◄  ৪৫
৪৭  ►

৪৬

 বাড়ির সামনে আসতেই পালকির দরজা একটু ফাঁক করে কুমু উপরের দিকে চেয়ে দেখলে। রোজ এই সময়টা বিপ্রদাস রাস্তার ধারের বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ত, আজ দেখলে সেখানে কেউ নেই। আজ যে কুমু এখানে আসবে সে-খবর এ-বাড়িতে পাঠানো হয় নি। পালকির সঙ্গে মহারাজার তকমা-পর দরোয়ানকে দেখে এ-বাড়ির দরোয়ান ব্যস্ত হয়ে উঠল, বুঝলে যে দিদিঠাকরুন এসেছে। বার-বাড়ির আঙিনা পার হয়ে অন্তঃপুরের দিকে পালকি চলেছিল। কুমু থামিয়ে দ্রুতপদে বাইরের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে চলল। তার ইচ্ছে তাকে আর কেউ দেখবার আগে সব-প্রথমেই দাদার সঙ্গে তার দেখা হয়। নিশ্চয় সে জানত বাইরের আরাম-কামরাতেই রোগীর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। ওখানে জানলা থেকে বাগানের কৃষ্ণচূড়া, কাঞ্চন ও অশথ গাছের একটি কুঞ্জসভা দেখতে পাওয়া যায়। সকালের রৌদ্র ডালপালার ভিতর দিয়ে এই ঘরেই প্রথম দেখা দেয়। এই ঘরটিই বিপ্রদাসের পছন্দ।

 কুমু সিঁড়ির কাছে আসতেই সর্বাগ্রে টম কুকুর ছুটে এসে ওর গায়ের ’পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেঁচিয়ে লেজ ঝাপটিয়ে অস্থির করে দিলে। কুমুর সঙ্গে সঙ্গেই লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে চেঁচাতে টম চলল। বিপ্রদাস একটা মুড়ে-তোলা কোচের পিঠে হেলান দিয়ে আধ-শোওয়া অবস্থায়, পায়ের উপর একটা ছিটের বালাপোশ টানা; একখানা বই নিয়ে ডান হাতটা বিছানার উপর এলিয়ে আছে, যেন ক্লান্ত হয়ে একটু আগে পড়া বন্ধ করেছে। চায়ের পেয়ালা আর ভুক্তাবশিষ্ট রুটি সমেত একটা পিরিচ পাশে মেজের উপরে পড়ে। শিয়রের কাছে দেয়ালের গায়ের শেলফে বইগুলো উলট-পালট এলোমেলো। রাত্রে যে-ল্যাম্প জ্বলেছিল সেটা ধোঁয়ায় দাগি অবস্থায় ঘরের কোণে এখনো পড়ে আছে।

 কুমু বিপ্রদাসের মুখের দিকে চেয়ে চমকে উঠল। ওর এমন বিবর্ণ, রুগ্ন মূর্তি কখনো দেখে নি। সেই বিপ্রদাসের সঙ্গে এই বিপ্রদাসের যেন, কত যুগের তফাত। দাদার পায়ের তলায় মাথা রেখে কুমু কাঁদতে লাগল।

 “কুমু যে, এসেছিস? আয় এইখানে আয়।” বলে বিপ্রদাস তাকে পাশে টেনে নিয়ে এল। যদিও চিঠিতে বিপ্রদাস তাকে আসতে একরকম বারণ করেছিল তবু তার মনে আশা ছিল যে কুমু আসবে। আসতে পেরেছে দেখে ওর মনে হল, তবে হয়তো কোনো বাধা নেই। তবে কুমুর পক্ষে তার ঘরকন্না সহজ হয়ে গেছে। এদের পক্ষ থেকেই কুমুকে আনবার জন্যে প্রস্তাব, পালকি ও লোক পাঠানোই নিয়ম— কিন্তু তা না হওয়া সত্ত্বেও কুমু এল এটাতে ওর যতটা স্বাধীনতা কল্পনা করে নিলে ততটা মধুসূদনের ঘরে বিপ্রদাস একেবারেই প্রত্যাশা করে নি।

 কুমু তার দুই হাত দিয়ে বিপ্রদাসের আলুথালু চুল একটু পরিপাটি করতে করতে বললে, “দাদা, তোমার এ কী চেহারা হয়েছে।”

 “আমার চেহারা ভালো হবার মতো ইদানীং তো কোনো ঘটনা ঘটে নি— কিন্তু তোর এ কী রকম শ্রী! ফ্যাকাশে হয়ে গেছিস যে।”

 ইতিমধ্যে খবর পেয়ে ক্ষেমা পিসি এসে উপস্থিত। সেই সঙ্গে দরজার কাছে একদল দাসী-চাকর ভিড় করে জমা হল। ক্ষেপিসিকে প্রণাম করতেই পিসি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলে। দাসদাসীরা এসে প্রণাম করলে। সকলের সঙ্গে কুশলসম্ভাষণ হয়ে গেলে পর কুমু বললে, “পিসি, দাদার চেহারা বড়ো খারাপ হয়ে গেছে।”

 “সাধে হয়েছে। তোমার হাতের সেবা না পেলে ওর দেহ যে কিছুতেই ভালো হতে চায় না। কতদিনের অভ্যেস।” বিপ্রদাস বললে, “পিসি, কুমুকে খেতে বলবে না?”

 “খাবে না তো কী। সেও কি বলতে হবে? ওদের পালকির বেহারা-দরোয়ান সবাইকে বসিয়ে এসেছি, তাদের খাইয়ে দিয়ে আসি গে। তোমরা দুজনে এখন গল্প করো, আমি চললুম।”

 বিপ্রদাস ক্ষেমাপিসিকে ইশারা করে কাছে ডেকে কানে কানে কিছু বলে দিলে। কুমু বুঝলে, ওদের বাড়ির লোেকদের কী ভাবে বিদায় করতে হবে তারই পরামর্শ। এই পরামর্শের মধ্যে কুমু আজ অপর পক্ষ হয়ে উঠেছে। ওর কোনো মত নেই। এটা ওর একটুও ভালো লাগল না। কুমুও তার শোধ তুলতে বসল। এ-বাড়িতে তার চিরকালের স্থান ফিরে দখলের কাজ শুরু করে দিলে।

 প্রথমত, দাদার খানসামা গোকুলকে ফিস ফিস করে কী একটা হুকুম করলে, তার পরে লাগল নিজের মনের মতো করে ঘর গোছাতে। বাইরের বারান্দায় সরিয়ে দিলে পিরিচ, পেয়ালা, ল্যাম্প, খালি সোড়া-ওআটারের বোতল, একখানা বেত-ছেঁড়া চৌকি, গোটাকতক ময়লা তোয়ালে এবং গেঞ্জি। শেলফের উপর বইগুলো ঠিকমতো সাজালে, দাদার হাতের কাছাকাছি একখানি টিপাই সরিয়ে এনে তার উপরে গুছিয়ে রাখলে পড়বার বই, কলমদান, ব্লটিংপ্যাড, খাবার জলের কাঁচের সোরাই আর গেলাস, ছোটো একটি আয়না এবং চিরুনি-ব্রুশ।

 ইতিমধ্যে গোকুল একটা পিতলের জগে গরম জল, একটা পিতলের চিলেমচি, আর সাফ তোয়ালে বেতের মোড়ার উপর এনে রাখলে। কিছুমাত্র সম্মতির অপেক্ষা না রেখে কুমু গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে বিপ্রদাসের মুখ-হাত মুছিয়ে দিয়ে তার চুল আঁচড়িয়ে দিলে, বিপ্রদাস শিশুর মতো চুপ করে সহ্য করল। কখন কী ওষুধ খাওয়াতে হবে এবং পথ্যের নিয়ম কী সমস্ত জেনে নিয়ে এমন ভাবে গুছিয়ে বসল যেন ওর জীবনে আর কোথাও কোনো দায়িত্ব নেই।

 বিপ্রদাস মনে মনে ভাবতে লাগল এর অর্থটা কী? ভেবেছিল, দেখা করতে এসেছে আবার চলে যাবে, কিন্তু সে-রকম ভাব তো নয়। শ্বশুরবাড়িতে কুমুর সম্বন্ধটা কী রকম দাঁড়িয়েছে সেটা বিপ্রদাস জানতে চায়, কিন্তু স্পষ্ট করে প্রশ্ন করতে সংকোচ বোধ করে। কুমুর নিজের মুখ থেকেই শুনবে এই আশা করে রইল। কেবল আস্তে আস্তে একবার জিজ্ঞাসা করলে, “আজ তোকে কখন যেতে হবে?”

 কুমু বললে, “আজ যেতে হবে না।”

 বিপ্রদাস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এতে তোর শ্বশুরবাড়িতে কোনো আপত্তি নেই?”

 “না, আমার স্বামীর সম্মতি আছে।”

 বিপ্রদাস চুপ করে রইল। কুমু ঘরের কোণের টেবিলটাতে একটা চাদর বিছিয়ে দিয়ে তার উপর ওষুধের শিশি বোতল প্রভৃতি গুছিয়ে রাখতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “তোকে কি তবে কাল যেতে হবে?”

 “না, এখন আমি কিছুদিন তোমার কাছে থাকব।”

 টম কুকুরটা কৌচের নীচে শান্ত হয়ে নিদ্রার সাধনায় নিযুক্ত ছিল, কুমু তাকে আদর করে তার প্রীতি-উচ্ছ্বাসকে অসংযত করে তুললে। সে লাফিয়ে উঠে কুমুর কোলের উপরে দুই পা তুলে কলভাষায় উচ্চস্বরে আলাপ আরম্ভ করে দিলে। বিপ্রদাস বুঝতে পারলে কুমু হঠাৎ এই গোলমালটা সৃষ্টি করে তার পিছনে একটু আড়াল করলে আপনাকে।

 খানিক বাদে কুকুরের সঙ্গে খেলা বন্ধ করে কুমু মুখ তুলে বললে, “দাদা, তোমার বার্লি খাবার সময় হয়েছে, এনে দিই।”

 “না, সময় হয় নি” বলে কুমুকে ইশারা করে বিছানার পাশের চৌকিতে বসালে। আপনার হাতে তার হাত তুলে নিয়ে বললে, “কুমু, আমার কাছে খুলে বল্, কী রকম চলছে তোদের।”

 তখনই কুমু কিছু বলতে পারলে না। মাথা নিচু করে বসে রইল, দেখতে দেখতে মুখ হল লাল, শিশুকালের মতো করে বিপ্রদাসের প্রশস্ত বুকের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল; বললে, “দাদা, আমি সবই ভুল বুঝেছি, আমি কিছুই জানতুম না।”

 বিপ্রদাস আস্তে আস্তে কুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। খানিক বাদে বললে, “আমি তোকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারি নি। মা থাকলে তোকে তোর শ্বশুরবাড়ির জন্যে প্রস্তুত করে দিতে পারতেন।”

 কুমু বললে, “আমি বরাবর কেবল তোমাদেরই জানি, এখান থেকে অন্য জায়গা যে এত বেশি তফাত তা আমি মনে করতে পারতুম না। ছেলেবেলা থেকে আমি যা-কিছু কল্পনা করেছি সব তোমাদেরই ছাঁচে। তাই মনে একটুও ভয় হয় নি। মাকে অনেক সময় বাবা কষ্ট দিয়েছেন জানি, কিন্তু সে ছিল দুরন্তপনা, তার আঘাত বাইরে, ভিতরে নয়। এখানে সমস্তটাই অন্তরে অন্তরে আমার যেন অপমান।”

 বিপ্রদাস কোনো কথা না বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। মধুসূদন যে ওদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক জগতের মানুষ তা সেই বিবাহ-অনুষ্ঠানের আরম্ভ থেকেই বুঝতে পেরেছে। তারই বিষম উদ্বেগে ওর শরীর যেন কোনোমতেই সুস্থ হয়ে উঠছে না। এই দিঙ্‌নাগের স্থূলহস্তাবলেপ থেকে কুমুকে উদ্ধার করবার তো কোনো উপায় নেই। সকলের চেয়ে মুশকিল এই যে, এই মানুষের কাছে ঋণে ওর সমস্ত সম্পত্তি বাধা। এই অপমানিত সম্বন্ধের ধাক্কা যে কুমুকেও লাগছে। এতদিন রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে বিপ্রদাস কেবলই ভেবেছে মধুসূদনের এই ঋণের বন্ধন থেকে কেমন করে সে নিষ্কৃতি পাবে। ওর কলকাতায় আসবার ইচ্ছে ছিল না, পাছে কুমুর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ওদের সহজ ব্যবহার অসম্ভব হয়। কুমুর উপর ওর যে স্বাভাবিক স্নেহের অধিকার আছে, পাছে তা পদে পদে লাঞ্ছিত হতে থাকে, তাই ঠিক করেছিল, নুরনগরেই বাস করবে। কলকাতায় আসতে বাধ্য হয়েছে অন্য কোনো মহাজনের কাছ থেকে ধার নেবার ব্যবস্থা করবে বলে। জানে যে এটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য, তাই এর দুশ্চিন্তার বোঝা ওর বুকের উপর চেপে বসে আছে।

 খানিক বাদে কুমু বিপ্রদাসের থেকে অন্যদিকে ঘাড় একটু বেঁকিয়ে বললে, “আচ্ছা দাদা, স্বামীর ’পরে কোনোমতে মন প্রসন্ন করতে পারছি নে, এটা কি আমার পাপ?”

 “কুমু, তুই তো জানিস, পাপপুণ্য সম্বন্ধে আমার মতামত শাস্ত্রের সঙ্গে মেলে না।”

 অন্যমনস্কভাবে কুমু একটা ছবিওআলা ইংরেজি মাসিক পত্রের পাতা ওলটাতে লাগল। বিপ্রদাস বললে, “ভিন্ন ভিন্ন মানুষের জীবন তার ঘটনায় ও অবস্থায় এতই ভিন্ন হতে পারে যে, ভালোমন্দর সাধারণ নিয়ম অত্যন্ত পাকা করে বেঁধে দিলে অনেক সময়ে সেটা নিয়মই হয়, ধর্ম হয় না।”

 কুমু মাসিক পত্রটার দিকে চোখ নিচু করে বললে, “যেমন মীরাবাইএর জীবন।”

 নিজের মধ্যে কর্তব্য-অকর্তব্যের দ্বন্দ্ব যখনই কঠিন হয়ে উঠেছে, কুমু তখনই ভেবেছে মীরাবাইএর কথা। একান্ত মনে ইচ্ছা করেছে কেউ ওকে মীরাবাইএর আদর্শটা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়।

 কুমু একটু চেষ্টা করে সংকোচ কাটিয়ে বলতে লাগল, “মীরাবাই আপনার যথার্থ স্বামীকে অন্তরের মধ্যে পেয়েছিলেন বলেই সমাজের স্বামীকে মন থেকে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু সংসারকে ছাড়বার সেই বড়ো অধিকার কি আমার আছে?”

 বিপ্রদাস বললে, “কুমু, তোর ঠাকুরকে তুই তো সমস্ত মন দিয়েই পেয়েছিস।”

 “এক সময়ে তাই মনে করেছিলুম। কিন্তু যখন সংকটে পড়লুম তখন দেখি, প্রাণ আমার কেমন শুকিয়ে গেছে, এত চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতে তাঁকে যেন আমার কাছে সত্য করে তুলতে পারছি নে। আমার সব চেয়ে দুঃখ সেই।”

 “কুমু, মনের মধ্যে জোয়ার-ভাঁটা খেলে। কিছু ভয় করিস নে; রাত্তির মাঝে মাঝে আসে, দিন তা বলে তো মরে না। যা পেয়েছিস, তোর প্রাণের সঙ্গে তা এক হয়ে গেছে।”

 “সেই আশীর্বাদ করো, তাঁকে যেন না হারাই। নির্দয় তিনি দুঃখ দেন, নিজেকে দেবেন বলেই। দাদা, আমার জন্যে ভাবিয়ে আমি তোমাকে ক্লান্ত করছি।”

 “কুমু, তোর শিশুকাল থেকে তোর জন্যে ভাবা যে আমার অভ্যেস। আজ যদি তোর কথা জানা বন্ধ হয়ে যায়, তোর জন্যে ভাবতে না পাই, তা হলে শূন্য ঠেকে। সেই শূন্যতা হাতড়াতে গিয়েই তো মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।”

 কুমু বিপ্রদাসের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, “আমার জন্যে তুমি কিন্তু কিছু ভেবো না, দাদা। আমাকে যিনি রক্ষা করবেন তিনি ভিতরেই আছেন, আমার বিপদ নেই।”

 “আচ্ছা, থাক্ ওসব কথা। তোকে যেমন গান শেখাতুম, ইচ্ছে করছে তেমনি করে আজ তোকে শেখাই।”

 “ভাগ্যি শিখিয়েছিলে দাদা, ওতেই আমাকে বাঁচায়। কিন্তু আজ নয়, তুমি আগে একটু জোর পাও। আজ আমি বরঞ্চ তোমাকে একটা গান শোনাই।”

 দাদার শিয়রের কাছে বসে কুমু আস্তে আস্তে গাইতে লাগল,

“পিয়া ঘর আয়ে, সোহী পীতম পিয় পারে রে।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর,
চরণকমল বলিহার রে।”

 বিপ্রদাস চোখ বুজে শুনতে লাগল। গাইতে গাইতে কুমুর দুই চক্ষু ভরে উঠল এক অপরূপ দর্শনে। ভিতরের আকাশ আলো হয়ে উঠল। প্রিয়তম ঘরে এসেছেন, চরণকমল বুকের মধ্যে ছুঁতে পাচ্ছে। অত্যন্ত সত্য হয়ে উঠল অন্তরলোক, যেখানে মিলন ঘটে। গান গাইতে গাইতে ও সেইখানে পৌঁচেছে। “চরণকমল বলিহার রে”—সমস্ত জীবন ভরে দিলে সেই চরণকমল, অন্ত নেই তাঁর—সংসারে দুঃখ-অপমানের জায়গা রইল কোথায়? “পিয়া ঘর আয়ে” তার বেশি আর কী চাই। এই গান কোনোদিন যদি শেষ না নয় তা হলে তো চিরকালের মতো রক্ষা পেয়ে গেল কুমু।

 কিছু রুটি-টোস্ট আর এক পেয়ালা বার্লি গোকুল টিপাইএর উপর রেখে দিয়ে গেল। কুমু গান থামিয়ে বললে, “দাদা, কিছুদিন আগে মনে-মনে গুরু খুঁজছিলুম, আমার দরকার কী? তুমি যে আমাকে গানের মন্ত্র দিয়েছ।”

 “কুমু, আমাকে লজ্জা দিস নে। আমার মতো গুরু রাস্তায় ঘাটে মেলে, তারা অন্যকে যে-মন্ত্র দেয় নিজে তার মানেই জানে না। কুমু, কতদিন এখানে থাকতে পারবি ঠিক করে বল্ দেখি।”

 “যতদিন না ডাক পড়ে।”

 “তুই এখানে আসতে চেয়েছিলি?”

 “না, আমি চাই নি।”

 “এর মানে কী?”

 “মানের কথা ভেবে লাভ নেই দাদা। চেষ্টা করলেও বুঝতে পারব না। তোমার কাছে আসতে পেরেছি এই যথেষ্ট। যতদিন থাকতে পারি সেই ভালো। দাদা, তোমার খাওয়া হচ্ছে না, খেয়ে নাও।”

 চাকর এসে খবর দিলে মুখুজ্যেমশায় এসেছেন। বিপ্রদাস একটু যেন ব্যস্ত হয়ে উঠে বললে, “ডেকে দাও।”