রাণী না খুনি? (প্রথম অংশ)/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

 আড়গোড়া হইতে বাহির হইয়া কর্ম্মচারী আবদুলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। আমিও একটু দূরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলাম।

 গমন করিতে করিতে কর্ম্মচারী আবদুলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন ভাই, তোমার গাড়িতে যে বাবুটী বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনি একাকী গমন করিয়াছিলেন, কি তাঁহার সহিত অপর আর কোন ব্যক্তি ছিল?”

 আবদুল। তিনি একাকীই আমার গাড়িতে গমন করিয়াছিলেন।

 কর্ম্মচারী। বড়বাজার হইতে যখন প্রত্যাবর্ত্তন করেন, তখনও কি তিনি একাকী ছিলেন?

 আবদুল। না, বড়বাজার হইতে আসিবার সময় অপর আর একটী লোক তাঁহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন।

 কর্ম্মচারী। যে ব্যক্তি তোমার গাড়িতে গমন করিয়াছিলেন, তাঁহাকে কোন্‌ দেশীয় লোক বলিয়া তোমার অনুমান হয়?

 আবদুল। তিনি বাঙ্গালি।

 কর্ম্মচারী। আর যে বাক্তি বড়বাজার হইতে তাঁহার সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তিনিও কি বাঙ্গালি?

 আবদুল। না, তিনি বাঙ্গালি নহেন। তাঁহাকে মাড়োয়ারী বা ক্ষেত্রি বলিয়া আমার অনুমান হয়। তিনি বাঙ্গালি নহেন, ইহা আমি বেশ বলিতে পারি।

 কর্ম্মচারী। যিনি তোমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, তিনি যে বাড়ী হইতে গমন করিয়াছিলেন, বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়াও কি তিনি সেই বাড়ীতে গমন করিয়াছিলেন, কি অপর কোন বাড়ীতে গিয়াছিলেন?

 আবদুল। অপর কোন বাড়ীতে তিনি গমন করেন নাই। যে বাড়ী হইতে আসিয়াছিলেন, পুনরায় সেই বাড়ীতেই গমন করিয়াছিলেন।

 কর্ম্মচারী। তোমার গাড়ি ও জুড়িগাড়ি, উভয় গাড়িই কি এক সময় যাইয়া সেই বাড়ীতে উপস্থিত হয়?

 আবদুল। আমাদিগের উভয় গাড়িই এক সময় সেই বাড়ীতে গিয়াছিল, এবং সেই স্থান হইতে উভয় গাড়িই একত্র বড়বাজার গমন করে।

 কর্ম্মচারী। আর বড়বাজার হইতে যখন তোমরা প্রত্যাবর্ত্তন কর, সেই সময়েও বোধ হয়, তোমাদের উভয় গাড়িই একত্র ফিরিয়া আইসে?

 আবদুল। না, জুড়িগাড়ি অগ্রে চলিয়া আইসে; আমার গাড়ি তাহার অনেক পশ্চাৎ আসিয়াছিল।

 কর্ম্মচারী। জুড়িগাড়িতে কে ছিল?

 আবদুল। কে ছিল তাহা আমি জানি না। কেবল একটা মাত্র স্ত্রীলোককে সেই গাড়িতে উঠিতে দেখিয়াছিলাম।

 কর্ম্মচারী। সেই স্ত্রীলোকটীর পোষাক-পরিচ্ছদ কিরূপ ছিল?

 আবদুল। পোষাক-পরিচ্ছদ খুব ভাল ছিল। শুনিয়াছি, উনি নাকি কোন স্থানের রাণী। তা রাণীর পোষাক আর ভাল হইবে না?

 কর্ম্মচারী। যে বাড়ী হইতে সেই বাবুটী তোমার গাড়িতে উঠিয়াছিলেন, এবং পরিশেষে বড়বাজার হইতে ফিরিয়া আসিয়া যে বাড়ীতে গমন করেন, সেই রাণীও কি সেই বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া জুড়িতে আরোহণ করিয়াছিলেন?

 আবদুল। হাঁ, তিনিও সেই বাড়ী হইতে বাহির হইয়া জুড়িতে উঠিয়াছিলেন, ইহা আমি দেখিয়াছি; কিন্তু কোন্‌ বাড়ীতে যে তিনি নামিয়া গিয়াছেন, তাহা আমি বলিতে পারি না।

 কর্ম্মচারী। কয়দিবসের নিমিত্ত উঁহারা গাড়ি দুইখানি ভাড়া করিয়াছিলেন?

 আবদুল। কেবলমাত্র একদিবসের জন্য। যে দিবস উঁহারা বড়বাজার গমন করিয়াছিলেন, কেবলমাত্র সেই দিবসই আমরা আসিয়াছিলাম, উহার পূর্ব্বে বা পরে আর কখনও আমরা তাঁহাদিগের নিকট গাড়ি লইয়া যাই নাই।

 কর্ম্মচারী। তোমরা কি সেই বাবুকে, কি রানীকে পূর্ব্ব হইতে চিনিতে?

 আবদুল। না।

 কর্ম্মচারী। তাহাদিগের বাড়ী?

 আবদুল। তাহাও আমরা পুর্ব্ব হইতে জানিতাম না।

 কর্ম্মচারী। তাহা হইলে কিরূপে তোমরা তোমাদিগের গাড়ি লইয়া তাহাদিগের বাড়ীতে যাইতে পারিলে?

আবদুল। আমাদিগের আফিসের সাহেবগণের সহিত উঁহাদিগের কিরূপ বন্দোবস্ত ছিল, তাহা আমি জানি না; কিন্তু যে দিবস আমরা গাড়ি লইয়া গিয়াছিলাম, সেই দিবস যে বাবুটী আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করিয়াছিলেন, তিনিই আমাদিগের আফিসে আসিয়াছিলেন, এবং তিনিই আমার গাড়িতে চড়িয়া আড়গোড়া হইতে আমাদিগের গাড়ি তাঁহার সেই বাড়ীতে লইয়া যান। পরিশেষে তিনিই আমার গাড়িতে বড়বাজারে গমন করেন, এবং সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করেন।

 কর্ম্মচারী। তোমাদিগের গাড়ির যে ভাড়া হইয়াছিল, তাহা তাঁহারা তোমাদিগের নিকট প্রদান করিয়াছিলেন কি?

 আবদুল। না, ভাড়া আমাদিগের হস্তে প্রদান করিবেন কেন?

 কর্ম্মচারী। তবে কি গাড়ির ভাড়া পরিশেষে তাঁহার নিকট হইতে আদায় করিয়া লওয়া হয়?

 আবদুল। গাড়ির ভাড়া পূর্ব্বে জমা দিয়া গাড়ি ভাড়া লওয়া হয়, কি পরিশেষে তাঁহাদিগের নিকট হইতে ভাড়া আদায় করা হয়, কি একবারেই ভাড়া লওয়া হয় নাই, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি।

 আবদুলের সহিত এইরূপে কর্ম্মচারীর কথাবার্ত্তা হইতে হইতে উভয়েই গিয়া একখানি দ্বিতল বাড়ীর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। সেই স্থানে গমন করিয়াই, আবদুল সেই বাড়ী দেখাইয়া দিয়া কহিল, “এই বাড়ী।”

 আবদুলের এই কথা শুনিয়াই কর্ম্মচারী সেই স্থানে একটু দাঁড়াইলেন; দেখিলেন, উহা বড়গোছের একটী দ্বিতল বাটা; কিস্ত সেই বাটীর দরজা খোলা নাই। বাহির হইতে সদর দরজা তালাবন্ধ। সেই বাটীর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, উহা একখানি খালি বাড়ী। সেই বাড়ীর দরজায় একখানি কাগজ মারা ছিল, উহাতে লেখাছিল, “এই বাড়ী ভাড়া দেওয়া যাইবে। সম্মুখের মুদীর দোকানে অনুসন্ধান করিলে, এই বাড়ীর অবস্থা অবগত হইতে পারিবেন।”

 আমাদিগের উদ্দেশ্য় কিয়ৎ পরিমাণে সিদ্ধ হইল। তখন কর্ম্মচারী আবদুলকে কহিলেন, “ভাই, তুমি আমার নিমিত্ত যে এত পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিলে, কিস্তু তাহার ফল কিছুই ফলিল না।”

 আবদুল। কেন?

 কর্ম্মচারী। আমার আজকাল এমনই দুরদৃষ্ট হইয়াছে যে, যে ব্যক্তি নিজে আমাকে একটী চাকরী দিবেন বলিয়া, আমাকে তাঁহার বাড়ীতে আসিতে কহিলেন, আমার দুর্ভাগ্য বশতঃ তিনি সেই বাটী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছেন! যাহা হউক ভাই, তোমাকে আমি আর অধিক কষ্ট দিতে চাহি না, তুমি এখন আপন স্থানে গমন কর। কিন্তু ভাই, সবিশেষ চেষ্টা করিয়া দেখিও, যদি তোমাদিগের ওখানে আমার একটী কার্য্যের যোগাড় হয়। আমি মধ্যে মধ্যে গিয়া তোমার এবং কোচবানজির সহিত সাক্ষাৎ করিব।

 কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কর্ম্মচারীও অপর আর একটী গলির ভিতর প্রবেশ করিলেন।

 এ পর্য্যন্ত আমি তাহাদিগের সন্নিকটেই ছিলাম। আবদুল সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, কর্ম্মচারী আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন ও কহিলেন, “এ পর্য্যন্ত সহিসের সহিত আমার যে সকল কথা হইয়াছে, তাহার আদ্যোপান্ত আপনি শুনিয়াছেন ত?”

 আমি। সমস্তই শুনিয়াছি।

 কর্ম্মচারী। উহারা যে বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, সে বাড়ীও দেখিয়াছেন?

 আমি। তাহাও দেখিয়াছি। উহা এখন তালাবদ্ধ।

 কর্ম্মচারী। এখন আর কি করিতে হইবে?

 আমি। এখন দেখিতে হইবে, এই বাড়ী ভাড়া কে লইয়াছিল। যে রাণী এই বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তাহার যদি কোনরূপ সন্ধান করিতে পারি, তাহা হইলে অনেক কথা বাহির হইবার সম্ভাবনা।

 কর্ম্মচারী। কিরূপ উপায়ে রাণীর সন্ধান পাওয়া যাইতে পারিবে?

 আমি। যাঁহার বাড়ী ভাড়া লইয়াছিল, তিনি যদি কোনরূপ সন্ধান বলিয়া দিতে পার়েন।

 কর্ম্মচারী। তবে চলুন, কাহার বাড়ী, অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা যাউক।

 আমি। অদ্য রাত্রি হইয়া আসিয়াছে, রাত্রিকালে এ কার্য্যের সুবিধা হইবে না; কল্য প্রাতঃকালে ইহার বন্দোবস্ত করিব। তদ্ব্যতীত আরও একটী কার্য্য আমাদিগের বাকী থাকিল, যে ব্যক্তি আড়গোড়া হইতে গাড়ি ভাড়া করিয়া এই বাড়ীতে আসিয়াছিল, সেই ব্যক্তি কালীবাবু কিনা তাহাও আবদুল প্রভৃতির নিকট হইতে আমাদিগকে জানিয়া লইতে হইবে।

 এইরূপ পরামর্শ করিয়া আমরা সে দিবস আপন আপন স্থানে প্রস্থান করিলাম।