মেজদিদি/আঁধারে আলো/ছয়
॥ছয়॥
চার বৎসর পরের কথা বলিতেছি। কলিকাতার একটা বড় বাড়িতে জমিদারের ছেলের অন্নপ্রাশন। খাওয়ানো-দাওয়ানোর বিরাট ব্যাপার শেষ হইয়া গিয়াছে। সন্ধ্যার পর বহির্বাটীর প্রশস্ত প্রাঙ্গণে আসর করিয়া আমোদ-আহ্লাদ, নাচ-গানের উদ্যোগ-আয়োজন চলিতেছে।
একধারে তিন-চারটি নর্তকী-ইহারাই নাচ-গান করিবে। দ্বিতলে বারান্দায় চিকের আড়ালে বসিয়া রাধারাণী একাকী নীচের জনশাগ দেখিতেছিল। নিমন্ত্রয়িতা মহিলারা এখনও শুভাগমন করেন নাই।
নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া সত্যেন্দ্র কহিলেন, এত মন দিয়ে কি দেখচ বল ত?
রাধারাণী স্বামীর দিকে ফিরিয়া চাহিয়া হাসিমুখে বলিল,যা সবাই দেখতে আসচে-বাইজীদের সাজ-সজ্জা-কিন্তু হঠাৎ তুমি যে এখানে?
স্বামী হাসিয়া জবাব দিলেন, একলাটি বসে আছ, তাই একটু গল্প করতে এলুম।
ইস্।
সত্যি। আচ্ছা, দেখচ ত, বল দেখি, ওদের মধ্যে সবচেয়ে কোন্টিকে তোমার পছন্দ হয়?
ঐটিকে, বলিয়া রাধারাণী আঙুল তুলিয়া যে স্ত্রীলোকটি সকলের পিছনে নিতান্ত সাদাসিধা পোশাকে বসিয়াছিল তাহাকেই দেখাইয়া लि।
স্বামী বলিলেন, ও যে নেহাত রোগা।
তা হোক, ঐ সবচেয়ে সুন্দরী। কিন্তু বেচারী গরীব-গায়ে গয়না-টয়না। এদের মত নেই!
সত্যেন্দ্র ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, তা হবে। কিন্তু, এদের মজুরী কত জান?
না।
সত্যেন্দ্র হাত দিয়া দেখাইয়া বলিলেন, এদের দু’জনের ত্রিশ টাকা করে, ঐ ওর পঞ্চাশ, আর যেটিকে গরীব বলচ, তার দু’শ টাকা।
বাধারাণী চমকিয়া উঠিল-দু’শ! কেন, ও কি খুব ভাল গান করে?
কানে শুনিনি কখনো। লোকে বলে, চার-পাঁচ বছর আগে খুব ভালই গাইত,—কিন্তু এখন পারবে কিনা বলা যায় না।
তবে অত টাকা দিয়ে আনলে কেন?
তার কমও আসে না। এতেও আসতে রাজী ছিল না, অনেক সাধাসাধি করে আনা হয়েচে।
রাধারাণী অধিকতর বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, টাকা দিয়ে সাধাসাধি কেন?
সত্যেন্দ্র নিকটে একটা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিয়া বলিলেন, তার প্রথম কারণ, ও ব্যবসা ছেড়ে দিয়েচে। গুণ ওর যতই হোক, এত টাকা সহজে কেহই দিতেও চায় না, ওকেও আসতে হয় না, এই ওব ফন্দি! দ্বিতীয় কারণ, আমার নিজের গরজ।
কথাটা রাধারাণী বিশ্বাস করিল না। তথাপি আগ্রহে ঘেঁষিয়া বসিয়া বলিল, তোমার গরজ ছাই। কিন্তু, ব্যবসা ছেড়ে দিলে কেন?
শুনবে? হ্যাঁ বল।
সত্যেন্দ্র একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া বলিল, ওর নাম বিজ্লী। এক সময়ে-কিন্তু, এখানে লোক এসে পড়বে যে রাণী, ঘরে যাবে?
যাব, চল, বলিয়া রাধারাণী উঠিয়া দাঁড়াইল।
স্বামীর পায়ের কাছে বসিয়া সমস্ত শুনিয়া রাধারাণী আঁচলে চোখ মুছিল। শেষে বলিল, তাই আজ ওকে অপমান করে শোধ নেবে? এ বুদ্ধি কে তোমাকে দিলে?
এদিকে সত্যেন্দ্রর নিজের চোখেও শুষ্ক ছিল না, অনেকবার গলাটাও ধরিয়া আসিতেছিল। তিনি বলিলেন, অপমান বটে, কিন্তু সে অপমান আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না। কেউ জানবেও না।
রাধারাণী জবাব দিল না। আর একবার আঁচলে চোখ মুছিয়া বাহির হইয়া গেল।
নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকে আসার ভরিয়া গিয়াছে এবং উপরের বারান্দায় বহু স্ত্রীকণ্ঠের। সলজ্জ চীৎকার চিকের আবরণ ভেদ করিয়া আসিতেছে। অন্যান্য নর্তকীরা প্রস্তুত হইয়াছে, শুধু বিজ্লী তখনও মাথা হেঁট করিয়া বসিয়া আছে। তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল। দীর্ঘ পাঁচ বৎসরে তাহাব সঞ্চিত অর্থ প্রায় নিঃশেষ হইয়াছিল, তাই অভাবের তাড়নায় বাধ্য হইয়া আবার সেই কাজ অঙ্গীকার করিয়া আসিয়াছে, যাহা সে শপথ করিয়া ত্যাগ করিয়াছিল। কিন্তু সে মুখ তুলিয়া খাড়া হইতে পারিতেছিল না। অপরিচিত পুরুষের সতৃষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখে দেহ যে এমন পাথরের মত ভারী হইয়া উঠিবে। -পা এমন করিয়া দুমড়াইয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিবে, তাহা সে ঘণ্টা-দুই পূর্বে কল্পনা করিতেও পারে নাই।
“আপনাকে ডাকছেন।” বিজ্লী মুখ তুলিয়া দেখিল, পাশে দাড়াইয়া একটি বার-তের বছরের ছেলে। সে উপরের বারান্দা নির্দেশ করিয়া পুনরায় কহিল, মা আপনাকে ডাকচেন।
বিজ্লী বিশ্বাস করিতে পারিল না। জিজ্ঞাসা করিল, কে ডাকচেন?
মা ডাকছেন।
তুমি কে?
আমি বাড়ির চাকর।
বিজ্লী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আমাকে নয়, তুমি আবার জিজ্ঞাসা করে এসো।
বালক খানিক পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, আপনার নাম বিজ্লী ত? আপনাকেই ডাকচেন,—আসুন আমার সঙ্গে, মা দাঁড়িয়ে আছেন।
চল, বলিয়া বিজ্লী তাড়াতাড়ি পায়ের ঘুঙুর খুলিয়া ফেলিয়া তাহাকে অনুসরণ করিয়া অন্দরে আসিয়া প্রবেশ করিল। মনে করিল, গৃহিণীর বিশেষ কিছু ফরমায়েস আছে, তাই আহবান।
শোবার ঘরের দরজার কাছে রাধারাণী ছেলে কোলে করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। ত্রস্ত কুষ্ঠিত-পদে বিজ্লী সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইবামাত্র সে সম্রামে হাত ধরিয়া ভিতরে টানিয়া আনিল; একটা চৌকির উপর জোর করিয়া বসাইয়া হাসিমুখে কহিল, দিদি, চিনতে পার?
বিজ্লী বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। রাধারাণী কোলের ছেলেকে দেখাইয়া বলিল, ছোট বোনকে না হয় না চিনলে দিদি, সে দুঃখ করি নে; কিন্তু এটাকে না চিনতে পারলে সত্যিই ভারী ঝগড়া করব। বলিয়া মুখ টিপিয়া মৃদু হাসিতে লাগিল।
এমন হাসি দেখিয়াও বিজ্লী তথাপি কথা কহিতে পারিল না। কিন্তু তাহার আঁধার আকাশ ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হইয়া আসিতে লাগিল। সেই অনিন্দ্যসুন্দর মাতৃমুখ হইতে সদ্যবিকশিত গোলাপ-সদৃশ শিশুর মুখের প্রতি তাহার দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়া রহিল। রাধারাণী নিস্তব্ধ। বিজ্লী নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া চাহিয়া অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া দুই হাত প্রসারিত করিয়া শিশুকে কোলে টানিয়া লইয়া সজোরে বুকে চাপিয়া ধরিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
রাধারাণী কহিল, চিনেচ দিদি? চিনেছি বোন।
রাধারাণী কহিল, দিদি, সমুদ্র-মন্থন করে বিষটুকু তার নিজে খেয়ে সমস্ত অমৃতটুকু এই ছোট বোনটিকে দিয়েচ। তোমাকে ভালবেসেছিলেন বলেই আমি তাঁকে পেয়েচি।
সত্যেন্দ্রর একখানি ক্ষুদ্র ফটোগ্রাফ হাতে তুলিয়া বিজ্লী একদৃষ্টি দেখিতেছিল; মুখ তুলিয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, বিষের বিষই যে অমৃত বোন। আমি বঞ্চিত হইনি ভাই। সেই বিষই এই ঘোর পাপিষ্ঠাকে অমর করেচে।
রাধারণী সে-কথার উত্তর না দিয়া কহিল, দেখা করবে দিদি?
বিজ্লী একমুহূর্ত চোখ বুজিয়া স্থির থাকিয়া বলিল, না দিদি। চার বছর আগে যেদিন তিনি এই অস্পৃশ্যটাকে চিনতে পেরে, বিষম ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন, সেদিন দর্প করে বলেছিলুম, আবার দেখা হবে, আবার তুমি আসবে। কিন্তু, সেই দর্প আমার রইল না, আর তিনি এলেন না। কিন্তু, আজ দেখতে পাচ্ছি, কেন দর্পহারী আমার সে দর্প ভেঙ্গে দিলেন। তিনি ভেঙ্গে দিয়ে যে কি করে গড়ে দেন, কেড়ে নিয়ে যে কি করে ফিরিয়ে দেন, সে-কথা আমার চেয়ে আর কেউ বেশী জানে না বোন। বলিয়া সে আর একবার ভাল করিয়া আঁচলে চোখ মুছিয়া কহিল, প্রাণের ভগবানকে নির্দ্দয় নিষ্ঠুর বলে অনেক দোষ দিয়েচি, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি, এই পাপিষ্ঠীকে তিনি কি দয়া করেচেন। তাঁকে ফিরিয়ে এনে দিলে, আমি ষে সব-দিকে মাটি হয়ে যেতুম? তাঁকেও পেতুম না, নিজেকেও হারিয়ে ফেলতুম।
কান্নায় রাধারাণীর গলা রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল, সে কিছুই বলিতে পারিল না! বিজ্লী পুনরায় কহিল, ভেবেছিলুম, কখনো দেখা হলে তাঁর পায়ে ধরে আর একটিবার মাপ। চেয়ে দেখব। কিন্তু আর তার দরকার নেই। এই ছবিটুকু দাও দিদি - এর বেশী আমি চাই নে। চাইলেও ভগবান তা সহ্য করবেন না-আমি চললুম, বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাধারাণী গাঢ়ম্বরে জিজ্ঞাসা করিল, আবার কবে দেখা হবে দিদি?
দেখা আর হবে না বোন। আর একটা ছোট বাড়ি আছে, সেইটে বিক্রী করে যত শ্রীব্র পারি চলে যাব। ভাল কথা, বলতে পাৱ ভাই, কেন হঠাৎ তিনি এতদিন পরে আমাকে স্মরণ করেছিলেন? যখন তাঁর লোক আমাকে ডাকতে যায়, তখন কেন একটা মিথ্যে নাম বলেছিল?
লজ্জায় রাধারাণীর মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, সে নতমুখে চুপ করিয়া রহিল।
বিজ্লী ক্ষণকাল ভাবিয়া বলিল হয়ত বুঝেছি। আমাকে অপমান করবেন বলে, না? তা ছাড়া ত এত চেষ্টা করে আমাকে আনবার কোন কারণই দেখি নে।
রাধারাণীর মাথা আরও হেঁট হইয়া গেল। বিজ্লী হাসিয়া বলিল, তোমার লজ্জা কি বোন? তবে তাঁরও ভুল হয়েচে। তাঁর পায়ে আমার শত-কোটী প্রণাম জানিয়ে বোলো, সে হবার নয়। আমার নিজের বলে আর কিছুই নেই। অপমান করলে, সমস্ত অপমান তাঁর গায়েই লাগবে।
নমস্কার দিদি!
নমস্কার বোন! বয়সে ঢ়ের বড় হলেও তোমাকে আশীর্ব্বাদ করবার অধিকার ত আর নেই- আই কায়মনে প্রার্থনা করি বোন, তোমার হাতের নোয়া অক্ষয় হোক। চললুম।
সমাপ্ত