যোগাযোগ/১৪
১৪
ঘােষালদিঘির ধারে জঙ্গল সাফ হয়ে গেল,—চেনা যায় না। জমি নিখুঁতভাবে সমতল, মাঝে মাঝে সুরকি দিয়ে রাঙানাে রাস্তা, রাস্তার ধারে ধারে আলাে দেবার থাম। দিঘির পানা সব তােলা হয়েছে। ঘাটের কাছে তকতকে নতুন বিলিতি পাল-খেলাবার দুটি নৌকা; তাদের একটির গায়ে লেখা “মধুমতী”, আর-একটির গায়ে “মধুকরী”। যে-তাঁবুতে রাজাবাহাদুব স্বয়ং থাকবেন তার সামনে ফ্রেমে হলদে বনাতের উপর লাল রেশমে বােনা “মধুচক্র”। একটা তাঁবু অন্তঃপুরের, সেখান থেকে জল পর্যন্ত চাটাই দিয়ে ঘেরা ঘাট। ঘাটের উপরেই মস্ত নিমগাছের গায়ে কাঠের ফলকে লেখা “মধুসাগর”। খানিকটা জমিতে নানা আকারের চানকায় সূর্যমুখী রজনীগন্ধা, গাঁদা দোপাটি, ক্যানা ও পাতাবাহার, কাঠের চৌকো বাক্সে নানা রঙের বিলিতি ফুল। মাঝে একটি ছােটো বাঁধানাে জলাশয়, তারই মধ্যে লােহার ঢালাই-করা নগ্ন স্ত্রীমূর্তি, মুখে শাঁখ তুলে ধরেছে, তার থেকে ফোয়ারার জল বেরােবে। এই জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছে “মধুকুঞ্জ”। প্রবেশপথে কারুকাজকরা লােহার গেট, উপরে নিশান উড়ছে—নিশানে লেখা “মধুপুরী”। চারদিকেই “মধু” নামের ছাপ। নানা রঙের কাপড়ে কানাতে চাঁদোয়ায় নিশানে রঙিন ফুলে চীনালণ্ঠনে হঠাৎ-তৈরি এই মায়াপুরী দেখবার জন্যে দূর থেকে দলে দলে লােক আসতে লাগল। এদিকে ঝক্ঝকে চাপরাস-ঝােলানাে হলদের উপর লালপাড় দেওয়া পাগড়ি-বাঁধা, জরির ফিতে-দেওয়া লাল বনাতের উর্দিপরা চাপরাসির দল বিলিতি জুতাে মস্মসিয়ে বেড়ায়, সন্ধ্যাবেলায় বন্দুকে ফাঁকা আওয়াজ করে, দিনরাত প্রহরে প্রহরে ঘণ্টা বাজায়, তাদের কারও কারও চামড়ার কোমরবন্ধে ঝােলানাে বিলিতি তলােয়ারটা জমিদারের মাটিকে পায়ে পায়ে খোঁচা দিতে থাকে। চাটুজ্যেদের সাবেক কালের জীর্ণসাজপরা ববকন্দাজেরা লজ্জায় ঘর হতে বার হতে চায় না। কাণ্ড দেখে চাটুজ্যে-পরিবারের গায়ের জ্বালা ধরল। নুরনগরের পাঁজরটার মধ্যে বিঁধিয়ে দিয়ে শেলদণ্ডের উপর আজ ঘােষালদের জয়পতাকা উড়েছে।
শুভপরিণয়ের এই সূচনা।