মুকুন্দলাল, যেন মাস্তুল-ভাঙা, পাল-ছেঁড়া, টোল-খাওয়া, তুফানে আছাড়-লাগা জাহাজ, সসংকোচে বন্দরে এসে ভিড়লেন। অপরাধের বােঝায় বুক ভারি। প্রমােদের স্মৃতিটা যেন অতিভােজনের পরের উচ্ছিষ্টের মতাে মনটাকে বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছে। যারা ছিল তাঁর এই আমােদের উৎসাহদাতা উদ্‌যোগকর্তা, তারা যদি সামনে থাকত তাহলে তাদের ধরে চাবুক কষিয়ে দিতে পারতেন। মনে-মনে পণ করছেন, আর কখনাে এমন হতে দেবেন না। তাঁর আলুথালু চুল, রক্তবর্ণ চোখ আর মুখের অতিশুষ্ক ভাব দেখে প্রথমটা কেউ সাহস করে কর্ত্রীঠাকরুনের খবরটা দিতে পারলে না; মুকুন্দলাল ভয়ে-ভয়ে অন্তঃপুরে গেলেন। “বড়োবউ, মাপ করো, অপরাধ করেছি, আর-কখনাে এমন হবে না” এই কথা মনে মনে বলতে বলতে শােবার ঘরের দরজার কাছে একটুখানি থমকে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলেন। মনে-মনে নিশ্চয় স্থির করেছিলেন যে, অভিমানিনী বিছানায় পড়ে আছেন। একেবারে পায়ের কাছে গিয়ে পড়বেন, এই ভেবে ঘরে ঢুকেই দেখলেন ঘর শূন্য। বুকের ভিতরটা দমে গেল। শােবার ঘরে বিছানায় নন্দরানীকে যদি দেখতেন তবে বুঝতেন যে, অপরাধ ক্ষমা করবার জন্যে মানিনী অর্ধেক রাস্তা এগিয়ে আছেন। কিন্তু বড়ােবউ যখন শােবার ঘরে নেই তখন মুকুন্দলাল বুঝলেন তাঁর প্রায়শ্চিত্তটা হবে দীর্ঘ এবং কঠিন। হয়তাে আজ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, কিংবা হবে আরও দেরি। কিন্তু এতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। সম্পূর্ণ শাস্তি এখনই মাথা পেতে নিয়ে ক্ষমা আদায় করবেন, নইলে জলগ্রহণ করবেন না। বেলা হয়েছে, এখনও স্নানাহার হয় নি, এ দেখে কি সাধ্বী থাকতে পারবেন? শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, প্যারী দাসী বারান্দার এক কোণে মাথায় ঘােমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, “তাের বড়ােবউমা কোথায়?”

 সে বললে, “তিনি তাঁর মাকে দেখতে পরশুদিন বৃন্দাবনে গেছেন।”

 ভালাে যেন বুঝতে পারলেন না, রুদ্ধকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় গেছেন?”

 “বৃন্দাবনে। মায়ের অসুখ।”

 মুকুন্দলাল একবার বারান্দার রেলিং চেপে ধরে দাঁড়ালেন। তার পরে দ্রুতপদে বাইরের বৈঠকখানায় গিয়ে একা বসে রইলেন। একটি কথা কইলেন না। কাছে আসতে কারও সাহস হয় না।

 দেওয়ানজি এসে ভয়ে ভয়ে বললেন, “মাঠাকরুনকে আনতে লোক পাঠিয়ে দিই?”

 কোন কথা না বলে কেবল আঙুল নেড়ে নিষেধ করলেন। দেওয়ানজি চলে গেলে রাধু খানসামাকে ডেকে বললেন, “ব্র্যাণ্ডি লে আও।”

 বাড়িসুদ্ধ লোক হতবুদ্ধি। ভূমিকম্প যখন পৃথিবীর গভীর গর্ভ থেকে মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে তখন যেমন তাকে চাপা দেবার চেষ্টা করা মিছে, নিরুপায়ভাবে তার ভাঙাচোরা সহ্য করতেই হয়— এ ও তেমনি।

 দিনরাত চলছে নির্জল ব্র্যাণ্ডি। খাওয়াদাওয়া প্রায় নেই। একে শরীর পূর্ব থেকেই ছিল অবসন্ন, তারপরে এই প্রচণ্ড অনিয়মে বিকারের সঙ্গে রক্তবমন দেখা দিল।

 কলকাতা থেকে ডাক্তার এল— দিনরাত মাথায় বরফ চাপিয়ে রাখলে।

 মুকুন্দলাল যাকে দেখেন খেপে ওঠেন, তাঁর বিশ্বাস তাঁর বিরুদ্ধে বাড়িসুদ্ধ লোকের চক্রান্ত। ভিতরে ভিতরে একটা নালিশ গুমরে উঠছিল— এরা যেতে দিলে কেন?

 একমাত্র মানুষ যে তাঁর কাছে আসতে পারত সে কুমুদিনী। সে এসে পাশে বসে; ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাঁর মুখের দিকে মুকুন্দলাল চেয়ে দেখেন,— যেন মার সঙ্গে ওর চোখে কিংবা কোথাও একটা মিল দেখতে পান। কখনো কখনো বুকের উপরে তার মুখ টেনে নিয়ে চুপ করে চোখ বুজে থাকেন, চোখের কোণ দিয়ে জল পড়তে থাকে, কিন্তু কখনো ভুলে একবার তার মার কথা জিজ্ঞাসা করেন না। এদিকে বৃন্দাবনে টেলিগ্রাম গেছে। কর্ত্রীঠাকরুনের কালই ফেরবার কথা। কিন্তু শোনা গেল কোথায় এক জায়গায় রেলের লাইন গেছে ভেঙে।