রাজসিংহ (১৮৮৫)/অষ্টম পরিচ্ছেদ

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 তথায়, উপলঘাতিনী কলনাদিনী, তটিনীর সঙ্গে সুমন্দমধুর বায়ু, এবং স্বরলহরী বিকীর্ণকারী কুঞ্জবিহঙ্গমগণ ধ্বনি মিশাইতেছে। তথায় স্তবকে স্তবকে বন্যকুসুম সকল প্রস্ফুটিত হইয়া, পার্ব্বতীয় বৃক্ষরাজি আলোকময় করিতেছে। তথায়, রূপ উছলিতেছে, শব্দ তরঙ্গায়িত হইতেছে, গন্ধ মাতিয়া উঠিতেছে, এবং মন প্রকৃতির বশীভূত হইতেছে। সেইখানে রাজসিংহ এক বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডের উপর উপবেশন করিয়া পত্র দুইখানি পড়িতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 প্রথম রাজা বিক্রমসিংহের পত্র পড়িলেন। পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন—মনে করিলেন, ব্রাহ্মণকে কিছু দিলেই পত্রের উদ্দেশ্য সফল হইবে। তার পর চঞ্চলকুমারীর পত্র পড়িতে লাগিলেন। পত্র এইরূপ;—

 রাজন্—আপনি রাজপুত-কুলের চূড়া-হিন্দুর শিরোভূষণ। আমি অপরিচিতা হীনমতি বালিকা—নিতান্ত বিপন্না না হইলে কখনই আপনাকে পত্র লিখিতে সাহস করিতাম না। নিতান্ত বিপন্না বুঝিয়াই আমার এ দুঃসাহস মার্জ্জনা করিবেন।

 যিনি এই পত্র লইয়া যাইতেছেন, তিনি আমার গুরুদেব। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে জানিতে পারিবেন—আমি রাজপুতকন্যা। রূপনগর অতি ক্ষুদ্র রাজ্য—তথাপি বিক্রমসিংহ সোলাঙ্কি রাজপুত—রাজকন্যা বলিয়া আমি মধ্যদেশাধিপতির কাছে গণ্যা না হই—রাজপুতকন্যা বলিয়া দয়ার পাত্রী। কেন না আপনি রাজপুতপতি—রাজপুত কুলতিলক।

 অনুগ্রহ করিয়া আমার বিপদ শ্রবণ করুন। আমার দুরদৃষ্ট ক্রমে, দিল্লীর বাদশাহ আমার পাণিগ্রহণ করিতে মানস করিয়াছেন। অনতিবিলম্বে তাঁহার সৈন্য, আমাকে লইয়া যাইবার জন্য আসিবে। আমি রাজপুতকন্যা, ক্ষত্ত্রিয় কুলোদ্ভবা—কি প্রকারে তাহাদের দাসী হইব? রাজহংসী হইয়া কেমন করিয়া বকসহচরী হইব? হিমালয়নন্দিনী হইয়া কি প্রকারে পঙ্কিল তড়াগে মিশাইব? রাজপুতকুমারী হইয়া কি প্রকারে তুরকী বর্ব্বরের আজ্ঞাকারিণী হইব? আমি স্থির করিয়াছি, এ বিবাহের অগ্রে বিষভোজনে প্রাণত্যাগ করিব।

 মহারাজাধিরাজ! আমাকে অহঙ্কৃতা মনে করিবেন না। আমি জানি যে আমি ক্ষুদ্র ভূম্যাধিকারির কন্যা—যোধপুর, অম্বর প্রভৃতি দোর্দ্দণ্ড প্রতাপশালী রাজাধিরাজগণও দিল্লীর বাদশাহকে কন্যাদান করা কলঙ্ক মনে করেন না—কলঙ্ক মনে করা দূরে থাক, বরং গৌরর মনে করেন। আমি সে সব ঘরের কাছে কোন ছার? আমার এ অহঙ্কার কেন? এ কথা আপনি জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। কিন্তু মহারাজ! সূর্য্যদেব অস্তে গেলে খদ্যোত কি জ্বলে না? শিশিরভরে নলিনী মুদিত হইলে, ক্ষুদ্র কুন্দ কুসুম কি বিকশিত হয় না? যোধপুর অম্বর কুলধ্বংস করিলে রূপনগরে কি কুলরক্ষা হইতে পারে না? মহারাজ, ভাটমুখে শুনিয়াছি, যে, বনবাসী রাণা প্রতাপের সহিত মহারাজা মানসিংহ ভোজন করিতে আসিলে, মহারাণা ভোজন করেন নাই, বলিয়াছিলেন, যে তুর্ককে ভগিনী দিয়াছে, আহার সহিত ভোজন করিব না। সেই মহাবীরের বংশধরকে কি আমায় বুঝাইতে হইবে যে এই সম্বন্ধ, রাজপুতকুলকামিনীর পক্ষে ইহলোক পরলোকে ঘৃণাস্পদ? মহারাজ! আজিও আপনার বংশে তুর্ক বিবাহ করিতে পারিল না কেন? আপনারা বীর্য্যবান্ মহাবলাক্রান্ত বংশ বটে, কিন্তু তাই বলিয়া নহে। মহাবল পরাক্রান্ত রুমের বাদশাহ কিম্বা পারস্যের শাহ্ দিল্লীর বাদশাহকে কন্যাদান গৌরব মনে করেন। তবে উদয়পুরেশ্বর কেবল তাহাকে কন্যাদান করেন না কেন? তিনি রাজপুত বলিয়া। আমিও সেই রাজপুত। মহারাজ! প্রাণত্যাগ করিব তবু কুল রাখিব প্রতিজ্ঞা করিয়াছি।

 প্রয়োজন হইলে প্রাণবিসর্জ্জন করিব, প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, কিন্তু তথাপি এই অষ্টাদশ বৎসর বয়সে, এ অভিনব জীবন রাখিতে বাসনা হয়। কিন্তু কে এ বিপদে এ জীবন রক্ষা করিবে? আমার পিতার ত কথাই নাই, তাঁহার এমন কি সাধ্য যে আলমগীরের সঙ্গে বিবাদ করেন। আর যত রাজপুত রাজা, ছোট হউন, বড় হউন, সকলেই বাদশাহের ভৃত্য সকলেই বাদশাহের ভয়ে কম্পিতকলেবর। কেবল আপনি— রাজপুতকুলের একা প্রদীপ—কেবল আপনিই স্বাধীন—কেবল উদয়পুরেশ্বরই বাদশাহের সমকক্ষ। হিন্দুকুলে আর কেহ নাই—যে এই বিপন্না বালিকাকে রক্ষা করে—আমি আপনার স্মরণ লইলাম—আপনি কি আমাকে রক্ষা করিবেন না?

 কত বড় গুরুতর কার্য্যে আমি আপনাকে অনুরোধ করিতেছি, তাহা আমি না জানি, এমত নহে। আমি কেবল বালিকাবুদ্ধির বশীভূতা হইয়া লিখিতেছি এমত নহে। দিল্লীশ্বরের সহিত বিবাদ সহজ নহে জানি। এ পৃথিবীতে আর কেহই নাই, যে তাহার সঙ্গে বিবাদ করিয়া তিষ্ঠিতে পারে। কিন্তু মহারাজ! মনে করিয়া দেখুন, মহারাণা সংগ্রাম সিংহ বাবরশাহাকে প্রায় রাজ্যচ্যুত করিয়াছিলেন। মহারাণা প্রতাপসিংহ আকবরশাহকেও মধ্যদেশ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিয়াছিলেন! আপনি সেই সিংহাসনে আসীন—আপনি সেই সংগ্রামের, সেই প্রতাপের বংশধর—আপনি কি তাঁহাদিগের অপেক্ষা হীনবল? শুনিয়াছি নাকি মহারাষ্ট্রে এক পার্ব্বতীয় দস্যু আলমগীরকে পরাভূত করিয়াছে—সে আলমগীর কি রাজস্থানের রাজেন্দ্রের কাছে গণ্য?

 আপনি বলিতে পারেন “আমার বাহুতে বল আছে—কিন্তু থাকিলেও আমি তোমার জন্য এত কষ্ট কেন করিব? আমি কেন অপরিচিতা মুখরা কামিনীর জন্য প্রাণিহত্যা করিব?—ভীষণ সমরে অবতীর্ণ হইব?” মহারাজ! সর্ব্বস্ব পণ করিয়া শরণাগতকে রক্ষা করা কি রাজধর্ম্ম নহে? সর্ব্বস্ব পণ করিয়া কুলকামিনীর রক্ষা কি রাজপুতের ধর্ম্ম নহে?”

 এই পর্য্যন্ত পত্রখানি রাজকন্যার হাতের লেখা। বাকি যে টুকু, সে টুকু তাঁহার হাতের নহে। নির্ম্মলকুমারী লিখিয়াদিয়াছিল; রাজকন্যা তাহা জানিতেন কি না আমরা বলিতে পারি না। সে কথা এই—

 “মহারাজ! আর একটা কথা বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু না বলিলেও নহে। আমি এই বিপদে পড়িয়া পণ করিয়াছি, যে, যে বীর আমাকে মোগল হস্ত হইতে রক্ষা করিবেন, তিনি যদি রাজপুত হয়েন, আর যদি আমাকে যথাশাস্ত্র গ্রহণ করেন, তবে আমি তাঁহার দাসী হইব। হে বীরশ্রেষ্ঠ! যুদ্ধে স্ত্রীলাভ বীরের ধর্ম্ম। সমগ্র ক্ষত্রকুলের সহিত যুদ্ধ করিয়া, পাণ্ডব দ্রৌপদীলাভ করিয়াছিলেন। কাশীরাজ্যে সমবেত রাজমণ্ডলসমক্ষে আপন বীর্য্য প্রকাশ করিয়া ভীষ্মদেব রাজকন্যাগণকে লইয়া আসিয়াছিলেন। হে রাজন্! রুক্মিণীর বিবাহ মনে পড়ে না? আপনি এই পৃথিবীতে আজিও অদ্বিতীয় বীর—আপনি কি বীরধর্ম্মে পরাঙ্মুখ হইবেন?

 আমি মুখরা, কতই বলিতেছি- পাছে বাক্যে আপনাকে না বাঁধিতে পারি—এজন্য গুরুদেবহস্তে রাখির বন্ধন পাঠাইলাম। তিনি রাখি বাঁধিয়া দিবেন—তার পর আপনার রাজধর্ম্ম আপনার হাতে। আমার প্রাণ আমার হাতে। যদি দিল্লী যাইতে হয়, দিল্লীর পথে বিষভোজন করিব।”


 পত্র পাঠ করিয়া রাজসিংহ কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইলেন; পরে মাথা তুলিয়া মাণিকলালকে বলিলেন,

 “মাণিকলাল, এ পত্রের কথা তুমি ছাড়া আর কে জানে?”

 মাণিক। যাহারা জানিত মহারাজ গুহামধ্যে তাহাদিগকে বধ করিয়া আসিয়াছেন।

 রাজা। উত্তম। তুমি গৃহে যাও। উদয়পুরে আসিয়া আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। এ পত্রের কথা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিও না।

 এই বলিয়া রাজসিংহ, নিকটে যে কয়টি স্বর্ণমুদ্রা ছিল, তাহা মাণিকলালকে দিলেন। মাণিকলান প্রণাম করিয়া বিদায় হইলেন।