১৯

 বিবাহের লঙ্কাকাণ্ডের সব-শেষ অধ্যায়টা এখনও বাকি।

 সকালবেলায় কুশণ্ডিকা সেরে তবে বরকনে যাত্রা করবে এই ছিল কথা। নবগোপাল তারই সমস্ত উদ্‌যোগ ঠিক করে রেখেছে, এমন সময় বিপ্রদাসের ঘর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসে রাজাবাহাদুর ব’লে বসল-কুশণ্ডিকা হবে বরের ওখানে, মধুপুরীতে।

 প্রস্তাবের ঔদ্ধত্যটা নবগোপালের কাছে অসহ্য লাগল। আর কেউ হলে আজ একটা ফৌজদারি বাধত। তবু ভাষার প্রাবল্যে নবগোপালের আপত্তি প্রায় লাঠিয়ালির কাছ পর্যন্ত এসে তবে থেমেছিল।

 অন্তঃপুরে অপমানটা খুব বাজল। বহুদূর থেকে আত্মীয়-কুটুম সব এসেছে, তাদের মধ্যে ঘরশত্রুর অভাব নেই। সবার সামনে এই অত্যাচার। ক্ষেমা পিসি মুখ গোঁ করে বসে রইলেন। বরকনে যখন বিদায় নিতে এল তাঁর মুখ দিয়ে যেন আশীর্বাদ বেরোতে চাইল না। সবাই বললে এ-কাজটা কলকাতায় সেরে নিলে তো কারও কিছু বলবার কথা থাকত না। বাপের বাড়ির অপমানে কুমু একান্তই সংকুচিত হয়ে গেল,— মনে হতে লাগল সে-ই যেন অপরাধিনী তার সমস্ত পূর্বপুরুষদের কাছে। মনে-মনে তার ঠাকুরের প্রতি অভিমান করে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, “আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি যে-জন্যে আমার এত শাস্তি! আমি তো তোমাকেই বিশ্বাস করে সমস্ত স্বীকার করে নিয়েছি।”

 বরকনে গাড়িতে উঠল। কলকাতা থেকে মধুসূদন যে-ব্যাণ্ড এনেছিল তাই উচ্চৈঃস্বরে নাচের সুর লাগিয়ে দিলে। মস্ত একটা শামিয়ানার নিচে হোমের আয়োজন। ইংরেজ মেয়েপুরুষ অভ্যাগত কেউ বা গদিওআলা চৌকিতে বসে কেউ কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগল। এরই মধ্যে তাদের জন্যে চা-বিস্কুটও এল। একটা টিপায়ের উপর মস্তবড়ো একটা ওয়েডিং কেকও সাজানো আছে। অনুষ্ঠান সারা হয়ে গেলে এরা এসে যখন কন্‌গ্র্যাচুলেট করতে লাগল, কুমু মুখ লাল করে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। একজন মোটাগোছের প্রৌঢ়া ইংরেজ মেয়ে ওর বেনারসি শাড়ির আঁচল তুলে ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে; ওর হাতে খুব মোটা সোনার বাজুবন্ধ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেও তার বিশেষ কৌতুহল বোধ হল। ইংরেজি ভাষায় প্রশংসাও করলে। অনুষ্ঠান সম্বন্ধে মধুসূদনকে একদল বললে, “how interesting,” আর একদল বললে, “isn't it?”

 এই মধুসূদনকে কুমু তার দাদা আর অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে ব্যবহার করতে দেখেছে, আজ তাকেই দেখলে ইংরেজ বন্ধুমহলে। ভদ্রতায় অতি গদ্‌গদভাবে অবনম্র, আর হাসির আপ্যায়নে মুখ নিয়তই বিকসিত। চাঁদের যেমন এক পিঠে আলাে আর এক পিঠে চির-অন্ধকার, মধুসূদনের চরিত্রেও তাই। ইংরেজের অভিমুখে তার মাধুর্য পূর্ণচাঁদের আলাের মতােই যেমন উজ্জ্বল তেমনি স্নিগ্ধ। অন্য দিকটা দুর্গম, দুর্দৃ‌শ্য এবং জমাট বরফের নিশ্চলতায় দুর্ভেদ্য।

 সেলুন-গাড়িতে ইংরেজ বন্ধুদের নিয়ে মধুসূদন; অন্য রিজার্ভ-করা গাড়িতে মেয়েদের দলে কুমু। তারা কেউ বা ওর হাত তুলে টিপে দেখে, কেউ বা চিবুক তুলে মুখশ্রী বিশ্লেষণ করে; কেউ বা বলে ঢ্যাঙা, কেউ বা বলে রােগা। কেউ বা অতি ভালােমানুষের মতাে জিজ্ঞাসা করে, হাঁগা, গায়ে কী রং মাখ, বিলেত থেকে তােমার ভাই বুঝি কিছু পাঠিয়েছে?” সকলেই মীমাংসা করলে, চোখ বড়ো নয়, পায়ের মাপটা মেয়েমানুষের পক্ষে অধিক বড়ো। গায়ের প্রত্যেক গয়নাটি নেড়েচেড়ে বিচার করতে বসল,— সেকেলে গয়না, ওজনে ভারি, সােনা খাটি— কিন্তু কী ফ্যাশান, মরে যাই।

 ওদের গাড়িতে স্টেশন-প্ল্যাটফর্মের উলটো দিকের জানলা খােলা ছিল সেই দিকে কুমু চেয়ে রইল, চেষ্টা করতে লাগল এদের কথা যাতে কানে না যায়। দেখতে পেলে একটা এক-পা-কাটা কুকুর তিন পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাটি শুঁকে বেড়াচ্ছে। আহা, কিছু খাবার যদি হাতের কাছে থাকত! কিছুই ছিল না। কুমু মনে-মনে ভাবতে লাগল, যে-একটি পা গিয়েছে তারই অভাবে ওর যা-কিছু সহজ ছিল তার সমস্তই হয়ে গেল কঠিন এমন সময় কুমুর কানে গেল সেলুন-গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে একজন ভদ্রলােক বলছে, “দেখুন এই চাষির মেয়েকে আড়কাটি আসাম চা-বাগানে ভুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, পালিয়ে এসেছে; গােয়ালন্দ পর্যন্ত টিকিটের টাকা আছে, ওর বাড়ি দুমরাঁও, যদি সাহায্য করেন তাে এই মেয়েটি বেঁচে যায়। সেলুন-গাড়ি থেকে একটা মস্ত তাড়ার আওয়াজ কুমু শুনতে পেলে। সে আর থাকতে পারলে না, তখনই ডানদিকের জানলা খুলে তার পুঁতিগাঁথা থলে উজাড় করে দশ টাকা মেয়েটির হাতে দিয়েই জানালা বন্ধ করে দিলে। দেখে এক জন মেয়ে বলে উঠল, “আমাদের বউয়ের দরাজ হাত দেখি।” আর-একজন বললে, “দরাজ নয় তাে দরজা, লক্ষ্মীকে বিদায় করবার।” আর-এক জন বললে, “টাকা ওড়াতে শিখেছে, রাখতে শিখলে কাজে লাগত।” এটাকে ওরা দেমাক বলে ঠিক করলে, বাবুরা যাকে এক পয়সা দিলে না, ইনি তাকে অমনি ঝনাত করে টাকা ফেলে দেন, এত কিসের গুমাের! ওদের মনে হল এও বুঝি সেই চাটুজ্যে-ঘােষালদের চিরকেলে রেষারেষির অঙ্গ।

 এমন সময়ে ওদের মধ্যে একটি মােটাসােটা কালােকোলাে মেয়ে, মস্ত ডাগর চোখ, স্নেহরসে ভরা মুখের ভাব, কুমুর সমবয়সী হবে, ওর কাছে এসে বসল। চুপি চুপি বললে, “মন কেমন করছে ভাই? এদের কথায় কান দিয়াে না, দু-দিন এই রকম টেপাটেপি বলাবলি করবে, তার পরে কণ্ঠ থেকে বিষ নেমে গেলেই থেমে যাবে।” এই মেয়েটি কুমুর মেজো জা, নবীনের স্ত্রী। ওর নাম নিস্তারিণী, ওকে সবাই মােতির মা বলে ডাকে।

 মােতির মা কথা তুললে, “যেদিন নুরনগরে এলুম, ইস্টিশনে তােমার দাদাকে দেখলুম যে।”

 কুমু চমকে উঠল। ওর দাদা যে স্টেশনে অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিল সে-খবর এই প্রথম শুনলে।

 “আহা কী সুপুরুষ! এমন কখনাে চক্ষে দেখি নি। ওই-যে গান শুনেছিলেম কীর্তনে—

গোরার রূপে লাগল রসের বান,—
ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীয়ার পুরনারীর প্রাণ

আমার তাই মনে পড়ল।”

 মুহূর্তে কুমুর মন গলে গেল। মুখ আড় করে জানলার দিকে রইল চেয়ে,— বাইরের মাঠ বন আকাশ অশ্রুবাষ্পে ঝাপসা হয়ে গেল।

 মােতির মার বুঝতে বাকি ছিল না কোন্ জায়গায় কুমুর দরদ, তাই নানারকম করে ওর দাদার কথাই আলোচনা করলে। জিজ্ঞাসা করলে, বিয়ে হয়েছে কি না।

 কুমু বললে, “না।”

 মােতির মা বলে উঠল, “মরে যাই! অমন দেবতার মতো রূপ, এখনও ঘর খালি! কোন্ ভাগ্যবতীর কপালে আছে ওই বর?”

 কুমু তখন ভাবছে— দাদা গিয়েছিলেন সমস্ত অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে, কেবল আমারই জন্যে। তার পরে এঁরা একবার দেখতেও এলেন না! কেবলমাত্র টাকার জোরে এমন মানুষকেও অবজ্ঞা করতে সাহস করলেন! তাঁর শরীর এই জন্যেই বুঝি বা ভেঙে পড়ল।

 বৃথা আক্ষেপের সঙ্গে বার বার মনে-মনে বলতে লাগল— দাদা কেন গেল ইস্টেশনে। কেন নিজেকে খাটো করলে। আমার জন্যে? আমার মরণ হল না কেন?

 যে-কাজটা হয়ে গেছে, আর ফেরানাে যাবে না, তারই উপর ওর মনটা মাথা ঠুকতে লাগল। কেবলই মনে পড়তে লাগল, সেই রােগে-ক্লান্ত শান্ত মুখ, সেই আশীর্বাদে-ভরা স্নিগ্ধগম্ভীর দুটি চোখ।