রাশিয়ার চিঠি (১৯৪৫)/১১
পিছিয়ে-পড়া জাতের শিক্ষার জন্যে সােভিয়েট রাশিয়ার কী রকম উদ্যোগ চলছে সে-কথা তােমাকে লিখেছি। আজ দুই-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
উরাল পর্বতের দক্ষিণে বাষকিরদের বাস। জারের আমলে সেখানকার সাধারণ প্রজার অবস্থা আমাদের দেশের মতােই ছিল। তারা চির-উপবাসের ধার দিয়েই চলত। বেতনের হার ছিল অতি সামান্য, কোনাে কারখানায় বড়াে রকমের কাজ করবার মতাে শিক্ষা ছিল না, অবস্থাগতিকে তাদের ছিল নিতান্তই মজুরের কাজ। বিপ্লবের পরে এই দেশের প্রজাদের স্বতন্ত্র শাসনের অধিকার দেবার চেষ্টা আরম্ভ হল।
প্রথমে যাদের উপর ভার পড়েছিল তারা অগেকার আমলের ধনী জোতদার, ধর্মযাজক এবং বর্তমানে আমাদের ভাষায় যাদের বলে থাকি শিক্ষিত। সাধারণের পক্ষে সেটাতে সুবিধা হল না। আবার এই সময়ে উৎপাত আরম্ভ করলে কচাকের সৈন্য। সে ছিল জার-আমলের পক্ষপাতী, তার পিছনে ছিল ক্ষমতাশালী বহিঃশত্রুদের উৎসাহ এবং আনুকূল্য। সােভিয়েটরা যদি বা তাদের তাড়ালে, এল ভীষণ দুর্ভিক্ষ। দেশে চাষবাসের ব্যবস্থা ছারখার হয়ে গেল।
১৯২২ খ্রীস্টাব্দ থেকে সােভিয়েট আমলের কাজ ঠিকমতো শুরু হতে পেরেছে। তখন থেকে দেশে শিক্ষাদান এবং অর্থোৎপত্তির ব্যবস্থা প্রবলবেগে গড়ে উঠতে লাগল। এর আগে বাষকিরিয়াতে নিরক্ষরতা ছিল প্রায় সর্বব্যাপী। এই কয় বছরের মধ্যে এখানে আটটি নর্মাল স্কুল, পাঁচটি কৃষিবিদ্যালয়, একটি ডাক্তারি শিক্ষালয়, অর্থকরী বিদ্যা শেখবার জন্যে দুটি, কারখানার কাজে হাত পাকাবার জন্যে সতেরােটি,প্রাথমিক-শিক্ষার জন্যে ২৪৯৫টি এবং মধ্য-প্রাথমিকের জন্যে ৮৭টি স্কুল শুরু হয়েছে। বর্তমানে বাষকিরিয়াতে দুটি আছে সরকারী থিয়েটার, দুটি ম্যুজিয়ম, চৌদ্দটি পৌরগ্রন্থাগার, ১১২টি গ্রামের reading room পাঠগৃহ, ত্রিশটি সিনেমা শহরে এবং ৪৬টি গ্রামে, চাষীরা কোনাে উপলক্ষ্যে শহরে এলে তাদের জন্যে বহুতর বাসা, ৮৯১টি খেলা ও আরামের জায়গা recreation corners, তা ছাড়া হাজার হাজার কর্মী ও চাষীদের ঘরে রেডিয়ে শ্রুতিযন্ত্র। বীরভূম জেলার লােক বাষকিরদের চেয়ে নিঃসন্দেহে স্বভাবত উন্নততর শ্রেণীর জীব। বাষকিরিয়ার সঙ্গে বীরভূমের শিক্ষা ও আরামের ব্যবস্থা মিলিয়ে দেখো। উভয় পক্ষের ডিফিকলটিজেও তুলনা করা কর্তব্য হবে।
সােভিয়েট রাষ্ট্রসংঘের মধ্যে যতগুলি রিপাব্লিক হয়েছে তার মধ্যে তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান সবচেয়ে অল্পদিনের। তাদের পত্তন হয়েছে ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দের অক্টোবরে, অর্থাৎ বছর-ছয়েকের চেয়েও তাদের বয়স কম। তুর্কমেনিস্তানের জনসংখ্যা সবসুদ্ধ সাড়ে দশ লক্ষ। এদের মধ্যে নয় লক্ষ লােক চাষের কাজ করে। কিন্তু নানা কারণে খেতের অবস্থা ভালাে নয়, পশুপালনের সুযােগও তদ্রূপ।
এরকম দেশকে বাঁচাবার উপায় কারখানার কাজ খােলা, যাকে বলে industrialization, বিদেশী বা স্বদেশী ধনী মহাজনদের পকেট ভরাবার জন্যে কারখানার কথা হচ্ছে না, এখানকার কারখানার উপস্বত্ব সর্বসাধারণের। ইতিমধ্যেই একটা বড়ো সুতাের কল এবং রেশমের কল খােলা হয়েছে। আশকাবাদ শহরে একটা বৈদ্যুতজনন স্টেশন বসেছে, অন্যান্য শহরেও উদ্যোগ চলছে। যন্ত্রচালনক্ষম শ্রমিক চাই, তাই বহুসংখ্যক তুর্কমেনি যুবকদের মধ্য-রুশিয়ার বড়াে বড়ো কারখানায় শিক্ষার জন্যে পাঠানো হয়ে থাকে। আমাদের যুবকদের পক্ষে বিদেশী-চালিত কারখানায় শিক্ষার সুযােগলাভ যে কত দুঃসাধ্য তা সকলেরই জানা আছে।
বুলেটিনে লিখছে, তুর্কমেনিস্তানে শিক্ষার ব্যবস্থা করা এত কঠিন যে, তার তুলনা বােধ হয় অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিরলবসতি জনসংস্থান দূরে দূরে, দেশে রাস্তার অভাব, জলের অভাব, লােকালয়ের মাঝে মাঝে বড়াে বড়ো মরুভূমি, লােকের আর্থিক দুরবস্থা অত্যন্ত বেশি।
আপাতত মাথাপিছু পাঁচ রুবল করে শিক্ষার খরচ পড়ছে। এদেশের প্রজাসংখ্যার সিকি পরিমাণ লােক যাযাবর nomads। তাদের জন্যে প্রাথমিক পাঠশালার সঙ্গে সঙ্গে বাের্ডিং স্কুল খােলা হয়েছে, ইঁদারার কাছাকাছি যেখানে বহুপরিবার মিলে আড্ডা বরে সেইরকম জায়গায়। পড়ুয়াদের জন্যে খবরের কাগজও প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
মস্কৌ শহরে নদীতীরে সাবেককালের একটি উদ্যানবেষ্টিত সুন্দর প্রাসাদে তুর্কমেনদের জন্যে শিক্ষক শিক্ষিত করবার একটি বিদ্যাভবন Turcomen People's Home of Education স্থাপিত হয়েছে। সেখানে সম্প্রতি একশ তুর্কমেন ছাত্র শিক্ষা পাচ্ছে, বারো-তেরাে বছর তাদের বয়স। এই বিদ্যাভবনের ব্যবস্থা স্বায়ত্তশাসননীতি অনুসারে। এই ব্যবস্থার মধ্যে কতকগুলি কর্মবিভাগ আছে। যেমন স্বাস্থ্যবিভাগ, গার্হস্থ্যবিভাগ household commission, ক্লাস কমিটি। স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে দেখা হয়, সমস্ত মহলগুলি compartments, ক্লাসগুলি, বাসের ঘর, আঙিনা পরিষ্কার আছে কি-না। কোনাে ছেলের যদি অসুখ করে, তা সে যতই সামান্য হােক, তার জন্যে ডাক্তার দেখাবার বন্দোবস্ত এই বিভাগের ’পরে। গার্হস্থ্যবিভাগের অন্তর্গত অনেকগুলি উপরিভাগ আছে। এই বিভাগের কর্তব্য হচ্ছে দেখা—ছেলেরা পরিষ্কার পরিপাটি আছে কি-না। ক্লাসে পড়বার কালে ছেলেদের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি রাখা ক্লাস-কমিটির কাজ। প্রত্যেক বিভাগ থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে অধ্যক্ষসভা গড়ে ওঠে। এই অধ্যক্ষসভার প্রতিনিধিরা স্কুল-কৌন্সিলে ভােট দেবার অধিকার পায়। ছেলেদের নিজেদের মধ্যে বা আর-কারও সঙ্গে বিবাদ হলে অধ্যক্ষসভা তার তদন্ত করে; এই সভার বিচার স্বীকার করে নিতে সব ছাত্রই বাধ্য।
এই বিদ্যাভবনের সঙ্গে একটি ক্লাব আছে। সেখানে অনেক সময়ে ছেলেরা নিজের ভাষায় নিজের নাট্যাভিনয় করে, গানবাজনার সংগত হয়। ক্লাবের একটি সিনেমা আছে, তার থেকে মধ্য-এশিয়ার জীবন-যাত্রার চিত্রাবলী ছেলেরা দেখতে পায়। এ ছাড়া দেয়ালে-টাঙানাে খবরের কাগজ বের করা হয়।
তুর্কমেনিস্তানের চাষের উন্নতির জন্যে সেখানে বহুসংখ্যক কৃষিবিদ্যার ওস্তাদ পাঠানাে হচ্ছে। দু-শর বেশি আদর্শ-কৃষিক্ষেত্র খােলা হয়েছে। তা ছাড়া জল এবং জমি ব্যবহার সম্বন্ধে যে ব্যবস্থা করা হল তাতে কুড়ি হাজার দরিদ্রতম কৃষক-পরিবার কষির খেত, জল এবং কৃষির বাহন পেয়েছে।
এই বিরল প্রজা দেশে ১৩০টা হাসপাতাল খােল রয়েছে, ডাক্তারের সংখ্যা ছয়-শ। বুলেটিনের লেখক সলজ্জ ভাষায় বলেছেন:
However, there is no occasion to rejoice in the fact, since there are 2,640 inhabitants to each hospital bed, and as regards doctors, Turcmenistan must be relegated to the last place in the Union. We can boast of some attainments in the field of modernization and the struggle against crass ignorance, though again we must warn the reader that Turcmenistan, being on a very low level of civilization, has preserved a good many customs of the distant past. However, the recent laws, passed in order to combat the selling of women into marriage and child marriages, had produced the desired effect.
তুর্কমেনিস্তানের মতাে মেরুপ্রদেশে ছয় বৎসরের মধ্যে আপাতত ১৩০টা হাসপাতাল স্থাপন করে এরা লজ্জা পায়—এমনতরো লজ্জা দেখা আমাদের অভ্যাস নেই বলে বড়াে আশ্চর্য বােধ হল। আমাদের বিস্তর ডিফিকnটিজ দেখতে পেলুম, সেগুলাে নড়ে বসবার কোনাে লক্ষণ দেখায় না তাও দেখলুম, কিন্তু বিশেষ লজ্জা দেখতে পাই নে কেন।
সত্যি কথা বলি, ইতিপূর্বে আমারও মনে দেশের জন্যে যথেষ্ট-পরিমাণে আশা করবার মতাে সাহস চলে গিয়েছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীর মতো আমিও ডিফিকলটিজের হিসাব দেখে স্তম্ভিত হয়েছি—মনে মনে বলেছি, এত বিচিত্র জাতের মানুষ, এত বিচিত্র জাতের মুর্খতা, এত পরস্পরবিরুদ্ধ ধর্ম, কী জানি কত কাল লাগবে আমাদের ক্লেশের বােঝা আমাদের কলুষের আবর্জনা নড়াতে।
সাইমন কমিশনের ফসল যে-আবহাওয়ায় ফলেছে স্বদেশ সম্বন্ধে আমার প্রত্যাশার ভীরুতা সেই আবহাওয়ারই। সােভিয়েট রাশিয়াতে এসে দেখলুম এখানকার উন্নতির ঘড়ি আমাদেরই মতো বন্ধ ছিল, অন্তত জনসাধারণের ঘরে—কিন্তু বহু শত বছরের অচল ঘড়িতেও আট—দশ বছর দম লাগাতেই দিব্যি চলতে লেগেছে। এতদিন পরে বুঝতে পেরেছি আমাদের ঘড়িও চলতে পারত কিন্তু দম দেওয়া হল না। ডিফিকলটিজের মন্ত্র আওড়ানােতে এখন থেকে আর বিশ্বাস করতে পারব না।
এইবার বুলেটিন থেকে দুই একটি অংশ উদ্ধৃত করে চিঠি শেষ করব:
The imperialist policy of the Czarist generals, after the conquest of Azerbaijan, consisted in converting the districts, inhabited by Mahommedans into colonies, destined to supply raw material to the central Russian markets.
মনে আছে অনেককাল হল, পরলােকগত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় একদা রেশমগুটির চাষ প্রচলন সম্বন্ধে উৎসাহী ছিলেন। তাঁরই পরামর্শ নিয়ে আমিও রেশমগুটির চাষ প্রবর্তনের চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলুম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, রেশমগুটির চাষে তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে যথেষ্ট আনুকূল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু যতবার এই গুটি থেকে সুতাে ও সুতাে থেকে কাপড় বােনা চাষীদের মধ্যে চলতি করবার ইচ্ছা করেছেন ততবারই ম্যাজিস্ট্রেট দিয়েছেন বাধা।—
The agents of the Czar's Government were ruthlessly carrying out the principle of ‘Divide and Rule’ and did all in their power to sow hatred and discord between the various races. National animosities were fostered by the Government and Mahommedans and Armenians were systematically incited against each other. The ever-recurring conflicts between these two nations at times assumed the assured the form of massacres.
হাসপাতালের সংখ্যা নিয়ে বুলেটিন-লেখক লজ্জা স্বীকার করেছেন বটে, কিন্তু একটা বিষয়ে গৌরব প্রকাশ না করে থাকতে পারেন নি:
It is an undoubted fact, which even the worst enemies of the Soviet cannot deny: for the last sight years the peace between the races of Azerbaijan has never been disturbed.
ভারতবর্ষের রাজত্বে লজ্জা প্রকাশের চলন নেই, গৌরব প্রকাশেরও রাস্তা দেখা যায় না।
এই লজ্জা স্বীকারের উপলক্ষ্যে একটা কথা পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার। বুলেটিনে আছে সমস্ত তুর্কমেনিস্তানে শিক্ষার জন্য জন-পিছু পাঁচ বল খরচ হয়ে থাকে। রুবলের মূল্য আমাদের টাকার হিসাবে আড়াই টাকা। পাঁচ রুবল বলতে বােঝায় সাড়ে বারাে টাকা? এই বাবদ কর আদায়ের কোনাে একটা ব্যবস্থা হয়তো আছে, কিন্তু সেই কর আদায় উপলক্ষ্যে প্রজাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিরােধ ঘটিয়ে দেবার কোনাে আশঙ্কা নিশ্চয় সৃষ্টি করা হয় নি। ইতি ৮ অক্টোবর, ১৯৩০।