যোগাযোগ/২৫
২৫
ইতিমধ্যে শ্যামাসুন্দরী হাঁপাতে হাঁপাতে মধুকে এসে জানালে, “বউ মুর্ছো গেছে।” মধুসূদনের মনটা দপ করে জ্বলে উঠল; বললে, “কেন, তাঁর হয়েছে কী?”
“তা তো বলতে পারি নে, দাদা দাদা করেই বউ হেদিয়ে গেল। তা একবার কি দেখতে যাবে?”
“কী হবে! আমি তো ওর দাদা নই।”
“মিছে রাগ করছ ঠাকুরপো, ওরা বড়োঘরের মেয়ে, পোষ মানতে সময় লাগবে।”
“রোজ রোজ উনি মুর্ছো যাবেন আর আমি ওঁর মাথায় কবিরাজি তেল মালিস করব। এই জন্যেই কি ওঁকে বিয়ে করেছিলুম?”
“ঠাকুরপো তোমার কথা শুনে হাসি পায়। তা দোষ হয়েছে কী, আমাদের কালে কথায় কথায় মানিনীর মান ভাঙাতে হত, এখন না হয় মুর্ছো ভাঙাতে হবে।”
মধুসূদন গোঁ হয়ে বসে রইল। শ্যামাসুন্দরী বিগলিত করুণায় কাছে এসে হাত ধরে বললে, “ঠাকুরপো অমন মন খারাপ ক’রো না, দেখে সইতে পারি নে।”
মধুসূদনের এত কাছে গিয়ে ওকে সান্ত্বনা দেয় ইতিপূর্বে এমন সাহস শ্যামার ছিল না। প্রগল্ভা শ্যামা ওর কাছে ভারি চুপ করে থাকত; জানত মধুসূদন বেশি কথা সইতে পারে না। মেয়েদের সহজ বুদ্ধি থেকে শ্যামা বুঝেছে মধুসূদন আজ সে-মধুসূদন নেই। আজ ও দুর্বল, নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সতর্কতা ওর নেই। মধুর হাতে হাত দিয়ে বুঝল এটা ওর খারাপ লাগে নি। নববধূ ওর অভিমানে যে ঘা দিয়েছে, কোনো একটা জায়গা থেকে চিকিৎসা পেয়ে ভিতরে ভিতরে একটু আরাম বোধ হয়েছে। শ্যামা অন্তত ওকে অনাদর করে না এটা তো নিতান্ত তুচ্ছ কথা নয়। শ্যামা কি কুমুর চেয়ে কম সুন্দরী, না হয় ওর রং একটু কালো,— কিন্তু ওর চোখ, ওর চুল, ওর রসালো ঠোঁট!
শ্যামা বলে উঠল, “ওই আসছে বউ, আমি যাই ভাই। কিন্তু দেখো ওর সঙ্গে রাগারাগি ক’রো না, আহা, ও ছেলেমানুষ!”
কুমু ঘরে ঢুকতেই মধুসূদন আর থাকতে পারলে না, বলে উঠল, “বাপের বাড়ি থেকে মুর্ছো অভ্যেস করে এসেছ বুঝি? কিন্তু আমাদের এখানে ওটা চলতি নেই। তোমাদের ওই নুরনগরি চাল ছাড়তে হবে।”
কুমু নির্নিমেষ চোখ মেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, একটি কথাও বললে না।
মধুসূদন ওর মৌন দেখে আরও রেগে গেল। মনের গভীর তলায় এই মেয়েটির মন পাবার জন্যে একটা আকাঙ্ক্ষা জেগেছে বলেই ওর এই তীব্র নিষ্ফল রাগ। বলে উঠল, “আমি কাজের লোেক, সময় কম, হিসটিরিয়াওআলী মেয়ের খেদমদগারি করবার ফুরসত আমার নেই, এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।”
কুমু ধীরে ধীরে বললে, “তুমি আমাকে অপমান করতে চাও? হার মানতে হবে। তোমার অপমান মনের মধ্যে নেব না।”
কুমু কাকে এ-সব কথা বলছে? ওর বিস্ফারিত চোখের সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে? মধুসূদন অবাক হয়ে গেল, ভাবলে এ-মেয়ে ঝগড়া করে না কেন? এর ভাবখানা কী?
মধুসূদন বক্রোক্তি করে বললে, “তুমি তোমার দাদার চেলা, কিন্তু জেনে রেখো, আমি তোমার সেই দাদার মহাজন, তাকে এক হাটে কিনে আর-এক হাটে বেচতে পারি।”
ও যে কুমুর দাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এ-কথা কুমুর মনে দেগে দেবার জন্যে মূঢ় আর কোনো কথা খুঁজে পেলে না।
কুমু বললে, “দেখো, নিষ্ঠুর হও তো হ’য়ো, কিন্তু ছোটো হ’য়ো না।” বলে সোফার উপর বসে পড়ল।
কর্কশস্বরে মধুসূদন বলে উঠল, “কী! আমি ছোটো! আর তোমার দাদা আমার চেয়ে বড়ো?”
কুমু বললে, “তোমাকে বড়ো জেনেই তোমার ঘরে এসেছি।”
মধুসূদন ব্যঙ্গ করে বললে, “বড়ো জেনেই এসেছ, না, টাকার লোভে?”
তখন কুমু সোফা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে খোলা ছাদে মেজের উপর গিয়ে বসল।
কলকাতায় শীতকালের কৃপণ রাত্রি, ধোঁয়ায় কুয়াশায় ঘোলা, আকাশ অপ্রসন্ন, তারার আলো যেন ভাঙা গলার কথার মতো। কুমুর মন তখন অসাড়, কোনো ভাবনা নেই, কোনো বেদনা নেই। একটা কুয়াশার মধ্যে সে যেন লুপ্ত হয়ে গেছে।
কুমু যে এমন করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবে মধুসূদন এ একেবারে ভাবতেই পারে নি। নিজের এই পরাভবের জন্যে সকলের চেয়ে রাগ হচ্ছে কুমুর দাদার উপর। শোবার ঘরে চৌকির উপরে বসে পড়ে শূন্য আকাশের দিকে সে একটা ঘুষি নিক্ষেপ করলে। খানিকক্ষণ বসে থেকে ধৈর্য আর রাখতে পারলে না। ধড়ফড় করে উঠে ছাদে বেরিয়ে ওর পিছনে গিয়ে ডাকলে, “বড়োবউ।”
কুমু চমকে উঠে পিছন ফিরে দাঁড়ালে।
“ঠাণ্ডায় হিমে বাইরে এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? চলো ঘরে।”
কুমু অসংকোচে মধুসূদনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মধুসূদনের মধ্যে যেটুকু প্রভুত্বের জোর ছিল তা গেল উড়ে। কুমুর বাঁ হাত ধরে আস্তে আস্তে বললে, “এস ঘরে।”
কুমুর ডানহাতে তার দাদার আশীর্বাদের সেই টেলিগ্রাম ছিল সেটি সে বুকে চেপে ধরল। স্বামীর হাত থেকে হাত টেনে নিলে না, নীরবে ধীরে ধীরে শোবার ঘরে ফিরে গেল।