রাজসিংহ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 নির্ম্মল, ধীরে ধীরে রাজকুমারীর কাছে গিয়া বসিলেন। দেখিলেন, রাজকুমারী একা বসিয়া কাঁদিতেছেন। সে দিন যে চিত্রগুলি ক্রীত হইয়াছিল, তাহার একখানি রাজকুমারীর হাতে দেখিলেন। নির্ম্মলকে দেখিয়া চঞ্চল চিত্রখানি উল্টাইয়া রাখিলেন—কাহার চিত্র নির্ম্মল তাহা দেখিতে পাইল না। নির্ম্মল কাছে গিয়া বসিয়া, বলিল,

 “এখন উপায়!”

 চঞ্চল। উপায় যাই হউক—আমি মোগলের দাসী কখনই হইব না।

 নির্ম্মল। তোমার অমত তা ত জানি, কিন্তু আলমগীর বাদশাহের হুকুম, রাজার কি সাধ্য যে অন্যথা করেন? উপায় নাই, সখি!—সুতরাং তোমাকে ইহা অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। আর স্বীকার করা ত সৌভাগ্যের বিষয়। যোধপুর বল, অম্বর বল, রাজা, বাদশাহ, ওমরাহ নবাব, সুবা, যাহা বল, পৃথিবীতে এত বড় লোক কে আছে, যে তাহার কন্যা দিল্লীর তক্তে বসিতে বাসনা করে না? পৃথিবীশ্বরী হইতে তোমার এত অসাধ কেন?

 চঞ্চল রাগ করিয়া বলিল, “তুই এখান হইতে উঠিয়া যা।”

 নির্ম্মল দেখিল ওপথে কিছু হইবে না। তবে আর কোন পথে রাজকুমারীর কিছু উপকার করিতে পারে তাহার সন্ধান করিতে লাগিল। বলিল,

 “আমি যেন উঠিয়া গেলাম—কিন্তু যাঁহার দ্বারা প্রতিপালন হইতেছি; আমাকে তাঁহার হিত খুঁজিতে হয়। তুমি যদি দিল্লী না যাও, তবে তোমার বাপের দশা কি হইবে তাহা কি একবার ভাবিয়াছ?”

 চ। ভাবিয়াছি। আমি যদি না যাই,তবে আমার পিতার কাঁধে মাতা থাকিবে না— রূপনগরের গড়ের একখানি পাতর থাকিবে না। তা ভাবিয়াছি—আমি পিতৃহত্যা করিব না। বাদশাহের ফৌজ আসিলেই আমি তাহাদিগের সঙ্গে দিল্লীযাত্রা করিব। ইহা স্থির করিয়াছি।

 নির্ম্মল প্রসন্ন হইল। বলিল, “আমিও সেই পরামর্শই দিতেছিলাম।”

 রাজকুমারী আবার ভ্রূভঙ্গী করিলেন— বলিলেন, “তুই কি মনে করেছিস্ যে আমি দিল্লীতে গিয়া মুসলমান বানরের শয্যায় শয়ন করিব? হংসী কি বকের সেবা করে?”

 নির্ম্মল কিছুই বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তবে কি করিবে?”

 চঞ্চলকুমারী হস্তের একটি অঙ্গুরীয় নির্ম্মলকে দেখাইল। বলিল, “দিল্লীর পথে বিষ খাইব।” নির্ম্মল জানিত ঐ অঙ্গুরীয়তে বিষ আছে।

 নির্ম্মল শিহরিয়া উঠিল; কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “আর কি কোন উপায় নাই?”

 চঞ্চল বলিল, “আর উপায় কি সখি? কে এমন বীর পৃথিবীতে আছে যে, আমার উদ্ধার করিয়া দিল্লীশ্বরের সহিত শত্রুতা করিবে? রাজপুতনার কুলাঙ্গার সকলি মোগলের দাস—আর কি সংগ্রাম আছে না প্রতাপ আছে?”

 নির্ম্মল। কি বল রাজকুমারি! সংগ্রাম কি প্রতাপ যদি থাকিত, তবে তাহারাই বা তোমার জন্য সর্ব্বস্ব পণ করিয়াই বা দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে বিবাদ করিবে কেন? পরের জন্য কেহ সহজে সর্ব্বস্ব পণ করে না। প্রতাপ নাই, সংগ্রাম নাই, কিন্তু রাজসিংহ আছে—কিন্তু তোমার জন্য রাজসিংহ সর্ব্বস্ব পণ করিবে কেন? বিশেষ তুমি মাড়বারের ঘরানা।

 চঞ্চল। সে কি? বাহুতে বল থাকিতে কোন্ রাজপুত শরণাগতকে রক্ষা করে নাই? আমি তাই ভাবিতেছিলাম নির্ম্মল—আমি এ বিপদে সেই সংগ্রাম প্রতাপের বংশতিলকেরই শরণ লইব—তিনি কি আমায় রক্ষা করিবেন না? বলিতে বলিতে চঞ্চলদেবী ঢাকা ছবিখানি উল্টাইলেন—নির্ম্মল দেখিল সে রাজসিংহের মূর্ত্তি। চিত্র দেখাইয়া রাজকুমারী বলিতে লাগিলেন, “দেখ সখি, এ রাজকান্তি দেখিয়া তোমার কি বিশ্বাস হয় না যে ইনি অগতির গতি, অনাথার রক্ষক? আমি যদি ইহার স্মরণ লই ইনি কি রক্ষা করিবেন না?”

 নির্ম্মলকুমারী অতি স্থিরবুদ্ধিশালিনী—চঞ্চলের সহোদরাধিকা। নির্ম্মল অনেক ভাবিল। শেষে চঞ্চলের প্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া জিজ্ঞাসা করিল,

 “রাজকুমারি—যে বীর তোমাকে এ বিপদ হইতে রক্ষা করিবে, তাহাকে তুমি কি দিবে?”

 রাজকুমারী বুঝিলেন। স্থির কাতর অথচ অবিকম্পিত কণ্ঠে বলিলেন,

 “কি দিব সখি! আমার কি আর দিবার আছে? আমি যে অবলা!”

 নির্ম্মল। তোমার তুমিই আছ?

 চঞ্চল অপ্রতিত হইয়া বলিল, “দূর হ!”

 নির্ম্মল। তা রাজার ঘরে এমন হইয়া থাকে। তুমি যদি রুক্মিণী হইতে পার, যদুপতি আসিয়া অবশ্য উদ্ধার করিতে পারেন।

 চঞ্চলকুমারী মুখাবনত করিল। বলিল, “তাঁহাকে পাইব আমি কি এমন ভাগ্য করিয়াছি? আমি বিকাইতে চাহিলে তিনি কি কিনিবেন?”

 নির্ম্মল। “সে কথার বিচারক তিনি—আমরা নই। রাজসিংহের বাহুতে শুনিয়াছি বল আছে; তাঁর কাছে কি দূত পাঠান যায় না। গোপনে—কেহ না জানিতে পারে এরূপ দূত কি তাঁহার কাছে যায় না?”

 চঞ্চল ভাবিল। বলিল, “তুমি আমার গুরুদেবকে ডাকিতে পাঠাও। আমায় আর কে তেমন ভালবাসে? কিন্তু তাঁহাকে সকল কথা বুঝাইয়া বলিয়া আমার কাছে আনিও। সকল কথা বলিতে আমার লজ্জা করিবে।”

 নির্ম্মল উঠিয়া গেল। কিন্তু তাহার মনে কিছুমাত্র ভরসা হইল না। সে কাঁদিতে কাঁদিতে গেল।