক্ষা করিত। দিগ্বিজয়ের প্রতি আদেশ ছিল যে যখন আমি যে রূপ আজ্ঞা করিব সে তখনই তদ্রুপ করিবে। সুতরাং আমি নিঃসহায় ছিলাম না।”
কথা সমাপ্ত হইলে গিরিজায়া বলিল “ঠাকুরাণি! আমি একটি বড় গুরুতর অপরাধ করিয়াছি। আমাকে মার্জ্জনা করিতে হইবে। আমি তাহার উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করিতে স্বীকৃত আছি।”
মৃ। “কি এমন গুরুতর কাজ করিলে?”
গি। “দিগ্বিজয় টা তোমার হিতকারী তাহা আমি জানিতাম না, আমি জানিতাম ওটা অতি অপদার্থ। এজন্য আমি প্রভাতে তাহাকে ভালরূপে ঘা কত ঝাঁটা দিয়াছি। তা ভাল করি নাই।”
মৃণালিনী হাসিয়া বলিলেন, “তা কি প্রায়শ্চিত্ত করিবে?”
গি। “ভিখারীর মেয়ের কি বিবাহ হয়?”
মৃ। (হাসিয়া) “করিলেই হয়।”
গি। “তবে আমি সে অপদার্থটাকে বিবাহ করিব। আর কি করি?”
মৃণালিনী আবার হাসিয়া বলিলেন “তবে আজি তোমার গায় হলুদ দিব।”