রাশিয়ার চিঠি (১৯৪৫)/৮
রাশিয়া থেকে ফিরে এসেছি, চলেছি আমেরিকার পথে। রাশিয়া-যাত্রায় আমার একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল—ওখানে জনসাধারণের শিক্ষা-বিস্তারের কাজ কী রকম চলছে আর ওরা তার ফল কী রকম পাচ্ছে সেইটে অল্পসময়ের মধ্যে দেখে নেওয়া।
আমার মত এই যে, ভারতবর্ষের বুকের উপর যত কিছু দুঃখ আজ অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার একটি মাত্র ভিত্তি হচ্ছে অশিক্ষা। জাতিভেদ, ধর্মবিরােধ, কর্মজড়তা, আর্থিক দৌর্বল্য—সমস্তই আঁকড়ে আছে এই শিক্ষার অভাবকে। সাইমন কমিশনে ভারতবর্যের সমস্ত অপরাধের তালিকা শেষ করে ব্রিটিশ শাসনের কেবল একটিমাত্র অপরাধ কবুল করেছে। সে হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষাবিধানের ক্রটি। কিন্তু আর কিছু বলবার দরকার ছিল না। মনে করুন যদি বলা হয়, গৃহস্থ সাবধান হতে শেখে নি, এক ঘর থেকে আর-এক ঘরে যেতে চৌকাঠে হুঁচট লেগে লে আছাড় খেয়ে পড়ে, জিনিসপত্র কেবলি হারায় তার পরে খুঁজে পায় না, ছায়া দেখলে তাকে জুজু বলে ভয় করে, নিজের ভাইকে দেখে চোর এসেছে বলে লাঠি উঁচিয়ে মারতে যায়—কেবলি বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকে, উঠে হেঁটে বেড়াবার সাহসই নেই, খিদে পায় কিন্তু খাবার কোথায় আছে খুঁজে পায় না, অদৃষ্টের উপর অন্ধ নির্ভর করে থাকা ছাড়া অন্য সমস্ত পথ তার কাছে লুপ্ত—অতএব নিজের গৃহস্থালির তদারকের ভার তার উপর দেওয়া চলে না—তার পরে সবশেষে গলা অত্যন্ত খাটো করে যদি বলা হয়, আমি ওর বাতি নিবিয়ে রেখেছি, তাহলে সেটা কেমন হয়।
ওরা একদিন ডাইনী বলে নিরপরাধকে পুড়িয়েছে, পাপিষ্ঠ বলে বৈজ্ঞানিককে মেরেছে, ধর্মমতের স্বাতন্ত্র্যকে অতি নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন করেছে, নিজেই ধর্মের ভিন্ন সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রাধিকারকে খর্ব করে রেখেছে, এ ছাড়া কত অন্ধতা কত মূঢ়তা কত কদাচার মধ্যযুগের ইতিহাস থেকে তার তালিকা স্তূপাকার করে তোলা যায়—এ-সমস্ত দূর হল কী করে। বাইরেকার কোনো কোট অফ ওয়ার্ডসের হাতে ওদের অক্ষমতার সংস্কার-সাধনের ভার দেওয়া হয় নি; একটিমাত্র শক্তি ওদের এগিয়ে দিয়েছে, সে হচ্ছে ওদের শিক্ষা।
জাপান এই শিক্ষার যোগেই অল্পকালের মধ্যেই দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে সর্বসাধারণের ইচ্ছা ও চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে, দেশের অর্থ উৎপাদনের শক্তিকে বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে; বতর্মান তুরস্ক প্রলবেগে এই শিক্ষা অগ্রসর করে দিয়ে ধর্মান্ধতার প্রবল বোঝা থেকে দেশকে মুক্ত করবার পথে চলেছে। “ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়।” কেননা ঘরে আলো আসতে দেওয়া হয় নি,—যে-আলোতে আজকের পৃথিবী জেগে, সেই শিক্ষার আলো ভারতের রুদ্ধদ্বারের বাইরে।
রাশিয়ায় যখন যাত্রা করলুম খুব বেশি আশা করি নি। কেননা কতটা সাধ্য এবং অসাধ্য তার আদর্শ ব্রিটিশ ভারতবর্ষ থেকেই আমি পেয়েছি। ভারতের উন্নতিসাধনের দুরূহতা যে কত বেশি সে-কথা স্বয়ং খ্রীষ্টান পাদ্রি টমসন অতি করুণস্বরে সমস্ত পৃথিবীর কাছে জানিয়েছেন। আমাকেও মানতে হয়েছে দুরূহতা আছে বই কি, নইলে আমাদের এমন দশা হবেই বা কেন। একটা কথা আমার জানা ছিল, রাশিয়ায় প্রজাসাধারণের উন্নতিবিধান ভারতবর্ষের চেয়ে বেশি দুরূহ বই কম নয়। প্রথমত এখানকার সমাজে যারা ভদ্রেতর শ্রেণীতে ছিল আমাদের দেশের সেই শ্রেণীর লোকের মতোই তাদের অন্তর বাহিরের অবস্থা। সেই রকমই নিরক্ষর নিরুপায়, পূজার্চনা পুরুতপাণ্ডা দিনক্ষণ তাগাতাবিজে বুদ্ধিশুদ্ধি সমস্ত চাপা-পড়া, উপরিওআলাদের পায়ের ধূলোতেই মলিন তাদের আত্মসম্মান, আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের সুযোগ সুবিধা তারা কিছুই পায় নি, প্রপিতামহদের ভূতে পাওয়া তাদের ভাগ্য, সেই ভূত তাদের বেঁধে রেখেছে হাজার বছরের আগেকার অচল খোঁটায়, মাঝে মাঝে য়িহুদী প্রতিবেশীদের ’পরে খুন চেপে যায় তখন পাশবিক নিষ্ঠুরতার আর অন্ত থাকে না। উপরওআলাদের কাছ থেকে চাবুক খেতে যেমন মজবুত, নিজেদের সমশ্রেণীর প্রতি অন্যায় অত্যাচার করতে তারা তেমনি প্রস্তুত।
এই তো হল ওদের দশা,—বর্তমানে যাদের হাতে ওদের ভাগ্য ইংরেজের মত তারা ঐশ্বর্যশালী নয়, কেবলমাত্র ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে নিজের দেশে তাদের অধিকার আরম্ভ হয়েছে—রাষ্ট্রব্যবস্থা আটেঘাটে পাকা হবার মতো সময় এবং সম্বল তারা পায় নি—ঘরে-বাইরে প্রতিকূলতা—তাদের মধ্যে আত্মবিদ্রোহ সমর্থন করবার জন্যে ইংরেজ এমন কি আমেরিকানরাও গোপনে ও প্রকাশ্যে চেষ্টা করছে। জনসাধারণকে সক্ষম ও শিক্ষিত করে তোলবার জন্যে তারা যে পণ করেছে তার “ডিফিকালটি” ভারতকর্তৃপক্ষের ডিফিকালটির চেয়ে বহুগুণে বড়ো।
অতএব রাশিয়ায় গিয়ে বেশি কিছু দেখতে পাব এ-রকম আশা করা অন্যায় হত। কীই বা জানি কীই বা দেখেছি যাতে আমাদের আশার জোর বেশি হতে পারে। আমাদের দুঃখী-দেশে লালিত অতিদুর্বল আশা নিয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলুম। গিয়ে যা দেখলুম তাতে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। ‘ল অ্যাণ্ড অর্ডার’ কী পরিমাণে রক্ষিত হচ্ছে বা না হচ্ছে তার তদন্ত করবার যথেষ্ট সময় পাই নি—শােনা যায়, যথেষ্ট জবরদস্তি আছে; বিনাবিচারে দ্রুতপদ্ধতিতে শাস্তি, সেও চলে; আর-সব বিষয়ে স্বাধীনতা আছে কিন্তু কর্তৃপক্ষের বিধানের বিরুদ্ধে নেই। এটা তাে হল চাঁদের কলঙ্কের দিক, কিন্তু আমার দেখবার প্রধান লক্ষ্য ছিল আলােকের দিক। সেদিকটাতে যে-দীপ্তি দেখা গেল,সে অতি আশ্চর্য—যারা একেবারেই অচল ছিল তারা সচল হয়ে উঠেছে।
শােনা যায় য়ুরােপের কোনো কোনো তীর্থস্থানে দৈবকৃপায় একমুহূর্তে চিরপঙ্গু তার লাঠি ফেলে এসেছে—এখানে তাই হল; দেখতে দেখতে খুঁড়িয়ে চলবার লাঠি দিয়ে এরা ছুটে চলবার রথ বানিয়ে নিচ্ছে—পদাতিকের অধম যারা ছিল তার বছর দশেকের মধ্যে হয়ে উঠেছে রথী। মানবসমাজে তারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তাদের বুদ্ধি স্ববশ, তাদের হাত হাতিয়ার স্ববশ।
আমাদের সম্রাটবংশীয় খ্রীষ্টান পাদ্রিরা বহুকাল ভারতবর্ষে কাটিয়েছেন, ডিফিকালটিস যে কী রকম অনড় তা তাঁরা দেখে এসেছেন। একবার তাঁদের মস্কৌ আসা উচিত। কিন্তু এলে বিশেষ- ফল হবে না—কারণ বিশেষ করে কলঙ্ক দেখাই তাঁদের ব্যবসাগত অভ্যাস, আলো চোখে পড়ে না, বিশেষত যাদের উপর বিরোগ আছে। ভুলে যান তাঁদের শাসনচন্দ্রেও কলঙ্ক, খুঁজে বের করতে বড়ো চশমার দরকার করে না।
প্রায় সত্তর বছর আমার বয়স হল—এতকাল আমার ধৈর্যচ্যুতি হয় নি। নিজেদের দেশের অতি দুর্বহ মূঢ়তার বােঝর দিকে তাকিয়ে নিজের ভাগ্যকেই বেশি করে দোষ দিয়েছি। অতি সামান্য শক্তি নিয়ে অতি সামান্য প্রতিকারের চেষ্টাও করেছি কিন্তু জীর্ণ আশার রথ যত মাইল চলেছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় দড়ি ছিঁড়েছে চাকা ভেঙেছে। দেশের হতভাগাদের দুঃখের দিকে তাকিয়ে সম অভিমান বিসর্জন দিয়েছি। কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চেয়েছি, তাঁরা বাহ্বাও দিয়েছেন, যেটুকু ভিক্ষে দিয়েছেন তাতে জাত যায় পেট ভরে না। সব-চেয়ে দুঃখ এবং লজ্জার কথা এই যে, তাঁদের প্রসাদলালিত আমাদের স্বদেশী জীবরাই সবচেয়ে বাধা দিয়েছে। যে-দেশ পরের কর্তৃত্বে চালিত সেই দেশে সব-চেয়ে গুরুতর ব্যাধি হল এই—সে-সব জায়গায় দেশের লােকের মনে যে ঈর্ষা, যে ক্ষুদ্রতা যে স্বদেশ-বিরুদ্ধতার কলুষ জন্মায় তার মতো বিষ নেই।
বাইরের সকল কাজের উপরেও একটা জিনিস আছে যেটা আত্মার সাধনা। রাষ্ট্রিক আর্থিক নানা গােলমালে যখন মনটা আবিল হয়ে ওঠে তখন তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই নে বলেই তার জোর কমে যায়। আমার মধ্যে সে বিপদ আছে, সেইজন্যেই আসল জিনিসকে আঁকড়ে ধরতে চাই। কেউ বা আমাকে উপহাস করে, কেউ বা আমার উপর রাগ করে, তাদের নিজের পথেই আমাকে টেনে নিতে চায়। কিন্তু কোথা থেকে জানি নে আমি এসেছি এই পৃথিবীর তীর্থে, আমার পথ আমার তীর্থ-দেবতার বেদীর কাছে। মানুষের দেবতাকে স্বীকার করে এবং প্রণাম করে যাব আমার জীবনদেবতা আমাকে সেই মন্ত্র দিয়েছেন। যখন আমি সেই দেবতার নির্মাল্য ললাটে পরে যাই তখন সব জাতের লােকই আমাকে ডেকে আসন দেয়, আমার কথা মন দিয়ে শােনে। যখন ভারতবর্ষীয়ের মুখােস পরে দাঁড়াই তখন বাধা বিস্তর। যখন আমাকে এরা মানুষরূপে দেখে, তখনি এরা আমাকে ভারতবর্ষীয় রূপেই শ্রদ্ধা করে; যখন নিছক ভায়তবর্ষীয় রূপে দেখা দিতে চাই তখন এরা আমাকে মানুষরূপে সমাদর করতে পারে না। আমার স্বধর্ম পালন করতে গিয়ে আমার চলবার পথ ভুল-বােঝার দ্বারা বন্ধুর হয়ে ওঠে। আমার পৃথিবীর মেয়াদ সংকীর্ণ হয়ে এসেছে; অতএব আমাকে সত্য হবার চেষ্টা করতে হবে, প্রিয় হবার নয়।
আমার এখানকার খবর সত্য মিথ্যা নানাভাবে দেশে গিয়ে পৌঁছয়। সে-সম্বন্ধে সব সময় উদাসীন থাকতে পারি নে বলে নিজের উপর ধিক্কার জন্মে। বার বার মনে হয়, বানপ্রস্থের বয়সে সমাজস্থের মতাে ব্যবহার করতে গেলে বিপদে পড়তে হয়।
যাই হােক এ-দেশের “এনর্মাস ডিফিকালটিজের” কথা বইয়ে পড়েছিলুম, কানে শুনেছিলুম, কিন্তু সেই ডিফিকালটিজ অতিক্রমণের চেহারা চোখে দেখলুম। ইতি ৪ অক্টোবর ১৯৩০।