রাজসিংহ/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

 প্রভাতে মোগল সৈন্য সাজিল। রূপনগরের গড়ের সিংহদ্বার হইতে, উষ্ণীষকবচ শোভিত, গুমফশ্মশ্রুসমন্বিত, অস্ত্রসজ্জাভীষণ অশ্বারোহী দল সারি দিল। পাঁচ পাঁচজন অশ্বারোহী এক এক সারি, সারির পিছু সারি, তার পর আবার সারি, দারি সারি সারি অশ্বারোহীর সারি চলিতেছে; ভ্রমরশ্রেণীসমাকুল ফুল্লকমলতুল্য তাহাদের বদনমণ্ডল সকল শোভিতে ছিল। তাহাদের অশ্বশ্রেণী গ্রীবাভঙ্গে সুন্দর, বল্গারোধে অধীর, মন্দগমনে ক্রীড়াশীল; অশ্বশ্রেণীর শরীরভরে হেলিতেছে দুলিতেছে এবং নাচিয়া নাচিয়া চলিতেছে।

 চঞ্চলকুমারী প্রভাতে উঠিয়া স্নান করিয়া, রত্নালঙ্কারে ভূষিতা হইলেন। নির্ম্মল অলঙ্কার পরাইল; চঞ্চল বলিল, “ফুলের মালা পরাও সখি—আমি চিতারোহণে যাইতেছি।” প্রবলবেগে প্রবহমান চক্ষের জল, চক্ষুঃপ্রান্তে ফেরৎ পাঠাইয়া নির্ম্মল বলিল, “রত্নালঙ্কার পরাই সখি, তুমি উদয়পুরেশ্বরী হইতে যাইতেছে।” চঞ্চল বলিল, “পরাও! পরাও! নির্ম্মল! কুৎসিত হইয়া কেন মরিব? রাজার মেয়ে আমি; রাজার মেয়ের মত সুন্দর হইয়া মরিব। সৌন্দর্য্যের মত কোন রাজ্য? রাজত্ব কি বিনা সৌন্দর্য্যে শোভা পায়? পরা।” নির্ম্মল অলঙ্কার পরাইল, সে কুসুমিততরুবিনিন্দিত কান্তি দেখিয়া কাঁদিল। কিছু বলিল না। চঞ্চল তখন, নির্ম্মলের গলা ধরিয়া কাঁদিল।

 চঞ্চল তার পর বলিল, “নির্ম্মল! আর তোমায় দেখিব না! কেন বিধাতা এমন বিড়ম্বনা করিলেন! দেখ ক্ষুদ্র কাঁটার গাছ যেখানে জন্মে সেইখানে থাকে; আমি কেন রূপনগরে থাকিতে পাইলাম না!”

 নির্ম্মল বলিল, “আমায় আবার দেখিবে। তুমি যেখানে থাক; আমার সঙ্গে আবার দেখা হইবে। আমার না দেখিলে তোমার মরা হইবে না; তোমায় না দেখিলে আমার মরা হইবে না।”

 চঞ্চল। আমি দিল্লীর পথে মরিব।

 নির্ম্মল। দিল্লীর পথে তবে আমায় দেখিবে।

 চঞ্চল। সে কি নির্ম্মল? কি প্রকারে তুমি যাইবে?

 নির্ম্মল কিছু বলিল না। চঞ্চলের গলা ধরিয়া কাঁদিল।

 চঞ্চলকুমারী বেশভুষা সমাপন করিয়া মহাদেবের মন্দিরে গেলেন। নিত্যব্রত শিবপূজা ভক্তিভাবে করিলেন। পূজান্তে বলিলেন, “দেবদেব মহাদেব! মরিতে চলিলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি বালিকার মরণে তেমার এত তুষ্টি কেন? প্রভো! আমি বাঁচিল কি তোমার সৃষ্টি চলিত না? যদি এতই মনে ছিল, কেন আমাকে রাজার মেয়ে করিয়া সংসারে পাঠাইয়াছিলে?”

 মহাদেবের বন্দনা করিয়া চঞ্চলকুমারী মাতৃচরণ বন্দনা করিতে গেলেন! মাতাকে প্রণাম করিয়া চঞ্চল কতই কাঁদিল। পিতার চরণে গিয়া প্রণাম করিল। পিতাকে প্রণাম করিয়া চঞ্চল কতই কাঁদিল! তার পর একে একে সখীজনের কাছে, চঞ্চল বিদায়গ্রহণ করিল। সকলে কাঁদিয়া গণ্ডগোল করিল। চঞ্চল কাহাকে অলঙ্কার, কাহাকে খেলেনা, কাহাকে অর্থ দিয়া পুরস্কৃত করিলেন। কাহাকে বলিলেন; “কাঁদিও না; আমি আবার আসিব।” কাহাকে বলিলেন, “কাঁদিও না; দেখিতেছ না, আমি পৃথিবীশ্বরী হইতে যাইতেছি?” কাহাকেও বলিলেন “কাঁদিও না—কাঁদিলে যদি দুঃখ ষাইত তবে আমি কাঁদিয়া রূপনগরের পাহাড় ভাসাইতাম!”

 সকলের কাছে বিদায় গ্রহণ করিয়া, চঞ্চলকুমারী শিবিকারোহণে চলিলেন। একসহস্র অশ্বারোহী সৈন্য শিবিকার অগ্রে স্থাপিত হইয়াছে; এক সহস্র পশ্চাতে। রজতমণ্ডিত, রত্নখচিত সে শিবিকা, বিচিত্র সুবর্ণখচিত বস্ত্রে আবৃত হইয়াছে। আশা সোঁটা লইয়া চোপদার বাগ্‌জালে গ্রাম্য দর্শকবর্গকে আনন্দিতা করিতেছে। চঞ্চলকুমারী শিবিকায় আরোহণ করিলেন। দুর্গমধ্য হইতে শঙ্খ নিনাদিত হইল; কুসুম ও লাজাবলীতে শিবিকা পরিপূর্ণ হইল; সেনাপতি চলিবার আজ্ঞা দিলেন; তখন অকস্মাৎ মুক্তপথতড়াগের জলের ন্যায় সেই অশ্বারোহিশ্রেণী প্রবাহিত হইল; বল্গা দংশিত করিয়া, নাচিতে নাচিতে, অশ্বশ্রেণী চলিল—অশ্বারোহীদিগের অস্ত্রের ঝঞ্ঝনা বাজিল।

 অশ্বারোহিগণ প্রভাতবায়ুপ্রফুল্ল হইয়া কেহ কেহ গান করিতেছিল। শিবিকার পশ্চাতেই যে অশ্বারোহিণ ছিল, তাহার মধ্যে অগ্রবর্ত্তী একজন গায়িতেছিল—যাহা গায়িতেছিল, তাহার অনুবাদ, যথা—

যারে ভাবি দূরে সে সতত নিকটে।
প্রাণ গেলে তবু সে যে রাখিবে সঙ্কটে।

 রাজকুমারীর কর্ণে সে গীত প্রবেশ করিল। তিনি ভাবিলেন, “হায়! যদি শিপাহীর গীত মতা হইত!” রাজকুমারী তখন রাজসিংহকে ভাবিতেছিলেন। তিনি জানিতেন না, যে আঙ্গুলকাটা মাণিকলাল তাঁহার পশ্চাতে এই গীত গায়িতেছিল। মাণিকলাল, যত্ন করিয়া শিবিকার পশ্চাতে স্থানগ্রহণ করিয়াছিল।