২৭

 সন্ধ্যে হয়ে এল, সেদিন কুমুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। শেষকালে দেখা গেল, ভাঁড়ারঘরের পাশে একটা ছোটো কোণের ঘরে যেখানে প্রদীপ পিলসুজ তেলের ল্যাম্প প্রভৃতি জমা করা হয় সেইখানে মেজের উপর মাদুর বিছিয়ে বসে আছে।

 মোতির মা এসে জিজ্ঞাসা করলে, “এ কী কাণ্ড দিদি?”

 কুমু বললে, “এ-বাড়িতে আমি সেজবাতি সাফ করব, আর এইখানে আমার স্থান।”

 মোতির মা বললে, “ভালো কাজ নিয়েছ ভাই, এ-বাড়ি তুমি আলো করতেই তো এসেছ, কিন্তু সে-জন্যে তোমাকে সেজবাতির তদারক করতে হবে না। এখন চলো।”

 কুমু কিছুতে নড়ল না।

 মোতির মা বললে, “তবে আমি তোমার কাছে শুই।”

 কুমু দৃঢ়স্বরে বললে, “না।” মোতির মা দেখলে এই ভালোমানুষমেয়ের মধ্যে হুকুম করবার জোর আছে। তাকে চলে যেতে হল।

 মধুসূদন রাত্রে শুতে এসে কুমুর খবর নিলে। যখন খবর শুনলে, প্রথমটা ভাবলে, “বেশ তো ওই ঘরেই থাক্ না, দেখি কতদিন থাকতে পারে। সাধ্যসাধনা করতে গেলেই জেদ বেড়ে যাবে।”

 এই বলে আলো নিবিয়ে দিয়ে শুতে গেল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না। প্রত্যেক শব্দেই মনে হচ্ছে ওই বুঝি আসছে। একবার মনে হল, যেন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। যতই রাত হয় মনের মধ্যে ছটফট করতে থাকে। কুমুকে যে অবজ্ঞা করবে কিছুতেই সে-শক্তি পাচ্ছে না। অথচ নিজে এগিয়ে গিয়ে তার কাছে হার মানবে এটা ওর পলিসি-বিরুদ্ধ। ঠাণ্ডা জল দিয়ে ধুয়ে এসে শুল, কিন্তু ঘুম আসে না। ছটফট করতে করতে উঠে পড়ল, কোনোমতেই কৌতুহল সামলাতে পারলে না। একটা লণ্ঠন হাতে করে নিদ্রিত কক্ষশ্রেণী নিঃশব্দপদে পার হয়ে অন্তঃপুরের সেই ফরাশখানার সামনে এসে একটুক্ষণ কান পেতে রইল, ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। সাবধানে দরজা খুলে দেখে, কুমু মেজের উপর একটা মাদুর পেতে শুয়ে, সেই মাদুরের এক প্রান্ত গুটিয়ে সেইটেকে বালিশ করেছে। মধুসূদনের যেমন ঘুম নেই, কুমুরও তেমনি ঘুম না থাকাই উচিত ছিল, কিন্তু দেখলে সে অকাতরে ঘুমোচ্ছে; এমন কি তার মুখের উপর যখন লণ্ঠনের আলো ফেললে তাতেও ঘুম ভাঙল না। এমন সময় কুমু একটুখানি উসখুস করে পাশ ফিরলে। গৃহস্থের জাগার লক্ষণ দেখে চোর যেমন করে পালায় মধুসূদন তেমনি তাড়াতাড়ি পালাল। ভয় হল পাছে কুমু ওর পরাভব দেখতে পায়, পাছে মনে-মনে হাসে।

 বাতির ঘর থেকে মধুসূদন বেরিয়ে এসে বারান্দা বেয়ে খানিকটা যেতেই সামনে দেখে শ্যামা। তার হাতে একটি প্রদীপ।

 “একি ঠাকুরপো, এখানে কোথা থেকে এলে?”

 মধুসূদন তার কোনো উত্তর না করে বললে, “তুমি কোথায় যাচ্ছ বউ?”

 “কাল যে আমার ব্রত, ব্রাহ্মণভোজন করাতে হবে তারই জোগাড়ে চলেছি— তােমারও নেমন্তন্ন রইল। কিন্তু তােমাকে দক্ষিণে দেবার মতাে শক্তি নেই ভাই।”

 মধুসূদনের মুখে একটা জবাব আসছিল, সেটা চেপে গেল।

 সেই শেষরাত্রের অন্ধকারে প্রদীপের আলােয় শ্যামাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। শ্যামা একটু হেসে বললে, “আজ ঘুম থেকে উঠেই তােমার মতাে ভাগ্যবান পুরুষের মুখ দেখলুম, আমার দিন ভালােই যাবে। ব্রত সফল হবে।”

 ভাগ্যবান শব্দটার উপর একটু জোর দিলে— মধুসূদনের কানে কথাটা বিড়ম্বনার মতাে শােনাল। কুমুর সম্বন্ধে কোনাে কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে শ্যামার সাহস হল না। “কাল কিন্তু আমার ঘরে খেতে এসাে, মাথা খাও,” বলে সে চলে গেল।

 ঘরে এসে মধুসূদন বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাইরে লণ্ঠনটা রাখলে, যদি কুমু আসে। কুমুদিনীর সেই সুপ্ত মুখ কিছুতে মন থেকে নড়তে চায় না; আর কেবলই মনে পড়ে কুমুর অতুলনীয় সেই হাতখানি শালের বাইরে এলিয়ে। বিবাহকালে এই হাত যখন নিজের হাতে নিয়েছিল তখন একে সম্পূর্ণ দেখতে পায় নি— আজ দেখে-দেখে চোখের আর আশ মিটতে চায় না। এই হাতের অধিকারটি সে কবে পাবে? বিছানায় আর টিঁকতে পারে না; উঠে পড়ল। আলাে জ্বালিয়ে কুমুর ডেস্কের দেরাজ খুললে। দেখলে সেই পুঁতি-গাঁথা থলিটি। প্রথমেই বেরােল বিপ্রদাসের টেলিগ্রামখানি— “ঈশ্বর তােমাকে আশীর্বাদ করুন”— তার পরে একখানি ফটোগ্রাফ, ওর দুই দাদার ছবি আর একখানি কাগজের টুকরাে, বিপ্রদাসের হাতে-লেখা গীতার এই শ্লোক—

যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ,
যৎ তপস্যসি, কৌন্তেয়, তৎ কুরুম্ব মদর্পণম্।

 ঈর্ষায় মধুসূদনের মন ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। দাঁতে দাঁতে লাগিয়ে বিপ্রদাসকে মনে-মনে লোপ করে দিলে। সেই লুপ্তির দিন একদা আসবে ও নিশ্চয় জানে— অল্প অল্প করে স্ক্রু আঁটতে হবে; কিন্তু কুমুদিনীর যে-উনিশটা বছর মধুসূদনের আয়ত্তের বাইরে, সেইটে বিপ্রদাসের হাত থেকে এই মুহূর্তেই ছিনিয়ে নিতে পারলে তবেই ও মনে শান্তি পায়। আর-কোনো রাস্তা জানে না জবরদস্তি ছাড়া। পুঁতির থলিটি আজ সাহস করে ফেলে দিতে পারলে না—যেদিন আংটি হরণ করে নিয়েছিল সেদিন ওর সাহস আরও বেশি ছিল। তখনও জানত কুমুদিনী সাধারণ মেয়েরই মতো সহজেই শাসনের অধীন, এমন কি, শাসনই পছন্দ করে। আজ বুঝেছে কুমুদিনী যে কী করতে পারে এবং পারে না কিচ্ছু বলবার জো নেই।

 কুমুদিনীকে নিজের জীবনের সঙ্গে শক্ত বাঁধনে জড়াবার একটি মাত্র রাস্তা আছে সে কেবল সন্তানের মায়ের রাস্তা। সেই কল্পনাতেই ওর সান্ত্বনা।

 এমনি করে ঘড়িতে পাঁচটা বাজল। কিন্তু শীতরাত্রির অন্ধকার তখনও যায় নি। আর কিছুক্ষণ পরেই আলো উঠবে, আজকের রাত হবে ব্যর্থ। মধুসূদন তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে চলল— ফরাশখানার সামনে পায়ের শব্দটা বেশ একটু স্পষ্টই ধ্বনিত করলে— দরজাটা শব্দ করেই খুললে— দেখলে ভিতরে কুমু নেই। কোথায় সে?

 উঠোনের কলে জল-পড়ার শব্দ কানে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলে, যত রাজ্যের পুরানো অব্যবহার্য মরচে-পড়া পিলসুজগুলো নিয়ে কুমু তেঁতুল দিয়ে মাজছে। এ কেবল ইচ্ছা করে কাজের ভার বাড়াবার চেষ্টা, শীতের ভোরবেলার নিদ্রাহীন দুঃখকে বিস্তারিত করে তোলা।

 মধুসূদন উপরের বারান্দা থেকে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। অবলার বলকে কী করে পরাস্ত করতে হয় এই তার ভাবনা। সকালে উঠে বাড়ির লােকে যখন দেখবে কুমু পিলসুজ মাজছে কী ভাববে। যে চাকরের উপরে মাজাঘষার ভার, সেই বা কী মনে করবে? বিশ্বসুদ্ধ লােকের কাছে তাকে হাস্যাস্পদ করবার এমন তাে উপায় আর নেই।

 একবার মধুসূদনের মনে হল কলতলায় গিয়ে কুমুর সঙ্গে বােঝাপড়া করে নেয়। কিন্তু সকালবেলায় সেই উঠানের মাঝখানে দুজনে বচসা করবে আর বাড়িসুদ্ধ লােকে তামাশা দেখতে বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে এই প্রহসনটা কল্পনা করে পিছিয়ে গেল। মেজো ভাই নবীনকে ডাকিয়ে বললে, “বাড়িতে কী সব ব্যাপার হচ্ছে চোখ রাখ কি?”

 নবীন ছিল বাড়ির ম্যানেজার। সে ভয় পেয়ে বললে, “কেন দাদা, কী হয়েছে?”

 নবীন জানে, দাদার যখন রাগ করবার একটা কারণ ঘটে তখন শাসন করবার একটা মানুষ চাই। দোষী যদি ফসকে যায় তো নির্দোষী হলেও চলে,— নইলে ডিসিপ্লিন থাকে না, নইলে সংসারে ওর রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রেস্‌টীজ চলে যায়।

 মধুসূদন বললে, “বড়ােবউ যে পাগলের মতাে কাণ্ডটা করতে বসেছে, তার কারণটা কী সে কি আমি জানি নে মনে কর?”

 বড়ােবউ কী পাগলামি করছে সে-প্রশ্ন করতে নবীন সাহস করলে না পাছে খবর না-জানাটাই একটা অপরাধ বলে গণ্য হয়।

 মধুসূদন বললে, “মেজোবউ ওর মাথা বিগড়ােতে বসেছেন সন্দেহ নেই।”

 বহু সংকোচে নবীন বলতে চেষ্টা করলে, “না, মেজোবউ তাে—”

 মধুসূদন বললে, “আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”

 এর উপরে আর কথা খাটে না। স্বচক্ষে দেখার মধ্যে সেই কাগজচাপার ইতিহাসটা নিহিত ছিল।