রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
স্মিথকে বিদায় দান করিয়া মিঃ ব্লেক তাঁহার গৃহকর্ত্রী মিসেস্ বার্ডেলকে আহ্বানপূর্ব্বক তাঁহার ব্যাগে কাপড়-চোপড় পুরিতে বলিলেন; তাহার পর তিনি একরাশি পত্র লিখিলেন।
মিঃ ব্লেক রাত্রি-শেষে প্রিয় কুকুর টাইগারকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার মোটর গাড়ীতে উঠিলেন; মোটর দ্রুতবেগে প্লাইমাউথ বন্দরের দিকে ধাবিত হইল।
ডকে আসিয়া তিনি বড় ধাঁধায় পড়িলেন; ডকের কোন্ জাহাজখানি লর্ড কার্ডবাইয়ের, অন্ধকারে তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। অতঃপর তিনি কি করিবেন ভাবিতেছেন, এমন সময় একজন মাঝির সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল; মাঝি তত রাত্রে তাঁহাকে একাকী ডকে ঘুরিতে দেখিয়া বিস্মিত হইল, নমস্কার করিয়া বলিল, “মহাশয় কি এখানে কাহারও অনুসন্ধানে আসিয়াছেন?”
মিঃ ব্লেক বলিলেন, “না, লর্ড কার্ডবাইয়ের জাহাজ ‘কর্সেয়ার’ কোথায়, তাহাই আমি খুঁজিতেছি। তুমি আমাকে সেইখানে পঁহুছাইয়া দিতে পার?”
মাঝি বলিল, “তা আর পারি না? আমার ত উহাই কাজ। আপনি আমার নৌকায় উঠিলে আপনাকে দুই মিনিটের মধ্যে সেই জাহাজে তুলিয়া দিব। ঐ দেখুন ‘কর্সেয়ার',—ঐ সবুজ আলো।”
মিঃ ব্লেক মোটর গাড়ীখানি বিদায় করিয়া নৌকায় উঠিলেন; অল্প সময়ের মধ্যেই নৌকা জাহাজের পাশে ভিড়িল। তিনি যখন জাহাজে পদার্পণ করিলেন, তখন পূর্ব্ব দিক ফরসা হইয়াছিল।
জাহাজের কাপ্তেন মিঃ ব্লেকের পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া বলিলেন, “আপনি রাত্রেই জাহাজে আসিবেন তাহা মনে করি নাই; কিন্তু আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছি, আপনি যখনই আদেশ করিবেন, সেই মুহূর্তেই জাহাজ ছাড়িয়া দিতে পারিব।”
মিঃ ব্লেক বলিলেন, “আপনার তৎপরতা প্রশংসনীয়; জাহাজ ছাড়িতে বিলম্ব করিবার আবশ্যক নাই। আপনার নামটি জানিতে পারি কি?”
কাপ্লেন বলিলেন, “আমার নাম পেণ্টল্যাও। জাহাজের অধ্যক্ষ মিঃ রস জাহাজ পরিচালনের ভার লইলেই আমি ছুটী পাইব। আপনি আমার সঙ্গে চলুন, আপনার কামরা দেখাইয়া দিতেছি।”
অবিলম্বে জাহাজ চলিতে আরম্ভ করিল। অল্পক্ষণ পরে জাহাজের অধ্যক্ষ রসের সহিত মিঃ ব্লেকের পরিচয় হইল। রস সদালাপে দক্ষ, অত্যন্ত বিনয়ী লোক। মিঃ ব্লেক তাহার সহিত আলাপ করিয়া সুখী হইলেন।
রসের সহিত আলাপ শেষ হইলে মিঃ ব্লেক কাপ্তেন পেণ্টল্যাণ্ডের সহিত তাঁহার শয়র কক্ষে প্রবেশ করিলেন। এই কক্ষের পাশেই উপবেশনের কক্ষ, কক্ষ দু’টি বৃহৎ; তাহা জাহাজের পশ্চাদ্ভাগে অবস্থিত।
কাপ্তেন বিদায় লইবার সময় বলিলেন, “আশা করি আপনার এখানে কোন অসুবিধা হইবে না। সর্দ্দার খানসামা আপনার সকল আদেশ পালন করিবে। আপনার যখন যাহা আবশ্যক হইবে, অসঙ্কোচে তাহা, তাহাকে বলিলেন। আপনিই এখন এ জাহাজের মালিক; আপনি যদি আমাদিগকে দক্ষিণ মেরুতে যাইতে আদেশ করেন, তাহাতেও আমাদের আপত্তি নাই।”
মিঃ ব্লেক সহাস্যে বলিলেন, “না, তত দূরে আমার যাইবার আবশ্যক নাই। আপনার মত সুদক্ষ কর্ম্মচারীগণের উপর যে জাহাজ পরিচালনের ভার আছে, তাহাতে আমার কোনও অসুবিধা ঘটিবার সম্ভাবনা নাই তাহা বুঝিয়াছি। যাহা হউক, আমি বড়ই পরিশ্রান্ত হইয়াছি, কয়েক ঘণ্টা ঘুমাইব; আপনিও বিশ্রাম করিতে যান।”
কাপ্তেন বিদায় লইলে মিঃ ব্লেক শয়নের পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া দুগ্ধফেননিভ সুকোমল শয্যায় শয়ন করিলেন; যেমন শয়ন অমনই নিদ্রা।
মিঃ ব্লেক যখন মোটর গাড়ীতে বন্দরে আসেন, সেই সময় আর একখানি মোটর তাঁহার অনুসরণ করিয়াছিল, কিন্তু তিনি তাহা লক্ষ্য করেন নাই; তিনি নিশ্চিন্ত মনে নৌকায় উঠিলে, সেই মোটর গাড়ীখানি বন্দর হইতে টেলিগ্রাফ অফিসের দিকে ধাবিত হইল। মোটরের আরোহী টেলিগ্রাফ অফিসে প্রবেশ করিয়া সাল্ভেরিটা রাজ্যে টেলিগ্রাম পাঠাইল।—মিঃ ব্লেক যদি এ সংবাদ জানিতে পারিতেন, তাহা হইলে তিনি সাল্ভেরিটা-অভিমুখে জাহাজ চালাইতে নিষেধ করিতেন। কিন্তু ভবিতব্যতার কথা কেহ বলিতে পারে না। —রূপসী বোম্বেটের জগৎ-জোড়া ফাঁদ!
মিঃ ব্লেক সমস্ত দিনের মধ্যে কেবিন হইতে বাহির হইলেন না; দীর্ঘনিদ্রায় শ্রান্তি দূর করিয়া তিনি রাত্রিকালে ভোজনাগারে ভোজন করিতে চলিলেন।
সেখানে জাহাজের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ম্যাকের সহিত তাঁহার, পরিচয় হইল। জাহাজের কাপ্তেন ও অধ্যক্ষের ন্যায় মিঃ ম্যাকেও অতি ভদ্রলোক; তাঁহার খেলার বাতিক অত্যন্ত অধিক। জাহাজে মিঃ ব্লকের সময় মহানন্দে কাটিতে লাগিল।
দ্বিতীয় দিন রাত্রে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন কইল, তাহার পর ঝুপ্ ঝুপ্ শব্দে বৃষ্টি আরম্ভ হইল; মিঃ ব্লেক তখন জাহাজের সুসজ্জিত সেলুনে বসিয়া ব্রিজ খেলা করিতেছিলেন; ইঞ্জিনিয়ার ম্যাকে খেলায় তাঁহার সহযোগিতা করিতেছিলেন। মিঃ ব্লেক খেলায় এরূপ তন্ময় হইয়াছিলেন যে, তিনি স্থান কাল বিস্মৃত হইয়াছিলেন; বাহিরের দুর্যোগের দিকে তাঁহার লক্ষ্য ছিল না।
যদি তিনি বুঝিতে পারিন,ঠিক সেই সময়—সেই ভীষণ ঝড় বৃষ্টির মধ্যে তাহার প্রিয় অনুচর স্মিথ অন্য একখানি জাহাজ হইতে আততায়ী কর্তৃক সমুদ্রগর্ভে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে, এবং জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়া সমুদ্র-তরঙ্গে একবার ডুবিতেছে, আবার ভাসিয়া উঠিতেছে; তা হইলে তাঁহার মনের ভাব কিরূপ হইত, অনুমান করা কঠিন। কিন্তু মিঃ ব্লেক তাহার বিপদের কথা কিছুই জানিতে পারিলেন না।
চারি জনে খেলা চলিতেছিল; টাইগার মিঃ ব্লেকের পদপ্রান্তে টেবিলের নীচে কুণ্ডলী পাকাইয়া নিদ্রা যাইতেছিল। হঠাৎ টাইগার টেবিলের তল হইতে বাহিরে আসিল, এবং সমুদ্রের দিকে চাহিয়া কাতর ভাবে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল।
মিঃ ব্লেক খেলা বন্ধ করিয়া ইঞ্জিনিয়ার মুখের দিকে চাহিলেন, বলিলেন, “ব্যাপার কি বুঝিতে পারিতেছি না, আমার কুকুর ত অকারণে এ ভাবে আর্ত্তনাদ করে না!”।
ইঞ্জিনিয়ার বলিলেন, “আমার বোধ হয় কোনও লোক এই দুর্য্যোগের মধ্যে জাহাজ হইতে সমুদ্রে পড়িয়া ডুবিতেছে; কুকুরটা তাহা বুঝিতে পারিয়া চীৎকার করিতেছে। সংস্কারবলে কুকুর ইহা জানিতে পারিয়াছে। হয় ত আপনি আমার কথা কুসংস্কার বলিয়া উড়াইয়া দিবেন; কিন্তু আমার এ অনুমান অন্ধ কুসংস্কার মাত্র নহে।”
“হইতেও পারে” বলিয়া মিঃ ব্লেক পুনর্ব্বার খেলায় মন দিবেন, এমন সময় টাইগার মিঃ ব্লেকের নিকট সরিয়া গিয়া তাঁহার জানুতে মস্তক ঘর্ষণ করিতে করিতে এক একবার কাতর ভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিতে লাগিল। তাহার মুখ দেখিয়া মিঃ ব্লেকের মনে হইল, তাহার কি যেন বলিবার আছে; কিন্তু তিনি তাহার মনের ভাব বুঝিতে পারিলেন না, সেই জন্য সাদরে তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “টাইগার, তোর হইল কি? তুই এত কাল আমার সঙ্গে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছিস্, আজ তোর কি ভয় লাগিল?”
কিন্তু মিঃ ব্লেকের আদরে টাইগারের চাঞ্চল্য দূর হইল না সে অত্যন্ত অস্থির ভাবে দ্বারের নিকট ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল; এবং বিস্ফারিত নেত্রে এক একবার সমুদ্রের দিকে চাহিয়া কাতর ভাবে আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল।
মিঃ ব্লেক তখন বন্ধুগণের সহিত খেলায় মত্ত, টাইগারের এই বিচিত্র ব্যবহারের কারণ বুঝিবার চেষ্টা করিলেন না; অবশেষে তিনি তাহার আর্ত্তনাদে বিরক্ত হইয়া খেলা বন্ধ করিলেন, এবং টাইগারকে সঙ্গে লইয়া জাহাজের ডেকের নীচে নামিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন। কিন্তু টাইগার সেখান হইতে নড়িল না, সে সেই কামরার দ্বার-প্রান্তে বসিয়া ক্রমাগত কাতর ভাবে চীৎকার করিতে লাগিল। মিঃ ব্লেক বিস্ফারিত নেত্রে অন্ধকারপূর্ণ সমুদ্রের দিকে চাহিলেন। তখনও প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়িতেছিল, বায়ুর বেগও প্রবল।—তিনি কোনও দিকে কিছু দেখি না পাইয়া ক্ষুব্ধ হৃদয়ে ডেকের নীচে চলিলেন।