রসমঞ্জরী
শ্রীশ্রীঈশ্বর।
জয়তিঃ।
রসমঞ্জরী।
শ্রীমদ্ভানু নামা কবি কর্ত্তৃক সংস্কৃত রচিত
গ্রন্থানুসারে।
শ্রীল শ্রীযুক্ত ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর কৃত নানা
বিধ পয়ারাদি ছন্দানুবন্ধে তদ্ভাষা বিরচিত।
অধুনা বহু বুধগণ করণ
সংশোধিত হওত এতন্মহানগর নিবাসি
শ্রীযুক্ত মধুসূদন রায়ের
হিন্দুপেটরিয়ট যন্ত্রে মুদ্রাঙ্কিতহইল।
এই গ্রন্থ যিনি গ্রহণেচ্ছু হইবেন তিনি
কলিকাতা রাধাবাজারে ১৩৬ নম্বর বাটীতে তত্ব্ব করিলে
পাইবেন।
শক ১৭৭৫। মাহ চৈক্র।
অথ রসমঞ্জরী।
****
জয়জয় রাধা শ্যাম, নিত্য নব রস ধাম, নিরুপম নায়িকা নায়ক। সর্ব্ব সুলক্ষণ ধারী, সর্ব্ব রস বশকারী, সর্ব্ব প্রতি প্রণয় কারক॥ বীণা বেণু যন্ত্র গাণে, রাগ রাগিনীর তানে, বৃন্দাবনে নাটিকা নাটক। গোপ গোপীগণ সঙ্গে, সদা রাস রস রঙ্গে, ভারতের ভক্তি প্রদায়ক।
রাঢ়ীয় কেশরী গ্রামী, গোষ্ঠীপতি দ্বিজ স্বামী, তপস্যী শাণ্ডিল্য শুদ্ধাচার। রাজঋষি গুণযুত, রাজা রঘুরাম সুত, কলিকালে কৃষ্ণ অবতার॥ কৃষ্ণচন্দ্র মহারাজ, সুরেন্দ্র ধরণী মাজ, কৃষ্ণনগরেতে রাজধানী। সিন্ধু অগ্নি রাহ মুখে, শশী ঝাঁপ দেয় সুখে, যার যশে হয়ে অভিমানী॥ তার পরিজন নিজ, ফুলের মুখটি দ্বিজ, ভরদ্বাজ ভারত ব্রাহ্মণ। ভুরিশিট রাজ্য বাসী, নানা কাব্য অভিলাষী, যে বংশে প্রতাপনারায়ণ॥ রাজবল্লভের কার্য্য কীর্ত্তিচন্দ্র নিল রাজ্য, মহারাজা রাখিলা স্থাপিয়া। রসমঞ্জরীর রস, ভাষায় করিতে বশ, আজ্ঞা দিলা রসে মিশাইয়া॥ সেই আজ্ঞা অনুসরি, গ্রন্থারম্ভে ভয় করি, ছল ধরে পাছে খল জন। রসিক পণ্ডিত যত, যদি দেখ দুষ্ট মত, শারি দিবা এই নিবেদন॥
অথ নায়িকা প্রকরণ।
শৃঙ্গার বীভৎস হাস্য রৌদ্র বীর ভয়। করুণা অদ্ভুত শান্তি এই রসনয়॥ আদ্যরস সকল রসের মধ্যে সার। নায়িকা বর্ণিব অগ্রে তাহার আধার॥
অথ নায়িকার স্বীয়াদি ভেদ।
স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্য বনিতা। অগ্রে এই তিন ভেদে পণ্ডিত বর্ণিতা॥
অথ স্বীয়া নায়িকা।
কেবল আপন নাথে অনুরাগ যার। স্বকীয়া তাহার নাম নায়িকার সার॥
নয়ন অমৃত নদী, সর্ব্বদা চঞ্চল যদি, নিজপতি বিনা কভু অন্য জনে চায়না। হাস্য অমৃতের সিন্ধু, ভুলায় বিদ্যুৎ ইন্দু, কদাচ অধর বিনা অন্য দিগে ধায়না॥ অমৃতের ধারা ভাষা, পতির শ্রবণে আশা, প্রিয়সখা বিনা কভু অন্য কানে যায়না। নতি রতি গতি মতি, কেবল পতির প্রতি, ক্রোধ হলে মৌন ভাব কেহ টের পায়না॥
অথ মুগ্ধাদি ভেদ।
মুগ্ধ মধ্যে প্রগল্ভা তাহার ভেদ তিন। তিনেতে এ তিন ভেদ বুঝহ প্রবীণ॥
অথ মুগ্ধা।
মুগ্ধা বলি তারে যার অঙ্কুর যৌবন। বয়ঃসন্ধি সেই কালে বুঝ বিচক্ষণ॥
দেখিনু নাগরী, রূপের সাগরী, বয়স সন্ধি সময়। শিশু গণে মেলে, রাঁধুবাড়ু খেলে, পুরুষে কিঞ্চিৎ ভয়॥ হংস খঞ্জরীটে, দেখি পদে দিটে, কবে হল বিনিময়। হৃদয় সরোজ, পূজিতে মনোজ, পণ্ডিতে হয় সংশয়॥
অথ নবোঢ়া।
এ যদি রমণে লাজে ভয় হয় স্তব্ধ। নবোঢ়া তাহাকে বলি প্রশ্রয়বিশ্রব্ধ॥
অথ স্বকীয়া নবোঢ়া।
হস্তেতে ধরিয়া, শয্যায় আনিয়়া, যদ্যপি কোলে বসায়। নানা বাক্যছলে, যত্নে কলে বলে, বাহিরে যাইতে চায়॥ নবোঢ়াকে বশ, করণ কর্কশ, সে রস কহিব কায়। যেই পারা করে, স্থির করে ধরে, সেজন ব্যামোহ পায়॥
অথ পরকীয়া নবোঢ়া।
আপনার পতি আছে, ভয়েতে না শুই কাছে, গায় হাত দেয় পাছে, এইডরে ডরে হে। প্রীতের বিষম কায, সে ভয়ে পড়িল বাজ, লাজে পলাইল লাজ, আশা বাসা হরে হে॥ মুখের বাড়াও প্রীতি, হৃদয়ের হর ভীতি, তার পরে যেবা রীতি, রাখ ক্ষমা করে হে। যৌবন কমলাঙ্কুর, লোভে না করিও চুর, হিয়া কাঁপে দুরদুর, পাছে যাই মরে হে॥
অথ সামান্য নবোঢ়া।
কিছা ধরনের আশে, আইনু তোমার পাশে, আগে জানি তাম নাহি এত দায় হবে হে। মুখে দেখি শোষে মুখ, বুক দেখি কাঁপে বুক, মনে হতে মনে পড়ে কিসে প্রাণ রবে হে। কেবা ইহা সহিবেক, আমা হতে নহিবেক, ক্রুদ্ধ হও যদি নিজ ধন ফিরে লবে হে। যেবা তীর্থে নাইলাম, তারি পুণ্য পাইলাম, অতঃপর ক্ষমা দেহ আমারে না সবে হে॥
অথ বিশ্রব্ধ নবোঢ়া।
স্তন দুটি করে ছাঁদ্যা, উরু দুটি ভুজে বাঁধ্যা, লাজে ভয়ে মুদিল নয়ন। প্রথমেতে নিরুত্তর, না না না তাহার পর, টাল টোল এখন তখন॥ যদি খায়্যা লাজ ভয়, ফিঞ্চিৎ সঞ্চিত হয়, তবে আর না যায় ধরণ। নবীন ভূষণ বাস, নব সুধা হাস ভাষ, নব রস কে করে গণন॥
অথ মুগ্ধার ভেদ।
মুগ্ধার প্রভেদ দুই করিয়া বর্ণনা। অজ্ঞাত যৌবনা আর বিজ্ঞাত যৌবনা॥
অথ অজ্ঞাত যৌবনা।
হইয়াছে যৌবন যার নহে অনুভব। অজ্ঞাত যৌবনা তাকে বলে কবি সব॥
সখী সখী মেলি, ধাওয়া ধাই খেলি, হারে কহে যেন চোর। অন্যদিনে ধাই, সভা আগে যাই, আজি কেন হারি মোর॥ নিতম্ব হৃদয়, ভারী হেন লয়, চক্ষু কর্ণে পড়ে জোর। কটি দেখি ক্ষীণ, খস্যা পড়ে চীন, বাড়ে ঘাগরার ডোর॥অথ বিজ্ঞাতযৌবনা।
নিজ নবযৌবন যে ব্যক্ত করে ছলে। বিজ্ঞাত যৌবনা তাকে কবিবর বলে॥
দেখিলাম ঘরে ঘরে, সকলে কাঁচলী পরে, নানা বর্ণে উড়ায় উড়ানী। পরিহাস্য জন যত, নানা ছলে কহে কত, বাহির হয়্যা হইল পোড়ানী॥ দেহের কি কব কথা, সকল শরীরে ব্যথা, কত শত বিছার জ্বলনী। তোরে বলি প্রিয়সই, লাজে কারে নাহি কই, পাছে জানে জনক জননী॥
অথ মধ্যা।
লজ্জা আর রতি আশা সমান যাহার। রসিক পণ্ডিতে কহে মধ্যা নাম তার॥
রতি রসে কৃতীপতি, মোরে ভাল বাসে অতি, দেয় নিজাঙ্গুরী কণ্ঠমালা। আঁখি আড়ে নাহি রাখে, সদা কাছে কাছে থাকে, সুখ বটে কিন্তু একজ্বালা॥ নখাঘাত দেখি বুকে, দন্ত চিহ্ন দেখি মুখে, সখী হাসে কর্ণে লাগে তালা। শয্যা ঠেকি এই দোষে, না শুইলে পতি রোষে, শরীর হইল ঝালাপালা।
অথ প্রগল্ভা।
প্রগল্ভা সে রতি রসে পূর্ণ আশা যার। রতি প্রীতি আনন্দেতে মোহ হয় তার॥
শুন শুন প্রিয় সই, রাত্রির কৌতুক কই, শুয়্যা ছিনু পতি সঙ্গে নানা সুখ তাকে লো। প্রকৃত কর্ম্মের বেলা, মোহে দোঁহে হলো মেলা, এ কর্ম্মেতে কত সুখ বুঝিবার পাকে লো। কিন্তু হলো কোন কর্ম্ম, বুঝিতে নারিনু মর্ম্ম, অবশেষে ভাব্যা মরি হাত দিয়া নাকে লো। উঠিয়া পরিনু বাস, বান্ধিলাম কেশ পাশ, তোর দিব্য যদি আর কিছু মনে থাকে লো॥
অথ মধ্যা প্রগল্ভার ধীরাদি ভেদ।
মান কালে মধ্যা প্রগল্ভার তিন ভেদ। বীরা অধীরা ধীরা ধীরা পরিচ্ছেদ॥ মুগ্ধার এ ভেদ নাই ভয় তার মূল। ক্রোধ হলে এক ভাব ক্রন্দন আকুল॥ প্রকারে প্রকাশে ক্রোধ যে জন সে ধীরা। সোজা সুজী যার ক্রোধ সে জন অধীরা॥ কিছু সোজা কিছু বাঁকা যার হয় ক্রোধ। ধীরাধীরা বলে তারে পণ্ডিত সুবোধ॥
অথ মধ্যা ধীরা।
আজি প্রভু দড়দড়, বেশ বনায়্যাছ বড়, শ্বেত রক্তচন্দনের চাঁদ ভালে ধরেছ। মন দেখি ভাঙ্গা২, নয়ন হয়েছে রাঙ্গা, বুঝি কোন দোষ দেখি মোরে রোষ করেছ॥ তোমা বিনা প্রভু নাই, যাইবার নাহি ঠাঁই, কুমুদের চাঁদ যেন তেন মন হরেছ। অপরাধ ক্ষমা কর, নূতন চন্দন পর, এই লও নব মালা বাসী মালা পরেছ॥
অথ মধ্যা অধীরা।
সোহাগ করিয়া নিত্য, বলহ আমার ভৃত্য, আজি দেখি একি কৃত্য, দর্পণেতে চাও হে। অধরে কজ্জল দাগ, নয়নে তাম্বুল রাগ, অলক্তাক্ত ভাল ভাগ, কার কাছে পাও হে॥ মোরে প্রাণ বলে ডাক, অন্যের নিকটে থাক, বুঝিলাম মন রাখ, মন কলা খাও হে। তোমা দেখি হয় ভীতি, কঠিন তোমার রীতি,বঝিনু তোমার প্রীতি যাও যাও যাও হে॥
অথ মধ্যা ধীরাধীরা।
তুমি মোর প্রাণ পতি, কখন করিলা রতি, বুঝি সুখে ভুলে ছিনু তেই নাই মনে হে। বুকে দেখি নখ চিহ্ন, অধর দশনে ভিন্ন, ভালে আল্তার দাগ রক্তিমা নয়নে হে। শ্রম বাক্ মুখ ধোও, ক্ষণেক শয্যায় শোও, ছুয়্যা শুদ্ধকর মালা তাম্বুল চন্দন হে। কত জান ভারি ভুরি, দেখিতে২ চুরি, পরিহার নমস্কার তোমা হেন জনে হে॥
অথ প্রগল্ভা ধীরা।
কাযের সময়, যত কথা হয়, এবে কোথা রয়, মনে থাকে। কেমন ধরম, কেমন করম, কেমন মরম, কহিব কাকে॥ ধিক বিধাতায়, এহেন আমায়, দিয়াছে তোমায়, ইহারি পাকে। দেখি যে চঞ্চল, ছোঁবে কি অঞ্চল, একাযে কি ফল কে তোমা ডাকে॥
অথ প্রগল্ভা অধীরা।
কোন্ ফুলে বঁধু, পান কর্যা মধু, হয়্যা আলে যদু, পোড়াতে মোরে। আল্তা কজ্জল, সিন্দুর উজ্জ্বল, জাগিয়া বিকল নয়ন ঘোরে॥ এতেক বলিয়া, ক্রোধেতে জ্বলিয়া, কমল ফেলিয়া, মারিল জোরে। কাঁদয়ে নাগর, গুণের সাগর, কোথায় আদর, থাকয়ে চোরে॥
অথ প্রগল্ভা ধীরাধীরা।
জাগিয়া নয়ন, তোমার যেমন, আমার তেমন, সকল বটে॥ সব কাযে সম, ফলে তর তম, কিসে আমি কম, বুঝিলে ঘটে॥ বিধি কৈল নারী, লাজ দিল ভারী, তেই সে না পারি, তোমার হঠে। বৃক্ষ মূলে হানি, শিরে ঢাল পানী, চরণ দুখানি, নৌকায় তটে॥
অথ জ্যেষ্ঠাদি ভেদ।
এই ধীরা এ অধীরা এই ধীরাধীরা। জ্যেষ্ঠা আর কনিষ্ঠা দ্বিভেদ হয় ফিরা॥ পতির অধিক স্নেহ যারে সেই জ্যেষ্ঠা। অল্প স্নেহ যারে তারে বলয়ে কনিষ্ঠা॥
অথ ধীরা জ্যেষ্ঠা।
স্ত্রীর বুঝি ধীর ক্রোধ, দুরে গেল শোধ বোধ, বন্ধু করে, উপরোধ, ধীরে ধীরে কহিছে। যদি পায়্যা থাক দোষ, তবু যুক্ত নহে রোষ, হাস্যে কর পরিতোষ, কামানলে দহিছে॥ রক্ত পদ্ম দুটি পায়, ভ্রমর নূপুর তায়, নিত্য নানা রস খায়, আজি তাই রহিছে। আকুল আমার প্রাণ, তবু নহে সমাধান, কঠিন তোমার মান, পরিণাম নহিছে॥
অথ ধীরা কনিষ্ঠা।
স্ত্রীর দেখি স্থির মান, করিবারে সমাধান, বন্ধু করে অপমান, ক্রোধে ক্রোধ হরিব। কিসে মোর পায়্যা দোষ, কেন কর এত রোষ, কিসে হবে পরিতোষ, বল তাই করিব॥ কেহ বুঝি কহিয়াছে, গিয়াছিনু কারো কাছে, অঙ্গে বুঝি চিহ্ন আছে, তবে কিসে তরিব। আরম্ভিয়া মিছা ক্রোধ, না করিলা উপরোধ, এত দূরে শোধ বোধ, কত সাধ্যা মরিব॥
অথ অধীরা জ্যেষ্ঠা।
যদ্যপি অধীরা হয়্যা, গালি দিলা কটু কয়্যা, তবু থাকিলাম সয়্যা, না সয়্যা কি করিব। তুমি প্রাণ তুমি ধন, তোমা বিনা অন্য জন, যদি জানে মোর মন, পরীক্ষা আচরিব॥ রুষ্ট হলে কটু কও, তুষ্ট হলে কোলে লও, আমা বিনা কারো নও, এই গুণে তরিব। ছল ছুতা মিছা সাঁচা, না জানি বিস্তর প্যাঁচা, প্রাণেশ্বরী প্রাণ বাঁচা, নহে আজি মরিব॥
অথ অধীরা কনিষ্ঠা।
বিনা দোষে দেও গালি, মাথে কলঙ্কের ডালি, মুখে যেন চুণ কালি, কিসে মুখ চাহিব। হয়্যাছি তোমার প্রভু, কত দোষ পাই তবু, গালি নাহি দিই কভু, কত গালি খাইব॥ বিনয়ে না মানি রোধ, যদি নাহি ছাড় ক্রোধ, এত দূরে শোধ বোধ, দেশ ছাড়্যা যাইব। তোমার যেমন মর্ম্ম, আমার তেমন কর্ম্ম, ইশাদ থাকিও ধর্ম্ম, কার্য্যকালে পাইব॥
অথ ধীরাধীরা জ্যেষ্ঠা।
এক বাক্যে বুঝি রাগ, আর বাক্যে অনুরাগ, হৃদয়ে হইল দাগ, বুঝিতে না পারিয়া। কি করিলে হও তুষ্ট, কি করিলে হও রুষ্ট, অদৃষ্ট হইল দুষ্ট, কিসে যাবে সারিয়া॥ যদি অপরাধী হই, নিতান্ত করিয়া কই, তোমা বিনা কারো নই, দুখে লও তরিয়া। তমি ধ্যান তুমি জ্ঞান, তুমি মান অপমান, তোমা বিনা নাহি আন, দেখিনু বিচারিয়া॥
অথ ধীরাধীরা কনিষ্ঠা।
এক বাক্যে দেখি রোষ, আর বাক্যে বুঝি তোষ, না বুঝিনু গুণ দোষ, বড় দায় পড়িল। কি করিলে ভাল হবে, বল তাই করি তবে, নহে ঘর লয়্যা রবে, আমার কি বহিল॥ পদ্মিনী ভ্রমর প্রিয়া, ভ্রমরে খেদায়্যা দিয়া, তাহারি বিদরে হিয়া, বুঝি তাই ফলিল। রতির সময় নউক, আমার যে হয় হউক, ক্রোধটি তোমার রউক, যে হবার হইল।
অথ পরকীয়া নায়িকা।
অপ্রকাশে যার রতি পর পতি সনে। পরকীয়া তাহারে বলয়ে কবিগণে॥
অথ পরকীয়া ভেদ।
উঢ়া আর অনুঢ়া দ্বিভেদ হয় তার। উঢ়া সেই বিবাহ হইয়া থাকে যার॥ অনুঢ়া সে জন যার হয় নাহি বিয়া। পিত্রাদি অধীন হেতু সেও পরকীয়া॥
অথ অনুঢ়া।
শুন২ প্রাণ বঁধু, পিয়াইয়া মুখ মধু, এমত করিলে বশ কত গুণ কব হে। অন্য সঙ্গে যদি পিতা, করে মোরে বিবাহিতা, কেমনে তাহার সঙ্গে তোমা ছাড়ি রব হে॥ এমত করিবা কর্ম্ম, নহে যেন স্ত্রীর ধর্ম্ম, বুকে মুখে হলে দাগ কলঙ্কিনী হব হে। যাবৎ না বিভা হয়, তাবৎ এমন ভয়, তাবতি এমত পীড়া দুজনেতে সব হে॥
অথ উঢ়া।
আপনার পতি আছে, সদা তারে পাই কাছে, তথাপি দারুণ মন পর লাগি মরে গো। সঙ্কেত তরুর মূলে, সঙ্কেত নদীর কূলে, ঘাটে, ভাঙ্গা মঠে মাঠে অন্ধকার ঘরে গো॥ কিঙ্কিণী কঙ্কণ রোল, লুকায়ে চুম্বন কোল, রমণে নাহিক সুখ কোটালের ডরে গো। পরপতি রতি আশ, ঘর ছাড়ি পর বাস, সুখ যদি নহে লোক তবে কেন করে গো॥
অথ পরকীয়ার অন্য ভেদ।
বিদগ্ধা লক্ষিতা গুপ্তা কুলটা মুদিতা। পরকীয়া নানা ভেদ প্রাচীন লিখিতা॥
অথ বিদগ্ধা।
বিদগ্ধা দ্বিমত হয় বাক্য আর কাযে। কথা শুনি কার্য্য দেখি বুঝিবা অব্যাজে॥
অথ বাগ্বিদগ্ধা।
চির পরবাসী স্বামী, বিরহে কাতরা আমি, বসন্তে মাতিল কাম কেমনে বা থাকিব। প্রভুর কুসুমোদ্যান, বড় মনোহর স্থান, মনুষ্যের গম্য নহে সেই স্থানে যাইব॥ ডাকে পিক অলিকুল, ফুটে নানা জাতি ফুল, গাইয়া প্রভুর গুণ রজনী পোহাইব। করিতে আমার তত্ত্ব, হইবে যাহার সত্ব, সেই বঁধু তারে দেখা সেই খানে পাইব।
অথ ক্রিয়া বিদগ্ধা।
সুখে শুয়ে পতি আছে, রামা বস্যে তার কাছে, ইশারায় উপপতি পিক ডাকে ডাকিল। রামা বলে হলো দায়, পাছে পতি টের পায়, না দেখি উপায় ভেবে স্তব্ধ হয়ে রহিল॥ কোকিল ডাকিছে হোর, কাম ভয়ে পাছে ঘোর, শ্রান্ত আছ নিদ্রা যাও বল্যা চক্ষু ঢাকিল॥ জাগ্রত আমার প্রিয়, কেন ডাক বনপ্রিয়, আর কি তোমারে ভয় বল্যা দুই রাখিল॥
অথ লক্ষিতা।
পরপতি রতি চিহ্ন ঢাকিতে যে নারে। লক্ষিতা করিয়া কবিগণ বলে তারে॥
আজি প্রভু দেশে এলে, রতি চিহ্ন কিসে পালে, সোহাগ পড়ুক মরে সতিপনা হরিলে। তুমি এলে বার্ত্তা পায়্যে, দেখিতে আইনু ধায়্যে, আছাড় খাইনু পথে সে তত্ত্ব না করিলে॥ মুখে বল দন্ত চিহ্ন, বুক বল নখে ভিন্ন, আলু থালু বেশ দেখে বুঝি লতা ধরিলে। নষ্ট হই দৃষ্ট হই, তোমা বিনা কার নই, কলঙ্ক এড়াবে নাহি সে জন না মরিলে॥
অথ গুপ্তা।
হয়েছে হতেছে হবে পর সঙ্গে রতি। গুপ্তকরে যে জন সে জন গুপ্ত মতি॥ মুখে বুকে দেখি দাগ, শাশুড়ী করুন রাগ, একেতো বিরহে মরি আর এই ভয় লো। কান্দিয়া পোহাই নিশা, আবেশে হারাই দিশা, কেমন কেমন করে অধর হৃদয় লো॥ স্তন নিজ নখাঘাতে, অধর পীড়িয়া দাঁতে, কোনমতে নিবারণ করি এ সময় লো। এইরূপে দিবারাতি, রাখিয়াছি কুল জাতি, চক্ষু খায়্যে তবু লোক কত কথা কয় লো॥
অথ কুলটা।
পতি কোলে থাকি যার অনেকেতে কায। কুলটা তাহারে বলে পণ্ডিত সমাজ।
অরে বিধি নিদারুণ, কি তোর স্মরিব গুণ, কুলটার আশা পূর্ণ করিতে না পারিলি। হস্ত পদ চক্ষু কাণ, দিলি দুই দুই খান, উড়িবারে দুই খানি পাখা দিতে নারিলি॥ চৌদ্দ ভুবনেতে যত, পুরুষ বিবিধ মত, সবার বুঝিত বল তাই বুঝি সারিলি। এ দুঃখ বা কত সব, অন্যের কি কথা কব, চতুর্ম্মুখ রজো গুণ তবু তুই নারিলি॥
অথ মুদিতা।
পর সঙ্গে রতি আশে উল্লাসিতা যেই। বিঘ্ন হীন দেখিয়া মুদিতা হয় সেই॥
প্রবাসে রয়েছে পতি, ননদী প্রসূতবতী, বিধবা শাশুড়ী ওই দৃষ্টিহীন রয় লো। দেবর বিলাস রায়, শ্বশুর ভবনে যায়, মন্দ মন্দ গন্ধবহ বিদরে হৃদয় লো॥ অস্ত গেছে দিনমণি, যতেক রসিক ধনি, ওই শুন বংশীধ্বনি, করয়ে ললিত লো। রোমাঞ্চ হতেছে মোর, খসিছে কাঁচলি ডোর, কেন সই ওষ্ঠাধর হতেছে কম্পিত লো॥ পরকীয় সুখ যত, ঘরে ঘরে শুনি কত, অভাগীর ধর্ম্ম ভয় এত কর্যা মরিলো। পর পুরুষের মুখ, দেখিলে যে হয় সুখ, একি জ্বালা সদা জ্বলি হরি হরি হরি লো॥
অথ সামান্য বনিতা।
ধন লোভে ভজে যেই পুরুষ সকলে। সামান্য বনিতা তারে কবি গণে বলে।
স্বকীয়া ধর্ম্মের বশে, পরকীয়া প্রীতি রসে, অমূল্য যৌবন ধন পুরুষেরে দেই লো। আমার যৌবন ধন, ভোগ করে সেই জন মান বুঝি মূল্য করে দিতে পারে যেই লো। যখন যে ধন চাই, সেইক্ষণে যদি পাই, আমার মনের মত বন্ধু হবে সেই লো। ধনিক রসিক জানি, নাগর মিলাবে আনি, আপনার মর্ম্ম কথা কয়্যা দিলাম এই লো॥
অথ সামান্য বনিতার ভেদ।
অন্য ভোগ দুঃখিতা আর বক্রোক্তি গর্ব্বিতা। মানবতী আদি ভেদে সামান্য বনিতা॥
অথ বক্রোক্তি গর্ব্বিতা।
গর্ব্বিতা দ্বি মত হয় রূপে আর প্রেমে। দুইটি একত্র হলে হীরা যেন হেমে॥
অথ রূপ গর্ব্বিতা।
অথ প্রেমগর্ব্বিতা।
অনিমিষ আঁখি স্থির চরিত্র। আপনার বঁধু করিয়া চিত্র॥ আমারে দেখয়ে একি বিচিত্র। কেহ বঁধু সখী শত্রু কি মিত্র॥
অথ অন্য সম্ভোগ দুঃখিতা।
কহ দূতী গিয়াছিলে কোন বনে। বড় শোভয় অঙ্গ ফুলা ভরণে॥ নিজ বেশ করে দড় আইলি লো। কই গেলি নরাধম সন্নিধি লো॥ ভুলিয়াছিলি আর ভুলাইলি রে। মধু গূঢ় বনে কত পাহলি রে॥
অথ মানবতী।
এসো পরাণ পুত্তলি এস, মরে যাই দেখি কিবা বেশ, আলোতে রহ হে রূপ ভাল করে হেরি হে। আল্তা কজ্জল দাগ ভালে, অরুণ প্রকাশ রাহু গালে, তবে আছ ভাল জান ভারী ভুরি ঢেরি হে॥
অথ নায়িকা সকলের অবস্থা ভেদ।
এসব নায়িকা পুনঃ অষ্ট মত হয়। বিপ্রলম্ভ সম্ভোগ তাহার পরিচয়॥ বাসসজ্জা উৎকণ্ঠিতা আর অভিসারিকা। বিপ্রলব্ধা তারপর স্বাধীন ভর্তৃকা॥ খণ্ডিতা তাহার পর কলহন্তারিতা। প্রোষিত ভর্তৃকা এই অষ্ট পরিমিতা॥
অথ বাসক সজ্জা।
পতি হেতু বাস ঘরে যেই করে সাজ। বাসক সজ্জা বলে তারে পণ্ডিত সমাজ॥ আঁচড়িয়া কেশ পাশ, পরিয়া উত্তম বাস, সখী সঙ্গে পরিহাস, গীত বাদ্য রটনা। চামর চন্দন চুয়া, ফুলমালা পাণ গুয়া, হাতে লয়্যা শারীশুয়া, কামরস পঠনা॥ কিঙ্কিণী কঙ্কণ হার, বাজুবন্ধ সিঁতি টাড়, নূপুরাদি অলঙ্কার, নিত্য নব পরণা। যোগী যেন যোগাসনে, বসিয়া ভাবয়ে মনে, কত ক্ষণে বন্ধু সনে, হইবেক ঘটনা॥
অথ উৎকণ্ঠিতা।
স্বামীর বিলম্ব যেই ভাবে অনুক্ষণ। উৎকণ্ঠিতা তাহারে বলয়ে কবিগণ॥
হইল বহু নিশি, প্রকাশ হয় দিশি, আইল কেন নাহি কালিয়া। পিকের কলরব, ডাকিছে অলি সব, অনলে দেও দেহ জ্বালিয়া॥ তিমির ঘনতরে, সভয় বনচরে, ফিরয়ে কিবা পথ ভুলিয়া। অপর সখীরসে, রহিল পরবশে, মদনে মোরে দিল যে জ্বালিয়া॥
অথ অভিসারিকা।
স্বামীর সঙ্কেত স্থলে যে করে গমন। তারে অভিসারিকা বলয়ে কবিগণ॥
নিকট সঙ্কেত সময় আইল, শুনে রসময়ী মুরলী গাইল, ধরি ধনুশর মদন ধাইল, চলে নিধুবনে কামিনী। পিক কলকলি শারিশুক ধ্বনি, ফুটে বনফুল ভ্রমর গুণগুণী, তাহাতে মিলিত নূপুর রুণরুণী, শীঘ্র চলে মৃদুগামিনী॥ বাছিয়া পরিলেক নীল অম্বর, মদন হেম গৃহে মেঘ ডম্বর, পথিক জন ডর করিতে সম্বর, ঝাঁপিল তাহে তনু দামিনী। বদন সরসিজ গন্ধযুত মন, মোহিত সহচরী ভ্রমর শিশুগণ, তথি মলয়াচল গত মন্দ পবন, বাওল দ্রুত সখি যামিনী॥
অথ বিপ্রলব্ধা।
সঙ্কেত স্থানেতে গিয়া নাহি পায় পতি। বিপ্রলব্ধা তারে বলে পণ্ডিত সুমতি॥
তিল পরিমাণ নান, সদা করি অনমান, গুরুভয় লঘুভয় গোলা। গৃহ ছাড়ি ঘন বন, করিলাম আরোহণ, সিন্ধু তরিনু ধরি ভেলা॥ হরি হরি মরি মরি, উহু উহু হরি হরি, তবু নহে হরি সনে মেলা। পর দুঃখ পর শ্রম, পর জনে জানে কম, অপরূপ খল জন খেলা॥
অথ স্বাধীন ভর্তৃকা।
কোলে বস্যা যার পতি আজ্ঞার অধীন। স্বাধীন ভর্তৃকা তারে বলে সুপ্রবীণ॥
শুন শুন প্রাণ নাথ, নিবেদি হে যোড় হাত, পুরিল সকল সাধ কিছু শেষ রয় হে। বাঁধ্যা দেহ মুক্তকেশ, বনাইয়া দেহ বেশ, তুমি মোরে ভালবাস লোকে যেন কয় হে॥ দেখিয়া তোমার মুখ, অতুল হইল সুখ, পাসরিনু যত দুঃখ আছিল যে ভয় হে। যত কাল জীয়া রই, তোমা ছাড়া যেন নই, নিত্যান্ত করিয়া কই, মনে যেন রয় হে॥অথ খণ্ডিতা।
অন্য ভোগ চিহ্ন অঙ্গে আসে যার পতি। খণ্ডিতা তাহার নাম বলে শুদ্ধমতি॥
আইস বঁধু দ্রুত হয়্যা, কেন আইস রয়্যা রয়্যা, মরিরে বালাই লয়্যা, কিবা শোভা পায়্যাছে। কপালে সিন্দুর বিন্দু, মলিন বদন ইন্দু, নয়ন রক্তের সিন্ধু, মোর দিগে ধায়্যাছে॥ অধরে কজ্জল দাগ, নয়নে তাম্বুল রাগ, বুঝি কেবা পায়্যা লাগ, মোর মাতা খ্যায়্যাছে। তোমার কি দোষ দিব, বাপ মায় কি বলিব, হরি হরি শিব শিব, যম মোরে ভুল্যাছে॥
অথ কলহান্তরিতা
কলহে খেদায়্যা পতি পশ্চাৎ তাপিতা। কবি গণে বলে তারে কলহান্তরিতা॥
ক্রোধে হয়্যা হতজ্ঞান, কৈনু তারে অপমান, এখন আকুল প্রাণ, দেখিতে না পাইয়া। ফুটিছে বিবিধ ফুল, ডাকে ভৃঙ্গ অলিকুল, সামালিব এই শূল, কার পানে চাহিয়া॥ কাতর হইয়া অতি, বিস্তর করিয়া নতি, চরণে ধরিল পতি, না চাহিনু ফিরিয়া। করিনু যেমন কর্ম্ম, ফলিল তাহার ধর্ম্ম, মরুক এমত মর্ম্ম, দুঃখে যাই মরিয়া॥
অথ প্রোষিত ভর্তৃকা।
পরবাসে পতি যার মলিনা বিরহে। প্রোষিত ভর্তৃকা তারে কবিগণ কহে॥ অনল চন্দন চুয়া, গরল তাম্বুল গুয়া, কোকিল বিকল করে অতি। বিধবার মত বেশ, অস্থি চর্ম্ম অবশেষ, তাপে কাম পোড়ায় বসতি॥ মনোজ তনুজ মত, কোদণ্ড করিয়া হত, হাতে লয় পিণ্ডের পদ্ধতি। সখী মুখে মান শুনি, পতি এলো হেন গণি, দেখিতে শ্বাসের গতাগতি॥
অথ প্রোষ্যৎ ভর্তৃকা।
যার কাছে আসে পতি প্রবাস গমন। প্রোষিত ভর্তৃকা মধ্যে তাহারো গণন॥ এ আট লক্ষণে তার না মিলে লক্ষণ। নবমী নায়িকা হতে পারে কেহ কন॥ কিন্তু অষ্ট নায়িকা সকল গ্রন্থে কয়। নবমী কহিতে গেলে গণ্ডগোল হয়॥ অত এব দ্বিধা বলি প্রোষিত ভর্তৃকা। প্রোষিত ভর্তৃকা আর প্রোষ্যৎ পতিকা॥
শুন২ ওরে প্রাণ, পতি পরবাসে যান, তুমি করিবে এবে সত্য করে কহিবে। এবে জানিলাম দড়, তোমা হৈতে পতি বড়, নহে কেন আগে যান তুমি পাছে রহিবে॥ যদি বড়হতে চাও, তবে আগে আগে যাও, নহে তুমি লঘু হবে আমার কি বহিবে। এবে সুখ দেয় যারা, পিছে দুঃখ দিবে তারা, কয়্যা অবসর আমি কত জ্বালা সহিবে॥
ইত্যাদি কহিয়া দিনু নায়িকা যতেক। পতির গমন কালে সবার প্রত্যেক॥ পুথি বাড়ে সকলের করিতে কবিতা। অনুভবে বুঝ্যা লবে লক্ষণ মিলিতা॥অথ নায়িকা উত্তমাদি ভেদ।
উত্তমা মধ্যমা আর অধমা নিয়মে। এসব নায়িকা তিন মত হয় ক্রমে॥
অথ উত্তমা।
অহিত করিলে পতি যেবা করে হিত। উত্তমা তাহার নাম বলয়ে পণ্ডিত॥
অথ মধ্যমা।
হিত কৈলে হিত করে অহিতে অহিত। মধ্যমা তাহার নাম মধ্যম চরিত॥
অথ অধমা।
হিত কৈলে অহিত করয়ে যেই জন। অধমা তাহার নাম বলে কবিগণ॥
অথ চণ্ডী নায়়িকা।
পতি প্রতি করে যেই অকারণ ক্রোধ। চণ্ডী তার নাম বলে পণ্ডিত সুবোধ॥
অথ সহচরী কথন।
অথ সখী।
আমার নিকটে রয়ে, মরম আমারে কয়ে, এমত শিখাব কথা সুধাবৃষ্টি করিবে। আঁচরিয়া দিব কেশ, বনাইয়া দিব বেশ, থাকুক পতির মন মুনি মন ভুলিবে॥ হাব ভাব লীলা হেলা, শিখাইব নানা খেলা, আসিতে আমার কাছে কাহারে না ডরিবে। দোষ যত লুকাইব, গুণ যত প্রকাশিব, বড় দায়ে ঠেক যদি আমা হতে তরিবে॥
অথ দূতী সখী।
নায়ক নায়িকা যেই করয়ে ঘটন। বিরহ যাপন করে দূতী সেই জন॥ স্বয়ং দূতী আদ্যদূতী এই সে প্রকার। আদ্যদূতী তিন মত শুন ভেদ তার॥ অমিতার্থ নিশ্চয়ার্থ আর পত্রহারী। বিশেষ বিশেষ শুন করিয়া বিচারি॥ ইঙ্গিতে যে কর্ম্ম করে অমিতার্থ সেই। নিশ্চয়ার্থ আজ্ঞা পায়্যা কর্ম্ম করে যেই॥ পত্র লয়্যা কার্য্য করে পত্রহারী সেই। বিশেষিয়া বুঝ সবে কয়্যা দিনু এই॥
অথ আদ্যদূতী।
অথ নায়ক প্রকরণ।
নায়িকা নায়ক দুই শৃঙ্গারে প্রধান। নায়িকা বর্ণিনু শুন নায়ক সন্ধান॥ পতি উপপতি আর বৈশিক নাগর। স্বীয়া পরকীয়া আর সামান্যার বর॥ বেদ মত বিভা করে যে জন সে পতি। উপপতি সেই যার পিরীতে বসতি॥ কোন রূপে ধন লোভে হয় সংঘটন। বৈষয়িক বৈশিক নাগর সেই জন॥
অথ পতি ভেদ।
অনুকুল দক্ষিণ ধৃষ্ট শঠ চারিমত। পতি ভেদ কেহ বলে তিনে কেহ রত॥ একে অনুরাগ যায় সেই অনুকুল। দক্ষিণ সে যার ঘরে পরে হয় তুল। ধৃষ্ট সেই দোষ করে পুনঃ করে হঠ। কপট বচনে পট সেই জন শঠ॥
অথ অনুকূল।
ওলো ধনি প্রাণ ধন, শুন মোর নিবেদন, সরোবর স্নান হেতু যায়্যো নালো যায়্যো না। যদ্যপি বা যাও ভুলে, অঙ্গুলে ঘোমটা তুলে, কমল কানন পানে চায়্যো না লো চায়্যোনা॥ মরাল মৃণাল লোভে, ভ্রমর কমল ক্ষোভে,নিকটে আইলে ভয় পায়্যো না লো পায়্যো না। তোমা বিনা নাহি কেহ,ঘামে পাছে গলে দেহ, বায় পাছে ভাঙ্গে কটি ধায়্যো না লো ধায়্যো না॥
অথ দক্ষিণা।
তোমার নিকটে যত, দিব্য করে কহি কত, বাহির হইবা মাত্র পর দেখি ভুলি লো। তোমায় যেমন প্রীতি, পর সঙ্গে সেই রীতি, কহিলাম আপনার দোষ গুণ গুলি লো॥ কি করে ধর্ম্মের ভয়, লোক লাজে কিবা রয়, দেখিতে পরের মুখ ফিরি কুলি কুলি লো। তুমি যদি হও রুষ্ট, অন্যা করিবেক তুষ্ট, ইহা বুঝে মোর সঙ্গে ছাড়্যা দেহ ঠুলি লো॥
অথ ধৃষ্ট।
দোষ দেখ্যা একবার, কৈলে নানা তিরস্কার, লাজ খায়্যা আনু ফিরে তবু দয়া হলো না। ভুজ পাশে বান্ধ্যা ধর, নিতম্ব প্রহার কর, দশনেতে কর ক্ষত অভিমানে গলো না॥ দূর কৈলে দূর নব, গালি দিলে সয়্যা রব, আমারে সহিল সব, তোমারেতো সলো না। পুরুষ পরশ মণি, যারে ছোঁয় সেই ধনী, ইহা বুঝে অনুক্ষণ দূর দূর বলো না॥
অথ শঠ।
কালি কয়েছিনু, আনিতে ভুলিনু, ক্ষম সেই অপরাধ। যে বল করিব, যাহা চাহ দিব, পুরাহ সকল সাধ। অঙ্গেতে যে দাগ, তোমারি সোহাগ, মিথ্যা দেহ অপবাদ। আমার পরাণ, হরিণী সমান, তোমার চক্ষু নিষাদ॥
অথ উপপতি।
নিজ নারী আছে ঘরে, যাহা বলি তাহা করে, নানা রূপ গুণ ধরে, তাহে মন রয় না। করিতে অন্যার সঙ্গ, সদাই সরস অঙ্গ এ বড় অপূর্ব্ব রঙ্গ, ধর্ম্ম ভয় হয় না॥ যাইতে সঙ্কেত স্থান, সদত আকুল প্রাণ, জ্ঞান মান অপমান, কিছু মনে লয় না। ব্যক্ত হলে কালামুখ, শয়নে নাহিক সুখ, রমণেতে নানা দুঃখ তবু ক্ষমা হয় না॥
অথ বৈশিক নাগর।
গিয়াছিনু সরোবরে, স্নান করিবার তরে,দেখিয়াছি এক জন অপরূপ কামিনী। চক্ষু মুখ পদ্ম ছন্দ, কিবা ছন্দ কিবা বন্ধ, নীলাম্বরে ঝাঁপে তনু মেঘে যেন দামিনী॥ ঈশ্বর সদয় হন দূতী মিলে এক জন, এইক্ষণে তার কাছে যায় দ্রুত গামিনী। যত চাহে দিব ধন, দিব নানা আভরণ, কোন মতে মোর সঙ্গে বঞ্চে এক যামিনী॥
অথ নায়কদিগের উত্তমাদি ভেদ।
উত্তম মধ্যম আর অধম নিয়মে। নায়িকার যেই ক্রম নায়ক সে ক্রমে॥ বাসসজ্জা আদি নায়িকার ভেদ যত। নায়কে সে ভেদ হয় লক্ষণ সম্মত॥ উপপতি বৈশিকেতে সকলি বিদিত। পতি প্রতি রসাভাষ কেবল খণ্ডিত॥ স্বকীয়ার রসাভাষ জান অভিসার। পতির খণ্ডিত ভাব তেমতি প্রকার॥ সর্ব্বজন সুসম্মত আরভাব সব। উদাহরণেতে দেখে করে অনুভব॥
অথ বাসক সজ্জা।
শয়ন সময়, বন্ধু রসময় করে রমণীর মোহন সাজ। অন্য কার্য্য ছলে ঘরে চলে, সাধিতে আপন গোপন কায॥ হাতে লয়্যা যন্ত্র, গান কাম তন্ত্র, মনে পায়্যা লাজ পায় এলাজ। ভাবে খাটে বসি, প্রাণের প্রেয়সী, আসিতে না জানি কতেক ব্যাজ॥
অথ উৎকণ্ঠিত নায়ক।
কেন না আইল প্রিয়া, বিরহে বিদরে হিয়া, স্থির হব কি করিয়া, ধৈর্য্য আর রহে না। কিবা কোন কার্য্য পাকে, ভীতা কিবা দেখ্যা কাকে, নহে এতক্ষণ থাকে, কাম কি সে দহে না॥ পান গুয়া গন্ধ মালা, অগ্নি সম দেয় জ্বালা, করিলেক ঝালাপালা, তনু প্রাণ রহে না। আসিবেক কত ক্ষণে, তবে সুখ পাব মনে, বিনা তার দরশনে, আর তাপ সহে না॥
অভিসারক নায়ক।
দ্বিতীয় প্রহর রাতে, মোরে কহিয়াছে যাতে, সময় হইল প্রায় স্থির মন টলিল। সুখের কে জানে লেখা, গেলে মাত্র পাব দেখা, অনেক দিনের পর আজি আশা ফলিল॥ অন্ধকারে দেখি আলো, গৌর লোক দেখি কাল, শত্রু জনে মিত্র ভাব জলে স্থল হইল। রজনীতে দিবা মত, তিমির হইল হত, কুপথে সুপথ জ্ঞান তাহে মন লইল॥
অথ বিপ্রলব্ধ নায়ক।
সুখের শয়ন ঘরে, স্বীয়া নানা রস করে, তাহা ছাড়্যা আইলাম পর আশা করিয়া। গুরু ভয় লঘু করে, অন্ধকারে নাহি ডরে, ছাড়িয়া আপন বেশ পর বেশ ধরিয়া॥ সঙ্কেত স্মরণ করে, আস্যাছিল বেশ ধরে, আমার বিলম্বে বুঝি ঘরে গেল ফিরিয়া। আসিয়া সঙ্কেত ঠাঁই, দেখিতে পাইল নাই, আহা মরি অন্য কেবা লয়্যা গেল হরিয়া॥
অথ স্বাধীনভার্য্য নায়ক।
তুমি প্রাণ তুমি ধন, তপ মন তুমি গণ, হৃদয়ে যে ক্ষণ থাক সেই ক্ষণ ভাল লো। যত জন আর আছে, তুচ্ছ করি তোমা কাছে, ত্রিভুবনে তুমি ভাল আর সব কাল লো॥ তোমার বদন চাঁদ, অচল চঞ্চল চাঁদ, আমার মোহন ফাঁদ অন্ধকারে আলো লো। করেছি বিস্তর সেবা, আজি মোরে সাজাইবা, আমার মাথার কিরা যদি মোরে টাল লো॥
অথ খণ্ডিত নায়ক।
আসিব বলিয়া গেলা, অন্য সঙ্গে হলো মেলা, শরীরেতে চিহ্ন আছে লুকাবে কি বলিয়া। মোর সঙ্গে কথা কয়্যা, বঞ্চিলা অন্যেরে লয়্যা, কতেক করিলা ভাব এ কান্তেরে ছলিয়া॥ ছিন্ন ভিন্ন দেখি বেশ, আলু থালু দেখি কেশ, দেখিয়া তোমার ভাব দেহ যায় জ্বলিয়া। কে সাধিলে মনোরথ, খণ্ডিয়া পিরীতি পথ, নিজ স্থানে যাও তুমি আমি যাই চলিয়া॥
অথ কলহান্তরিত নায়ক।
অল্প অপরাধ পায়ে, কেন দিনু খেদাইয়ে, এবে কার মুখ চায়ে, কাম জ্বালা সারিব। বিবেচনা নাহি করি, এখন ঝুরিয়া মরি, অনুমানে হেন বুঝি রহিতে না পারিব॥ পুনঃ দূতী পাঠাইব, প্রীতি করি আনাইব, সবে এক দোষ তাহে পতি হয়্যা হারিব। হারি মানি দ্বন্দ্ব যাউক, তার অভিমান থাউক, তাহা বিনা এ সঙ্কটে তরিবারে নারিব॥
অথ প্রোষিত ভার্য্য নায়ক।
কোথায রহিল রামা, বিরহে দহিয়া আমা, নিরন্তর কাম জ্বালা কত আর সহিব। পিক ডাকে কুহু২, ভ্রমর গুঞ্জরে মুহু, সাপে খেকো বায়ু জ্বালা কত আর সহিব॥ চন্দন কমল দল, পোড়া যেন দাবানল, সুধাকর বিষধর কত সয়্যা রহিব। আলো দেখি অন্ধকার, পুরস্কার তিরস্কার, হেন বুঝি অবশেষে উদাসীন হইব॥
অথ প্রোষিতপত্নীক নায়ক।
যদি যাবে আমা ছাড়্যা, প্রাণ কেন লও কাড়্যা, আপন উদ্বেগ হেতু অগ্নি লয়্যা যাবে লো। তোমা সঙ্গে যাবে তাপ, আমি এড়াইব পাপ, খেতে শুতে অনুক্ষণ মনস্তাপ পাবে লো॥ প্রবোধ করিয়া তায়, ঠেকিবে দারুণ দায়, এমত হইবে ব্যক্ত সম্বিত হারাবে লো। কয়্যা দিনু শেষ মর্ম্ম, বুঝিয়া করহ কর্ম্ম, পদে পদে পাবে জ্বালা ক পদ এড়াবে লো॥
ইত্যাদি বুঝিবা নায়কের অষ্ট মত। উদাহরণেতে অনুভবে পাবে যত॥
অথ নায়ক সহায় কথন।
অথ পীঠমর্দ্দ।
রমণী করিলে ক্রোধ যে করে সান্ত্বনা। মর্ম্মধী সচিব পীঠমর্দ্দ সেই জনা॥
রমণী রত্ন সহেনা আঁচ, টুটয়ে অগ্নি পরশে কাঁচ, করিতে মান দিবে না স্থান দিবে না স্থান। কি করে ক্ষোভ সহে রামার, অবলা জাতি মৃদু আকার, জ্বলয়ে বহ্নি নহে সে মান নহে সে মান॥ রস তাপে হিয়ে বিনাশে পায়, তপনে আপ সুখায়্যা যায়, রসিয়ে মান রবে কোথায় রবে কোথায়। প্রমদা বন্ধন সংসারেরি, প্রমদা আকর আহ্লাদেরি, সদতে রাখহ সুযত্নে তায় সুরত্ন প্রায়॥
অথ বিট।
কাম শাস্ত্রে যেই জন পরম নিপুণ। বিট বলি তার নাম ধরে নানা গুণ॥
চুম্ব আলিঙ্গন, কামের দীপন, মন্ত্র তন্ত্র আদি যত। যাহে নারী বশ, যাহে বাড়ে রস, এমত জানিবা কত॥ বেশ ভূষা বাস, সন্দেহ সম্ভাষ, নৃত্য গীত নানা মত। ফিরি নানা ঠাঁই, আর কর্ম্ম নাই, আমার এই সতত॥
অথ চেটক।
সন্ধান চতুর যেই সময় ঘটক। কবিগণ তার নাম বলয়ে চেটক॥
যখন বিরলে পাব, তখনি নিকটে যাব, যদি ক্রোধে গালি দেয় তবু সয়্যা রহিব। নয়নের ভঙ্গী করি, ফল কিম্বা ফুলধরি, চারি চক্ষে এক হলে ইশারায় কহিব॥ স্নানেতে যখন যায়, ধরিতে বসন তায়, কৌতুকে কুম্ভীর হয়্যা জলে ডুবে রহিব॥ দুঃখ বিনা নহে সুখ, দেখিতে সে চাঁদ মুখ, গ্রীষ্ম হিম বৃষ্টি বাতে পরাঙ্মুখ নহিব॥
অথ বিদূষক।
কিবা রোষে কিবা তোষে যার পরিহাস। বিদূষক তার নাম হাস্যের বিলাস॥
চন্দন কজ্জল রাগ, বদনে যে দেখ দাগ, অপমান এই দেখ মুখে কালি চূণ লো। দেখ দেখ শোভা কিবা, চাঁদে আলো যেন দিবা, দোহাই দোহাই তোর কামে করে খুন লো॥ করি বা পরীক্ষা যদি, রসের তরঙ্গ নদী, দুই জনে ডুবি আইস কে হয় নিপুণ লো। আপনি দোষের ঘর, পরীক্ষা করিতে ডর, আমার মাথায় দোষ এতো বড় গুণ লো॥
অথ শৃঙ্গার নিরূপণ।
শৃঙ্গারের দুই ভেদ শুনহ প্রয়োগ। প্রথমতঃ বিপ্রলম্ভ দ্বিতীয় সম্ভোগ॥
অথ বিপ্রলম্ভ।
বিপ্রলম্ভ চারি মত শুনহ প্রকাশ। পূর্ব্বরাগ মান প্রেম বৈচিত্র্য প্রবাস॥
অথ পূর্ব্বরাগ।
অঙ্গ সঙ্গ হওনের পূর্ব্ব যে লালস। তারে বলি পর্ব্বরাগ তাহে দশাদশ॥ লালস উদ্বেগ জড় কৃষ জাগরণ। ব্যগ্ররোগ বায়ু মোহ নিদানে মরণ॥ প্রত্যেক বর্ণিতে হয় কবিতা বিস্তর। অনুভবে বুঝে লবে নাগরী নাগর॥
অথ মান।
যেই ক্রোধে দম্পতীর রসের বিচ্ছেদ। সেই মান অহেতু সহেতু দুই ভেদ॥ অহেতু যে মান সেই অনায়াসে বধ্য। সহে তুর তিন ভেদ গুরু লঘু মধ্য॥ অন্যার সহিত পতি যদি কথা কয়। তাহে জন্মে লঘুমান বাক্যে দূর হয়॥ অন্য নাম গুণপতি যদি কাছে কয়। তাহে জন্মে মধ্য মান পরীক্ষায় ক্ষয়॥ অন্য ভোগ চিহ্ন যদি দেখে পতি গায়। তাহে জন্মে গুরু মান প্রণামেতে যায়॥ সাম ভেদ ক্রিয়া দান নতি ত্যাগ রোষ। এই সাতে মান ভাঙ্গে হয় পরিতোষ॥ প্রিয়বাক্যে স্তব করে তারে বলি সাম। আত্মগুণ তার দোষ ভেদ তার নাম॥ সখী দ্বারা ভয় প্রদর্শন সেই ক্রিয়া। দান যাহে বস্ত্র মাল্য ভূষণাদি দিয়া॥ নতি সেই যাহে পায় ধর্যা নমস্কার। ঔদাস্য প্রকাশ সেই ত্যাগ নাম যার॥ রোষ সেই যাহে ভয় কষ্টের বিস্তার। মান শান্তি চিহ্ন অশ্রু লোমাঞ্চ সীৎকার॥ অবশ্য এসব রূপে মানের বিনাশ! অসাধ্য হইলে তারে বলি রসাভাস॥ প্রত্যেকে বর্ণিতে হয় কবিতা বিস্তর। অনুভবে বুঝে লবে নাগরী নাগর॥
অথ প্রেমবৈচিত্র্য।
অথ প্রবাস।
প্রবাস দ্বিমত হয় নিকট আর দূর। দশ দশা হয় তাহে বিষাদ প্রচুর॥ প্রথমেতে চিন্তা দ্বিতীয়াতে জাগরণ। তৃতীয়াতে উদ্বেগ চতুর্থে ক্ষীণতন॥ পঞ্চমে মলিন ষষ্ঠে প্রলাপ বিষাদ। সপ্তমেতে ব্যাধি হয় অষ্টমে উন্মাদ॥ নবমেতে মোহ হয় দশমে মরণ। অনুভবে বুঝে লবে দেখিয়া লক্ষণ॥
অথ সম্ভোগ।
সম্ভোগের চারি ভেদ করিয়া বাখান। সঙ্ক্ষিপ্ত সঙ্কীর্ণ সম্পূর্ণ সমৃদ্ধিমান॥ পূর্ব্বরাগ পরে অল্প চুম্ব অল্প কোল। সঙ্ক্ষিপ্ত সে রতি তাহে চিত্ত হয় লোল॥ মানভঙ্গে পুরুষ সঙ্গে মেলন যে হয়। সঙ্কীর্ণ তাহার নাম কবিগণ কয়॥ কিঞ্চিৎ প্রবাস পরে হয় যে মেলন। সংপূর্ণ তাহার নাম কহে কবি গণ॥ সুদূর প্রবাস পরে মেলন যে রস। সে রস সমৃদ্ধি মান দম্পতী অবশ॥
অথ সম্ভোগের প্রকার।
দর্শন স্পর্শন কথা পথরোধ বাস। বনখেলা জলখেলা গীত বাদ্য হাস॥ লুক্কাওন মধুপান আদি নানা মত। অনন্ত অনন্তভাব বিরচিব কত॥
অথ দর্শন।
সাক্ষাৎ দর্শন।
নয়নে নয়ন, বদনে বদন, চরণে চরণ, আদেশি রহ। হৃদয়ে হৃদয়, প্রাণ সমুদয়, পরাণে আলয়, ভাঙ্গিয়া লহ॥ গমনে গমন, রমণে রমণ, বচনে বচন, বিনয় কহ। পায়্যাছি দরশ, পরম পরশ, সকলে সরস, হইয়া রহ॥
অথ স্বপদর্শন।
নিদ্রার আবেশে, রজনীর শেষে, মনোহর বেশে, বঁধূ আসিয়া প্রেম পারাবার, করিল বিস্তার, নাহি পাই পার, যাই ভাসিয়া॥ যে রস হইল, মনেতে রহিল, যে কথা কহিল, মৃদুহাসিয়া। ধরম করম, সরম ভরম, নরম মরম, গেল নাশিয়া॥
অথ চিত্রদর্শন।
দেখিবারে মিত্র, করিলাম চিত্র, এবড় বিচিত্র, হইল তায়। দেখিতে বদন, মাতিল মদন, ছাড়িয়া সদন, চেতন যায়॥ না পানু দেখিতে, নারিনু রাখিতে, লিখিতে লিখিতে, হইল দায়। চিত্রের পুতুল, করিল আকূল, হারানু দুকূল, চিত্রের প্রায়॥
অথ আলম্বনাদি কথন।
আলম্বন বিভাবন আর উদ্দীপন। এইতিন ভাবের শুনহ বিবরণ॥ আলম্বন সেই যাহে রসের আশ্রয়। নায়ক নায়িকা দুই তার বিনিময়॥ নানাবিধ অনুভাবে বলি বিভাবন। যাহে রস বাড়ে তাহে বলি উদ্দীপন॥
অথ উদ্দীপন।
গুণ স্মরা নাম লওয়া নিত্য রূপ দেখা। গীত বাদ্য শুনা আর কর্ম্ম রেখা লেখা॥ সুগন্ধি ভূষণ মেঘ পিক ভৃঙ্গ রব॥ চন্দ্র আদি নানা মত উদ্দীপন সব॥
অথ বিভাবন।
ভাব হাব হেলা হাস শোভা দীপ্তি কান্তি। মধুরতা উদারতা প্রগল্ভতা কান্তি॥ ধৈর্য্য লীলা বিলাস বিচ্ছিত্তি মৌগ্ধ্য ভ্রম। কিলকিঞ্চিৎ মোট্টায়িত কুট্টমিত শ্রম॥ বিব্বোক লালিত্য মদ চকিত বিকার। নানা মত অনুভব কত কব আর॥
অথ ভাবহাদির পরিচয়।
চিত্তের প্রথম যেই বিকার সে ভাব। গলা চক্ষু ভুরূ আদি বিকাশেতে হাব॥ বক্ষ কাঁপে বস্ত্র খসে তারে বলি হেলা। প্রিয় কৃত কর্ম্ম চেষ্টা তারে বলি লীলা॥ হাস সেই হাস্যে বলি বৃথা হয় যেই। পরিচ্ছেদ বিনা শোভা মধুরতা সেই॥ শোভা কান্তি দীপ্তি শ্রম ব্যক্ত আছে এই। শ্রমে অঙ্গ শ্লথ যেই কান্তি হয় সেই॥ রতি বিপরীত আদি সেই প্রগল্ভতা। ক্রোধেও বিনয় বাক্য সেই উদারতা॥ ধৈর্য্য সেই দুঃখেতে প্রেমের নহে হ্রাস। সাক্ষাতে প্রফুল্ল অঙ্গ সেই সে বিলাস॥ অল্প অভরণে শোভা বিচ্ছিত্তি সে হয়। বিভ্রম ব্যক্ত হলে বেশ বিপর্য্যয়। ক্রন্দনেতে হাস্য আর অভয়েতে ভয়। অক্রোধেতে ক্রোধ কিলকিঞ্চিৎ সে হয়॥ প্রসঙ্গেতে অঙ্গ ভঙ্গ সেই মোট্টায়িত। অঙ্গ ছুলে সুখে ক্রোধ সেই কুট্টমিত॥ বিব্বোক বাঞ্ছিত বস্তু পায়্যা অনাদর। অঙ্গভঙ্গ ঝনৎকার লালিত্যে সুন্দর॥ লজ্জায় না কহি কার্য্য চেষ্টায় জানায়। বিকার তাহারে বলে বুঝ অভিপ্রায়॥ জ্ঞাততে অজ্ঞান সম মৌগ্ধ্য সেইহয়া চকিত ভ্রমরাদি দর্শনেতে ভয়॥ যৌবনাদি অভিমান জন্য মদ হয়। কেলি তাপ আদি যত কবিগণ কয়॥ কেশ বাস খসে অঙ্গ মোড়া হাই উঠে। লোমাঞ্চ প্রফুল্ল গদ্গদি ঘর্ম্ম ছুটে।
অথ স্বাত্বিকভাব।
স্তম্ভ হয় ঘর্ম্ম বয় রোমাঞ্চ প্রকাশ। বিবর্ণ কম্পন অশ্রুঃ গদ গদ ত্রাস॥ প্রিয় বিনা সুখ যত দুঃখ সে তো হয়। প্রিয় পাইলে দুঃখে সুখ রাগ তারে কয়।
অথ যৌবনকথন।
যৌবনের চারি ভেদ শুন বিবরণ। আগে বয়ঃসন্ধি পরে নবীন যৌবন॥ তার পরে বৃদ্ধ ভাব বুঝ বিচক্ষণ॥ যৌবনের সন্ধি কাল দ্বাদশ বৎসর। দশম নিয়ম কন ব্যাস মুনিবর॥
যৌবন পরম ধন, স্ববশ ইন্দ্রয় গণ, শিশু বৃদ্ধ দেখি লোক রসকথা কহে না। বালকের নাহি শুদ্ধি, বৃদ্ধ হলে হতবুদ্ধি, যুবা বিনা রস আর কোন খানে রহে না। যুবা সূর্য্য বলবান্, যুবা চন্দ্র দ্যুতিমান্, যুবা বিনা সংসারের ভার অন্যে বহেনা। বিনা নর কিবা অন্য, যৌবনে সকল ধন্য, যৌবন হইলে নষ্ট দেখি দেহ রহে না॥
নারীর যৌবন বড় দুরন্ত। শরীরের মাঝে পোষে বসন্ত॥ বিনোদ বিননে বিনায়্যা বেণী। পুরুষে দংশিতে পোষে সাপিনী॥ কত কত অলি নয়নে ঘোরে। মধুবাক্যে কত কোকিল ঝোরে॥ মলয় বাতাস শ্বাসেতে বহে। সৌরভে সুরভি গৌরব নহে॥ কমল কানন আননে থাকে। বান্ধুলি মধুর অধরে রাখে॥ দুখানি বিষাণ নিশান রাখ্যা। হৃদয়ে মলয় রাখ্যাছে ঢাক্যা॥ লোহিত কমল মৃণাল সাতে। অভ রণে ঢাক্যা রাখ্যাছে হাতে॥ ত্রিবলী ডোরেতে বান্ধ্যা অনঙ্গ। কটিতটে থুয়্যা দেখয়ে রঙ্গ॥ সম্বরে অম্বর দিয়া কান্তার। মদন সদন রস ভাণ্ডার॥ কিশলয় করিকরের ভয়। চরণের তলে শরণ লয়॥ যৌবন মরম না জানে যেবা। পণ্ডিত তাহারে বলয়ে কেবা॥ তপ জপ জ্ঞান দান যে কিছু। সকলি যৌবন ধনের পিছু॥ যৌবন এতিন অক্ষর লেখ। যে জান মরম উত্তম দেখ॥ যৌবন মরম যে জানে নাই। প্রথম ছাড়িয়া তাহার ঠাই॥ যদ্যপি যৌবনে উদ্যম করে। প্রথমের মত গলিয়া মরে॥ ভারত চন্দ্রের ভারতি যোগ। যৌবনেতে কর যৌবন ভোগ॥
অথ স্ত্রীজাতিকথন।
অতঃপর চারি জাতি বর্ণিব কামিনী। পদ্মিনী, চিত্রিণী, আর শঙ্খিনী, হস্তিনী॥
পদ্মিনী।
নয়ন কমল, কুঞ্চিত কুন্তল, ঘন কুচস্থল, মৃদুহাসিনী। ক্ষুদ্র রন্ধ্র নাসা, মৃদু মন্দ ভাষা, নৃত্যগীতে আশা, সত্যবাদিনী॥ দেব দ্বিজে ভক্তি, পতি আনুরক্তি, অল্প রতিশক্তি, নিদ্রা ভোগিনী। মদন আলয়, লোম নাহি হয়, পদ্মগন্ধ কয়, সেই পদ্মিনী॥
চিত্রিণী।
শঙ্খিনী।
দীঘল শ্রবণ, দীঘল নয়ন, দীঘল চরণ, দীঘল পাণি। মদন আলয়, অল্প লোম হয়, মীনগন্ধ কয়, শঙ্খিনী জানি॥
হস্তিনী।
স্থূল কলেবর, স্থূল পয়োধর, স্থল পদ কর, ঘোর নাদিনী। আহার বিস্তর, নিদ্রা ঘোরতর, রমণে প্রখর, পরগামিনী॥ ধর্ম্মে নাহি ডর, দম্ভ নিরন্তর, কর্ম্মে তৎপর, মিথ্যাবাদিনী। মদন আলয়, বহু লোম হয়, মদগন্ধ কয়, সেই হস্তিনী॥
পুরুষজাতি কথন।
চারি জাতি নায়িকার শুনহ নায়ক। শশ, মৃগ, বৃষ, অশ্ব, সন্তোষ দায়ক॥ পদ্মিনীর শশ পতি, মৃগচিত্রিণীর। বৃষে শঙ্খিনীর তুষ্টি অশ্বে হস্তিনীর॥ রূপ গুণ দোষ সব নায়িকার মত। চারি জাতি নায়কেতে লক্ষণ সম্মত॥ রসভাণ্ড মত রসদণ্ড ভেদ হয়। ছয়, আট, দশ, বার, পরিমাণ কয়॥ নর নারী স্বভাবেতে বিশেষ যে হয়। কহিতে কবিতা বাড়ে ক্ষোভ এই রয়॥
সমাপ্ত।
এই লেখাটি ১ জানুয়ারি ১৯২৯ সালের পূর্বে প্রকাশিত এবং বিশ্বব্যাপী পাবলিক ডোমেইনের অন্তর্ভুক্ত, কারণ উক্ত লেখকের মৃত্যুর পর কমপক্ষে ১০০ বছর অতিবাহিত হয়েছে অথবা লেখাটি ১০০ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে ।