মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।


ধাতুমূর্ত্তির বিসর্জ্জন।

 মহম্মদআলির নিকট বিদায় হইয়া, রাজপথ অতিবাহিত করিয়া পশুপতি ধীরে ধীরে চলিলেন। ধীরে ধীরে চলিলেন―যবনের কারাগার হইতে বিমুক্ত হইয়াও দ্রুতপদক্ষেপণে তাঁহার প্রবৃত্তি জন্মিল না। রাজপথে যাহা দেখিলেন, তাহাতে আপনার মনোমধ্যে আপনি মরিলেন। তাঁহার প্রতিপদে মৃত নাগরিকের দেহ চরণে বাজিতে লাগিল; প্রতিপদে শোণিতসিক্ত কর্দ্দমে চরণ আর্দ্র হইতে লাগিল। পথের দুই পার্শ্বে গৃহাবলী জনশূন্য―বহুগৃহ ভস্মীভূত; কোথাও বা তপ্ত অঙ্গার এখনও জ্বলিতেছিল। গৃহান্তরে দ্বার ভগ্ন―গবাক্ষ ভগ্ন―প্রকোষ্ঠ ভগ্ন―তদুপরি মৃতদেহ! এখনও কোন হতভাগ্য মরণ যন্ত্রণায় অমানুষিক কাতরস্বরে শব্দ করিতেছিল। এ সকলের মূল তিনিই। দারুণ লোভের বশবর্ত্তী হইয়া তিনি এই রাজধানীকে শ্মশানভূমি করিয়াছেন। পশুপতি মনে মনে স্বীকার করিলেন যে তিনি প্রাণদণ্ডের যোগ্য পাত্র বটে―কেন মহম্মদআলিকে কলঙ্কিত করিয়া কারাগার হইতে পলায়ন করিলেন? যবন তাঁহাকে ধৃত করুক―অভিপ্রেত শাস্তিপ্রদান করুক―মনে করিলেন, ফিরিয়া যাইবেন। মনে মনে তখন ইষ্ট দেবীকে স্মরণ করিলেন―কিন্তু কি কামনা করিবেন? কামনার বিষয় আর কিছুই নাই। আকাশ প্রতি চাহিলেন। গগনের নক্ষত্রচন্দ্রগ্রহমণ্ডলী-বিভূষিত সহাস্য পবিত্র শোভা তাঁহার চক্ষে সহিল না―তীব্র জ্যোতিসম্পীড়িতের ন্যায় চক্ষুরধঃক্ষেপণ করিলেন। সহসা অনৈসর্গিক ভয় আসিয়া তাঁহার হৃদয় আচ্ছন্ন করিল―অকারণ ভয়ে তিনি আর পদক্ষেপ করিতে পারিলেন না। সহসা বলহীন হইলেন। বিশ্রাম করিবার জন্য পথিমধ্যে উপবেশন করিতে গিয়া দেখিলেন―এক শবাসনে উপবেশন করিতেছিলেন। শবনিস্রুত রক্ত তাঁহার বসনে এবং অঙ্গে লাগিল। তিনি কণ্টকিত-কলেবরে পুনরুত্থান করিলেন। আর দাঁড়াইলেন না। দ্রুতপদে চলিলেন। সহসা আর এক কথা মনে পড়িল―তাঁহার নিজ বাটী? তাহা কি যবনহস্তে রক্ষা পাইয়াছে? আর সে বাটীতে যে কুসুমময়ী প্রাণ-পুত্তলীকে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন, তাহার কি হইয়াছে? মনোরমার কি দশা হইয়াছে। তাঁহার প্রাণাধিকা, তাঁহাকে পাপ পথ হইতে পুনঃ পুনঃ নিবারণ করিয়াছিল, সেও বুঝি তাঁহার পাপ সাগরের তরঙ্গে ডুবিয়াছে। এ যবনসেনাপ্রবাহে সে কুসুম কলিকা না জানি কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে!

 পশুপতি উন্মত্তের ন্যায় আপন ভবনাভিমুখে ছুটিলেন। আপনার ভবনসম্মুখে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, যাহা ভাবিয়াছিলেন তাহাই ঘটিয়াছে―জ্বলন্ত পর্ব্বতের ন্যায় তাঁহার উচ্চচূড় অট্টালিকা অগ্নিময় হইয়া জ্বলিতেছে।

 দৃষ্টিমাত্র হতভাগ্য পশুপতির প্রতীত হইল যে যবনেরা তাঁহার পৌরজনসহ মনোরমাকে বধ করিয়া গৃহে অগ্নি দিয়া গিয়াছে। মনোরমা যে পলায়ন করিয়াছিল, তাহা তিনি কিছু জানিতে পারেন নাই।

 নিকটে কেহই ছিল না যে তাঁহাকে এ সম্বাদ প্রদান করে। আপন বিকল চিত্তের সিদ্ধান্তই তিনি গ্রহণ করিলেন। হলাহল কলস পরিপূর্ণ হইল―হৃদয়ের শেষ তন্ত্রী ছিঁড়িল। তিনি কিয়ৎক্ষণ বিস্ফারিত নয়নে দহ্যমান অট্টালিকা প্রতি চাহিয়া রহিলেন―মরণোন্মুখ পতঙ্গবৎ অল্পক্ষণ বিচলশরীরে একস্থানে অবস্থিতি করিলেন―শেষে মহাবেগে সেই অনলতরঙ্গ মধ্যে ঝাঁপ দিলেন। সঙ্গের প্রহরী চমকিত হইয়া রহিল।

 মহাবেগে পশুপতি জ্বলন্ত দ্বারপথে পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। চরণ দগ্ধ হইল―অঙ্গ দগ্ধ হইল―কিন্তু পশুপতি ফিরিলেন না। অগ্নিকুণ্ড অতিক্রম করিয়া আপন শয়নকক্ষে গমন করিলেন―কাহাকেও দেখিলেন না। দগ্ধ শরীরে কক্ষে কক্ষে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহার অন্তরমধ্যে যে দুরন্ত তাগ্নি জ্বলিতেছিল―তাহাতে তিনি বাহ্যিক দাহযন্ত্রণা অনুভূত করিতে পারিলেন না।

 ক্ষণে ক্ষণে গৃহের নূতন নূতন খণ্ড সকল অগ্নিকর্তৃক আক্রান্ত হইতেছিল। ক্ষণমধ্যে আক্রান্ত প্রকোষ্ঠ বিষম শিখা আকাশপথে উত্থিত করিয়া ভয়ঙ্কর গর্জ্জন করিতেছিল। ক্ষণে ক্ষণে দগ্ধ গৃহাংশ সকল অশণিসম্পাত শব্দে ভূতলে পড়িয়া যাইতেছিল। ধূম, ধূলি, তৎসঙ্গে লক্ষ লক্ষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গে আকাশ অদৃশ্য হইতে লাগিল।

 দাবানল-সম্বেষ্টিত আরণ্য-গজের ন্যায় পশুপতি অগ্নিমধ্যে ইতস্ততঃ দাস দাসী স্বজনসহিত মনোরমার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কাহারও কোন চিহ্ন পাইলেন না। হতাশ হইলেন। তখন দেবীর মন্দির প্রতি তাহার দৃষ্টিপাত হইল। দেখিলেন দেবী অষ্টভুজার মন্দির অগ্নি কর্তৃক আক্রান্ত হইয়া জ্বলিতেছে। পশুপতি পতঙ্গবৎ তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন অনলমণ্ডল মধ্যে অদগ্ধা স্বর্ণপ্রতিমা বিরাজ করিতেছে। পশুপতি উন্মত্তের ন্যায় কহিলেন,

 “মা! জগদম্বে! আর তোমাকে জগদম্বা বলিব না। আর তোমার পূজা করিব না। তোমাকে প্রণামও করিব না। আশৈশব আমি কায়মনোবাক্যে তোমার সেবা করিলাম―ঐ পদধ্যান ইহ জন্মে সার করিয়াছিলাম―এখন, মা এক দিনের পাপে সর্ব্বস্ব হারাইলাম। তবে কি জন্য তোমার পূজা করিয়াছিলাম? কেনই বা তুমি আমার পাপমতি অপনীত না করিলে?”

 মন্দির-দহন অগ্নি অধিকতর প্রবল হইয়া গর্জ্জিয়া উঠিল। পশুপতি তথাপি প্রতিমা সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ঐ দেখ! ধাতুমূর্ত্তি!―তুমি ধাতুমূর্ত্তি মাত্র, দেবী নহ―ঐ দেখ, অগ্নি গর্জ্জিতেছে। যে পথে আমার প্রাণাধিকা গিয়াছে―সেই পথে, তোমাকেও প্রেরণ করিবে। কিন্তু আমি অগ্নিকে এ কীর্ত্তি রাখিতে দিব না―আমি তোমাকে স্থাপনা করিয়াছিলাম―আমিই তোমাকে বিসর্জ্জন করিব। চল! ইষ্টদেবি! তোমাকে গঙ্গার জলে বিসর্জ্জন করিব।”

 এই বলিয়া পশুপতি প্রতিমা উত্তোলন আকাঙ্ক্ষায় উভয় হস্তে তাহা ধৃত করিলেন। সেই সময়ে আবার অগ্নি গর্জ্জিয়া উঠিল। তখনই পর্ব্বত বিদারানুরূপ প্রবল শব্দ হইল,―দগ্ধ মন্দির, আকাশপথে ধূলিধূম ভস্ম সহিত অগ্নি স্ফুলিঙ্গ রাশি প্রেরণ করিয়া, চূর্ণ হইয়া পড়িয়া গেল। তন্মধ্যে প্রতিমাসহিত পশুপতির সজীবনে সমাধি হইল।