মেগাস্থেনীসের ভারত-বিবরণ (১৯৪৪)/৫০তম অংশ
আরিয়ান
ভারতবর্ষের অধিবাসিগণ
মেগাস্থেনীস বলেন যে, ভারতীয় জাতিসমূহের সংখ্যা এক শত আঠার। [ভারতীয় জাতিসমূহের সংখ্যা বহু, এই পর্যন্ত আমি মেগাস্থেনীসের সহিত একমত; কিন্তু আমি নিশ্চিত রূপে বুঝিতে পারিতেছি না যে তিনি কিপ্রকারে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জানিয়া এই সংখ্যা লিপিবদ্ধ করিলেন, কারণ তিনি ভারতবর্ষের অধিকাংশই দর্শন করেন নাই এবং সমুদায় জাতির মধ্যেও আদানপ্রদান ও গতায়াত নাই।]
ডায়োনীসস
(মেগাস্থেনীস বলেন যে) ভারতবাসিগণ প্রাচীনকালে শকদিগের ন্যায় যাযাবর ছিল। এই শকগণ ভূমি কর্ষণ করিত না। তাহারা ঋতু অনুসারে শকটে শকভূমির এক প্রদেশ হইতে অন্য প্রদেশে পরিভ্রমণ করিত। তাহারা নগরে বাস করিত না কিম্বা মন্দিরে দেবতাদিগের আরাধনা করিত না। এইরূপ, ভারতবাসীদিগেরও নগর কিংবা দেবমন্দির ছিলনা। তাহারা যে বন্য পশু হত্যা করিত তাহারই চর্ম পরিধান করিত এবং বৃক্ষবল্কল আহার করিয়া প্রাণধারণ করিত। ভারতীয় ভাষায় এই বৃক্ষের নাম তাল। খজুর বৃক্ষের মস্তকে যেমন ফল জন্মে তেমনি এই বৃক্ষের মস্তকে পশমের গোলকের মত ফল জন্মে। তাহারা যে বন্য পশু ধরিতে পারিত তাহা আহার করিয়াও প্রাণ ধারণ করিত, তাহারা আমমাংস ভোজন করিত—অন্তত ডায়োনীসসের ভারতবর্ষে গমনের পূর্ব্বে এইরূপ প্রথা ছিল। কিন্তু ডায়োনীসস ভারতবর্ষে যাইয়া তদ্দেশবাসিগণের অধীশ্বর হন, অনেক নগর প্রতিষ্ঠা করেন ও উহাদিগের জন্য বিধি প্রণয়ন করেন, যেমন গ্রীসে তেমনি ভারতবাসীদিগের মধ্যে মদ্যের ব্যবহার প্রচলন করেন এবং তাহাদিগকে ভূমিতে বীজ বপন করিতে শিক্ষা দেন ও তদর্থে স্বয়ং বীজ প্রদান করেন। ইহার কারণ এই যে জ্যা-মাতা (Demeter) যথন ট্রীপ্টলেমসকে পৃথিবীর সর্বত্র বীজ বপন করিতে প্রেরণ করেন তখন তিনি এদেশে আগমন করেন নাই; অথবা অপর কোনও ডায়োনীসস ট্রীপ্টলেমসের পূর্বে ভারতবর্ষে আগমন করিয়া ভারতবাসীদিগকে কর্যিত ফলশঙ্গের বীজ প্রদান করেন। ডায়োনীসসই সর্বপ্রথম হলে বৃষ যোজনা করেন, এবং বহু ভারতবাসীকে যাযাবরের পরিবর্তে কৃষকে পরিণত করেন ও তাহাদিগকে যুদ্ধোপযোগী অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করেন। তাহারা করতাল দুন্দুভিধ্বনি সহকারে দেবতাগণের বিশেষতঃ ডায়োনীসসের পূজা করে, কারণ তিনি তাহাদিগকে এইরূপ শিক্ষা দিয়াছেন। তিনি তাহাদিগকে সাটীরিক (Satyric) নৃত্য শিক্ষা দেন; গ্রীকগণের মধ্যে উহা কর্ডাক্স নামে অভিহিত। তিনিই ভারতবাসীদিগকে দেবোদ্দেশ্যে কেশ ধারণ করিতে, পাগড়ি পরিতে ও গন্ধদ্রব্যে দেহ অনুলিপ্ত করিতে শিক্ষা দেন। এইজন্য সেকেন্দর সাহার সময়েও ভারতবর্ষীয়েরা দুন্দুভি ও করতালধ্বনির সহিত যুদ্ধার্থ সজ্জিত হইত।
কিন্তু ভারতবর্ষে নূতন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করিয়া প্রত্যাগমন করিবার সময়ে তিনি তাঁহার সঙ্গী ও বক্কসের পূজাভিজ্ঞ স্পার্টেম্বাস নামক এক ব্যক্তিকে এই দেশের রাজত্বে বরণ করেন। স্পার্টেম্বাসের মৃত্যুর পর তৎপুত্র বৌদ্ধ (Boudyas) রাজ্যলাভ করেন। পিতা ভারতবাসীদিগের উপর ৫২ বৎসর ও পুত্র ২০ বৎসর প্রভুত্ব করেন। শেষোক্ত রাজার পুত্র ক্রদ্যুস (Kradeuas) তৎপর সিংহাসনে আরোহণ করেন, অতঃপর ইঁহার বংশধরগণ সাধারণত উত্তরাধিকার-সূত্রে রাজ্যলাভ করেন ও পিতার পর পুত্র রাজত্ব করেন; কিন্তু এই বংশে উত্তরাধিকারীর অভাব হইলে ভারতবর্ষীয়েরা গুণানুসারে রাজা নির্বাচন করে।
হার্ক্যুলিস
কিন্তু শুনা যায় যে হীরাক্লীস প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষেই জন্মগ্রহণ করেন, যদিও প্রচলিত জনশ্রুতি এই যে তিনি ভিন্ন দেশ হইতে এদেশে আগমন করেন। এই হীরাক্লীসকে সৌরসেনীরা (Sourasenoi) বিশেষভাবে পূজা করে; ইহারা একটি ভারতীয় জাতি; মথুরা (Methora) ও কৃষ্ণপুর (Kleisobora) নামক ইহাদিগের দুইটি নগর আছে; যমুনা (Jobares) নামক নৌচলনোপযোগী নদী ইহাদিগের দেশ দিয়া প্রবাহিত হইতেছে। কিন্তু মেগাস্থেনীস বলেন যে এই হারাক্লীস থীব্স—দেশীয় হীরাক্লীসের মত বস্ত্র পরিধান করেন, ভারতবাসীরাও তাহা স্বীকার করে। ভারতবর্ষে ইঁহার বহুসংখ্যক পুত্র জন্মগ্রহণ করে (কারণ থীব্সের হীরাক্লীসের ন্যায় ইনিও অনেক রমণীর পাণিপীড়ন করেন), কিন্তু কন্যা মাত্র একটি হয়। এই কন্যার নাম পাণ্ড্যা (Pandaia)। যে দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ও হীরাক্লীস তাঁহাকে যাহার রাজত্ব প্রদান করেন তাঁহার নামানুসারে তাহা পাণ্ড্য (Pandaia) নামে অভিহিত হয়। তিনি পিতার নিকট হইতে পাঁচ শত হস্তী, চারি সহস্র অশ্বারোহী ও এক লক্ষ ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য প্রাপ্ত হন। কোন কোনও ভারতীয় লেখক হীরাক্লীস সম্বন্ধে এইরূপ বলিয়া থাকেন— যখন হীরাক্লীস পৃথিবীকে হিংস্রজন্তুশূন্য করিবার উদ্দেশ্যে জলে স্থলে সর্বত্র পরিভ্রমণ করিতেছিলেন তখন তিনি সমুদ্রে নারীজাতির একটি ভূষণ প্রাপ্ত হন। [অদ্যাপি যে সকল ভারতীয় বণিক্ আমাদিগের নিকট পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে তাহারা আগ্রহাতিশয় সহকারে উহা ক্রয় করিয়া বিদেশে লইয়া যায়। প্রাচীন কালে ধনী ও বিলাসী গ্রীকগণের ন্যায় বর্তমান সময়ে ধনী ও বিলাসী রোমকগণ ইহা অধিকতর আগ্রহের সহিত ক্রয় করে।] ভারতীয় ভাষায় ইহার নাম সামুদ্রিক মুক্তা (margarita)। অলংকার রূপে পরিধান করিলে ইহা কেমন সুন্দর দেখায় তাহা অনুভব করিয়া হীরাক্লীস কন্যার দেহ সজ্জিত করিবার উদ্দেশ্যে সমুদায় সমুদ্র হইতে এই মুক্তা আহরণ করেন।
মুক্তা
মেগাস্থেনীস বলেন যে, যে-সকল শুক্তিকায় এই মুক্তা পাওয়া যায় তাহা এদেশে জাল দ্বারা ধরা হয় এবং সেগুলি মৌমাছির ন্যায় দলবদ্ধ হইয়া বাস করে। মৌমাছির দলের ন্যায় ইহাদিগেরও রাজা বা রাণী আছে। যদি কেহ সৌভাগ্যবশত রাজাকে ধরিতে পারে তবে সহজেই সমুদায় শুক্তিকার ঝাঁক জালে আবদ্ধ করিতে সমর্থ হয়। কিন্তু রাজা পলায়ন করিলে অপর সকলকে ধরিবার কোনও সম্ভাবনা নাই। শুক্তিকাগুলি ধৃত হইলে যতক্ষণ তাহাদিগের মাংস পচিয়া পড়িয়া না যায় ততক্ষণ সেগুলি রাথিয়া দেওয়া হয়; পরে উহাদিগের অস্থি অলংকার রূপে ব্যবহৃত হয়। ভারতবর্ষে মুক্তার মূল্য সমান ওজনের বিশুদ্ধ স্বর্ণের তিন গুণ। এদেশে খনি হইতে স্বর্ণ উত্তোলিত হয়।
পাণ্ড্যদেশ
শুনা যায়, হীরাক্লীসের কন্যা যে প্রদেশে রাজত্ব করিতেন তথায় রমণীগণ সাত বৎসর বয়সে বিবাহযোগ্য হয় এবং পুরুষেরা অত্যন্ত অধিক হইলে চল্লিশ বৎসর জীবিত থাকে। এ বিষয়ে ভারতবাসীদিগের মধ্যে নিম্নলিখিত প্রবাদ প্রচলিত আছে। হীরাক্লীস শেষ বয়সে একটি কন্যা লাভ করেন; যখন তিনি দেখিলেন তাঁহার অস্তিম কাল নিকটবর্তী, অথচ মানমর্যাদায় আপনার সমকক্ষ এমন কেহ নাই যাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিতে পারেন তখন যাহাতে উভয়ের বংশধর ভারতবর্ষে রাজত্ব করিতে পারে তদুদ্দেশ্যে তিনি সপ্তবর্ষবয়স্কা কন্যায় অভিগমন করেন, এইজন্য তিনি কন্যাকে বিবাহযোগ্যা করেন এবং এইজন্যই যে জাতির উপর পাণ্ড্যা রাজত্ব করেন তাহারা সকলেই হীরাক্লীসের নিকট হইতে এই অধিকার প্রাপ্ত হয়। [এখন আমার মনে হয়, হীরাক্লীস যদি এমন একটা অত্যাশ্চর্য কর্ম সম্পাদন করিতে পারিয়াছিলেন তবে তিনি যথাকালে কন্যায় অভিগমন করিবার উদ্দেশ্যে আপনাকে আরও দীর্ঘজীবী করিতেও পারিতেন। কিন্তু বাস্তবিক রমণীদিগের বিবাহযোগ্য বয়স সম্বন্ধে যাহা উক্ত হইয়াছে তাহা যদি সত্য হয় তবে আমার বোধ হয় পুরুষদিগের বয়স সম্বন্ধে যে কথিত হইয়াছে—যাহারা অত্যধিক দীর্ঘজীবী তাহারাও চল্লিশ বৎসর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়—তাহাও সর্বথা সঙ্গত। কারণ যাহারা এত শীঘ্র বার্ধক্যে উপনীত হয়, এবং বার্ধক্যে উপনীত হইয়াই মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহারা নিশ্চয়ই শীঘ্র শীঘ্র যৌবনে পদার্পণ করিবে ইহাই যুক্তিযুক্ত। সুতরাং এদেশে পুরুষগণের মধ্যে ত্রিশ বৎসর বয়সেই বার্ধক্যের প্রথম চিহ্ন দৃষ্ট হইবে, যুবকেরা কুড়ি বৎসর বয়সেই যৌবন অতিক্রম করিবে এবং প্রায় পঞ্চদশ বর্ষ বয়সেই তাহারা পূর্ণযৌবন লাভ করিবে। এই নিয়মাণ্ডুসারেই নারীজাতি সাত বৎসর বয়সে বিবাহযোগ্যা হইবে।] কেননা, মেগাস্থেনীস স্বয়ংই লিখিয়াছেন যে এ দেশে ফলশস্যও অপরাপর দেশ অপেক্ষা শীঘ্র শীঘ্র পরিপক্ক ও বিনষ্ট হয়।
ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস
ভারতবর্ষীয়গণের গণনানুসারে ডায়োনীসস হইতে চন্দ্রগুপ্ত পর্যন্ত ৬০৪২ বৎসরে ১৫৩ জন নৃপতি রাজত্ব করেন; কিন্তু এই কালের মধ্যে তিন বার সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। *** আর একটি ৩০০ বৎসর এবং আর একটি ১২০ বৎসর। ভারতবর্ষীয়েরা বলে যে ডায়োনীসস হীরাক্লীসের পনর পুরুষ পূর্বে বর্তমান ছিলেন এবং এক তিনি ভিন্ন আর কেহই ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন নাই; এমন কি কাম্বুসীদের পুত্র কাইরাসও নহে; যদিও তিনি শকগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন এবং সমস্ত এসিয়ার নৃপতিগণের মধ্যে শৌর্যবীর্যে সর্বাপেক্ষা অধিক খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। অবশ্য সেকেন্দর সাহা এদেশে আগমন করেন এবং যে কেহ তাঁহার সম্মুখবর্তী হয় তাহাকেই যুদ্ধে পরাভূত করেন; আর সৈন্যগণ অবাধ্য না হইলে তিনি সমুদায় পৃথিবী জয় করিতে পারিতেন। পক্ষান্তরে, [ভারতবাসিগণ বলিয়া থাকে] ন্যায়বোধ প্রবল বলিয়া ভারতবর্ষের কোনও ভূপতিই অপর দেশ জয় করিবার অভিপ্রায়ে যুদ্ধযাত্রা করেন নাই।