মৃণালিনী (১৮৭৪)/চতুর্থ খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

চতুর্থ খণ্ড।


প্রথম পরিচ্ছেদ।

ঊর্ণনাভ।

 যতক্ষণ মৃণালিনীর সুখের তারা ডুবিতেছিল, ততক্ষণ বঙ্গদেশের সৌভাগ্য শশীও সেই পথে যাইতেছিল। যে ব্যক্তি রাখিলে, বঙ্গ রাখিতে পারিত, সেই ঊর্ণনাভের ন্যায় বিরলে বসিয়া অভাগা জন্মভূমিকে বন্ধ করিবার জন্য জাল পাতিতে ছিল। নিশীথ সময়ে নিভৃতে বসিয়া ধর্ম্মাধিকার পশুপতি, নিজ দক্ষিণ হস্তস্বরূপ শান্তশীলকে ভর্ৎসনা করিতেছিলেন। “শান্তশীল! প্রাতে যে সম্বাদ দিয়াছ, তাহা ত কেবল তোমার অপারগতার পরিচয় মাত্র। তোমার প্রতি আর কোন ভার দিবার ইচ্ছা নাই।”

 শান্তশীল কহিল, “যাহা অসাধ্য তাহা পারি নাই। অন্য কার্য্যের পরিচয় গ্রহণ করুন।”

 প। “সৈনিকদিগকে কি উপদেশ দেওয়া হইতেছে?”

 শা। “এই যে, আমাদিগের আজ্ঞা না পাইলে কেহ সজ্জিত না হয়।”

 প। “প্রান্তপাল ও কোষ্ঠপাল দিগকে কি উপদেশ দেওয়া হইয়াছে?”

 শা। “এই বলিয়া দিয়াছি যে অচিরাৎ যবন সম্রাটের নিকট হইতে কর লইয়া কতিপয় যবন দূত স্বরূপ আসিতেছে। তাহাদিগের গতিরোধ না করে।”  প। “দামোদর শর্ম্মা উপদেশানুযায়ী কার্য্য করিয়াছেন কি না?”

 শা। “তিনি অতি চতুরের ন্যায় কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিয়াছেন।”

 প। “সে কি প্রকার?”

 শা। “তিনি একখানি পুরাতন গ্রন্থের একখানি পত্র পরিবর্ত্তন করিয়া তাহাতে আপনার রচিত যবন বিষয়িণী কবিতা গুলিন ন্যস্ত করিয়াছিলেন। তাহা লইয়া অদ্য প্রাহ্নে রাজাকে শ্রবণ করাইয়াছেন। এবং মাধবাচার্য্যের অনেক নিন্দা করিযাছেন।”

 প। “কবিতায় ভবিষ্যৎ বঙ্গবিজেতার রূপ বর্ণনা সবিস্তারে লিখিত আছে। তৎসম্বন্ধে মহারাজ কোন অনুসন্ধান করিয়াছিলেন?”

 শা। “করিয়াছিলেন, মদন সেন সম্প্রতি কাশীধাম হইতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন, এ সম্বাদ মহারাজ অবগত আছেন। মহারাজ কবিতায় ভবিষ্যৎ বঙ্গজেতার অবয়ব বর্ণনা শুনিয়া তাঁহাকে ডাকিতে পাঠাইলেন। মদন সেন উপস্থিত হইলে মহারাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেমন, তুমি মগধে যবনরাজ প্রতিনিধিকে দেখিয়া আসিয়াছ?’ সে কহিল ‘আসিয়াছি।’ মহারাজ তখন আজ্ঞা করিলেন, ‘সে দেখিতে কি প্রকার, বিবরিত কর।’ তখন মদন সেন বখ্‌তিয়ার খিলিজির যথার্থ যেরূপ দেখিয়াছেন তাহাই বিবরিত করিলেন। কবিতাতেও সেই রূপ বর্ণিত ছিল। সুতরাং বঙ্গজয় ও তাঁহার রাজ্যনাশ নিশ্চিত বলিয়া বুঝিলেন।”

 প। “তাহার পর।”

 শা। “রাজা তখন রোদন করিতে লাগিলেন, কহিলেন ‘আমি এ বৃদ্ধ বয়সে কি করিব? সপরিবারে যবনহস্তে প্রাণে নষ্ট হইব দেখিতেছি।’ তখন দামোদর শিক্ষামত কহিলেন, ‘মহারাজ! ইহার সদুপায় এই যে, অবসর থাকিতে থাকিতে আপনি সপরিবারে তীর্থযাত্রা করুন। ধর্ম্মাধিকারের প্রতি রাজকার্য্যের ভার দিয়া যাউন। তাহা হইলে আপনার শরীর রক্ষা হইবে। পরে শাস্ত্র মিথ্যা হয় রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন।’ রাজা এ পরামর্শে সন্তুষ্ট হইয়া নৌকা সজ্জা করিতে আদেশ করিয়াছেন। অচিরাৎ সপরিবারে পুরুষোত্তমে যাত্রা করিবেন।”

 প। “দামোদর সাধু। তুমিও সাধু। এক্ষণে আমার মনস্কামনা সিদ্ধির সম্ভাবনা দেখিতেছি। নিতান্ত পক্ষে, স্বাধীন রাজা না হই, যবনরাজ প্রতিনিধি হইব। কার্য্য সিদ্ধ হইলে তোমাদিগকে সাধ্যমত পুরস্কৃত করিতে ত্রুটি করিব না। তাহা ত জান। এক্ষণে বিদায় হও। কল্য প্রাতেই যেন তীর্থ যাত্রা জন্য নৌকা প্রস্তুত থাকে।”

 শান্তশীল বিদায় হইল।