◄  ৫৬
৫৮  ►

৫৭

 খবরটা বিপ্রদাসের কানে গেল। দাই এল, সন্দেহ রইল না যে কুমুর গর্ভাবস্থা। মধুসূদনের কানেও সংবাদ পৌচেছে। মধুসূদন ধন চেয়েছিল, ধন পুরো পরিমাণেই জমেছে, ধনের উপযুক্ত খেতাবও মিলেছে, এখন নিজের মহিমাকে ভাবী বংশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই এ-সংসারে তার কর্তব্য চরম লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছবে। মনটা যতই খুশি হল ততই অপরাধের সমস্ত দায়িত্ব কুমুর উপর থেকে সরিয়ে বোঝাই করলে বিপ্রদাসের উপর। দ্বিতীয় একখানা চিঠি তাকে লিখলে, শুরু করলে whereas দিয়ে, শেষ করলে Your obedient servant মধুসূদন ঘোষাল সই করে। মাঝখানটাতে ছিল I shall have the painful necessity ইত্যাদি। এ-রকম ভয়-দেখানো চিঠিতে চাটুজ্যে-বংশের উপর উলটো ফল ফলে, বিশেষত ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে। বিপ্রদাস চিঠিটা দেখালে কালুকে। তার মুখ লাল হয়ে উঠল। সে বললে, “এ-রকম চিঠিতে আমারই মতো সামান্য লোকের দেহে একেবারে বাদশাহি মাত্রায় রক্ত গরম হয়ে ওঠে। অদৃশ্য কোতোয়াল বেটাকে হাঁক দিয়ে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, শির লেও উসকো।”

 দিনের বেলা নানাপ্রকার লেখাপড়ার কাজ ছিল, সে সমস্ত শেষ করে সন্ধ্যাবেলা বিপ্রদাস কুমুকে ডেকে পাঠালে। কুমু আজ সারাদিন দাদার কাছে আসেই নি। নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

 বিপ্রদাস বিছানা ছেড়ে চৌকিতে উঠে বসল। রোগীর মতো শুয়ে থাকলে মনটা দুর্বল থাকে। সামনের দিকে কুমুর জন্যে একটা ছোটো চৌকি ঠিক করে রেখেছে। আলোটা ঘরের কোণে একটু আড়াল করে রাখা। মাথার উপর বড়ো একটা টানা পাখা হুস হুস করে চলছে। বৈশাখ-শেষের আকাশে তখনো গরম জমে আছে, দক্ষিনে হাওয়া একএকবার অল্প একটু নিশ্বাস ছেড়েই ঘেমে যাচ্ছে, গাছের পাতাগুলো যেন একান্ত কান-পাতা মনোযোগের মতো নিস্তব্ধ। সমুদ্রের মোহানায় গঙ্গা যেখানে নীল জলকে ফিকে করে দিয়েছে, অন্ধকারটা যেন সেইরকম। দীর্ঘবিলম্বিত গোধূলির শেষ আলোটা তখনো তার কালিমার ভিতরে ভিতরে মিশ্রিত। বাগানের পুকুরটা ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে থাকত, কিন্তু খুব একটা জ্বল্‌জ্বলে তারা স্থির প্রতিবিম্ব আকাশের অঙ্গুলি-সংকেতের মতো তাকে নির্দেশ করে দিচ্ছে। গাছতলার নীচে দিয়ে চাকররা ক্ষণে ক্ষণে লণ্ঠন হাতে করে যাতায়াত করছে, আর পেঁচা উঠছে ডেকে।

 কুমু বোধ হয় একটু ইতস্তত করে একটু দেরি করেই এল। বিপ্রদাসের কাছে চৌকিতে বসেই বললে, “দাদা, আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমার যেন কোথায় যেতে ইচ্ছে করছে।”

 বিপ্রদাস বললে, “ভুল বলছিস কুমু, তোর ভালোই লাগবে। আর কিছুদিন পরেই তোর মন উঠবে ভরে।”

 “কিন্তু তা হলে—” বলে কুমু থেমে গেল।

 “তা জানি—এখন তোর বন্ধন কাটাবে কে?”

 “তবে কি যেতে হবে দাদা?”

 “তোকে নিষেধ করতে পারি এমন অধিকার আর আমার নেই। তোর সন্তানকে তার নিজের ঘরছাড়া করব কোন্ স্পর্ধায়?”

 কুমু অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল, বিপ্রদাসও কিছু বললে না।

 অবশেষে খুব মৃদু স্বরে কুমু জিজ্ঞাসা করলে, “তা হলে কবে যেতে হবে?”

 “কালই, আর দেরি সইবে না।”

 “দাদা, একটা কথা বোধ হয় বুঝতে পারছ, এবার গেলে ওরা আমাকে আর কখনো তোমার কাছে আসতে দেবে না।”

 “তা আমি খুবই জানি।”

 “আচ্ছা, তাই হবে। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলে রাখি, কোনো দিন কোনো কারণেই তুমি ওদের বাড়ি যেতে পারবে না। জানি দাদা, তোমাকে দেখবার জন্যে আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠবে, কিন্তু ওদের ওখানে যেন কখনো তোমাকে না দেখতে হয়। সে আমি সইতে পারব না।”

 “না কুমু, সে জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না।”

 “ওরা কিন্তু তোমাকে বিপদে ফেলবার চেষ্টা করবে।”

 “ওরা যা করতে পারে তা করা শেষ হলেই আমার উপর ওদের ক্ষমতাও শেষ হবে। তখনই আমি হব স্বাধীন। তাকে তুই বিপদ বলছিস কেন?”

 “দাদা, সেইদিন তুমিও আমাকে স্বাধীন করে নিয়ো। ততদিনে ওদের ছেলেকে আমি ওদের হাতে দিয়ে যাব। এমন কিছু আছে যা ছেলের জন্যেও খোওয়ানো যায় না।”

 “আচ্ছা, আগে হোক ছেলে, তার পরে বলিস।”

 “তুমি বিশ্বাস করছ না, কিন্তু মার কথা মনে আছে তো? তাঁর তো হয়েছিল ইচ্ছামৃত্যু। সেদিন সংসারে তিনি তাঁর জায়গাটি পাচ্ছিলেন না, তাই তাঁর ছেলেমেয়েদেরকে অনায়াসে ফেলে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মানুষ যখন মুক্তি চায় তখন কিছুতেই তাকে ঠেকাতে পারে না। আমি তোমারই বোন, দাদা, আমি মুক্তি চাই। একদিন যেদিন বাঁধন কাটব, মা সেদিন আমাকে আশীর্বাদ করবেন, এই আমি তোমাকে বলে রাখলুম।”

 আবার অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে রইল। হঠাৎ হু হু করে বাতাস উঠল, টিপায়ের উপর বিপ্রদাসের পড়বার বইটার পাতাগুলো ফর্ ফর্ করে উলটে যেতে লাগল। বাগান থেকে বেলফুলের গন্ধে ঘর গেল ভরে।

 কুমু বললে, “আমাকে ওরা ইচ্ছে করে দুঃখ দিয়েছে তা মনে কোরো না। আমাকে সুখ ওরা দিতে পারে না আমি এমনি করেই তৈরি। আমিও তো ওদের পারব না সুখী করতে। যারা সহজে ওদের সুখী করতে পারে তাদের জায়গা জুড়ে কেবল একটা-না-একটা মুশকিল বাধবে। তা হলে কেন এ বিড়ম্বনা! সমাজের কাছ থেকে অপরাধের সমস্ত লাঞ্ছনা আমিই একলা মেনে নেব, ওদের গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগবে না। কিন্তু একদিন ওদেরকে মুক্তি দেব, আমিও মুক্তি নেব; চলে আসবই, এ তুমি দেখে নিয়ো। মিথ্যে হয়ে মিথ্যের মধ্যে থাকতে পারব না। আমি ওদের বড়োবউ, তার কি কোনো মানে আছে যদি আমি কুমু না হই? দাদা, তুমি ঠাকুর বিশ্বাস কর না, আমি বিশ্বাস করি। তিন মাস আগে যে-রকম করে করতুম, আজ তার চেয়ে বেশি করেই করি। আজ সমস্ত দিন ধরেই এই কথা ভাবছি যে, চারি দিকে এত এলোমেলো, এত উলটোপালটা, তবু এই জঞ্জালে একেবারে ঢেকে ফেলে নি জগৎটাকে। এ-সমস্তকে ছাড়িয়ে গিয়েও চন্দ্রসূর্যকে নিয়ে সংসারের কাজ চলছে, সেই যেখানে ছাড়িয়ে গেছে সেইখানে আছে বৈকুণ্ঠ, সেইখানে আছেন আমার ঠাকুর। তোমার কাছে এ-সব কথা বলতে লজ্জা করে—কিন্তু আর তো কখনো বলা হবে না, আজ বলে যাই। নইলে আমার জন্যে মিছিমিছি ভাববে। সমস্ত গিয়েও তবু বাকি থাকে, এই কথাটা বুঝতে পেরেছি; সেই আমার অফুরান, সেই আমার ঠাকুর। এ যদি না বুঝতুম তা হলে এইখানে তোমার পায়ে মাথা ঠুকে মরতুম, সে-গারদে ঢুকতুম না। দাদা, এ-সংসারে তুমি আমার আছ বলেই তবে এ-কথা বুঝতে পেরেছি।” এই বলেই কুমু চৌকি থেকে নেবে দাদার পায়ের উপর মাথা রেখে পড়ে রইল। রাত বেড়ে চলল, বিপ্রদাস জানলার বাইরে অনিমেষ দৃষ্টি মেলে ভাবতে লাগল।