মৃণালিনী (১৮৭৪)/তৃতীয় খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


“আমি ত উন্মাদিনী”

 অপরাহ্নে মাধবাচার্য্য প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। তিনি সম্বাদ আনিলেন, যে, ধর্ম্মাধিকার প্রকাশ করিয়াছেন যে, যবনসেনা আসিয়াছে বটে, কিন্ত পুর্ব্বজিত রাজ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা শুনিয়া যবনসেনাপতি সন্ধিসংস্থাপনে ইচ্ছুক হইয়াছেন। আগামী কল্য তাঁহারা দূত প্রেরণ করিবেন। দূতের আগমন সাপেক্ষ কোন যুদ্ধোদ্যম হইতেছে না। এই সম্বাদ দিয়া মাধাবচার্য্য কহিলেন, “এই কুলাঙ্গার রাজা ধর্ম্মাধিকারের বুদ্ধিতে নষ্ট হইবে।”

 কথা হেচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশলাভ করিল কি না সন্দেহ। তাঁহাকে বিমনা দেখিয়া মাধবাচার্য্য বিদায় হইলেন।

 সন্ধ্যার প্রাক্কালে মনোরমা, হেমচন্দ্রের গৃহে প্রবেশ করিলেন। হেমচন্দ্রকে দেখিয়া মনোরম! কহিলেন,

 “ভ্রাতঃ তোমার ললাট কুঞ্চিত; তোমার ভ্রূকুটীকুটিল বিস্ফারিত লোচনে পলক নাই; লোচনযুগল—দেখি—তাই ত চক্ষু আর্দ্র; তুমি রোদন করিয়াছ।”

 হেমচন্দ্র মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন; আবার চক্ষু অবনত করিলেন; পুনর্ব্বার উন্নত গবাক্ষপথে দৃষ্টি করিলেন; আবার মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। মনোরমা বুঝিলেন যে দৃষ্টির এইরূপ গতির কোন উদ্দেশ্য নাই। যখন কথা কণ্ঠাগত, অথচ বলিবার নহে, তখনই দৃষ্টি এইরূপ হয়। মনোরমা কহিলেন,

 “হেমচন্দ্র, তুমি কেন কাতর হইয়াছ? কি হইয়াছে? হেমচন্দ্র কহিলেন, “কিছু না।”

 মনােরামা প্রথমে কিছু বলিলেন না—পরে আপনা আপনি মৃদু মৃদু কথা কহিতে লাগিলেন “কিছু না— বলিবে না! ছি! ছি! বুকের ভিতর বিছা পুষিবে।” বলিতে বলিতে মনােরমার চক্ষু দিয়া এক বিন্দু বারি বহিল;—পরে অকস্মাৎ হেমচন্দ্রের মুখ প্রতি চাহিয়া কহিলেন; “আমাকে বলিবে না কেন? আমি যে তােমার ভগিনী।”

 মনােরমার মুখের ভাবে, শান্তদৃষ্টিতে এত যত্ন, এত মৃদুতা, এত সহৃদয়তা প্রকাশ পাইল, যে, হেমচন্দ্রের অন্তঃকরণ দ্রবীভূত হইল। তিনি কহিলেন, “আমার যে যন্ত্রণা তাহা ভগিনীর নিকট কথনীয় নহে।”

 মনােরমা কহিলেন। “তবে আমি ভগিনী নহি।”

 হেমচন্দ্র কিছুতেই উত্তর করিলেন না। তথাপি প্রত্যাশাপন্ন হইয়া মনােরমা তাঁহার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। কহিলেন

 “আমি তােমার কেহ নহি।”

 হেম। “আমার দুঃখ ভগিনীর অশ্রাব্য—অপরের ও অশ্রাব্য।”

 হেমচন্দ্রের কণ্ঠস্বর করুণাময়—নিতান্ত আধিব্যক্তি পরিপূর্ণ; তাহা মনােরমার অন্তস্তলে গিয়া বাজিল। তখনই সে স্বর পবিবর্ত্তিত হইল, চক্ষে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল—অধর দংশন করিয়া হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমার দুঃখ কি? দুঃখ কিছুই না। আমি মালাভ্রমে কাল সর্প কণ্ঠে ধরিয়াছিলাম, এখন তাহা কণ্ঠচ্যুত করিয়াছি।

 মনােরমা আবার পূর্ব্ববৎ হেমচন্দ্রের প্রতি অনিমিক্ চক্ষে চাহিয়া রহিলেন। ক্রমে, তাঁহার মুখমণ্ডলে, অতি মধুর, অতি সকরুণ, হাস্য প্রকটিত হইল। বালিকা, প্রগল্‌ভতা প্রাপ্ত হইলেন। মনোরমা কহিলেন, “বুঝিয়াছি। তুমি না বুঝিয়া ভালবাস, তাহার পরিণাম ঘটিয়াছে।”

 হে। “ভাল বাসিতাম।” হেমচন্দ্র বর্ত্তমানের পরিবর্ত্তে অতীত কাল ব্যবহার করিলেন। অমনি নীরবে নিঃস্রুত অশ্রুজলে তাঁহার মুখমণ্ডল ভাসিয়া গেল।

 মনোরম বিরক্ত হইলেন। বলিলেন “ছি, ছি! প্রতারণা! এসংসার প্রতারণা, প্রতারণা! প্রতারণা! কেবল প্রতারণা!” মনোরমা বিরক্তিবশতঃ আপন অলকদাম চম্পকাঙ্গুলিতে জড়িত করিয়া টানিতে লাগিলেন।

 হেমচন্দ্র বিস্মিত হইলেন; কহিলেন “কি প্রতারণা করিলাম?”

 মনোরমা কহিলেন, “ভালবাসিতাম কি? তুমি ভালবাস। নহিলে কাঁদিলে কেন? কি? আজি তোমার স্নেহের পাত্র অপরাধী হইয়াছে বলিয়া তোমার প্রণয় বিনষ্ট হইয়াছে? কে তোমায় এমত প্রবোধ দিয়াছে?” বলিতে বলিতে মনোরমার প্রৌঢ়ভাবাপন্ন মুখ কান্তি সহসা প্রফুল্ল পদ্মবৎ অধিকতর ভাবব্যঞ্জক হইতে লাগিল, চক্ষু অধিক জ্যোতিঃস্ফূর্য্যৎ হইতে লাগিল, কণ্ঠস্বর অধিকতর পরিস্ফুট, আগ্রহ প্রকম্পিত হইতে লাগিল; বলিতে লাগিলেন, “এ কেবল বীর দম্ভকারী পুরুষদিগের দুর্প মাত্র, অহঙ্কার করিয়া প্রণয় অগ্নি নির্ব্বাণ করা যায়? তুমি বালির বাঁধ দিয়া এই কুলপরিপ্লাবিনী গঙ্গার বেগ রোধ করিতে পারিবে, তথাপি তুমি প্রণয়িনীকে পাপিষ্ঠা মনে করিয়া কখনও প্রণয়ের বেগ রোধ করিতে পারিবে না। হা কৃষ্ণ! মানুষ সকলেই প্রতারক!”

 হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন, আমি ইহাকে এক দিন বালিকা মনে করিয়াছিলাম!”

 মনোরমা কহিতে লাগিলেন, “তুমি পুরাণ শুনিয়াছ? আমি পণ্ডিতের নিকট তাহার গূঢ়ার্থসহিত শুনিয়াছি। লেখা আছে, ভগীরথ গঙ্গা আনিয়াছিলেন; এক দাম্ভিক মত্ত হস্তী তাহার বেগ সম্বরণ করিতে গিয়া ভাসিয়া গিয়াছিল। ইহার অর্থ কি? গঙ্গা প্রেম প্রবাহ স্বরূপ; ইহা জদীশ্বর পদ-পদ্ম-নিঃসৃত; ইহা জগতে পবিত্র,—যে ইহাতে অবগাহন করে সেই পুণ্যময় হয়। ইনি মৃত্যুঞ্জয় জটা-বিহারিণী; যে মৃত্যুকে জয় করিতে পারে, সেও প্রণয়কে মস্তকে ধারণ করে। আমি যেমন শুনিয়াছি, ঠিক সেইরূপ বলিতেছি। দাম্ভিক হস্তী দম্ভের অবতার স্বরূপ, সে প্রণয়বেগে ভাসিয়া যায়। প্রণয় প্রথমে একমাত্র পথ অবলম্বন করিয়া উপযুক্ত সময়ে শতমুখী হয়, প্রণয় স্বভাবসিদ্ধ হইলে, শত পাত্রে ন্যস্ত হয়—পরিশেষে সাগর সঙ্গমে লয় প্রাপ্ত হয়— সংসারস্থ সর্ব্বজীবে বিলীন হয়।”

 হে। তোমার উপদেষ্টা কি বলিয়াছেন প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই? পাপাসক্তকে কি ভালবাসিতে হইবে?”

 ইহার উত্তর ত মনোরমার উপদেষ্টা বলিয়া দেন নাই। উত্তর জন্য আপনার হৃদয় মধ্যে সন্ধান করিলেন; অমনি উত্তর আপনি মুখে অসিল। কহিলেন, “পাপাসক্তকে ভালবাসিতে হইবে। প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই। সকলকেই ভালবাসিবে, প্রণয় জন্মাইলেই তাহাকে যত্নে স্থান দিবে, কেন না প্রণয় অমূল্য। ভাই, যে ভাল, তাকে কে না ভালবাসে? যে মন্দ, তাকে যে আপনা ভুলিয়া ভালবাসে, আমি তাকে বড় ভালবাসি। কিন্তু আমি ত উন্মাদিনী।”

 হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “মনোরমা, এ সকল তোমায় কে শিখাইল? তোমার উপদেষ্টা অলৌকিক ব্যক্তি।”

 মনোরমা মুখাবনত করিয়া কহিলেন, “তিনি সর্বজ্ঞানী, কিন্তু—”

 হে। “কিন্তু কি?”

 ম। “তিনি অগ্নিস্বরূপ—আলো করেন, কিন্তু দগ্ধও করেন।”

 মনোরমা ক্ষণেক মুখাবনত করিয়া নীরব হইয়া রহিলেন।

 হেমচন্দ্র বলিলেন, “মনোরমা, তোমার মুখ দেখিয়া, আর তোমার কথা শুনিয়া, আমার বোধ হইতেছে তুমিও ভালবাসিয়াছ। বোধ হয় যাঁহাকে তুমি অগ্নির সহিত তুলনা করিলে তিনিই তোমার প্রণয়াধিকারী।”

 মনোরমা পূর্ব্বমত নীরবে রহিলেন। হেমচন্দ্র পুনরপি বলিতে লাগিলেন। যদি ইহা সত্য হয়, তবে আমার একটি কথা শুন। স্ত্রীলোকের সতীত্বের অধিক আর ধর্ম্ম নাই; যে স্ত্রীর সতীত্ব নাই, সে শূকরীর অপেক্ষাও অধম। সতীত্বের হানি কেবল কার্য্যেই ঘটে এমত নহে; স্বামিভিন্ন অন্য পুরুষের চিন্তা মাত্রও সতীত্বের বিঘ্ন। তুমি বিধবা, যদি স্বামিভিন্ন অপরকে মনেও ভাব তবে তুমি ইহলোকে পরলোকে স্ত্রীজাতির অধম হইয়া থাকিবে। অতএব সাবধান হও। যদি কাহারও প্রতি চিত্ত নিবিষ্ট থাকে, তবে তাহাকে বিস্মৃত হও।”

 মনোরমা উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিলেন; পরে মুখে অঞ্চল দিয়া হাসিতে লাগিলেন, হাসি বন্ধ হয় না। হেমচন্দ্র কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইলেন, কহিলেন, “রহস্য করিতেছ কেন?”

 মনোরম কহিলেন, “ভাই, এই গঙ্গাতীরে গিয়া দাঁড়াও; গঙ্গাকে ডাকিয়া কহ, “গঙ্গে, তুমি পর্ব্বতে ফিরে যাও।”

 হে। “কেন?”

 ম। “স্মৃতি কি আপন ইচ্ছাধীন? একি পাট কাপড়, মনে করিলে তুলিব, মনে করিলে পরিব? রাজপুত্র, কালসর্পকে মনে করিয়া কি সুখ? কিন্তু তথাপি তুমি তাহাকে ভুলিতেছ না কেন?”

 হে। “তাহার দংশনের জ্বালায়।”

 ম। “আর সে যদি দংশন না করিত? তবে কি তাহাকে ভুলিতে?”

 হেমচন্দ্র উত্তর করিলেন না। মনোরমা বলিতে লাগিলেন “তোমার ফুলের মালা কাল সাপ হইয়াছে, তবু তুমি ভুলিতে পারিতেছ না; আমি, আমি ত পাগলিনী—আমি আমার পুষ্পহার কেন ছিঁড়িব?”

 হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এক প্রকার অন্যায় বলিতেছ না। বিস্মৃতি স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া নহে; লোকে আত্মগরিমায় অন্ধ হইয়া পরের প্রতি যে সকল উপদেশ দান করে, তন্মধ্যে “বিস্মৃত হও” এই উপদেশের অপেক্ষা হাস্যাস্পদ আর কিছুই নাই। কেহ কাহাকে বলে না, অর্থচিন্তা ত্যাগ কর; যশের ইচ্ছা ত্যাগ কর; জ্ঞানচিন্তা ত্যাগ কর; ক্ষুধানিবারণেচ্ছা ত্যাগ কর; তৃষ্ণানিবারণেচ্ছা ত্যাগ কর; নিদ্রা ত্যাগ কর; তবে কেন বলিবে, প্রণয় ত্যাগ কর? প্রণয় কি এ সকল অপেক্ষায় সুখকারিতায় ন্যূন? এ সকল অপেক্ষায় প্রণয় নূন নহে— কিন্তু ধর্ম্মের অপেক্ষা ন্যূন বটে। ধর্ম্মের জন্য প্রেমকে সংহার করিবে। স্ত্রীর পরম ধর্ম্ম সতীত্ব। সেই জন্য বলিতেছি, যদি পার, প্রেম সংহার কর।”

 ম। “আমি অবলা; জ্ঞানহীনা; বিবশা; আমি ধর্ম্মাধর্ম কাহাকে বলে তাহা জানি না। আমি এই মাত্র জানি ধর্ম্ম ভিন্ন প্রেম জন্মে না।”

 হে। “সাবধান, মনোরমে! বাসনা হইতে ভ্রান্তি জন্মে; ভ্রান্তি হইতে অধর্ম্ম জন্মে। তোমার ভ্রান্তি পর্য্যন্ত হইয়াছে। তুমি বিবেচনা করিয়া বল দেখি, তুমি যদি ধর্ম্মে একের পত্নী, মনে অন্যের পত্নী হইলে, তবে তুমি দ্বিচারিণী হইলে কি না?”

 গৃহমধ্যে হেমচন্দ্রের অসিচর্ম্ম ঝুলিতেছিল; মনোরমা চর্ম্ম হস্তে লইয়া কহিলেন, “ভাই, হেমচন্দ্র, তোমার এ ঢাল কিসের চামড়া?”

 হেমচন্দ্র হাস্য করিলেন। মনোরমার মুখ প্রতি চাহিয়া দেখিলেন, বালিকা।