রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
পরদিবস প্রত্যূষেই আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে বহির্গত হইলাম। থানা হইতে বহির্গত হইয়া, প্রথমেই দরখাস্তকারী জহরত-ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমি দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় যাঁহার দোকান, তিনি দোকানে উপস্থিত ছিলেন না। কয়েকজন কর্ম্মচারী কেবলমাত্র দোকানে উপস্থিত ছিলেন। আমি কে, এবং কি নিমিত্ত সেই স্থানে গমন করিয়াছি, তাহা অবগত হইবার পর, দোকানের একজন কর্ম্মচারী আমাকে সঙ্গে করিয়া সেই দোকানের স্বত্বাধিকারীর নিকট লইয়া গেলেন। সেই সময় তিনি আপনার বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন। আমার পরিচয় ও সেই স্থানে আমার গমনের কারণ অবগত হইয়া, সবিশেষ যত্নের সহিত তিনি আমাকে বসাইলেন, এবং তাঁহার দোকানের যে কর্ম্মচারী আমার সহিত সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে তাঁহার দোকানে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে কহিলেন। আদেশমাত্র কর্ম্মচারী সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। কর্ম্মচারী প্রস্থান করিবার পর, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি দরখাস্ত করিয়াছিলাম, সেই কার্য্যের অনুসন্ধানের ভার কি আপনার উপর অর্পিত হইয়াছে?”
আমি। তাহারই অনুসন্ধান করিবার মানসে আমি এই স্থানে আগমন করিয়াছি।
ধনী। আমি যে সকল কথা দরখাস্তে লিখিয়াছি, তাহা আপনি উত্তমরূপে পড়িয়া দেখিয়াছেন কি?
আমি। আমি উহা বেশ করিয়া পড়িয়া দেখিয়াছি, এবং দরখাস্তখানি আমার সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।
এই বলিয়া আমার পকেট হইতে সেই দরখাস্তখানি বাহির করিয়া, আমার সম্মুখে রাখিয়া দিলাম, এবং তাঁহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি দরখাস্তে যে সকল বিষয় লিখিয়াছেন, তদ্ব্যতীত আর কোন কথা আমাকে বলিতে চাহেন কি?”
ধনী। যাহা কিছু আমার বলিবার, তাহা আমি এই দরখাস্তে ব্যক্ত করিয়াছি। তদ্ব্যতীত আর কোন বিষয় যদি আপনি অবগত হইতে চাহেন, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি যতদুর জানি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতে প্রস্তুত আছি।
আমি। যে সময় রাণীজি জহরত খরিদ করিবার মানসে কালী বাবুর সমভিব্যাহারে আপনার দোকানে আগমন করিয়াছিলেন, সেই সময় আপনি নিজে বোধ হয়, দোকানে উপস্থিত ছিলেন না?
ধনী। সেই সময় আমি নিজে দোকানে উপস্থিত ছিলাম। যাহা কিছু হইয়াছিল, তাহার সমস্তই আমার সম্মুখে হইয়াছিল।
আমি। রানীজিকে কি আপনি দেখিয়াছিলেন?
ধনী। তাঁহাকে আমরা কেহই দর্শন করি নাই। তিনি গাড়ির ভিতরে ছিলেন, গাড়ি হইতে তিনি বহির্গত হন নাই, বা গাড়ির আবরণও উন্মুক্ত করা হয় নাই।
আমি। যে গাড়ির ভিতর রাণীজি ছিলেন বলিতেছেন, সেই গাড়ির ভিতর কোন লোক যে ছিল, তাহা আপনারা কোনরূপে ভাল করিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলেন কি?
ধনী। গাড়ির ভিতর যে লোক ছিল, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যদিও আমরা তাঁহাকে স্পষ্ট দেখি নাই; কিন্ত তাঁহার পরিহিত বস্ত্রাদির কিয়দংশ মধ্যে মধ্যে আমরা দেখিয়াছিলাম, এবং তাঁহার বেশ স্পষ্ট স্পষ্ট কথাও আমরা শুনিতে পাইয়াছিলাম।
আমি। আপনারা তাঁহার কথা শুনিয়া, তাঁহাকে স্ত্রীলোক বলিয়াই অনুমান করিয়াছিলেন?
ধনী। তিনি যে স্ত্রীলোক, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
আমি। তাঁহার কথা শুনিয়া তাঁহাকে কোন্ দেশীয় স্ত্রীলোক বলিয়া অনুমান হয়?
ধনী। তাহা আমরা স্থির করিতে পারি নাই। কারণ তাঁহার সমভিব্যাহারী সেই কালীবাবুর সহিত যখন তিনি কথা বলিয়াছিলেন, তখন বাঙ্গালা কথাই বলিয়াছিলেন; কিন্ত আমরা তাঁহাকে যে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহার উত্তরে, এবং মধ্যে মধ্যে আমাদিগকে যে দুই একটী অপর কোন জহরত দেখাইতে বলিয়াছিলেন, তাহা হিন্দী ভাষায় বলিয়াছিলেন। কিন্তু সে হিন্দী বেশ পরিষ্কার হিন্দী নহে, যেন বাঙ্গালার সহিত মিশ্রিত বলিয়া আমার অনুমান হইয়াছিল।
আমি। রাণীজি যে গাড়িতে ছিলেন, সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কেহ ছিল?
ধনী। তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই। সেই গাড়ির ভিতর অপর আর কাহাকেও দেখি নাই, বা অপর আর কোন ব্যক্তির কোনরূপ কথাও শুনিতে পাই নাই।
আমি। তিনি কোন্ স্থানের রাণী, তাহা কিছু আপনাকে বলিয়াছিলেন কি?
ধনী। তিনি আমাকে বলেন নাই; কিন্তু কালীবাবু বলিয়া ছিলেন। যে স্থানের নাম তিনি উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহা আমার মনে নাই, সেই স্থানের নাম ইতিপূর্ব্বে আর কখনও শুনি নাই। সেই নামটা মনে করিবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টাও করিয়াছি; কিন্তু কিছুতেই মনে করিয়া উঠিতে পারি নাই।
আমি। রাণীজি যে গাড়িতে আগমন করিয়াছিলেন, কালী বাবুও কি সেই গাড়িতে আসিয়াছিলেন?
ধনী। না, রাণীজি একখানি জুড়িগাড়িতে আসিয়াছিলেন। কালীবাবু আসিয়াছিলেন— একখানি কম্পাস গাড়িতে।
আমি। উহা কি ঘরের গাড়ি বলিয়া অনুমান হয়?
ধনী। না, আমার বোধ হয়, উহা ঘরের গাড়ি নয়; আড়গোড়ার গাড়ি।
আমি। আপনি কিরূপে জানিতে পারিলেন যে, উহা আড়গোড়ার গাড়ি?
ধনী। সেই, গাড়ির সহিস-কোচবানের পোষাক ও পরিচ্ছদ দেখিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে যে, সেই গাড়ি নিশ্চয়ই কোন এক আড়গোড়ার।
আমি। দুইখানি গাড়িই কি আড়গোড়ার গাড়ি বলিয়া অনুমান হয়?
ধনী। দুইখানিই এক আড়গোড়ার গাড়ি। দুইখানি গাড়ির সহিস-কোচবানদিগের পোষাক-পরিচ্ছদ একই প্রকারের।
আমি। রামজীলাল আপনার কে?
ধনী। রামজীলাল সম্পর্কে আমার কেহই হন না; কিন্ত তিনি আমার জহরতের দোকানের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারী।
আমি। কতদিবস হইতে তিনি আপনার দোকানে কর্ম্ম করিতেছেন?
ধনী। রামজীলাল আমার একজন বহু পুরাতন কর্ম্মচারী; প্রায় ত্রিশ বৎসর তিনি আমার দোকানে কর্ম্ম করিতেছেন।
আমি। তাঁহার স্বভাব-চরিত্র কিরূপ?
ধনী। তাঁহার স্বভাব-চরিত্রও যেরূপ ভাল, তিনি বিশ্বাসীও সেইরূপ। আমার বোধ হয়, আমি আমাকে যতদূর বিশ্বাস করিতে না পারি, তাহা অপেক্ষা অধিক তাঁহাকে বিশ্বাস করিতে পারি। আমার দোকানের লক্ষ লক্ষ টাকার দ্রব্যাদি সমস্তই তাঁহার হস্তে, তিনি মনে করিলে ইহার সমস্তই অনায়াসেই আত্মসাৎ করিতে পারেন। কিন্ত তিনি এতদূর বিশ্বাসী যে, আজ পর্য্যন্ত একটা পয়সাও তাঁহা কর্ত্তৃক অপহৃত হয় নাই।
আমি। রামজীলাল যদি আপনার এতদূর বিশ্বাসী কর্ম্মচারী, তাহা হইলে সেই দশ হাজার টাকার জহরত লইয়া তিনি কিরূপে প্রস্থান করিলেন?
ধনী। রামজীলাল যে সেই জহরত লইয়া পলায়ন করিয়াছেন, তাহা কখনই সম্ভব হইতে পারে না। এরূপ কথা আমি কোনরূপেই বিশ্বাস করিতে পারি না।
আমি। তবে রামজীলাল কোথায় গমন করিলেন?
ধনী। আমিও তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আমার বোধ হয়, রামজীলাল কোনরূপ বিপদ্গ্রস্ত হইস্বাছেন বলিয়া প্রত্যাবর্ত্তন করিতে পারিতেছেন না।
আমি। সে যাহা হউক, রামজীলাল যে সকল জহরত লইয়া গিয়াছেন, তাহার কোনরূপ তালিকা প্রস্তত করিয়াছেন কি?
ধনী। না, তাহা করি নাই। যদি আবশ্যক হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রস্তত করিয়া দিতে পারি।
আমি। তাহা হইলে অনুগ্রহ-পূর্ব্বক একটা সবিশেষ বিবরণযুক্ত তালিকা প্রস্তত করিয়া এখনই আমাকে প্রদান ককন।
আমার কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ জহরতগুলির সবিশেষ বিবরণযুক্ত একটী তালিকা প্রস্তত করিয়া কর্ম্মচারী আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি সেই তালিকা আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া পুনরায় তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা, সেই সকল জহরত যদি অপরাপর জহরতের সহিত একত্র পুনরায় আপনাকে দেখাই, তাহা হইলে চিনিতে পারিবেন ত?”
ধনী। জহরতগুলি যেরূপ অবস্থায় আমার এই স্থান হইতে লইয়া গিয়াছে, সেইরূপ অবস্থায় যদি উহা না থাকে, তাহা হইলে উহার প্রত্যেক পাথরের মতি প্রভৃতি পৃথক্ পৃথক্ অবস্থায় অপর প্রস্তর প্রভৃতির সহিত মিশ্রিত করিয়া আমার সম্মুখে আনিবেন, দেখিবেন, আমার দ্রবা আমি তাহার ভিতর হইতে অনায়াসেই বাছিয়া লইতে সমর্থ হইব।
জহরত-বিক্রেতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া সেইদিবস আমি তাঁহার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সমর আমার মনে হইল, দোকানদার রামজীলালের চরিত্র সম্বন্ধে যেরূপ ভাবে বর্ণন করিলেন, তাহাতে রামজীলালের উপর এই সকল জহরত অপহরণ করা সম্বন্ধে কিরূপে সন্দেহ করিতে পারি? যে ব্যক্তি লক্ষ লক্ষ টাকা লইয়া আপন ইচ্ছানুযায়ী সমস্ত কার্য্যের বন্দোবস্ত করেন, অথচ যাহার কার্য্যের নিমিত্ত মনিব কখনও একবারেরও নিমিত্ত দৃষ্টিপাত করেন না, সেই ব্যক্তি কেবলমাত্র যে দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত লইয়া পলায়ন করিবে, তাহা কিন্তু সহজে মনে স্থান দিতে পারা যায় না।
যাহা হউক, দোকানদারের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া আমি থানায় প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। ভাবিলাম, একটু পরেই পুনরায় এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া যাইব; কিন্তু কার্য্যে তাহা ঘটিল না। সেই সময় কোন একটী সবিশেষ প্রয়োজনীয় রাজ্য-সম্বন্ধীয় সরকারী কার্য্য আসিয়া আমার হস্তে উপস্থিত হইল। সুতরাং বর্ত্তমান কার্য্যের অনুসন্ধান সেই সময় আমাকে পরিত্যাগ করিতে হইল। আমি সেই কার্য্যের অনুসন্ধান সেই সময় পরিত্যাগ করিলাম সত্য; কিন্তু সেই অনুসন্ধান একবারে বন্ধ হইল না। অপর আর একজন কর্ম্মচারীর হস্তে এই অনুসন্ধানের ভার অর্পণ করিয়া, যতদূর আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহার সমস্ত বিবরণ আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলাম। তিনি তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বহির্গত হইলেন, আমিও সেই সবিশেষ প্রয়োজনীয় সরকারী কার্য্যের অনুসন্ধানে বহির্গত হইবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলাম।