রাণী না খুনি? (শেষ অংশ)/প্রথম পরিচ্ছেদ
রাণী না খুনি?
(শেষ অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
বাড়ীওয়ালার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া আমি প্রথমতঃ আমার থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থান হইতে পূর্ব্ব-কথিত কর্ম্মচারীদ্বয়কে সঙ্গে লইয়া পুনরায় কালীবাবুর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সময় আমরা কালীবাবুর নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় কালীবাবু ও ত্রৈলোক্য উভয়েই তাহাদিগের গৃহে বসিয়াছিল। আমাদিগকে দেখিয়া ত্রৈলোক্য চিনিতে পারিল, এবং সেই স্থানে উপবেশন করিতে কহিল। আমরা তিনজনেই সেই স্থানে উপবেশন করিলাম। আমাদিগকে দেখিয়া কালীবাবু কহিল, “কি মহাশয়! পুনরায় কি মনে করিয়া? আসামী ধরা পড়িয়াছে না কি?”
আমি। আসামী এখনও ধরা পড়ে নাই, ধরিবার চেষ্টাতেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। যে মোকদ্দমায় রামজীলালের নামে ওয়ারেণ্ট বাহির হইয়াছে, সেই মোকদ্দমার বিষয় আমি এখনও সম্পূর্ণরূপে বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। তাই পুনরায় আপনার নিকট আসিয়াছি।
কালী। বলুন, আমাকে কি সাহায্য করিতে হইবে। আমাকে যেরূপ ভাবে সাহায্য করিতে বলিবেন, আমি সেইরূপ ভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি।
আমি। সবিশেষ কোনরূপ সাহায্য করিবার সময় এখনও সময় উপস্থিত হয় নাই। যখন বুঝিতে পারিব, আপনার সাহায্যের সবিশেষ প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে, তখন আপনার সাহায্য প্রার্থনা করিব। এখন কেবল দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি মাত্র।
কালী। আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, তাহা আপনি অনায়াসেই জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।
আমি। আপনি ঠিক বলুন দেখি, সেই জহরতগুলি কাহার নিমিত্ত আপনি দোকান হইতে খরিদ করিয়া আনিয়াছিলেন?
কালী। সেই সকল জহরত আমি আমার নিজের জন্য খরিদ করিয়াছিলাম না। যাঁহার নিমিত্ত খরিদ করিয়াছিলাম, সে কথা ত আমি পূর্ব্বেই আপনাদিগকে বলিয়াছি। যাঁহার নিমিত্ত জহরত খরিদ করা হইয়াছিল, তাঁহাকে রামজীলালও স্বচক্ষে দেখিয়া গিয়াছিল।
আমি। তাঁহাকে রামজীলাল দেখিয়াছিল, তুমি দেখিয়াছিলে, এবং ত্রৈলোক্যও দেখিয়াছিল, এ কথা ত আমরা পূর্ব্বেই শুনিয়াছি। এখন ত আর রামজীলালকে পাইতেছি না যে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিব। সেই নিমিত্তই তোমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যে ব্যক্তি জহরত খরিদ করিয়াছিলেন, তিনি কে?
কালী। তিনি একজন জমিদার। একথাও পূর্ব্বে আমরা আপনাকে বলিয়াছি।
আমি। পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছ, তাহাও শুনিয়াছি, এখন যাহা বলিবে তাহাও শুনিব। তিনি কোন্ দেশীয় জমিদার?
কালী। পশ্চিমদেশীয় জমিদার।
আমি। তুমি পূর্ব্বে বলিয়াছিলে, তিনি বাঙ্গালি। এখন বলিতেছ, তিনি পশ্চিমদেশীয়। তোমার কোন্ কথা প্রকৃত, তাহা এখন আমাকে সবিশেষ করিয়া বলিতে হইতেছে। তুমি জানিও, আমি জানিতে পারিয়াছি, সেই জমিদার কে?
কালী। বদি আপনি জানিতে পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে আর জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন কি?
আমি। প্রয়োজন সবিশেষরূপ আছে বলিয়াই জিজ্ঞাসা করিতেছি। এখন তুমি আমার কথার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে কিনা?
কালী। প্রকৃত কথা কেন বলিব না? আপনি আমাকে প্রতারণা করিতেছেন কেন? আমি এত চেষ্টা করিয়া পরিশেষে যাহার আর সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই, তাহাকে আপনি সন্ধান করিয়া বাহির করিবেন কি প্রকারে?
আমি। আমি কিরূপে তাহার সন্ধান করিয়াছি, তাহা তুমি জানিতে চাও?
কালী। যদি অনুগ্রহ করিয়া বলেন।
আমি। কালীবাবু! তুমি মনে করিতেছ যে, তোমার সদৃশ চতুর লোক আর কেহই নাই; কিন্তু তোমার মনে করা কর্ত্তব্য যে, তোমা অপেক্ষা অধিক চতুর লোক, বোধ হয়, অনেক থাকিতে পারে। আচ্ছা আমি কিরূপে সেই জমিদারের অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহা তোমাকে বলিতেছি; একটু মনোযোগ দিয়া শুনিলেই অনায়াসেই তাহা বুঝিতে পারিবে। তুমি রামজীলালকে যে সকল নোট প্রদান করিয়াছিলে, সেই সকল নোট তুমি সেই জমিদার অর্থাৎ যে ব্যক্তি সেই সকল জহরত গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার নিকট হইতে পাইয়াছ, কেমন একথা প্রকৃত কি না?
কালী। তদ্ভিন্ন সেই সকল নোট আর আমি কোথায় পাইব?
আমি। সেই সকল নোটের মধ্যে অনেকগুলি নম্বরী-নোট আছে?
কালী। আছে, তাহার নম্বর ত আমি আপনাদিগকে দিয়াছি।
আমি। আমাদিগের দেশে যাহার হাতে নম্বরী-নোট পড়ে, তিনি সেই সকল নম্বরী-নোটের নম্বর রাখিয়া থাকেন, একথা বোধ করি তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করিবে?
কালী। নতুবা আমি আপনাকে সেই সকল নোটের নম্বর কিরূপে দিতে পারিলাম?
আমি। তুমি জান, যে সকল নোট সরকার বাহাদুর এদেশে চালাইতেছেন, তাহা কোথা ছাপা হয়, এবং কোথা হইতে প্রথম আমাদিগের দেশে প্রচারিত হয়?
কালী। শুনিয়াছি, সমস্ত নোট বিলাত হইতে ছাপা হইয়া এদেশে আইসে, এবং করেন্সি আফিস হইতে প্রথমতঃ সেই নোট বাহির হইয়া, ক্রমে এদেশীয় লোকের নিকট গিয়া উপস্থিত হয়।
আমি। করেন্সি আফিস হইতে যে সকল নোট বাহির হয়, তাহার নম্বর করেন্সি আফিসে থাকে কিনা, তাহা তুমি বলিতে পার?
কালী। করেন্সি আফিসে নিশ্চয়ই নম্বর রাখিয়া থাকে।
আমি। আর যে সকল নম্বরী-নোট সেই স্থান হইতে যাহাকে দেওয়া হয়, তাহার নাম ও ঠিকানা সেই স্থানে লেখা থাকে; তাহাও বোধ হয়, তুমি অবগত আছ?
কালী। তাহাও রাখিবার খুব সম্ভাবনা।
আমি। তাহা, হইলে এখন তুমি বুঝিতে পারিলে যে, আমি তোমার সেই জমিদারের ঠিকানা করিতে পারিয়াছি কি না?
কালী। না মহাশয়! আপনার এই কথায় আমি কিরূপে জানিতে পারিব যে, আপনি কিরূপে জমিদার মহাশয়ের ঠিকানা করিতে পারিয়াছেন?
আমি। আমি যাহা বলিলাম, তাহা অপেক্ষা আরও স্পষ্ট করিয়া না বলিলে যে তুমি বুঝিতে পারিবে না, ইহাই আশ্চর্য্য। যাহা হউক, আরও স্পষ্ট করিয়া আমি তোমাকে বলিতেছি। তোমার সেই জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে তুমি যে সকল নোট পাইয়াছ, তাহার নম্বর তুমিই আমাদিগকে প্রদান করিয়াছ। ইহার পরই আমি করেন্সি আফিসে গিয়া জানিতে পারি, কোন্ তারিখে সেই সুকল নোট সর্ব্বপ্রথমে করেন্সি আফিস হইতে বাহির হয়, এবং কাহাকে প্রদান করা হয়। পরে তাহার নিকট গিয়া জানিতে পারি, সেই নোট তিনি কাহাকে প্রদান করেন। এইরূপে অনুসন্ধান করিতে করিতে সেই সকল নোট তুমি যাঁহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছ, তাঁহার নিকট গিয়া উপস্থিত হই, এবং তাঁহার প্রমুখাৎ জানিতে পারি, যাহা যাহা ঘটয়াছিল। তিনি আমাকে আরও বলিয়াছেন, যে সকল জহরতের পরিবর্ত্তে তোমাকে সেই সকল নোট প্রদান করা হয়, আবশ্যক হইলে সেই সকল জহরতও তিনি আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিবেন। এখন বুঝিতে পারিলে, অনুসন্ধানের কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া এই সকল বিষয় আমি জানিয়া লইয়াছি?
কালী। তাহা এখন বুঝিতে পারিয়াছি।
আমি। এখনও তুমি আমাদিগের নিকট মিথ্যা কথা বলিতেছ কি না, তাহাই জানিবার নিমিত্ত তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, নেই জমিদার কে? কারণ, ইতিপূর্ব্বে তুমি আমাদিগের নিকট কয়েকটী কথা মিথ্যা বলিয়াছ।
কালী। আমি সেই জমিদার মহাশয়ের নাম জানি না।
আমি। তিনি কোন্ দেশীয় লোক?
কালী। পশ্চিমদেশীয়।
আমি। পূর্ব্বে কেন বলিয়াছিলে যে, তিনি একজন বঙ্গদেশীয় জমিদার-পুত্ত্র?
কালী। একথা কি আমি পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম?
আমি। বলিয়াছিলে।
কালী। যদি বলিয়া থাকি, তাহা হইলে ভুল-ক্রমে বলিয়া থাকিব।
আমি। তুমি যে সময় তাঁহার বাসায় গিয়া জহরত সকল প্রদান কর, সেই সময় সেই স্থানে আর কে ছিল?
কালী। আর কেহ ছিল বলিয়া, আমার মনে হয় না।
আমি। রামজীলাল?
কালী। রামজীলাল ত ছিলই। কিন্তু মহাশয়! রামজীলাল ঠিক সেই সময় তাঁহার নিকট গমন করেন নাই, তিনি বাহিরে ছিলেন।
আমি। রামজীলালকে বাহিরে রাখিয়া তুমি একাকীই বাড়ীর ভিতর গমন করিয়াছিলে?
কালী। হাঁ।
আমি। জমিদার মহাশয়ের নিকট হইতে টাকা আনিয়া তুমিই রামজীলালের হস্তে প্রদান কর?
কালী। হাঁ।
আমি। জমিদার মহাশয় এখন সেই বাড়ীতে আছেন কি?
কালী। আজ কয়েকদিবস পর্য্যন্ত আমি সেদিকে যাই নাই। বোধ হয়, থাকিতে পারেন।
আমি। সেই বাড়ীটী তুমি এখন আমাকে দেখাইয়া দিতে পার?
কালী। পারিব না কেন? তবে জিজ্ঞাসা করি, যখন আপনার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইয়াছে, তখন আপনি ত তাঁহার সেই বাড়ী জানেন।
আমি। আমার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয় নাই। অপর আর একজন কর্ম্মচারীকে আমি তাঁহার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। সেই কর্ম্মচারীকে তিনি যাহা বলিয়াছেন, কেবল তাহাই আমি অবগত আছি মাত্র। আমি নিজে সেই বাড়ী চিনি না, এই নিমিত্তই সেই বাড়ী দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাকে বলিতেছি। যে কর্ম্মচারী সেই বাড়ী দেখিয়া আসিয়াছিলেন, তিনিও এখন এখানে নাই। অপর কোন কার্য্য-উপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন।
কালী। তাহা হইলে চলুন, আমি আপনার সহিত গমন করিয়া সেই বাড়ী আমি আপনাকে দেখাইয়া দিতেছি।
কালীবাবুর কথা শুনিয়া আমি সেই স্থানে আর কালবিলম্ব করিলাম না। তাহাকে লইয়া তখনই সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমি মনে করিয়াছিলাম, আড়গোড়ার সহিসের সাহায্যে আমরা যে বাড়ীর অনুসন্ধান পাইয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ীই আমাদিগকে দেখাইয়া দিবেন; কিন্তু পরে দেখিলাম, আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, কালীবাবু সেই বাড়ী আমাদিগকে দেখাইয়া না দিয়া, অন্য স্থানে অপর একখানি বাড়ী দেখাইয়া দিল। সেই বাড়ীর দরজায় একজন দ্বারবান্ বসিয়া আছে দেখিয়া তাহাকে দুই একটী কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তাহার নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, তাহার মনির পশ্চিমদেশীয় একজন জমিদার সেই বাড়ীতে ছিলেন; কিন্ত কয়েকদিবস হইল, তাঁহার দেশে গমন করিয়াছেন। আরও জানিতে পারিলাম যে, কালীবাবু সেই দ্বারবানের নিকট পরিচিত। দ্বারবান্ তাহার মনিবের নিকট অনেকবার কালীবাবুকে দেখিয়াছে। দ্বারবান্ ইহাও বলিল যে, কালীবাবুর নিকট হইতে তাহার মনিব অনেকগুলি মূল্যবান্ কাপড় ও জহরত খরিদ করিয়াছেন।
দ্বারবানের নিকট আমি এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি পুনরায় কালীবাবুর সঙ্গে তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।