রাজযোগ/গ্রন্থকারের ভূমিকা

গ্রন্থকারের
ভূমিকা

ঐতিহাসিক জগতের প্রারম্ভ হইতে বর্ত্তমানকাল পর্য্যন্ত মনুষ্যসমাজে অনেক অলৌকিক ঘটনার সংঘটনের বিষয় উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এক্ষণেও যে সকল সমাজ আধুনিক বিজ্ঞানের পূর্ণালোকে বাস করিতেছে, তাহাদের মধ্যেও এইরূপ ঘটনার সাক্ষ্যপ্রদানকারী লোকের অভাব নাই। এইরূপ প্রমাণের অধিকাংশই বিশ্বাসের অযোগ্য, কারণ, যে ব্যক্তিগণের নিকট হইতে এই সকল প্রমাণ পাওয়া যায়, তন্মধ্যে অনেকেই অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বা প্রতারক। অনেক সময়ই দেখা যায়, লোকে যে ঘটনাগুলিকে অলৌকিক বলিয়া নির্দ্দেশ করে, সেগুলি প্রকৃতপক্ষে নকল। কিন্তু কথা এই, উহার কাহার নকল? যথার্থ অনুসন্ধান না করিয়া কোন কথা একেবারে উড়াইয়া দেওয়া সত্যপ্রিয় বৈজ্ঞানিক মনের পরিচয় নহে। যে সকল বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মদর্শী নন, তাঁহারা নানাপ্রকার অলৌকিক মনোরাজ্যের ব্যাপারপরম্পরা ব্যাখ্যা করিতে অসমর্থ হইয়া সেগুলির অস্তিত্ব একেবারে অস্বীকার করিতে চেষ্টা পান। অতএব, ইঁহারা—যে সকল ব্যক্তির বিশ্বাস, মেঘপটলারূঢ় কোন পুরুষবিশেষ অথবা কতকগুলি পুরুষ তাহাদের প্রার্থনার উত্তর প্রদান করেন, অথবা তাহাদের প্রার্থনার প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম করেন,—তাহাদের অপেক্ষা অধিকতর দোষী। কারণ, ইহাদের বরং অজ্ঞতা অথবা বাল্যকালের ভ্রমপূর্ণ শিক্ষাপ্রণালীর (যাহা তাহাদিগকে এইরূপ অপ্রাকৃত পুরুষদিগের প্রতি নির্ভর করিতে শিক্ষা দিয়াছে ও যে নির্ভরতা এক্ষণে তাহাদের অবনত স্বভাবের একাংশস্বরূপ হইয়া পড়িয়াছে) দোহাই দেওয়া চলিতে পারে, কিন্তু পূর্ব্বোক্ত শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের দোহাই দিবার কিছুই নাই।

সহস্ৰ সহস্ৰ বৎসর ধরিয়া লোকে এইরূপ অলৌকিক ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করিয়াছে, উহার বিষয়ে বিশেষরূপ চিন্তা করিয়াছে ও তৎপরে উহার ভিতর হইতে কতকগুলি সাধারণ তত্ত্ব বাহির করিয়াছে; এমন কি, মানুষের ধর্ম্মপ্রবৃত্তির ভিত্তিভূমি পর্য্যন্ত বিশেষরূপে তন্ন তন্ন করিয়া বিচার করা হইয়াছে। এই সমুদয় চিন্তা ও বিচারের ফল এই রাজযোগবিদ্যা। রাজযোগ,—আজকালকার অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতদিগের অমার্জ্জনীয় ধারা অবলম্বনে—যে সকল ঘটনা ব্যাখ্যা করা দুরূহ,—তাহাদিগের অস্তিত্বের অস্বীকার করে না বরং ধীরভাবে অথচ সুস্পষ্ট ভাষায় কুসংস্কারাবিষ্ট ব্যক্তিগণকে বলে যে আলৌকিক ঘটনা, প্রার্থনার উত্তর, বিশ্বাসের শক্তি এগুলি যদিচ সত্য, কিন্তু মেঘপটলারূঢ় কোন পুরুষ অথবা পুরুষগণ দ্বারা ঐ সকল ব্যাপার সংসাধিত হয়, এইরূপ কুসংস্কারপূর্ণ ব্যাখ্যা দ্বারা ঐ ঘটনাগুলি বুঝা যায় না। ইহা সমুদয় মানবজাতিকে এই শিক্ষা দেয় যে, জ্ঞান ও শক্তির অনন্ত সমুদ্র আমাদের পশ্চাতে রহিয়াছে, প্রত্যেক ব্যক্তি তাহারই একটি ক্ষুদ্র প্রণালী মাত্র। ইহাতে আরও এই শিক্ষা দেয় যে, যেমন সমুদয় বাসনা ও অভাব মানুষের অন্তরেই রহিয়াছে, সেইরূপ তাহার অন্তরেই তাহার ঐ অভাব মোচনের শক্তিও রহিয়াছে; যখনই এবং যেখানেই কোন বাসনা, অভাব বা প্রার্থনা পরিপূর্ণ হয়, তখনই বুঝিতে হইবে যে, এই অনন্ত ভাণ্ডার হইতেই এই সমুদয় প্রার্থনাদি পরিপূর্ণ হইতেছে, উহা কোন অপ্রাকৃতিক পুরুষ হইতে নহে। অপ্রাকৃতিক পুরুষের ধারণায় মানুষের ক্রিয়াশক্তি কিঞ্চিৎ পরিমাণে উদ্দীপ্ত হইতে পারে বটে, কিন্তু ইহাতে আবার আধ্যাত্মিক অবনতি আনয়ন করে। ইহাতে স্বাধীনতা চলিয়া যায়; ভয় ও কুসংস্কার আসিয়া হৃদয়কে অধিকার করে। ইহা ‘মানুষ স্বভাবতঃ দুর্ব্বলপ্রকৃতি’ এইরূপ ভয়ঙ্কর বিশ্বাসে পরিণত হইয়া থাকে। যোগী বলেন, ‘অপ্রাকৃতিক বলিয়া কিছু নাই, তবে প্রকৃতির স্থূল ও সূক্ষ্ম দ্বিবিধ প্রকাশ বা রূপ আছে বটে।’ সূক্ষ্ম কারণ, স্থূল কার্য্য। স্থূলকে সহজেই ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায়, সূক্ষ্ম তদ্রুপ নহে। রাজযোগ অভ্যাস দ্বারা সূক্ষ্ম অনুভূতি অজ্জির্ত হইতে থাকে।

ভারতবর্ষে যত বেদমতানুসারী দর্শনশাস্ত্র আছে, তাহাদের সকলের একই লক্ষ্য—পূর্ণতা লাভ করিয়া আত্মার মুক্তি। ইহার উপায় যোগ। ‘যোগ’ শব্দ বহুভাবব্যাপী। সাংখ্য ও বেদান্ত উভয় মতই কোন না কোন আকারে যোগের সমর্থন করে।

বর্ত্তমান গ্রন্থে নানাপ্রকার যোগের মধ্যে রাজযোগের বিষয় লিখিত হইয়াছে। পাতঞ্জলসূত্র রাজযোগের শাস্ত্র ও সর্ব্বোচ্চ প্রামাণিক গ্রন্থ। অন্যান্য দার্শনিকগণের কোন কোন দার্শনিক বিষয়ে পতঞ্জলির সহিত মতভেদ হইলেও, সকলেই অবিপর্য্যয়ে তদীয় সাধনপ্রণালীর অনুমোদন করিয়াছেন। এই পুস্তকের প্রথমাংশে, বর্ত্তমান লেখক নিউইয়র্কে কতকগুলি ছাত্রকে শিক্ষা দিবার জন্য যে সকল বক্তৃতা প্রদান করেন, সেইগুলি দেওয়া গেল। অপরাংশে পতঞ্জলির সূত্রগুলির ভাবানুবাদ ও তাহার সহিত একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। যতদূর সাধ্য পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার না করিবার ও কথোপকথনোপযোগী সহজ ও সরল ভাষায় লিখিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। প্রথমাংশে সাধনার্থিগণের জন্য কতকগুলি সরল ও বিশেষ উপদেশ দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু তাঁহাদের সকলকেই বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দেওয়া যাইতেছে যে যোগের কোন কোন সামান্য অঙ্গ ব্যতীত, নিরাপদে যোগশিক্ষা করিতে হইলে, গুরু সর্ব্বদা নিকটে থাকা আবশ্যক। যদি কথাবার্ত্তার ছলে প্রদত্ত এই সকল উপদেশ লোকের অন্তরে এই সম্বন্ধে আরও অধিক জানিবার ইচ্ছা উদ্রেক করিয়া দিতে পারে, তাহা হইলে গুরুর অভাব হইবে না।

পাতঞ্জলদর্শন সাংখ্যমতের উপর স্থাপিত, এই দুই মতে প্রভেদ অতি সামান্য। দুটি প্রধান মতবিভিন্নতা এইঃ প্রথমতঃ,—পতঞ্জলি আদিগুরুস্বরূপ সগুণ ঈশ্বর স্বীকার করেন, কিন্তু সাংখ্যেরা কেবল প্রায় পূর্ণতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি, যাঁহার উপর সাময়িক (কোন কল্পে) জগতের শাসনভার প্রদত্ত হয়, এইরূপ অর্থাৎ জন্য-ঈশ্বর মাত্র স্বীকার করিয়া থাকেন। দ্বিতীয়তঃ, যোগীরা মনকে আত্মা বা পুরুষের ন্যায় সর্ব্বব্যাপী বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন, সাংখ্যেরা তাহা করেন না।