যোগাযোগ/৫২
৫২
মােতির মা জিজ্ঞাসা করলে, “কিছু খবর আছে বুঝি?”
“আছে। দেরি করতে পারলুম না, তােমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এলুম। তুমি তাে চলে এলে, তার পরে দাদা হঠাৎ আমার ঘরে এসে উপস্থিত। মেজাজটা খুবই খারাপ। সামান্য দামের একটা গিল্টি করা চুরোটের ছাইদান টেবিল থেকে অদৃশ্য হয়েছে। সম্প্রতি যাঁর অধিকারে সেটা এসেছে তিনি নিশ্চয়ই সেটাকে সোনা বলে ঠাউরেছেন, নইলে পরকাল খোয়াতে যাবেন কোন্ সাধে। জান তো তুচ্ছ একটা জিনিস নড়ে গেলে দাদার বিপুল সম্পত্তির ভিতটাতে যেন নাড়া লাগে, সে তিনি সইতে পারেন না। আজ সকালে আপিসে যাবার সময় আমাকে বলে গেলেন শ্যামকে দেশে পাঠাতে। আমি খুব উৎসাহের সঙ্গেই সেই পবিত্র কাজে লেগেছিলুম। ঠিক করেছিলুম তিনি আপিস থেকে ফেরবার আগেই কাজ সেরে রাখব। এমন সময়ে বেলা দেড়টার সময় হঠাৎ দাদা এক দমে আমার ঘরে এসে ঢুকে পড়লেন; বললেন, ‘এখনকার মতো থাক্।’ যেই ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছেন, আমার ডেস্কের উপর বউরানীর সেই ছবিটি চোখে পড়ল। থমকে গেলেন। বুঝলুম আড়-চাহনিটাকে সিধে করে নিয়ে ছবিটিকে দেখতে দাদার লজ্জা বোধ হচ্ছে। বললুম, ‘দাদা, একটু ব’সো, একটা ঢাকাই কাপড় তোমাকে দেখাতে চাই। মোতির মার ছোটো ভাজের সাধ, তাই তাকে দিতে হবে। কিন্তু গণেশরাম দামে আমাকে ঠকাচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে। তোমাকে দিয়ে সেটা একবার দেখিয়ে নিতে চাই। আমার যতটা আন্দাজ তাতে মনে হয় না তো তেরো টাকা তার দাম হতে পারে। খুব বেশি হয় তো ন-টাকা সাড়ে ন-টাকার মধ্যেই হওয়া উচিত।
মোতির মা অবাক হয়ে বললে, “ও আবার তোমার মাথায় কোথা থেকে এল? আমার ছোটো ভাজের সাধ হবার কোনো উপায়ই নেই। তার কোলের ছেলেটির বয়স তো সবে দেড় মাস। বানিয়ে বলতে তোমার আজকাল দেখছি কিছুই বাধে না। এই তোমার নতুন বিদ্যে পেলে কোথায়?”
“যেখান থেকে কালিদাস তাঁর কবিত্ব পেয়েছেন, বাণী বীণাপাণির কাছ থেকে।”
“বীণাপাণি তোমাকে যতক্ষণ না ছাড়েন ততক্ষণ তোমাকে নিয়ে ঘর করা যে দায় হবে।”
“পণ করেছি, স্বর্গারোহণকালে নরকদর্শন করে যাব, বউরানীর চরণে এই আমার দান।”
“কিন্তু সাড়ে ন-টাকা দামের ঢাকাই কাপড় তখন-তখনই তোমার জুটল কোথায়?”
“কোথাও না। কুড়ি মিনিট পরে ফিরে এসে বললুম, ‘গণেশরাম সে-কাপড় আমাকে না বলেই ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।’ দাদার মুখ দেখে বুঝলুম, ইতিমধ্যে ছবিটা তাঁর মগজের মধ্যে ঢুকে স্বপ্নের রূপ ধরেছে। কী জানি কেন, পৃথিবীতে আমারই কাছে দাদার একটু আছে চক্ষুলজ্জা, আর কারও হলে ছবিটা ধাঁ করে তুলে নিতে তাঁর বাধত না।”
“তুমিও তো লোভী কম নয়। দাদাকে না-হয় সেটা দিতেই।”
“তা দিয়েছি, কিন্তু সহজ মনে দিই নি। বললেম, “দাদা, এই ছবিটা থেকে একটা অয়েলপেণ্টিং করিয়ে নিয়ে তোমার শোবার ঘরে রেখে দিলে হয় না? দাদা যেন উদাসীনভাবে বললে, ‘আচ্ছা, দেখা যাবে।’ বলেই। ছবিটা নিয়ে উপরের ঘরে চলে গেল। তার পরে কী হল ঠিক জানি নে। বোধ করি আপিসে যাওয়া হয় নি, আর ওই ছবিটাও ফিরে পাবার আশা রাখি নে।”
“তোমার বউরানীর জন্যে স্বর্গটাই খোয়াতে যখন রাজি আছ, তখন না-হয় একখানা ছবিই বা খোয়ালে।”
“স্বর্গটা সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, ছবিটা সম্বন্ধে একটুও সন্দেহ ছিল না। এমন ছবি দৈবাৎ হয়। যে-দুর্লভ লগ্নে ওঁর মুখটিতে লক্ষ্মীর প্রসাদ সম্পূর্ণ নেমেছিল ঠিক সেই শুভযোগটি ওই ছবিতে ধরা পড়ে গেছে। একএকদিন রাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে ওই ছবিটি দেখেছি। প্রদীপের আলোয় ওর ভিতরকার রূপটি যেন আরও বেশি করে দেখা যায়।”
“দেখো, আমার কাছে অত বাড়াবাড়ি করতে তোমার একটুও ভয় নেই?”
“ভয় যদি থাকত তাহলেই তোমার ভাবনার কথাও থাকত। ওঁকে দেখে আমার আশ্চর্য কিছুতে ভাঙে না। মনে করি আমাদের ভাগ্যে এটা সম্ভব হল কী করে? আমি যে ওঁকে বউরানী বলতে পারছি এ ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। আর উনি যে সামান্য নবীনের মতো মানুষকেও হাসিমুখে কাছে বসিয়ে খাওয়াতে পারেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এও এত সহজ হল কী করে? আমাদের পরিবারের মধ্যে সব চেয়ে হতভাগ্য আমার দাদা। যাকে সহজে পেলেন তাকে কঠিন করে বাঁধতে গিয়েই হারালেন।”
“বাস্ রে, বউরানীর কথায় তোমার মুখ যখন খুলে যায় তখন থামতে চায় না।”
“মেজোবউ, জানি, তোমার মনে একটুখানি বাজে।”
“না, কক্খনো না।”
“হাঁ, অল্প একটু। কিন্তু এই উপলক্ষ্যে একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। নুরনগরে স্টেশনে প্রথম বউরানীর দাদাকে দেখে যে-সব কথা বলেছিলে চলতি ভাষায় তাকে ও বাড়াবাড়ি বলা চলে।”
“আচ্ছা আচ্ছ, ও-সব তর্ক থাক্, এখন কী বলতে চাচ্ছিলে বলো।”
“আমার বিশ্বাস, আজকালের মধ্যেই দাদা বউরানীকে ডেকে পাঠাবেন। বউরানী যে এত আগ্রহে বাপের বাড়ি চলে এলেন, আর তার পর থেকে এতদিন ফেরবার নাম নেই, এতে দাদার প্রচণ্ড অভিমান হয়েছে তা জানি। দাদা কিছুতেই বুঝতে পারেন না সোনার খাঁচাতে পাখির কেন লোভ নেই। নির্বোধ পাখি, অকৃতজ্ঞ পাখি।”
“তা ভালোই তো, বড়ঠাকুর ডেকেই পাঠান না। সেই কথাই তো ছিল।”
“আমার মনে হয়, ডাকবার আগেই বউরানী যদি যান ভালো হয়, দাদার ওইটুকু অভিমানের না-হয় জিত রইল। তা ছাড়া বিপ্রদাসবাবু তো চান বউরানী তাঁর সংসারে ফিরে যান, আমিই নিষেধ করেছিলুম।”
বিপ্রদাসের সঙ্গে এই নিয়ে আজ কী কথা হয়েছে মোতির মা তার কোনো আভাস দিলে না। বললে, “বিপ্রদাসবাবুর কাছে গিয়ে বলোই না।”
“তাই যাই, তিনি শুনলে খুশি হবেন।”
এমন সময় কুমু দরজার বাইরে থেকে বললে, “ঘরে ঢুকব কী?”
মোতির মা বললে, “তোমার ঠাকুরপো পথ চেয়ে আছেন।”
“জন্ম-জন্ম পথ চেয়ে ছিলুম, এইবার দর্শন পেলুম।”
“আঃ ঠাকুরপো, এত কথা তুমি বানিয়ে বলতে পার কী করে?”
“নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই, বুঝতে পারি নে।”
“আচ্ছা, চলো এখন খেতে যাবে।”
“খাবার আগে একবার তোমার দাদার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা কয়ে আসি গে।”
“না, সে হবে না।”
“কেন?”
“আজ দাদা অনেক কথা বলেছেন, আজ আর নয়।”
“ভালো খবর আছে।”
“তা হোক, কাল এসো বরঞ্চ। আজ কোনো কথা নয়।”
“কাল হয়তো ছুটি পাব না, হয়তো বাধা ঘটবে। দোহাই তোমার, আজ একবার কেবল পাঁচ মিনিটের জন্যে। তোমার দাদা খুশি হবেন, কোনো ক্ষতি হবে না-তাঁর।”
“আচ্ছা, আগে তুমি খেয়ে নাও, তার পরে হবে।”
খাওয়া হয়ে গেলে পর কুমু নবীনকে বিপ্রদাসের ঘরে নিয়ে এল। দেখলে দাদা তখনো ঘুমোয় নি। ঘর প্রায় অন্ধকার, আলোর শিখা ম্লান। খোলা জানলা দিয়ে তারা দেখা যায়। থেকে থেকে হু হু করে বইছে দক্ষিণের হাওয়া; ঘরের পর্দা, বিছানার ঝালর, আলনায় ঝোলানো বিপ্রদাসের কাপড় নানারকম ছায়া বিস্তার করে কেঁপে কেঁপে উঠছে, মেজের উপর খবরের কাগজের একটা পাতা যখন-তখন এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে। আধ-শোওয়া অবস্থায় বিপ্রদাস স্থির হয়ে বসে। এগোতে নবীনের পা সরে না। প্রদোষের ছায়া আর রোগের শীর্ণতা বিপ্রদাসকে একটা আবরণ দিয়েছে, মনে হচ্ছে ও যেন সংসার থেকে অনেক দূর, যেন অন্য লোকে। মনে হল ওর মতো এমনতরো একলা মানুষ আর জগতে নেই।
নবীন এসে বিপ্রদাসের পায়ের ধুলো নিয়ে বললে, “বিশ্রামে ব্যাঘাত করতে চাই নে। একটি কথা বলে যাব। সময় হয়েছে, এইবার বউরানী ঘরে ফিরে আসবেন বলে আমরা চেয়ে আছি।”
বিপ্রদাস কোনো উত্তর করলে না, স্থির হয়ে বসে রইল।
খানিক পরে নবীন বললে, “আপনার অনুমতি পেলেই ওঁকে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করি।”
ইতিমধ্যে কুমু ধীরে ধীরে দাদার পায়ের কাছে এসে বসেছে। বিপ্রদাস তার মুখের উপর দৃষ্টি রেখে বললে, “মনে যদি করিস তোর যাবার সময় হয়েছে তা হলে যা কুমু।” .
কুমু বললে, “না দাদা, যাব না।” বলে বিপ্রদাসের হাঁটুর উপর উপুড় হয়ে পড়ল।
ঘর স্তব্ধ, কেবল থেকে থেকে দমকা বাতাসে একটা শিথিল জানলা খড়্ খড়্ করছে, আর বাইরে বাগানে গাছের পাতাগুলো মর্মরিয়ে উঠছে।
কুমু একটু পরে বিছানা থেকে উঠেই নবীনকে বললে, “চলো, আর দেরি নয়। দাদা, তুমি ঘুমোও।”
মোতির মা বাড়িতে ফিরে এসে বললে, “এতটা কিন্তু ভালো না।”
“অর্থাৎ চোখে খোঁচা দেওয়াটা যেমনি হোক না, চোখটা রাঙা হয়ে ওঠা একেবারেই ভালো নয়।”
“না গো না, ওটা ওঁদের দেমাক। সংসারে ওঁদের যোগ্য কিছুই মেলে না, ওঁরা সবার উপরে।”
“মেজোবউ, এতবড়ো দেমাক সবাইকে সাজে না, কিন্তু ওঁদের কথা আলাদা।”
“তাই বলে কি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি করতে হবে?”
“আত্মীয়স্বজন বললেই আত্মীয়স্বজন হয় না। ওঁরা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক শ্রেণীর মানুষ। সম্পর্ক ধরে ওঁদের সঙ্গে ব্যবহার করতে আমার সংকোচ হয়।”
“যিনি যতবড়ো লোকই হোন না কেন, তবু সম্পর্কের জোর আছে এটা মনে রেখো।”
নবীন বুঝতে পারলে, এই আলোচনার মধ্যে কুমুর ’পরে মোতির মার একটুখানি ঈর্ষার ঝাঁজও আছে। তা ছাড়া এটাও সত্যি, পারিবারিক বাঁধনটার দাম মেয়েদের কাছে খুবই বেশি। তাই নবীন এ নিয়ে বৃথা তর্ক না করে বললে, “আর কিছুদিন দেখাই যাক না। দাদার আগ্রহটাও একটু বেড়ে উঠুক, তাতে ক্ষতি হবে না।”