মৃণালিনী (১৮৭৪)/তৃতীয় খণ্ড/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
অমৃতে গরিল—গরলামৃত।
হেমচন্দ্র আচার্য্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া মৃণালিনীকে দুশ্চরিত্রা বিবেচনা করিয়াছিলেন; মৃণালিনীর পত্র পাঠ না করিয়া তাহা ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছিলেন, তাঁহার দূতীকে বেত্রাঘাত করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন। কিন্তু ইহা বলিয়া তিনি মৃণালিনীকে ভাল বাসিতেন না, তাহা নহে। মৃণালিনীর জন্য তিনি রাজ্যত্যাগ করিয়া মথুরাবাসী হইয়াছিলেন। এই মৃণালিনীর জন্য গুরুর প্রতি শরসন্ধান করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন, মৃণালিনীর জন্য গৌড়ে নিজব্রত বিস্মৃত হইয়া ভিখারিণীর তোষামোদ করিয়া ছিলেন। আর এখন? এখন, হেমচন্দ্র মাধবাচার্য্যকে শূল। দেখাইয়া বলিয়াছিলেন, “মৃণালিনীকে এই শূলে বিদ্ধ করিব?” কিন্তু তাই বলিয়া কি, এখন তাহার স্নেহ একেবারে ধ্বংস প্রাপ্ত হইয়াছিল? স্নেহ কি এক দিনে ধ্বংস হইয়া থাকে? বহুদিন অবধি পার্ব্বতীয় বারি পৃথিবী হৃদয়ে বিচরণ করিয়া আপন গতিপথ খোদিত করে, এক দিনের সূর্য্যাতপে কি সে নদী শুকায়? জলের যে পথ খোদিত হইয়াছে, জল সেই পথেই যাইবে, সে পথ রোধ কর, পৃথিবী ভাসিয়া যাইবে। হেমচন্দ্র সেইরাত্রে, নিজ শয়ন কক্ষে, শয্যোপরি শয়ন করিয়া সেই মুক্ত বাতায়ন সন্নিধানে মস্তক রাখিয়া, বাতায়নপথে দৃষ্টি করিতেছিলেন— তিনি কি নৈশ শোভা দৃষ্টি করিতে ছিলেন? যদি তাঁহাকে সে সময়ে কেহ জিজ্ঞাসা করিত যে রাত্র সজ্যোৎস্না কি অন্ধকার, তাহা তিনি তখন সহসা বলিতে পারিতেন না। তাঁহার হৃদয় মধ্যে যে রজনীর উদয় হইয়াছিল, তিনি কেবল তাহাই দেখিতেছিলেন। সে রাত্রি ত তখনও সজ্যোৎস্না! নহিলে তাঁহার উপাধান আর্দ্র কেন? কেবল মেঘোদয় মাত্র। যাহার হৃদয়-আকাশে অন্ধকার বিরাজ করে সে রোদন করে না।
যে কখন রোদন করে নাই, সে মনুষ্যমধ্যে অধম। তাহাকে বিশ্বাস করিও না। নিশ্চিত জানিও সে পৃথিবীর সুখ কখন ভোগ করে নাই—পরের সুখও কখন তাহার সহ্য হয় না। এমত হইতে পারে, যে কোন আত্মচিত্তবিজয়ী মহাত্মা বিনা বাস্পমোচনে গুরুতর মনঃপীড়া সকল সহ্য করিতেছেন, এবং করিয়া থাকেন; কিন্তু তিনি যদি কস্মিন্ কালে, এক দিন বিরলে, একবিন্দু অশ্রুজলে পৃথিবী সিক্ত না করিয়া থাকেন, তবে তিনি চিত্তজয়ী মহাত্মা হইলে হইতে পারেন, কিন্তু আমি বরং চোরের সহিত প্রণয় করিব, তথাপি তাঁহার সঙ্গে নহে।
হেমচন্দ্র রোদন করিতেছিলেন,—যে স্ত্রীকে পাপিষ্ঠা, মনে স্থান দিবার অযোগ্য বলিয়া জানিয়াছিলেন, তাহার জন্য রোদন করিতেছিলেন। মৃণালিনীর কি তিনি দোষ আলোচনা করিতেছিলেন? তাহা করিতেছিলেন বটে, কিন্তু কেবল তাহাই নহে। এক একবার মৃণালিনীর প্রেমপরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, প্রেমপরিপূর্ণ বিস্তীর্ণ নেত্র, প্রেম পরিপূর্ণ কথা, প্রেম পরিপূর্ণ কার্য্য সকল মনে করিতেছিলেন। এক দিন মথুরায়, হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নিকট একখানি লিপি প্রেরণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন, উপযুক্ত বাহক পাইলেন না; কিন্তু মৃণালিনীকে গবাক্ষ পথে দেখিতে পাইলেন। তখন হেমচন্দ্র একটী আম্র ফলের উপরে আবশ্যকীয় কথা লিখিয়া মৃণালিনীর ক্রোড় লক্ষ্য করিয়া বাতায়ন পথে প্রেরণ করিলেন; আম্র ধরিবার জন্য মৃণালিনী কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া আসাতে আম্র মৃণালিনীর ক্রোড়ে পড়িয়া তাঁহার কর্ণে লাগিল, অমনি তদাঘাতে কর্ণবিলম্বী রত্নকুণ্ডল কর্ণ ছিন্ন ভিন্ন করিয়া কাটিয়া পড়িল; কর্ণশ্রুত রুধিরে মৃণালিনীর গ্রীবা ভাসিয়া গেল। মৃণালিনী ভ্রুক্ষেপও করিলেন না; কর্ণে হস্তও দিলেন না; হাসিয়া আম্র তুলিয়া লিপি পাঠ পূর্ব্বক, তখনই তৎপৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর লিখিয়া আম্র প্রতিপ্রেরণ করিলেন। এবং যতক্ষণ হেমচন্দ্র দৃষ্টিপথে রহিলেন ততক্ষণ বাতায়নে থাকিয়া হাস্যমুখে দেখিতে লাগিলেন। হেমচন্দ্রের তাহা মনে পড়িল। আর এক দিন মৃণালিনীকে বৃশ্চিক দংশন করিয়াছিল। তাহার যন্ত্রণায় মৃণালিনী মুমূর্ষুবৎ কাতর হইয়াছিলেন। তাঁহার একজন পরিচারিকা তাহার উত্তম ঔষধ জানিত; তংসেবন মাত্র যন্ত্রণা একেবারে শীতল হয়; দাসী শীঘ্র ঔষধ আনিতে গেল। ইত্যবসরে হেমচন্দ্রের দূতী গিয়া কহিল যে হেমচন্দ্র উপবনে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন। মুহুর্ত্তমধ্যে ঔষধ আসিত, কিন্তু মৃণালিনী তাহার অপেক্ষা করেন নাই; অমনি সেই মরণাধিক যন্ত্রণা বিস্মৃত হইয়া উপবনে উপস্থিত হইলেন। আর ঔষধি সেবন হইল না। হেমচন্দ্রের তাহা স্মরণ হইল। আর এক দিন হেমচন্দ্র মথুরা হইতে গুরু দর্শনে যাইতেছিলেন; মথুরা হইতে এক প্রহরের পথ আসিয়া হেমচন্দ্রের পীড়া হইল। তিনি এক পান্থনিবাসে পড়িয়া রহিলেন; কি প্রকারে এ সম্বাদ অন্তঃপুরে মৃণালিনীর কর্ণে প্রবেশ করিল। মৃণালিনী সেই রাত্রে এক ধাত্রী মাত্র সঙ্গে লইয়া রাত্রিকালে সেই এক যোজন পথ পদব্রজে অতিক্রম করিয়া হেমচন্দ্রকে দেখিতে আসিলেন। যখন মৃণালিনী পান্থনিবাসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি পথশ্রান্তিতে প্রায় নির্জ্জীব; চরণ ক্ষত বিক্ষত; রুধির বহিতেছিল। সেই রাত্রিতেই মৃণালিনী পিতার ভয়ে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। গৃহে আসিয়া তিনি স্বয়ং পীড়িতা হইলেন। হেমচন্দ্রের তাহাও মনে পড়িল। আর কত দিনের কত কথা মনে পড়িল। সেই সকল কথা মনে করিয়া হেমচন্দ্র কাঁদিতেছিলেন, শত বার আপনি প্রশ্ন করিতেছিলেন, “সেই মৃণালিনী অবিশ্বাসিনী—ইহা কি সম্ভব?” শতবার ভাবিতেছিলেন, “কেন আমি মৃণালিনীর পত্র পড়িলাম না? নবদ্বীপে কেন আসিয়াছে তাহাই বা কেন জানিলাম না? তাহা হইলে এ সংশয়ের মোচন হইত।” পত্র খণ্ড গুলিন যে বনে নিক্ষিপ্ত করিয়াছিলেন, তাহা যদি সেখানে পাওয়া যায় তবে তাহা মুক্ত করিয়া যতদূর পারেন, ততদূর মর্ম্মাবগত হইবেন; এইরূপ প্রত্যাশা করিয়া এক বার সেই বন পর্য্যন্ত গিয়াছিলেন, কিন্তু সেখানে বনতলস্থ অন্ধকারে কিছুই দেখিতে পায়েন নাই। বায়ু লিপিখণ্ড সকল উড়াইয়া লইয়া গিয়াছিল। যদি তখন আপন দক্ষিণ বাহু ছেদন করিয়া দিলে হেমচন্দ্র সেই লিপিখণ্ড গুলিন পাইতেন তবে হেমচন্দ্র তাহাও দিতেন।
আবার ভাবিতে ছিলেন, “আচার্য্য কেন মিথ্যা কথা বলিবেন। আচার্য্য অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ—কখন মিথ্যা বলিবেন না। বিশেষ আমাকে পুত্রাধিক স্নেহ করেন—জানেন এ সম্বাদে আমার মরণাধিক যন্ত্রণা হইবে, কেন আমাকে তিনি মিথ্যা কথা বলিয়া এত যন্ত্রণা দিবেন? আর তিনিও স্বেচ্ছাক্রমে এ কথা বলেন নাই। আমি সদর্পে তাঁহার নিকট কথা বাহির করিয়া লইলাম—যখন আমি বলিলাম যে আমি সকলই অবগত আছি—তখনই তিনি কথা বলিলেন। মিথ্যা বলিবার উদ্দেশ্য থাকিলে বলিতে অনিচ্ছুক হইবেন কেন? তবে হইতে পারে, হৃষীকেশ তাঁহার নিকট মিথ্যা বলিয়া থাকিবে। কিন্তু হৃষীকেশই বা অকারণে গুরুর নিকট মিথ্যা বলিবে কেন? আর মৃণালিনীই বা তাহার গৃহ ত্যাগ করিয়া নবদ্বীপে আসিবে কেন? মৃণালিনী অবিশ্বাসিনী বা?”
যখন এইরূপ ভাবেন, তখন হেমচন্দ্রের মুখ কালিমাময় হয়, ললাট ঘর্ম্মসিক্ত হয়; তিনি শয়ন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া বসেন; দন্তে অধর দংশন করেন, লোচন আরক্ত এবং বিস্ফারিত হয়; শূল ধারণ জন্য হস্ত মুষ্টিবদ্ধ হয়। আবার মৃণালিনীর প্রেমময় মুখমণ্ডল মনে পড়ে। অমনি ছিন্নমুল বৃক্ষের ন্যায় শয্যায় পতিত হয়েন; উপাধানে মুখ লুক্কায়িত করিয়া শিশুর ন্যায় রোদন করেন। হেমচন্দ্র ঐরূপ রোদন করিতে ছিলেন, এমত সময়ে তাঁহার শয়নগৃহের দ্বার উদঘাটিত হইল। গিরিজায়া প্রবেশ করিল।
হেমচন্দ্র প্রথমে মনে করিলেন মনোরমা। তখনই দেখিলেন, সে কুসুমময়ী মূর্ত্তি নহে। পরে চিনিলেন যে গিরিজায়া। প্রথমে বিস্মিত, পরে আহ্লাদিত, শেষে কৌতুহলাক্রান্ত হইলেন। বলিলেন, “তুমি আবার কেন?”
গিরিজায়া কহিল, “আমি মৃণালিনীর দাসী। মৃণালিনীকে আপনি ত্যাগ করিয়াছেন কিন্তু আপনি মৃণালিনীর ত্যাজ্য নহেন। সুতরাং আমাকে আবার আসিতে হইয়াছে। আমাকে বেত্রাঘাত করিতে সাধ থাকে করুন। আমি একবার সরিয়া গিয়াছিলাম কিন্তু ঠাকুরাণীর জন্য এবার তাহা সহিব স্থির সঙ্কল করিয়াছি।”
এ তিরস্কারে হেমচন্দ্র অত্যন্ত অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “তোমার কোন শঙ্কা নাই। স্ত্রীলোককে আমি মারিব না। তুমি কেন আসিয়াছ? মৃণালিনী কোথায়? বৈকালে তুমি বলিয়াছিলে তিনি নবদ্বীপে আসিয়াছেন? নবদ্বীপে আসিয়াছেন কেন? আমি তাঁহার পত্র না পড়িয়া ভাল করি নাই।”
গি। “মৃণালিনী নবদ্বীপে আপনাকে দেখিতে আসিয়াছেন।”
হেমচন্দ্রের শরীর কণ্টকিত হইল। এই মৃণালিনীকে কুলটা বলিয়া অপমানিত করিয়াছেন? তিনি পুনরপি গিরিজায়াকে কহিলেন “মৃণালিনী কোথায় আছেন?”
গি। “তিনি আপনার নিকট জন্মের শোধবিদায় লইতে আসিয়াছেন। সরোবরতীরে দাঁড়াইয়া আছেন। আপনি আসুন।”
এই বলিয়া গিরিজায়া চলিয়া গেল। হেমচন্দ্র তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন।
গিরিজায়া বাপীতীরে, যথায় মৃণালিনী সোপানোপরি বসিয়া ছিলেন, তথায় উপনীত হইলেন। হেমচন্দ্র ও তথায় আসিলেন। গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণি! গাত্রোত্থান কর। রাজপুত্র আসিয়াছেন।”
মৃণালিনী উঠিয়া দাঁডাইলেন। উভয়ে উভয়ের মুখ নিরীক্ষণ করিলেন। মৃণালিনীর দৃষ্টি লোপ হইল; অশ্রুজলে চক্ষু পূরিয়া গেল। অবলম্বন শাখা ছিন্ন হইলে যেমন শাখাবিলম্বিনী লতা ভূতলে পড়িয়া যায়, মৃণালিনী সেইরূপ হেমচন্দ্রের পদমূলে পতিত হইলেন। গিরিজায়া অন্তরে গেল।