॥পাঁচ॥

পরদিন সকালে কেষ্ট হঠাৎ গুটিগুটি ঘরে ঢুকিয়া হেমাঙ্গিনীর পায়ের কাছে বিছানার একপাশে আসিয়া বসিল। হেমাঙ্গিনী পা দুইটি একটু গুটািইয়া লইয়া সস্নেহে বলিলেন, দোকানে যাস্‌নি কেষ্ট?

 এইবার যাব।

 দেরি করিস নে দাদা, এইবেলা যা, নইলে এক্ষুনি আবার গালাগালি করবে। কেষ্টর মুখ একবার আরক্ত, একবার পাণ্ডুর হইল। যাই, বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। একবার ইতস্ততঃ করিয়া কি একটা বলিতে গিয়া আবার চুপ করিল।

 হেমাঙ্গিনী তাহার মনের কথা যেন বুঝিলেন, বলিলেন, কিছু বলবি আমাকে রে?

 কেষ্ট মাটির দিকে চাহিয়া অতি মৃদুস্বরে বলিল, কাল কিছু খাইনি মেজদি-

 কাল থেকে খাসনি। বলিস্‌ কি কেষ্ট? কিছুক্ষণ পর্যন্ত হেমাঙ্গিনী স্থির হইয়া রহিলেন, তাহার পর দুই চোখ জলে পূর্ণ হইয়া গেল। সেই জল ঝরঝর করিয়া ঝরিতে লাগিল। তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া আর একবার কাছে বসাইয়া, একটি একটি করিয়া সব কথা শুনিয়া লইয়া বলিলেন, কাল রাত্তিরেই কেন এলি নে?

 কেষ্ট চুপ করিয়া রহিল। হেমাঙ্গিনী আঁচলে চোখ মুছিয়া বলিলেন,  আমার মাথার দিব্যি রইল ভাই, আজ থেকে আমাকে তোর সেই মরা মা ব’লে মনে করবি।

 যথাসময়ে সমস্ত কথা কাদম্বিনীর কানো গেল। তিনি নিজের বাড়ি হইতে মেজবৌকে ডাক দিয়া বলিলেন, ভাইকে আমি খাওয়াতে পারি। নে যে, তুমি অত কথা তাকে গায়ে পড়ে বলতে গেছ?

 কথার ধরণ দেখিয়া হেমাঙ্গিনীর গা জ্বালা করিয়া উঠিল। কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া বলিলেন, যদি গায়ে পড়েই ব’লে থাকি, তাতেই বা দোষ কি?

 কাদম্বিনী প্রশ্ন করিলেন, তোমার ছেলেটিকে ডেকে এনে আমি যদি এমনি করে বলি, তোমার মানটি থাকে কোথায় শুনি? তুমি এমন করে ‘নাই' দিলে আমি তাকে শাসন করি কি করে বল দেখি?

 হেমাঙ্গিনী আর সহ্য করিতে পারিলেন না। বলিলেন, দিদি, পনের-ষোল বছর এক সঙ্গে ঘর করাচি-তোমাকে আমি চিনি। পেটে মেরে আগে তোমার নিজের ছেলেকে শাসন কর, তার পরে পরের ছেলেকে করে, তখন গায়ে পড়ে কথা কইতে যাবো না।

 কাদম্বিনী অবাক হইয়া বলিলেন, আমার পাঁচুগোপালের সঙ্গে ওর তুলনা? দেবতার সঙ্গে বাঁদরের তুলনা? এর পরে আরও কি যে তুমি বলে বেড়াবে, তাই ভাবি মেজবৌ।

 মেজবৌ উত্তর দিলেন, কে দেবতা কে বাঁদর, সে আমি জানি। কিন্তু আর আমি কিছুই বলব, না দিদি, যদি বলিত এই যে-তোমার মত নিষ্ঠুর, তোমার মত বেহায়া মেয়েমানুষ আর সংসার নেই। বলিয়া তিনি প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন।

 সেইদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে অর্থাৎ কর্তারা ঘরে ফিরিবার সময়টিতে বড়বৌ নিজের উঠানে দাঁড়াইয়া দাসীকে উপলক্ষ্য করিয়া উচ্চকণ্ঠে অর্জন-গর্জন আরম্ভ করিয়া দিলেন-যিনি রাত-দিন কচ্ছেন, তিনিই এর বিহিত করবেন। আমার ভায়ের মর্ম আমি বুঝি নে, বোঝে পরে। কখ্‌খনো ভাল হবে না ভাই-বোনে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখলে ধর্ম সইবেন না। -তা বলে দিচ্ছি, বলিয়া তিনি রান্নাঘরে গিয়া ঢুকিলেন।

 উভয় জায়ের মধ্যে এই ধরনের গালি-গালাজ, শাপ-শাপান্ত অনেকবার অনেক রকম করিয়া হইয়া গিয়াছে, কিন্তু আজ ঝাঁজটা কিছু বেশী। অনেক সময় হেমাঙ্গিনী শুনিয়াও শুনিতেন না, বুঝিয়াও গায়ে মাখিতেন না; কিন্তু আজ নাকি তাঁহার দেহটা খারাপ ছিল, তাই উঠিয়া আসিয়া জানালায় দাঁড়াইয়া কহিলেন, এর মধ্যেই চুপ করলে কেন দিদি? ভগবান হয়ত শুনতে পাননি-আর খানিকক্ষণ ধরে আর সর্বনাশ কানা কর- বট্‌ঠাকুর ঘরে আসুন, তিনি শুনুন, ইনি ঘরে এসে শুনুন-এরই মধ্যেই হাঁপিয়ে পড়লে চলবে কেন?

 কাদম্বিনী উঠানের উপড়ে ছুটিয়া আসিয়া মুখ উঁচু করিয়া চেঁচাইয়া উঠিলেন, আমি কি কোন সর্বনাশীর নাম মুখে এনেছি?

 হেমাঙ্গিনী স্থিরভাবে জবাব ‘দিলেন, মুখে আনবে কেন দিদি, মুখে আনবার পাত্রী নাও। কি তুমি কি ঠাওরাও, একা তুমিই সেয়ানা আর পৃথিবীসুদ্ধ সেয়ানা আর পৃথিবীসুদ্ধ ন্যাকা? ঠেস দিয়ে কার কপাল ভাঙচ, সে কি কেউ টের পায় না?

 কাদম্বিনী এবার নিজমূর্ত্তি ধরিলেন। মুখ ভ্যাংচাইয়া হাত-পা নাড়িয়া বলিলেন, টের পেলেই বা। যে দোষে থাকবে, তারই গায়ে লাগবে। আর একা তুমিই টের পাও, আমি পাই নে? কেষ্ট যখন এলো, সাত চড়ে রা করত না, যা বলতুম, মুখ বুজে তাই করত-আজি দুপুরবেলা কার জোরে কি জবাব দিয়ে গেল, জিজ্ঞাসা করে দ্যাখো এই প্রসন্নার মাকে,—বলিয়া দাসীকে দেখাইয়া দিল।

 প্রসন্নর মা কহিল, সে-কথা সত্য মেজবৌমা। আজ সে ভাত ফেলে উঠে যেতে মা বললেন, এ পিণ্ডিই না গিললে যখন যমের বাড়ি যেতে হবে, তখন এত তেজ কিসের জন্যে? সে বলে গেল,—আমার মেজদি থাকতে কাউকে ভয় করি নে।

 কাদম্বিনী সদর্পে বলিলেন, কেমন হ’ল তা। কার জোরে এত তেজ শুনি? আজ আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, মেজবৌ, ওকে তুমি একশ'বার ডেকো না। আমাদের ভাইবোনের কথার মধ্যে থেকো না।

 হেমাঙ্গিনী কথা কহিলেন না। কেঁচো সাপের মত চক্র ধরিয়া কামড়াইয়াছে শুনিয়া, তাঁহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। জানালা হইতে ফিরিয়া আসিয়া চুপ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন, কত বেশী পীড়নের দ্বারা ইহাও সম্ভব হইতে পারিয়াছে।

 আবার মাথা ধরিয়া জ্বর বোধ হইতেছিল, তাই অসময়ে শয্যায়, আসিয়া নির্জ্জীবের মত পড়িয়া ছিলেন। তাঁহার স্বামী ঘরে ঢুকিয়া ইহা লক্ষ্য না করিয়াই ক্রোধাভরে বলিয়া উঠিলেন, বৌঠানের ভাইকে নিয়ে আজ কি কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছ? কারু আনা শুনবে না, যেখানে যত হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া আছে, দেখলেই তার দিকে কোমর বেঁধে দাঁড়াবে, রোজ রোজ আমার এত হাঙ্গামা সহ্য হয় না মেজবৌ। আজ বৌঠান আমাকে না-হক্‌ দস্তা কথা শুনিয়ে দিলেন।

 হেমাঙ্গিনী শ্রান্তকণ্ঠে কহিলেন, বৌঠান হক্‌ কথা কবে বলেন যে আজ তোমাকে না-হক্‌ কথা বলেছেন?

 বিপিন বললেন, কিন্তু আজ তিনি ঠিক কথাই বলেছেন। তোমার স্বভাব জানি ত। সেবার বাড়ির রাখাল ছোঁড়াটাকে নিয়ে এই রকম করলে, মতি কামারের ভাগ্নের অমন বাগানখানা তোমার জন্যেই মুঠোর ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল, উল্টে পুলিশ থামাতে এক শ’ দেড় শ’ ঘর থেকে গেল। তুমি নিজের ভাল-মন্দও কি বোঝা না? কবে এ স্বভাব যাবে?

 হেমাঙ্গিনী এবার উঠিয়া বসিয়া স্বামীর মুখপানে চাহিয়া কহিলেন, আমার স্বাভাব যাবে মরণ হলে, তার আগে নয়। আমি মা,— কোলে ছেলেপুলে আছে, মাথার ওপর ভগবান আছেন। এর বেশী আমি গুরুজনের নামে নালিশ করতে চাই নে। আমার অসুখ করেচে-আর আমাকে বকি না-তুমি যাও। বলিয়া গাইয়ের র‍্যাপার-খানা টানিয়া পাশ ফিরিয়া শুইয়া পড়িলেন।

 বিপিন প্রকাশ্যে আর তর্ক করিতে সাহস করিলেন না, কিন্তু মনে মনে স্ত্রী-র উপর এবং বিশেষ করিয়া ঐ গলগ্রহ দুর্ভাগাটার উপর আজ মর্মান্তিক চটিয়া গেলেন।