যৌবনের বজ্রনির্ঘোষ/অধ্যায়: এক
আমার শৈশব কেটেছিল পুরুলিয়া জেলার আদ্রাতে। সেখানে লেখাপড়ার কোনও প্রচলন ছিল না। মেয়েদের স্কুলে পড়ানো হত ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। ছেলেদের স্কুল থেকে ‘স্কুল ফাইনাল’ দেওয়া যেত।
এ হল গত শতকের পাঁচ-এর দশকের ছবি। ২০১৪-তে এসেও আদ্রার সাংস্কৃতিক মান একটুও বাড়েনি। ছেলে বা মেয়েদের পড়ার কোনও সুযোগই নেই। কারণ, কলেজই নেই।
এখন সাধারণের এন্টারটেইনমেন্ট বলতে মুরগি লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, মোষের লড়াই, জুয়া, নাচনির নাচ, হাঁড়িয়া, তাড়ি ইত্যাদি।
সাধারণ মানুষের জীবিকা বলতে, স্টেশনের পাশে, রাস্তার ফুটপাত দখল করে টিন দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট দোকান। চাষের জমি অফুরন্ত নয়। তবে কিছু জমিতে চাষ হয়। আদ্রার বহু মানুষ রেলে কাজ করেন। কিন্তু ওয়াগন ব্রেকার পেশার মানুষও আছে। হিজড়ে সম্প্রদায়ের আধিপত্য আছে। ওদের জীবিকা বলতে দোকানদারদের থেকে তোলাবাজি। হিজড়েদের দুটো দল আছে। ওদের মধ্যে খুন-খারাপিও লেগে থাকে। হিজড়ে মানে অবশ্য প্রায় সবই মেয়েলি পুরুষ।
এখনও শহর থেকে আদ্রায় এলে একটাও হোটেল পাওয়া যায় না থাকার জন্য। কারণ, হোটেল নেই।
ওখানে হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশনের একটি শাখা নানারকম অনুষ্ঠান করে। একটি উদাহরণ, বিদ্যাসাগরের জন্মদিন পালনে ‘বিদ্যাসাগর’ নিয়ে আলোচনা গুরুত্ব পায় না। লোক আসে ম্যাজিক, গান ইত্যাদি দেখতে ও শুনতে।
আদ্রায় এখন নাচ-গানের সংস্কৃতি হিউম্যানিস্টস্ অ্যাসোসিয়েশন অন্তত তৈরি করে চলেছে। ওদের নেতা সত্যজিৎ চ্যাটার্জি। লম্বায় প্রায় ছ’ফুট, মেদহীন, স্বাস্থ্যবান বছর পঁয়তাল্লিশের সিংহপুরুষ তরুণ। খুব ভাল অর্গানাইজার। খুব ভালোভাবে সংগঠনকে পরিচালনা করতে পারেন।
আদ্রা থেকে একটিও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় না, যাতে সাহিত্য রস পাওয়া যায়। এখনও তাই-ই আছে।
আমি আদ্রাতে বড় হলে, এরকমই যে কোনও একটি পেশায় আমাকে ঢুকে যেতে হত। কোনও দিনই লেখক হওয়ার সুযোগ পেতাম না।
এরপর ’৫৫ তে চলে আসি খড়্গপুরে। রেলশহর। রেলওয়ে কর্মচারীর সংখ্যা হাজার হাজার। নাটক করার কয়েকটি ক্লাব ছিল। কেউ কেউ নিজের চেষ্টায় মাঝারি মাপের গায়কও হয়েছিলেন।
খড়্গপুর থেকে কলকাতায় না এলে আমিও আমার লেখাকে একটুও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম না।
ব্যতিক্রমী কয়েকজন লেখক মফস্সল থেকে উঠে এসেছেন, সেটা ব্যতিক্রম ছাড়া কিছু নয়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম হল রমাপদ চৌধুরী।
যেখানে যে সংস্কৃতি চালু আছে, সেখানের সেই সংস্কৃতির প্রভাব মানুষের ওপর পড়বেই।
আগে আমি গল্প লিখতাম। কিন্তু, আমার রাজনৈতিক সচেতনতা গল্প লেখার থেকে সমাজ সচেতন প্রবন্ধ লেখার দিকে টেনে নিয়ে এল। রাজনীতির বীজটা পুঁতেছিলেন স্কুলের শিক্ষক শুভেন্দুকুমার রায়। সেই বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম হল ১৯৬০ সালে কলকাতায় এসে।
এলাম কলকাতায়
বাবা অবসর নিলেন। আমারও স্কুলের পাঠ শেষ হল। আমরা এলাম কলকাতার এক রিফিউজি কলোনিতে।
এসেই মন খারাপ। কলোনির ধু ধু প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা বাড়ি। এখানেই শেষ জীবনটা কাটাতে হবে।
জায়গাটার নাম কৃষ্ণপুর কো-অপারেটিভ রিফিউজি কলোনি, যার বর্তমান নাম দমদম পার্ক।
এখানে বাবা একতলা বাড়ি বানালেন। গাছগাছালি পুঁতলেন। দুটো নারকেল গাছ। দুটো হিমসাগর জামের গাছ। একটা কাঁঠাল গাছ। পেয়ারা, করমচা ইত্যাদি গাছে ভরে গেল বাগান।
আড়াইখানা বেডরুম। খুদে ডাইনিংরুম একটা। একটা ছোট্ট রান্নাঘর। দুটো পায়খানা, একটা বাথরুম। সামনে একটা খোলা বারান্দা। এখানেই সাতজনের বসবাস শুরু হল।
এই বাড়িটা তৈরি করার আগে ভাড়া থাকতাম এ’পাড়াতেই। বাগজোলা খালের দিকে কলোনির শেষ প্রান্তে ধীরেন ব্যানার্জির বাড়িতে। ব্যানার্জিকাকু লম্বা, গায়ের রং টকটকে ফর্সা। তিনি একটা গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাল অভিনয় করতেন। রেলে চাকরি করতেন। তাঁর ছোটভাই ময়নাকাকুর কাছেই আমি সাঁতার শিখলাম।
আমাদের বাড়ি তৈরি হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকলাম।
অঞ্চলটি ফাঁকা ফাঁকা। ঘর-বাড়ি হচ্ছে। অনেকে আসছে। বর্ষায় জলভাসি রাস্তা। মাছ, কাঁকড়া মিলত সেই জলে। প্রচুর কই, ভ্যাদা মাছ পাওয়া যেত। আমরা পাড়ার ছেলেরা সেগুলো ধরতাম।
দক্ষিণে বাগজোলা খাল, পূর্বে একটি সরুখাল, উত্তরে শ্যামনগর রোড এবং পশ্চিমে যশোর রোড দিয়ে অঞ্চলটি ঘেরা। বাগজোলা খালের দক্ষিণে বাঙ্গুর কলোনি। তারও দক্ষিণে লেডি বোস্টন কলোনি বা লেকটাউন।
বাঙ্গুর কলোনি আর লেডি বোস্টন কলোনির মাঝখানে যশোর রোড ঘেঁষে একটি ছোট্ট পাড়া। নাম বরাট কলোনি। কয়েকটা বাড়ি দিয়েই পাড়া শেষ।
পুবদিকের সরু খালটা পেরোলে দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমি, সল্টলেক। সেখানে নৌকো করে মাছ ধরা হয়। ওই জলাভূমিগুলো ভরাট করা চলছে গঙ্গার পলি দিয়ে। পলি আসছে বিশাল বিশাল পাইপের মধ্য দিয়ে জলের সঙ্গে। উপনগর গড়া হবে। কাজে হাত দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
আর, উত্তরে শ্যামনগর অঞ্চল। শ্যামনগর রোড দিয়ে যশোর রোডে যাওয়া যায়। অঞ্চলটি মস্তান অধ্যুষিত। প্রচুর কাপড়ের কল আছে।
যশোর রোডটা বাংলাদেশের যশোর থেকে উত্তরের নাগেরবাজার দিয়ে দক্ষিণ দিকে এসে আর জি কর— এই শেষ। রাস্তাটা আর জি কর রোড নাম নিয়ে খাল পেরিয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে শ্যামবাজার চলে গেছে। এই রাস্তায় বাস চলে। আমাদের বাসস্ট্যাণ্ডটা ছিল বাগজোলা খালের কাছেই।
এ’পাড়ায় প্রায় সবাই মধ্যবিত্ত। তার মধ্যে একটু অবস্থাপন্ন শচীন রায়। বড় দোতলা বাড়ি। অবশ্য তিনতলা বাড়ি একটাও নেই। শচীনবাবুর বাড়িতে আছে একটা ফ্রিজ। সেটাকে বলা হত রেফ্রিজারেটর। সেটা যখন চলে তখন সারা তল্লাটে জানান দেয় ঘট্ঘট্ আওয়াজে।
আরেকজন পাড়ার এক ডাকাবুকো কণ্ট্রাক্টর সুশীল মুখার্জি। তাঁর বাড়ির উল্টোদিকে উঁচু টিনের দেওয়াল তোলা একটা বড় বাগান।
এটা বাঙাল পাড়া। তাই, আমার দাদুকে পাড়ার অনেকেই চেনেন। প্রবীণরা প্রায়ই সকলেই চেনেন।
ছিমছাম পরিবেশ, গ্রাম্য, শান্ত। এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে শুরু হল আমাদের বসবাস। শুরু হল আমার যৌবনের পথ চলা।