মৃণালিনী (১৮৭৪)/প্রথম খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

আচার্য্য।

 ইহার কিছু দিন পরে, একদিন প্রয়াগতীর্থে, গঙ্গা যমুনা সঙ্গমে, অপূর্ব্ব প্রাবৃট্‌দিনান্তশোভা প্রকটিত হইতেছিল। প্রাবৃট্‌কাল, কিন্তু মেঘ নাই, অথবা যে মেঘ আছে, তাহা স্বর্ণময় তরঙ্গমালাবৎ পশ্চিম গগনে বিরাজ করিতেছিল। সূর্য্যদেব অস্তে গমন করিয়াছিলেন। বর্ষার জলসঞ্চারে গঙ্গা যমুনা উভয়েই সম্পূর্ণশরীরা, যৌবনের পরিপূর্ণতায় উন্মাদিনী যেন দুই ভগিনী ক্রীড়াচ্ছলে পরস্পরে আলিঙ্গন করিতেছিল। চঞ্চল বসনাগ্রভাগবৎ তরঙ্গমালা পবনতাড়িত হইয়া কূলে প্রতিঘাত করিতেছিল। বর্ষাকালে সেই গঙ্গা যমুনা সঙ্গমের জলময় শোভা যে না দেখিল তাহার বৃথায় চক্ষুঃ।

 একখানি ক্ষুদ্রতরণীতে দুই জন মাত্র নাবিক। তরণী অসঙ্গত সাহসে সেই দুর্দ্দমনীয় যমুনার স্রোতােবেগে আরােহণ করিয়া, প্রয়াগের ঘাটে আসিয়া লাগিল। একজন নৌকায় রহিল একজন তীরে নামিল। ঘাটের উপরে, সংসারবিরাগী পুণ্যপ্রয়াসীদিগের কতকগুলিন আশ্রম আছে। তন্মধ্যে একটি ক্ষুদ্র কুটীরে আগত ব্যক্তি প্রবেশ করিলেন।

 কুটীর মধ্যে এক ব্রাহ্মণ কুশাসনে উপবেশন করিয়া জপে নিযুক্ত ছিলেন; ব্রাহ্মণ অতি দীর্ঘাকার পুরুষ; শরীর শুষ্ক; আয়ত মুখমণ্ডলে শ্বেতশ্মশ্রু বিরাজিত; ললাট ও বিরলকেশ তালুদেশে অল্পমাত্র বিভূতিশােভা। ব্রাহ্মণের কান্তি গম্ভীর এবং কটাক্ষ কঠিন; দেখিলে তাহাকে নির্দ্দয় বা অভক্তিভাজন বলিয়া বােধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, অথচ শঙ্কা হইত। আগন্তুককে দেখিবামাত্র তাঁহার সে পরুষভাব যেন দূর হইল, মুখের গাম্ভীর্য্য মধ্যে প্রসাদের সঞ্চার হইল। আগন্তুক ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। ব্রাহ্মণ আশীর্ব্বাদ করিয়া কহিলেন,

 “বৎস হেমচন্দ্র, আমি অনেক দিবসাবধি তােমার প্রতীক্ষা করিতেছি।”

 হেমচন্দ্র বিনীতভাবে কহিলেন, “অপরাধ গ্রহণ করিবেন না, দিল্লীতে কার্য্য সিদ্ধ হয় নাই। পরন্তু যবন আমার পশ্চাদ্গামী হইয়াছিল; এই জন্য কিছু সতর্ক হইয়া আসিতে হইয়াছিল। তদ্ধেতু বিলম্ব হইয়াছে।”

 ব্রাহ্মণ কহিলেন, “দিল্লীর সম্বাদ আমি সকল শুনিয়াছি। যােগমায়ার দর্শনে আমার শিষ্য দেবিদাস গমন করিয়াছিলেন। তােমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তােমার স্মরণ থাকিতে পারে। তিনি আমার নিকট সকল পরিচয় দিয়াছেন। এবং ইহাও বলিয়াছেন, যে এক রাত্রি তুমি তাঁহার আশ্রমে লুক্কায়িত ছিলে। এক্ষণে যে যবন রাজার চরেরা তোমার অনুসরণ করিয়াছিল তাহারা কি প্রকারে নিবৃত্ত হইল?”

 হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাহারা যমুনা-জলচরের উদরে পরিপক্ক হইতেছে। ও শ্রীচরণ আশীর্ব্বাদে সকল বিপদ্ হইতে উদ্ধার পাইয়াছি।”

 ব্রাহ্মণ কহিলেন, “অনর্থক বিপদ্‌কে কেনই নিমন্ত্রিত করিয়া আন? কেবল ক্রীড়া কৌতূহলের বশীভূত হইয়া বিপদাগার যবনদুর্গমধ্যে কেন প্রবেশ করিয়াছিলে?”

 হেম। “যবনদুর্গমধ্যে প্রবেশ করিবার উদ্দেশ্য এই, যে তাহা না করিলে যবনদিগের মন্ত্রণা কিছুই অবগত হইতে পরিতাম না। আর অসতর্ক হইয়াও আমি দুর্গমধ্যে প্রবেশ করি নাই। আমার অনুগত ভৃত্য দিগ্বিজয় যবনবেশে দুর্গ নিকটে আমার অশ্ব রক্ষা করিতেছিল। আমার পূর্ব্বপ্রদত্ত আদেশানুসারেই আমার নির্গমনের বিলম্ব দেখিয়া দুর্গমধ্যে অশ্ব লইয়া গিয়াছিল। ঐ উৎসবের দিন ভিন্ন, প্রবেশের এমত সুযোগ হইত না, এজন্য ঐ দিন দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলাম।”

 ব্রাহ্মণ কিঞ্চিৎ পরুষভাবে কহিলেন, “এ সকল ঘটনা ত অনেক দিন হইয়া গিয়াছে, ইহার পূর্ব্বে তোমার এখানে আসার সম্ভাবনা ছিল। তুমি কেন বিলম্ব করিলে? তুমি মথুরায় গিয়াছিলে?”

 হেমচন্দ্র অধোবদন হইলেন। ব্রাহ্মণ কহিলেন “বুঝিলাম তুমি মথুরায় গিয়াছিলে। আমার নিষেধ গ্রাহ্য কর নাই। যাহাকে দেখিতে মথুরায় গিয়াছিলে, তাহার কি সাক্ষাৎ পাইয়াছ?”

 এবার হেমচন্দ্র রুক্ষভাবে কহিলেন “সাক্ষাৎ যে পাইলাম সে আপনারই দয়া। মৃণালিনীকে আপনি কোথায় প্রেরণ করিয়াছেন?”

 মাধবাচার্য্য কহিলেন, “আমি যে কোথায় পাঠাইয়াছি, তাহা তুমি কি প্রকারে সিদ্ধান্ত করিলে?”

 হে। “মাধবাচার্য্য ভিন্ন এ মন্ত্রণা কাহার? আমি মৃণালিনীর ধাত্রীর মুখে শুনিলাম যে মৃণালিনী আমার অঙ্গুরীয় দেথিয়া কোথায় গিয়াছে আর তাহার উদ্দেশ নাই। আমার অঙ্গুরীয় আপনি পাথেয় জন্য ভিক্ষা স্বরূপ লইয়াছিলেন। অঙ্গুরীয়ের পরিবর্ত্তে অন্য রত্ন দিতে চাহিয়াছিলাম কিন্তু আপনি গ্রহণ করেন নাই। তৎকালেই আমি সন্দিহান হইয়াছিলাম, কিন্তু আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নাই এই জন্যই বিনা বিবাদে অঙ্গুরীয় প্রদান করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার সে অসতর্কতার আপনিই সমুচিত প্রতিফল দিয়াছেন।”

 মাধবাচার্য্য কহিলেন, “যদি তাহাই হয়, আমার উপর রাগ করিও না। তুমি দেবকার্য্য না সাধিলে কে সাধিবে? তুমি যবনকে না দূরীকৃত করিলে কে করিবে? যবন নিপাত তোমার এক মাত্র ধ্যান স্বরূপ হওয়া উচিত। এখন মৃণালিনী তোমার হৃদয়ের অর্দ্ধভাগিনী হইবে কেন? এক বার তুমি মৃণালিনীর আশায় মথুরায় বসিয়াছিলে বলিয়া তুমি পিতৃরাজ্যভ্রষ্ট হইয়াছ। যবনাগমনকালে হেমচন্দ্র যদি মথুরায় না থাকিয়া মগধে থাকিত, তবে মগধ জয় কেন হইবে? আবার কি সেই মৃণালিনীপাশে বদ্ধ হইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিবে! মাধবাচার্য্যের জীবন থাকিতে তাহা হইবে না সুতরাং যেখানে থাকিলে মৃণালিনী তোমার দুষ্প্রাপণীয়া হইবে, আমি তাহাকে সেইখানে রাখিয়াছি।”

 হে। “আপনার দেবকার্য্য আপনি উদ্ধার করুন; আমি অবসৃত হইলাম।”

 মা। “তোমার দুর্ব্বুদ্ধি ঘটিতেছে। এই কি তোমার দেবভক্তি? ভাল তাহাই না হউক, দেবতারা আত্মকর্ম্ম সাধন জন্য তোমার ন্যায় মনুষ্যের সাহায্যের অপেক্ষা করেন না। কিন্তু তুমি কাপুরুষ যদি না হও, তবে তুমি কি প্রকারে শত্রুশাসন হইতে অবসৃত হইতে চাও; এই কি তোমার বীরগর্ব্ব? এই কি তোমার শিক্ষা? রাজবংশে জন্মিয়া কি প্রকারে আপন অপহৃত রাজ্যোদ্ধারে বিমুখ হইতে চাহিতেছ?”

 হে। “রাজ্য—শিক্ষা—গর্ব্ব অতল জলে নিমগ্ন হউক।”

 মা। “নরাধম! তোমার জননী কেন তোমাকে দশমাস দশদিন গর্ব্ভে ধারণ করিয়া যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল? কেনই বা দ্বাদশবর্ষ দেবারাধনা ত্যাগ করিয়া এ পাষণ্ডকে সর্ব্ববিদ্যা শিখাইলাম?”

 মাধবাচার্য্য অনেক ক্ষণ নীরবে করলগ্নকপোল হইয়া রহিলেন। ক্রমে হেম চন্দ্রের অনিন্দ্য গৌর মুখকান্তি মধ্যাহ্ন-মরীচি-বিশোষিত স্থলপদ্মবৎ আরক্ত বর্ণ হইয়া আসিতেছিল; কিন্তু গর্ভাগ্নি গিরি-শিখর তুল্য, তিনি স্থির ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরিশেষে মাধবাচার্য্য কহিলেন “হেমচন্দ্র, ধৈর্য্যাবলম্বন কর। মৃণালিনী কোথায় তাহা বলিব—মৃণালিনীর সহিত তোমার বিবাহ দেওয়াইব। কিন্তু এক্ষণে আমার পরামর্শানুবর্ত্তী হও, অগ্রে স্বকার্য্য সাধন কর।”

 হেমচন্দ্র কহিলেন, “মৃণালিনী কোথায় না বলিলে আমি। যবন বধ জন্য লৌহমাত্র স্পর্শ করিব না।”

 মাধবাচার্য কহিলেন, “আর যদি মৃণালিনী মরিয়া থাকে?”

 হেমচন্দের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি কহিলেন “তবে সে আপনারই কাজ।” মাধবাচার্য্য কহিলেন, “আমি স্বীকার করিতেছি আমিই দেবকার্য্যের কণ্টককে, বিনষ্ট করিয়াছি।”

 হেমচন্দ্রের মুখকান্তি বর্ষণোন্মুখ মেঘবৎ বর্ণ প্রাপ্ত হইল।

ত্রস্ত হস্তে ধনুকে শর সংযোজন করিয়া কহিলেন “যে মৃণালিনীর বধকর্ত্তা সে আমার বধ্য। এই শরে গুরুহত্যা ব্রহ্মহত্যা উভয় দুষ্ক্রিয়া সাধন করিব।”

 মাধবাচার্য্য হাস্য করিলেন। কহিলেন, “গুরুহত্যা ব্রহ্মহত্যায় তোমার যত আমোদ, স্ত্রী হত্যায় আমার তত নহে। এক্ষণে তোমাকে পাতকের ভাগী হইতে হইবে না। মৃণালিনী জীবিতা আছে। পার তাহার সন্ধান করিয়া সাক্ষাৎ কর। এক্ষণে আমার আশ্রম হইতে স্থানান্তরে যাও। আশ্রম কলুষিত করিও না; অপাত্রে আমি কোন ভার ন্যস্ত করি না।” এই বলিয়া মাধবাচার্য্য পূর্ব্ববৎ জপে নিযুক্ত হইলেন।

 হেমচন্দ্র আশ্রম হইতে নির্গত হইলেন। ঘাটে আসিয়া ক্ষুদ্র তরণী আরোহণ করিলেন। যে দ্বিতীয় ব্যক্তি নৌকায় ছিল, তাহাকে বলিলেন, “দিগ্বিজয়! নৌকা ছাড়িয়া দাও।”

 দিগ্বিজয় বলিল, “কোথায় যাইব?” হেমচন্দ্র বলিলেন, “যেখানে ইচ্ছা—যমালয়।”

 দিগ্বিজয় প্রভুর স্বভাব বুঝিত। অস্ফুটস্বরে কহিল, “সেটা অল্প পথ।” এই বলিয়া সে তরণী ছাড়িয়া দিয়া স্রোতের প্রতিকূলে বাহিতে লাগিল।

 হেমচন্দ্র অনেক ক্ষণ নীরবে থাকিয়া শেষে কহিলেন, “দূর হউক! ফিরিয়া চল।”

 দিগ্বিজয় নৌকা ফিরাইয়া পুনরপি প্রয়াগের ঘাটে উপনীত হইল। হেমচন্দ্র লম্ফ দিয়া তীরে অবতরণ করিয়া পুনর্ব্বার মাধবাচার্য্যের আশ্রমে গেলেন।

 তাঁহাকে দেখিয়া মাধবাচার্য্য কহিলেন। পুনর্ব্বার কেন আসিয়াছ?”

 হেমচন্দ্র কহিলেন, “আপনি যাহা বলিবেন তাহাই স্বীকার করিব। মৃণালিনী কোথায় আছে আজ্ঞা করুন।”

 মা। “তুমি সত্যবাদী—আমার আজ্ঞাপালন করিতে স্বীকার করিলে। ইহাতেই আমি সন্তুষ্ট হইলাম। গৌড়নগরে এক শিষ্যের বাটীতে মৃণালিনীকে রাখিয়াছি। তোমাকেও সেই প্রদেশে যাইতে হইবে, কিন্তু তুমি তাহার সাক্ষাৎ পাইবে না। শিষ্যের প্রতি আমার বিশেষ আজ্ঞা আছে যে যতদিন মৃণালিনী তাঁহার গৃহে থাকিবে ততদিন সে পুরুষান্তরের সাক্ষাৎ না পায়।”

 হে। “সাক্ষাৎ না পাই যাহা বলিলেন ইহাতেই আমি চরিতার্থ হইলাম। এক্ষণে কি কার্য্য করিতে হইবে অনুমতি করুন।”

 মা। “তুমি দিল্লী গিয়া যবনের মন্ত্রণা কি জানিয়া আসিআছ?”

 হে। “যবনেরা বঙ্গ বিজয়ের উদ্যোগ করিতেছে। অতি ত্বরায় বখ্‌তিয়ার খিলিজি সেনা লইয়া তদ্দেশাভিমুখে যাত্রা করিবে।”

 মাধবাচার্য্যের মুখ হর্ষপ্রফুল্ল হইল। তিনি কহিলেন, “এত দিনে বিধাতা বুঝি এ দেশের প্রতি সদয় হইলেন।”

 হেমচন্দ্র একতানমনে মাধবাচার্য্যের প্রতি চাহিয়া তাঁহার কথার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। মাধবাচার্য্য বলিতে লাগিলেন,

 “কয় মাস পর্য্যন্ত আমি কেবল গণনায় নিযুক্ত আছি। গণনার যাহা ভবিষ্যৎ বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে তাহা ফলিবার উপক্রম হইতেছে।”

 হেম। “কি প্রকার?”  মা। “গণিয়া দেখিলাম যে যবন সাম্রাজ্য ধ্বংস বঙ্গরাজ্য হইতে আরম্ভ হইবে।”

 হে। “তাহা হইতে পারে। কিন্তু কত কালেই বা তাহা হইবে? আর কাহা কর্ত্তৃক?”

 মা। “তাহাও গণিয়া স্থির করিয়াছি। যখন পশ্চিম দেশীয় বণিক বঙ্গরাজ্যে অস্ত্র ধারণ করিবে তখন যবনরাজ্য উৎসন্ন হইবেক।”

 হে। “তবে আমার জয়লাভের কোথা সম্ভাবনা? আমি ত বণিক্ নহি।”

 মা। “তুমিই বণিক্। মথুরায় যখন তুমি মৃণালিনীর প্রয়াসে দীর্ঘকাল বাস করিয়াছিলে তখন তুমি কি ছলনা করিয়া তথায় বাস করিতে”

 হে। “আমি তখন বণিক্ বলিয়া মথুরায় পরিচিত ছিলাম বটে।”

 মা। “সুতরাং তুমিই পশ্চিমদেশীয় বণিক্। বঙ্গরাজ্যে গিয়া তুমি অস্ত্র ধারণ করিলেই যবন নিপাত হইবে। তুমি আমার নিকট প্রতিশ্রুত হও, যে কল্য প্রাতেই বঙ্গে যাত্রা করিবে। যে পর্য্যন্ত তথায় না যবনের সহিত যুদ্ধ কর, সে পর্য্যন্ত মৃণালিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিবে না।”

 হেমচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “তাহাই স্বীকার করিলাম। কিন্তু একা যুদ্ধ করিয়া কি করিব?”

 মা। “বঙ্গেশ্বরের সেনা আছে।”

 হে। “থাকিতে পারে—সে বিষয়েও কতক সন্দেহ; কিন্তু যদি থাকে তবে তাহারা আমার অধীন হইবে কেন?”

 মা। “তুমি অগ্রগামী হও। নবদ্বীপে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। সেই খানে গিয়া ইহার বিহিত উদ্যোগ করা যাইবে। বঙ্গেশ্বরের নিকট আমি পরিচিত আছি।”

 “যে আজ্ঞা” বলিয়া হেমচন্দ্র প্রণাম করিয়া বিদায় হইলেন। যতক্ষণ তাঁহার বীরমূর্ত্তি নয়নগোচর হইতে লাগিল, আচার্য্য ততক্ষণ তৎপ্রতি অনিমিক লোচনে চাহিয়া রহিলেন। আর যখন হেমচন্দ্র অদৃশ্য হইলেন, তখন মাধবাচার্য্য মনে মনে বলিতে লাগিলেন,

 “যাও, বৎস! প্রতিপদে বিজয় লাভ কর! যদি ব্রাহ্মণবংশে আমার জন্ম হয়, তবে তোমার পদে কুশাঙ্কুরও বিধিবে না। মৃণালিনী! মৃণালিনী বিহগীরে আমি তোমারই জন্যে পিঞ্জরে বদ্ধ করিয়া রাখিয়াছি। কিন্তু কি জানি পাছে তুমি তাহার কলধ্বনিতে বিমোহিত হইয়া পরমকার্য্য বিস্মৃত হও, তোমার পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ব্রাহ্মণ তোমাকে কিছু দিনের জন্য মনঃপীড়া দিতেছে।”