১৭

 বিয়ের দিনে, রাজার হুকুম, কনের বাড়ি যাবার পথে ধুমধাম একেবারেই বন্ধ। আলো জ্বলল না, বাজনা বাজল না, সঙ্গে কেবল নিজেদের পুরোহিত, আর দুই জন ভাট। পালকিতে করে নিঃশব্দে বিয়ে বাড়িতে বর এল, লোকে হঠাৎ বুঝতেই পারলে না। ওদিকে মধুপুরীর তাঁবুতে আলো জ্বালিয়ে ব্যাণ্ড বাজিয়ে বিপরীত হৈ হৈ শব্দে বরযাত্রীর দল আহারে আমোদে প্রবৃত্ত। নবগোপাল বুঝলে এটা হল পালটা জবাব। এমন স্থলে কন্যাপক্ষ হাতে পায়ে ধরে বরপক্ষের সাধ্যসাধনা করে;—নবগোপাল তার কিছুই করলে না। একবার জিজ্ঞাসা করলে না, বরযাত্রীদের হল কী।

 কুমুদিনী সাজসজ্জা করে বিবাহ-আসরে যাবার আগে দাদাকে প্রণাম করতে এল; তার সর্বশবীর কাঁপছে। বিপ্রদাসের তখন এক-শ পাঁচ ডিগ্রী জ্বর, বুকে পিঠে রাইসরষের পলস্তারা; কুমুদিনী তার পায়ের উপর মাথা ঠেকিয়ে আর থাকতে পারলে না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ক্ষেমা পিসি মুখে হাত চাপা দিয়ে বললে, “ছি, ছি, অমন করে কাঁদতে নেই।”

 বিপ্রদাস একটু উঠে বসে ওকে হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল—দুই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ক্ষেমা পিসি বললে, “সময় হল যে।”

 বিপ্রদাস কুমুর মাথায় হাত দিয়ে রুদ্ধকণ্ঠে বললে, “সর্বশুভদাতা কল্যাণ করুন।” বলেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

 বিবাহের সমস্তক্ষণ কুমুর দু-চোখ দিয়ে কেবল জল পড়েছে। বরের হাতে যখন হাত দিলে সে-হাত ঠাণ্ডা হিম, আর থরথর করে কাঁপছে। শুভদৃষ্টির সময় সে কি স্বামীর মুখ দেখেছে? হয়তো দেখে নি। এদের ব্যবহারে সবসুদ্ধ জড়িয়ে স্বামীর উপর ওর ভয় ধরে গেছে। পাখির মনে হচ্ছে তার জন্যে বাসা নেই, আছে ফাঁস।

 মধুসূদন দেখতে কুশ্রী নয় কিন্তু বড় কঠিন। কালো মুখের মধ্যে যেটা প্রথমেই চোখে পড়ে সে হচ্ছে পাখির চঞ্চুর মতো মস্ত বড়ো বাঁকা নাক, ঠোঁটের সামনে পর্যন্ত ঝুঁকে পড়ে যেন পাহারা দিচ্ছে। প্রশস্ত গড়ানে কপাল ঘন ভ্রূর উপর বাধাপ্রাপ্ত স্রোতের মতো স্ফীত। সেই ভ্রূর ছায়াতলে সংকীর্ণ তির্যক চক্ষুর দৃষ্টি তীব্র। গোঁফদাড়ি কামানো, ঠোঁট চাপা, চিবুক ভারি। কড়া চুল কাফ্রিদের মতাে কোঁকড়া, মাথার তেলাে ঘেঁষে ছাটা। খুব আঁটসাঁট শরীর; যত বয়েস তার চেয়ে __ বােধ হয়, কেবল দুই রগের কাছে চুলে পাক ধরেছে। বেঁটে, মাথায় প্রায় কুমুদিনীর সমান। হাত দুটো রােমশ ও দেহের তুলনায় খাটো। সবসুদ্ধ মনে হয় মানুষটা একেবারে নিরেট; মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বদাই কী একটা প্রতিজ্ঞা যেন গুলি পাকিয়ে আছে। যেন ভাগ্যদেবতার কামান থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে একাগ্রভাবে চলেছে একটা একগুঁয়ে গােলা। দেখলেই বােঝা যায় বাজে কথা বাজে বিষয় বাজে মানুষের প্রতি মন দেবার ওর একটুও অবকাশ নেই।

 বিবাহটা এমন ভাবে হল যে, সকলেরই মনে খারাপ লাগল। বরপক্ষকন্যাপক্ষের প্রথম সংস্পর্শমাত্রই এমন একটা বেসুর ঝনঝনিয়ে উঠল যে, তার মধ্যে উৎসবের সংগীত কোথায় গেল তলিয়ে। থেকে-থেকে কুমুর মনের একটা প্রশ্ন অভিমানে বুক ঠেলে ঠেলে উঠছে, “ঠাকুর কি তবে আমাকে ভােলালেন?” সংশয়কে প্রাণপণে চাপা দেয়, রুদ্ধঘরের মধ্যে একলা বসে বারবার মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলে, মন যেন দুর্বল না হয়। সবচেয়ে কঠিন হয়েছে দাদার কাছে সংশয় লুকোনো।

 মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কুমুদিনীর সেবার ’পরেই বিপ্রদাসের একান্ত নির্ভর। কাপড়চোপড়, দিনখরচের টাকাকড়ি, বইয়ের আলমারি, ঘােড়ার দানা, বন্দুকের সম্মার্জন, কুকুরের সেবা, ক্যামেরার রক্ষণ, সংগীতযন্ত্রের পর্যবেক্ষণ, শােবার বসবার ঘরের পারিপাট্যসাধন,—সমস্ত কুমুর হাতে। এত বেশি অভ্যাস হয়ে এসেছে যে, প্রাত্যহিক ব্যবহারে কুমুর হাত কোথাও না থাকলে তার রােচে না। সেই দাদার রােগশয্যায় বিদায়ের আগে শেষ কয়দিন যে-সেবা করতে হয়েছে তার মধ্যে নিজের ভাবনার কোনাে ছায়া না পড়ে এই তার দুঃসাধ্য চেষ্টা। কুমুর এসরাজের হাত নিয়ে বিপ্রদাসের ভারি গর্ব। লাজুক কুমু সহজে বাজাতে চায় না। এই দুদিন সে আপনি যেচে দাদাকে কানাড়া-মালকোষের আলাপ শুনিয়েছে। সেই আলাপের মধ্যেই ছিল তার দেবতার স্তব, তার প্রার্থনা, তার আশঙ্কা, তার আত্মনিবেদন। বিপ্রদাস চোখ বুজে চুপ করে শোনে আর মাঝে মাঝে ফরমাশ করে—সিন্ধু, বেহাগ, ভৈরবী— যে-সব সুরে বিচ্ছেদ-বেদনার কান্না বাজে। সেই সুরের মধ্যে ভাইবোন দুজনেরই ব্যথা এক হয়ে মিশে যায়। মুখের কথায় দুজনে কিছুই বললে না; না দিলে পরস্পরকে সান্ত্বনা, না জানালে দুঃখ।

 বিপ্রদাসের জ্বর কাশি বুকে ব্যথা সারল না, বরং বেড়ে উঠছে। ডাক্তার বলছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, হয়তো ন্যুমোনিয়ায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, খুব সাবধান হওয়া চাই। কুমুর মনে উদ্বেগের সীমা নেই। কথা ছিল বাসি-বিয়ের কালরাত্রিটা এখানেই কাটিয়ে দিয়ে পরদিন কলকাতায় ফিরবে। কিন্তু শোনা গেল মধুসূদন হঠাৎ পণ করেছে, বিবাহের পরদিনে ওকে নিয়ে চলে যাবে। বুঝলে, এটা প্রথার জন্যে নয়, প্রয়োজনের জন্যে নয়, প্রেমের জন্যে নয়, শাসনের জন্যে। এমন অবস্থায় অনুগ্রহ দাবি করতে অভিমানিনীর মাথায় বজ্রাঘাত হয়। তবু কুমু মাথা হেঁট করে লজ্জা কাটিয়ে কম্পিতকণ্ঠে বিবাহের রাতে স্বামীর কাছে এইমাত্র প্রার্থনা করেছিল যে, আর দুটো দিন যেন তাকে বাপের বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়, দাদাকে একটু ভালো দেখে যেন সে যেতে পারে। মধুসূদন সংক্ষেপে বললে, “সমস্ত ঠিকঠাক হয়ে গেছে।” এমন বজ্রে-বাঁধা একপক্ষের ঠিকঠাক, তার মধ্যে কুমুর মর্মান্তিক বেদনারও এক তিল স্থান নেই। তার পর মধুসূদন ওকে রাত্রে কথা কওয়াতে চেষ্টা করেছে, ও একটিও জবাব দিল না—বিছানার প্রান্তে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইল।

 তখনও অন্ধকার, প্রথম পাখির দ্বিধাজড়িত কাকলি শােনবামাত্র ও বিছানা ছেড়ে চলে গেল।

 বিপ্রদাস সমস্ত রাত ছটফট করেছে। সন্ধ্যার সময় জ্বর-গায়েই বিবাহসভায় যাবার জন্যে ওর ঝোঁক হল। ডাক্তার অনেক চেষ্টায় চেপে রেখে দিলে। ঘন ঘন লােক পাঠিয়ে সে খবর নিয়েছে। খবরগুলাে যুদ্ধের সময়কার খবরের মতাে, অধিকাংশই বানানাে। বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “কখন বর এল? বাজনাবাদ্যির আওয়াজ তাে পাওয়া গেল না।”

 সংবাদদাতা শিবু বললে, “আমাদের জামাই বড়ো বিবেচক-বাড়িতে অসুখ শুনেই সব থামিয়ে দিয়েছে—বরযাত্রদের পায়ের শব্দ শােনা যায় না, এমনি ঠাণ্ডা।”

 “ওরে শিবু, খাবার জিনিস তো কুলিয়েছিল? আমার ওই এক ভাবনা ছিল, এ তো কলকাতা নয়!”

 “কুলােয় নি? বলেন কী হুজুর? কত ফেলা গেল। আরও অতগুলাে লােককে খাওয়াবার মতাে জিনিস বাকি আছে।”

 “ওরা খুশি হয়েছে তাে?”

 “একটি নালিশ কারও মুখে শোনা যায় নি। একেবারে টুঁ শব্দটি না। আরও তাে এত এত বিয়ে দেখেছি, বরযাত্রের দাপাদাপিতে কন্যাকর্তার ভির্মি লাগে! এরা এমনি চুপ, আছে কি না-আছে বােঝাই যায় না।”

 বিপ্রদাস বললে, “ওরা কলকাতার লােক কি না, তাই ভদ্র ব্যবহার জানা আছে। ওরা বােঝে যে, যে-বাড়ি থেকে মেয়ে নেবে তাদের অপমানে নিজেদেরই অপমান।”

 “আহা হুজুর যা বললেন এই কথাটি ওদের লােকজনদের আমি শুনিয়ে দেব। শুনলে ওরা খুশি হবে।”

 কুমু কাল সন্ধ্যের সময়েই বুঝেছিল অসুখ বাড়বার মুখে। অথচ সে যে দাদার সেবা করতে পারবে না এই দুঃখ সর্বক্ষণ তার বুকের মধ্যে ফাঁদে-পড়া পাখির মতো ছটফট করতে লাগল। তার হাতের সেবা যে তার দাদার কাছে ওষুধের চেয়ে বেশি।

 স্নান করে ঠাকুরকে ফুল দিয়ে কুমু যখন দাদার ঘরে এল তখনও সূর্য ওঠে নি। কঠিন রোগের সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়াই করে ক্ষণকাল ছুটি পাবার সময় যে অবসাদের বৈরাগ্য আসে সেই বৈরাগ্যে বিপ্রদাসের মন তখন শিথিল। জীবনের আসক্তি, সংসারের ভাবনা সব তার কাছে শস্যশূন্য মাঠের মতো ধূসরবর্ণ। সমস্ত রাত দরজা বন্ধ ছিল, ডাক্তার ভোরের বেলায় পুবদিকের জানালাটা খুলে দিয়েছে। অশথগাছের শিশির-ভেজা পাতার আড়ালে অরুণবর্ণ আকাশের আভা ধীরে ধীরে শুভ্র হয়ে আসছে,—অদূরবর্তী নদীতে মহাজনি নৌকোর বৃহৎ তালিদেওয়া পালগুলি সেই আরক্তিম আকাশের গায়ে স্ফীত হয়ে উঠল। নহবতে করুণ সুরে রামকেলি বাজছে।

 পাশে বসে কুমু নিজের দুই ঠাণ্ডা হাতের মধ্যে দাদার শুকনো গরম হাত তুলে নিলে। বিপ্রদাসের টেরিয়র কুকুর খাটের নিচে বিমর্ষ মনে চুপ করে শুয়ে ছিল। কুমু খাটে এসে বসতেই সে দাঁড়িয়ে উঠে দু-পা তার কোলের উপর রেখে লেজ নাড়তে নাড়তে করুণ চোখে ক্ষীণ আর্তস্বরে কী যেন প্রশ্ন করলে।

 বিপ্রদাসের মনে ভিতরে-ভিতরে কী একটা চিন্তার ধারা চলছিল, তাই হঠাৎ এক সময়ে অসংলগ্নভাবে বলে উঠল, “দিদি, আসলে কিছুই নয়,—কে বড়ো কে ছোটো, কে উপরে কে নিচে, এ সমস্তই বানানো কথা। ফেনার মধ্যে বুদ্‌বুদ্‌গুলোর কোন্‌টার কোথায় স্থান তাতে কী আসে যায়। আপনার ভিতরে আপনি সহজ হয়ে থাকিস কিছুতেই তোকে মারবে না।”

 “আমাকে আশীর্বাদ করাে, দাদা, আমাকে আশীর্বাদ করো,” বলে কুমু দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না চাপা দিলে।

 বিপ্রদাস বালিশে ঠেস দিয়ে একটু উঠে বসে কুমুর মুখ নামিয়ে ধরে তার মাথায় চুমাে খেলে।

 ডাক্তার ঘরে ঢুকে বললে, “আর নয়, কুমুদিদি, এখন ওর একটু শান্ত থাকা দরকার।”

 কুমু রােগীর বালিশ একটু চেপে-চুপে ঠিক করে গায়ের উপর গরম কাপড়টা টেনে দিয়ে, পাশের টিপাইটার উপরকার বিশৃঙ্খলতা একটু সেরে নিয়ে দাদার কানের কাছে মৃদুস্বরে বললে, “সেরে গেলেই কলকাতায় যেয়াে দাদা, সেখানে তােমাকে দেখতে পাব।”

 বিপ্রদাস বড়াে বড়ো দুই স্নিগ্ধ চোখ কুমুর মুখের উপর স্থির রেখে বললে, “কুমু পশ্চিমের মেঘ যায় পুবে, পুবের মেঘ যায় পশ্চিমে, এ-সব হাওয়ায় হয়। সংসারে সেই হাওয়া বইছে। মেঘের মতােই অমনি সহজে এটাকে মেনে নিস দিদি। এখন থেকে আমাদের কথা বেশি ভাবিস নে। যেখানে যাচ্ছিস সেখানে লক্ষ্মীর আসন ওই জুড়ে থাকিস—এই আমার সকল মনের আশীর্বাদ। তাের কাছে আমরা আর কিছুই চাই নে।”

 দাদার পায়ের কাছে কুমু মাথা রেখে পড়ে রইল। “আজ থেকে আমার কাছে আর কিছুই চাবার নেই। এখানকার প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় আমার কোনাে হাতই থাকবে না”—এক মুহূর্তে এতবড় বিচ্ছেদের কথা মনে মেনে নেওয়া যায় না। ঝড়ে যখন নৌকাকে ডাঙা থেকে টেনে নিয়ে যায় তখন নােঙর যেমন করে মাটি আঁকড়ে থাকতে চায়, দাদার পায়ের কাছে কুমুর তেমনি এই শেষ ব্যগ্রতার বন্ধন। ডাক্তার আবার এসে ধীরে ধীরে বললে, “আর নয় দিদি।” বলে নিজের অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে ফেললে। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজার বাইরে যৈ-চৌকিটা ছিল তার উপর বসে পড়ে মুখে আঁচল দিয়ে কুমু নিঃশকে কাঁদতে লাগল। হঠাৎ এক সময়ে মনে পড়ে গেল দাদার “বেসি” ঘোড়াকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে যাবে বলে কাল রাত্রে সে গুড়মাখা আটার রুটি তৈরি করে রেখেছিল। সইস আজ ভোরবেলায় তাকে খিড়কির বাগানে রেখে এসেছে। কুমু সেখানে গিয়ে দেখলে ঘোড়া আমড়া-গাছতলায় ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে কুমুর পায়ের শব্দ শুনেই কান খাড়া করলে এবং তাকে দেখেই চিঁহিঁ চিঁহিঁ করে ডেকে উঠল। বাঁ হাত তার কাঁধের উপর রেখে ডান হাতে কুমু তার মুখের কাছে রুটি ধরে তাকে খাওয়াতে লাগল। সে খেতে খেতে তার বড়ো বড়ো কালো স্নিগ্ধ চোখে কুমুর মুখের দিকে কটাক্ষে চাইতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে বেসির দুই চোখের মাঝখানকার প্রশস্ত কপালের উপর চুমো খেয়ে কুমু দৌড়ে চলে গেল।