রূপসী বোম্বেটে/প্রথম খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ

রূপসী বোম্বেটে



প্রথম খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছদ

ইংলণ্ড হইতে প্রেরিত দুই কোটী টাকার স্বর্ণ-মুদ্রা যথাসময়ে সুবিখ্যাত আট্‌লাণ্টিক লাইনার কোম্পানীর জাহাজে সাল্‌ভেরিণ্টা রাজধানীর বন্দরে উপস্থিত হইল। প্রেসিডেণ্ট পিয়ারন এক মহাদুশ্চিন্তা হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একজন সেক্রেটারীকে ডাকাইয়া বলিলেন, “কোর্টেজ, প্রহরীদের জানাইবে তাহারা যেন বন্দরে টাকা আনিতে যাইবার জন্য প্রস্তুত থাকে। টাকা আসিলে তুমি তাহার উপযুক্ত পাহারার বন্দোবস্ত করিবে।”

 সেক্রেটারী কোর্টেজ প্রস্থান করিলেন। পিয়ারসন চেয়ারে ঠেস দিয়া বসিয়া চুরুট, টানিতে লাগিলেন; অনেকক্ষণ চিন্তার পর তিনি অস্ফুট স্বরে বলিলেন,“এত দিনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। দুই কোটী টাকা এ সময়ে না পাইলে যে কি কম বিব্রত হইতাম, তা বলা যায় না। সৈন্যগণ ছয় মাস বেতন পায় নাই, প্রাপ্য বেতনের জন্য তাহারা অত্যন্ত পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিয়াছে; কামান বন্দুকগুলিও পুরাতন হইয়া গিয়াছে, শীঘ্রই কিছু নূতন অস্ত্র আমদানি করিতে হইবে। সাণ্টা-রোজা পর্য্যন্ত রেলের লাইনটুকু খুলিতে না পারিলে চলিতেছে না; আর প্রাসাদের কোন কোন অংশের পরিবর্ত্তন পরিবর্দ্ধনও নিতান্ত আবশ্যক। এইবার আমাকেও কিছু সম্বল ফরিয়া লইতে হইবে ও দুই কোটী টাকা এক সঙ্গে কখনও হাতে আসে নাই।”

 বস্তুতঃ এতগুলি টাকা হস্তগত হওয়ায় প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের মনে আনন্দ-সঞ্চারের যথেষ্টই কারণ ছিল। পাঁচ বৎসর পূর্ব্বে যখন তিনি একাকী সাল্‌ভেরিটায় পদার্পণ করেন, তখন তিনি তেমন ধনবান ছিলেন না, কাহাও সহিত তাঁহার বিশেষ পরিচয়ও ছিল না। তাহার পর এই পাঁচ বৎসরে তাঁহার কি পরিবর্তন! এখন তিনি সাল্‌ভেরিটার নির্ব্বাচিত নরপতি; প্রজাতন্ত্রের ভাগ্য-নিয়ন্তা! প্রজা-বিপ্লবে তিনি ভূস্বামীগণের পক্ষে যোগদান না করিলে, এত শীঘ্র তিনি রাজ্যের সর্ব্বেসর্ব্বা হইতে পারিতেন না। এখন ধন মান, যশ, প্রভূত্ব সকলই তিনি লাভ করিয়াছেন। অষ্ট্রেলিয়ার একটা সোনার খনির ডাইরেক্টর আজ সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের অধিনায়ক। অদ্ভুত ভাগ্য!

 সাল্‌ভেরিটা রাজ্যের সৈন্যগণই তাঁহার প্রধান সহায়। তিনি অপূর্ব্ব কৌশলে বহু চেষ্টায় সৈন্যগণকে তাঁহার পক্ষাবলম্বী করিয়া, ছিলেন।—সেনাপতির মৃত্যুর পর সর্ব্ব-সম্মতিক্রমে তিনিই প্রধান। সেনানায়কের পদ লাভ করেন;—সেই পদ হইতে প্রেসিডেণ্টের পদ লাভ করা তাঁহার পক্ষে কঠিন হয় নাই।

 'জিগ্‌স’ খনির মালেকান স্বত্ত্ব কৌশলে আত্মসাৎ করিয়া মিসেস্‌ কার্টারের বিশ্বাসঘাতক কর্মচারীরা প্রচুর সুবর্ণ লাভ করিয়াছিল;কিন্তু'পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তে যায়', এ কথা মিথ্যা নহে পিয়ারসন। ঘোড়-দৌড়ের বাজীতে ও জুয়ায় সর্ব্বস্বান্ত হইয়া সেই অঞ্চল পরিত্যাগ পূর্ব্বক মেলবোর্ণ সহরে পলায়ন করেন এবং ‘পিটারসন’ এই ছদ্মনামে এক প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন; তিনি সেখানেও কিছু ‘দাও’ মারিয়াছিলেন। পরে সেই ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হওয়ায় তিনি রাজদ্বারে অভিযুক্ত হইলে, তাঁহার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী ওয়ারেণ্ট বাহির হয়। তখন হাতে যে কিছু নগদ টাকা ছিল, তাহা লইয়া তিনি প্রাণভয়ে গোপনে দেশান্তরে। পলায়ন করিলেন; নিরুদ্দিষ্ট ‘পিটারসনের’ কেহ সন্ধান পাইল না।

 কিছু কাল অজ্ঞাতবাসের পর পিয়ারসনের হঠাৎ সাল্‌ভেরিটা রাজ্যে পদার্পণ করিলেন। ভাগ্যলক্ষ্মীর প্রসন্নতায় ক্রমে তিনি কিরূপে রাজ্যের প্রধান নায়কের পদ লাভ করিয়াছিলেন, সে কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি।

 সালভেরিটায় পিয়ারসন যে সকল উচ্চপদস্থ রাজকর্ম্মচারীকে বন্ধুরূপে লাভ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে জেনারেল মেন্‌ডোজার নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় জেনারেল মেন্‌ডোজা লণ্ডনে সালভেরিটা রাজ্যের রাজদূতের কর্ম্মে নিযুক্ত ছিলেন। জেনারেল মেন্‌ডোজার একটি পরমাসুন্দরী অবিবাহিতা কন্যা ছিল; সকলেই শুনিয়াছিল জেনারেল মেন্‌ডোজা প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনের হস্তে কন্যা-রত্ন সম্প্রদান করিয়া তাঁহার সহিত বন্ধুত্ব-বন্ধন দৃঢ়তর করিবেন। প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন এই যুবতীকে ভাল বাসিয়াছিলেন; যুবতী যেমন রূপবতী, তাঁহার পিতার সেইরূপ অগাধ সম্পত্তি। জেনারেল মেন্‌ডোজার অন্য সন্তানাদি ছিল না; তাঁহার যে সম্পত্তি ছিল, তাহার মূল্য পাঁচ কোটী মুদ্রা। জেনারেল মেন্‌ডোজার মৃত্যুর পর এই বিপুল অর্থ তাঁহার জামাতার হস্তগত হইবে, পিারসন এ কথা জানিতেন। এই সকল কারণে তিনি তাড়াতাড়ী বিবাহের জন্য অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করিতেছিলেন, প্রণয়িনীর বিরহ-যন্ত্রণা তাঁহার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল। জেনারেল মেন্‌ডোজারও এ বিবাহে আপত্তি ছিল না; তিনি তাঁহার কন্যার বিবাহে জামাতাকে পঞ্চাশ লক্ষ মুদ্রা যৌতুক দিবেন। প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন এ কথাও শুনিয়াছিলেন। তিনি চুরুট টানিতে টানিতে সুখের স্বপ্নে বিভোর হইলেন।

 হটাৎ সেক্রেটারী কর্টেজের পুনরাবির্ভাবে পিয়ারসনের সুখ-স্বপ্ন ভঙ্গ হইল, প্রফুল্ল মুখ দেখিতে দেখিতে গম্ভীর হইয়া উঠিল; তিনি চেয়ারে সোজা হইয়া বসিলেন।

 সেক্রেটারী কর্টেজ তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া বলিল, “আমি সকল বন্দোবস্ত শেষ করিয়া আসিয়াছি। কাপ্তেন এলামেডা আপনার দেহ-রক্ষী সৈন্যদলের দশজনকে সঙ্গে লইয়া জাহাজে টাকা আনিতে গিয়াছেন। টাকাগুলি শীঘ্রই প্রাসাদে আনীত হইবে। এই দশজন রক্ষী-সৈন্য আজ রাত্রি দ্বিপ্রহর পর্যন্ত এখানে টাকার পাহারায় থাকিবে; তাহার পর লেফ্‌টেনাণ্ট সান্‌ড্রা আর দশজন রক্ষী-সৈন্য লইয়া পাহারায় আসিলে তাহারা ছুটী পাইবে। আপনার। শয়নকক্ষে পার্শে যে কুঠুরী আছে, তাহাতেই টাকাগুলি রাখিবার। ব্যবস্থা হইয়াছে। আমি লেফ্‌টেনাণ্ট সাণ্ড্রাকে বলিয়া দিয়াছি, তাহার প্রহরীর রাত্রে যেন কোনও রকম গণ্ডগোল করিয়া আপনার! নিদ্রার ব্যাঘাত না ঘটায়, তাহারা নিঃশব্দে পাহারায় নিযুক্ত থাকিবে।”

 প্রসিডেণ্ট পিয়ারসন বলিলেন, “তোমার বন্দোবস্তে আমি খুসী হইলাম। রাজকীয় ধনাগারের কাজ যাহাতে শীঘ্র শেষ হয় তুমি তাহার ব্যবস্থা করিবে। এত টাকা দীর্ঘকাল প্রাসাদে পড়িয়া থাকে, ইহা আমার ইচ্ছা নয়।”  সেক্রেটারী কর্টেজ বলিল, “ধনাগারের নির্ন্মাণ-কার্য যাহাতে শীঘ্র শেষ হয়, আমি তাহার চেষ্টা করিতেছি। আমি কন্‌ট্রাক্টরকে তাগিদ দিয়াছিলাম; সে বলিয়াছে এই সপ্তাহের মধ্যেই কাজ শেষ হইবে।”

 পিয়ারসন বলিলেন, “উত্তম। আজ সন্ধ্যার পর আমি মন্ত্রণাসভার সদস্যগণকে আহ্বান করিব। সৈন্যগণের অনেক দিনের বেতন বাকি পড়িয়াছে, আপাততঃ তাহাদিগকে ছয় মাসের বেতন দেওয়া হইবে; এবং তাহাদের বেতন বৃদ্ধি করা যাইবে কি না সে সম্বন্ধে সদস্যগণের সহিত মন্ত্রণা করা আবশ্যক। তুমি সদস্যগণকে রাত্রি আটটার সময় সভায় যোগদান করিবার জন্য নোটীস্‌ দিবে, আর তুমিও সভায় উপস্থিত থাকিবে।—এখন তুমি যাইতে পার।”

 রাত্রি আটটার সময় মন্ত্রণা-সভার সদস্যগণ সভাগৃহে সমবেত হইলেন। সভাপতি সৈন্যগণের বেতন বৃদ্ধির যে প্রস্তাব কমিলন, তাহা সর্ব্ব-সম্মতি ক্রমে গৃহীত হইল।

 সভার কার্য্য শেষ হইলে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসন প্রফুল্ল চিত্তে তাঁহার শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিলেন; সেই কক্ষের পার্শ্বস্থিত কক্ষে স্বর্ণ-মূদ্রা গুলি সংরক্ষিত হইয়াছিল।—পিয়ারসন একবার সেই কক্ষে গমন করিয়া রক্ষী-সৈন্যগণের অধিনায়ক কাপ্টেন এলামেডাকে দুই একটি উপদেশ দিয়া স্বর্ণমুদ্রাপূর্ণ কাষ্ঠ-নির্ম্মিত আধারগুলি পরীক্ষা করিলেন, তাহার পর শয়নকক্ষে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক সুকোমল শুভ্র শয্যায় শ্রান্ত দেহ প্রসারিত করিলেন।—রাত্রি বারটার সময় রক্ষী পরিবর্ত্তনের কথা; তৎপূর্ব্বেই তিনি গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইলেন।

 সেইদিন সন্ধ্যাকালে রাজধানী হইতে প্রায় পনের মাইল দূরে সমুদ্র-তটবর্তী একটি নিভৃত অরণ্যে কয়েকজন লোক নিম্নস্বরে কি পরামর্শ করিতেছিল।

 সেই অরণ্যের অদূরে সমুদ্র-বক্ষে একখানি শুভ্র বর্ণের জাহাজ হইতে অস্ফুট বাস্পের শব্দ উথিত হইতেছিল; জাহাজের সমস্ত দীপ নির্ব্বাপিত হইয়াছিল।—ইহা রূপসী বোম্বেটের জাহাজ।

 রাত্রি ঠিক আট ঘটিকার সময় জাহাজের কাপ্তেনের ইঙ্গিতে কয়েকজন নাবিক জাহাজের উপর হইতে দুইখানি ফ্ল্যাট জলে নামাইয়া দিল; প্রত্যেক ফ্ল্যাটের উপর এক একখানি প্রকাণ্ড মোটর গাড়ী। গাড়ীতে মাল বহিবার জন্য প্রচুর স্থান ছিল।

 ফ্ল্যাট দুইখানি জলে নামিলে নাবিকগণ আদেশের প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া রহিল; কিন্তু তাহাদিগকে অধিকক্ষণ বিলম্ব করিতে হইল না। আমেলিয়া ও তাঁহার মাতুল জাহাজের কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 রূপসী বোম্বেটে আমেলিয়া সমুদ্রের দিকে চাহিয়া তাঁহার মাতুল গ্রেভিস্‌কে মৃদুস্বরে বলিলেন, “সৌভাগ্যক্রমে আজ সমুদ্র বেশ স্থির আছে; কার্যোদ্ধারে তেমন অসুবিধা না হইবারই কথা।”

 একখানি ফ্ল্যাটের এক প্রান্তে রাইমার দাঁড়াইয়াছিল; সে বলিল, “হাঁ, আমারও বিশ্বাস—সহজেই আমরা কার্যোদ্ধার করিতে পারিব। কিন্তু আর আমাদের বিলম্ব করা হইবে না। আপ বলিয়াছেন, রাত্রি বারটার সময় প্রহরী, পরিবর্ত্তিত হইবে, তাহার পূর্ব্বেই আমাদের ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া আবশ্যক।”

 পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্ল্যাট দুইখানি সমুদ্রতটে উপস্থিত হইল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই মোটর গাড়ী দু’খানিকে ফ্ল্যাট হইতে তীরে অবতরণ করা হইল। অতঃপর মোটর গাড়ী দুইখানি পোর্টো কস্টা বন্দরের দিকে ধীরে ধীরে পরিচালিত হইল। গাড়ীতে ল্যাম্প প্রজ্বলিত হইল না। আমেলিয়া স্বয়ং একখানি মোটর পরিচালিত করিতে লাগিলেন, রাইমার অন্যখানি লইয়া চলিল।

 রাত্রি এগারটার সময় মোটর দুইখানি নগরোপকণ্ঠে উপস্থিত হইল।

 প্রাসাদের পশ্চাতে একটি নিবিড় জঙ্গল ছিল; একটি জন-বিরল পথ দিয়া মোটর দুইখানি সেই জঙ্গলের নিকট লইয়া যাওয়া হইল।

 একটি উচ্চ পাহাড়ের উপর সাল্‌ভেরিটার রাজপ্রাসাদ নির্ম্মিত; তাহার চারি পাশে অন্য কোন ঘর বাড়ী ছিল না।

 মোটর দুইখানি দুই জন লোকের জিম্মায় রাখিয়া রাইমার অবশিষ্ট নাবিকগণকে সঙ্গে লইয়া সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়া প্রাসাদের অভিমুখে অগ্রসর হইল, সকলেই নীরবে লঘু পদ-বিক্ষেপে চলিতে লাগিল।

 প্রাসাদ হইতে নগরে যাইবার পথের ধারে একটু ফাঁকা জমি ছিল; রাইমার অনুচরবর্গের সহিত সেই স্থানে আসিয়া মাটীতে শুইয়া পড়িল।

 অল্পক্ষণ পরে রাজপথ ঘোড়ার গাড়ীর চক্রশব্দে মুখরিত হইল। মন্ত্রণাসভার সদস্যগণ সভাভঙ্গে এই সকল গাড়ীতে প্রাসাদ হইতে গৃহে ফিরিতেছিলেন।—রাইমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিল, গাড়ীগুলি নগরের অভিমুখে দ্রুত, ধাবিত হইতেছে। শকটের আরোহীরা ভূতলশায়ী বোম্বেটেদের দেখিতে পাইলেন না।—অল্পক্ষণ পরেই চক্রধ্বনি নীরব হইল।

 শকট গুলি অদৃশ্য হইলে রাইমার ভূমি-শয্যা ত্যাগ করিয়া তাঁহার অনুচরগণকে, দুই দলে বিভক্ত করিল; এবং এক দলের অধিনায়ককে দুই একটি উপদেশ দিয়া কিছু দূরে পথের অন্য ধারে পাঠাইল।  বোম্বেটেরা দুই দলে বিভক্ত হইয়া পথপ্রান্তবর্ত্তী বৃক্ষের অন্তরালে আশ্রয় গ্রহণ করিল।

 রাত্রি বারোটা বাজিবার কয়েক মিনিট পূর্ব্বে দশজন প্রহরী প্রাসাদের দিকে অগ্রসর হইল। বল বাহুল্য, ইহারা কাপ্তেন আলামেডার অধীনস্থ প্রহরীদের ছুটী দিবার জন্য টাকার পাহারা দিতে যাইতেছিল।

 এই সকল প্রহরীর সঙ্গে আলো ছিল না; তাহারা চলিতে চলিতে দেখিতে পাইল, তাহাদের সম্মুখ ও পশ্চাৎ হইতে দুই দল লোক ঠিক একই সময়ে আসিয়া তাহাদের ঘাড়ের উপর লাফাইয়া পড়িল! এই অদ্ভুত ব্যাপারে তাহারা এরূপ বিস্মিত হইয়াছিল যে, তাহারা আত্মরক্ষা করিবারও অবসর পাইল না; বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রহরীর মুখব্যাদন করিবার পূর্ব্বেই বোম্বেটেরা তাহাদের মুখে বালুকাপূর্ণ থলি চাপাইয়া দিয়া তাহাদের মুখ বন্ধ করিল; তাহার পর সকলকে বাঁধিয়া ফেলিল।—মুহূর্ত্ত মধ্যে এই কাণ্ড ঘটিল।

 রাইমার অস্ফুট স্বরে অনুচরগণকে বলিল, “উহাদের পোষাক খুলিয়া লইয়া শীঘ্র পরিধান কর; কোট, কোমরবন্ধ ও টুপি লইলেই চলিবে, প্যাণ্টগুলা না বদলাইলে ও ক্ষতি নাই। বন্দুকগুলা ও সঙ্গে লইতে ভুলিও না।”

 রাইমার স্বয়ং লেফটেনাণ্টের পোষাক খুলিয়া লইয়া পরিধান করিল। সকলের পরিচ্ছদ-পরিবর্ত্তন শেষ হইলে, তাহারা প্রাসাদের সিংহদ্বারে উপস্থিত হইল; আমেলিয়া ও তাঁহার মাতুল সকলের পশ্চাতে রহিলেন।

 দেউড়ীতে দুইজন সশস্ত্র প্রহরী পাহারায় নিযুক্ত ছিল; তাহারা দেউড়ীর দুই পাশে দাঁড়াইয়া ঝিমাইতেছিল, বোম্বেটেদের চিনিতে পারিল না, প্রাসাদের রক্ষী-সৈন্য বলিয়া ভ্রম করিল। কিন্তু তাহারা কর্ত্তব্য ভুলিল না, আগন্তুক দস্যুদলকে সাঙ্কেতিক শব্দ জিজ্ঞাসা—করিল।

 বোম্বেটেরা তাহাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়া মুহূর্ত্ত মধ্যে তাহাদিগকেও আক্রমণপূর্ব্বক বাঁধিয়া ফেলিল। প্রথমেই মুখ বন্ধ হওয়ায তাহারা চীৎকার করিবার সুযোগ পাইল না। ঠিক সেই মুহূর্ত্তে প্রাসাদের ঘড়িতে ঠং ঠং শব্দে বারোটা বাজিয়া গেল। রাইমার তাহার অনুচরবর্গকে লইয়া সোপানশ্রেণী অতিক্রম পৃর্ব্বক প্রাসাদ উঠিতে লাগিল।

 রাইমার সদলবলে নির্দিষ্ট কক্ষের অভিমুখে চলিতে লাগিল। যে কক্ষে স্বর্ণমুদ্রাগুলি সংরক্ষিত ছিল,—তাহার দ্বার বন্ধ করিয়া দশজন প্রহরী পাহারায় নিযুক্ত ছিল। তাহাদের পদশব্দে রাইমার বুঝিল—তাহারা জাগিয়া আছে।

 রাইমার তাহার তরবারির মুষ্টি দ্বারা রুদ্ধ দ্বারে আঘাত করিল। একজন প্রহরী ভিতর হইতে দ্বার খুলিয়া দিল;রাইমার কক্ষ মধ্যে বৃষ্টিপাত করিল, দেখিল দীপরশ্মি অত্যন্ত মৃদু। হর্ষে তাহার চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

 রক্ষী-সৈন্য, দলের অধিনায়ক কাপ্তেন আলামেডা তৎক্ষণাৎ দ্বারপ্রান্তে অগ্রসর হইলেন; তিনি রাইমারকে সম্মুখে দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলেন। সেই মৃদু আলোকেই তিনি দেখিতে পাইলেন, তাহার স্থান গ্রহণ করিবার জন্য যে কর্ম্মচারীর আসিবার কথা ছিল, তাঁহার পরিবর্তে আর একজন লোক আসিয়াছে; অথচ সে তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত!

 কাপ্তেন আলামেডার বিস্ময় দূর হইবার পূর্ব্বেই রাইমার অনুচরবর্গের সহিত কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। কাপ্তেন আলামেডা রাইমারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “লেফ্‌টেনাণ্ট সাণ্ড্রা। আসিলেন না কেন?—কথা ছিল তিনি-"

 কাপ্তেন আলামেডা, কি কথা ছিল, তাহা আর বলিবার অবসর পাইলেন না। রাইমার এক লম্ফে তাঁহার উপর নিপর্তিত হইয়া তাঁহার মুখ বাঁধিয়া ফেলিল। সঙ্গে সঙ্গে অন্য বোম্বেটেরা অবশিষ্ট প্রহরীদের আক্রমণ পূর্ব্বক একই সময়ে সকলের মুখচাপা দিল। কেহই বাঙ্‌ নিষ্পত্তি করিতে পারিল না। তাহাদের মনে হইল, তাহারা কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল; নিদ্রিত অবস্থায় একটা উৎকট দুঃস্বপ্ন দেখিতেছে মাত্র, ইহা সত্য নহে।—তাহারা ঘুমাইতেছে কি পরীক্ষা করিবার জন্য চোখে হাত দিতে গেল, কিন্তু হাত উঠিল। না, দুই হাত একত্র পিঠের দিকে বাঁধা!

 বোম্বেটেরা ঠিক একই সময়ে সকল প্রহরীর হাত পা মুখ বাঁধিয়া ফেলিল, এক প্রাণীকেও চীৎকার করিতে দিল না,—কথাটা প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হয় বটে, কিন্তু বোম্বেটেরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিল, ধরা পড়িলে তাহাদের কি দুর্দ্দশা হইবে, তাহাও তাহারা জানিত; তাহাদের চেষ্টার কোনও ক্রটী ছিল না। অন্য দিকে, ধনরক্ষকেরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল, তাহার উপর তাহাদের একটু ঢুলুনী আসিয়াছিল; তাহারা স্বপ্নেও ভাবে নাই, হঠাৎ এমন বিষম বিভ্রাট উপস্থিত হইবে। যদিও বা কেহ চীৎকার করিবার অবসর পাইয়া। থাকে, সে চীৎকারে সাহস করে নাই; কারণ সেনাপতির আদেশ ছিল, রাত্রে কোনও প্রহরী কোনও কারণে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলিয়া প্রেসিডেণ্ট বাহাদুরের নিদ্রার ব্যাঘাত না করে।

 কাপ্তেন আলামেডা রাইমার কর্তৃক হঠাৎ আক্রান্ত হইয়া মেঝের উপর নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহার মস্তক সবেগে প্রাচীর-গাত্রে নিপতিত হইয়াছিল; সেই আঘাতে তিনি মূর্চ্ছিত হন।

 সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তিনি দ্বারপ্রান্তে নিপতিত ছিলেন। রাইমার তাঁহাকে সরাইয়া তাঁহার হাত পা দৃঢ়রূপে রজ্জুবদ্ধ করিল।

 আমেলিয়া সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়া রাইমারকে বলিলেন, “আজ তুমি কাজে খুব দক্ষতা দেখাইয়াছ। তোমার উপর বড় সন্তুষ্ট হইয়াছি।—কিন্তু আর বিলম্ব করিয়া কাজ নাই, আগে পিয়ারসনকে বন্দী কর।”

 পিয়ারসন তখন তাঁহার সুকোমল শুভ্র শয্যায়—গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত; কানের কাছে ঢাক কাজাইলেও বোধ হয় সে নিদ্রা ভাঙ্গে না!—রাইমার তিনজন বোম্বেটেকে সঙ্গে লইয়া পিয়ারসনের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিল।

 এক প্রান্তে একখানি টেবিলের উপর মিট্‌মিট্‌ করিয়া একটা বাতি জ্বলিতেছিল, তাহার অস্ফুট আলোকে রাইমার প্রেসিডেণ্টকে অদূরবর্ত্তী খট্টায় নিদ্রিত দেখিল।

 পিয়ারসন হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গে দেখিতে পাইলেন, চারি জন লোক তাঁহার মুখ ও হাত পা বাঁধিয়া ফেলিয়াছে!

 পিয়ারসনের উঠিবার শক্তি রহিল না; চক্ষু খোলা ছিল, তিনি বিস্ফারিত নেত্রে আততায়ীগণের কাজ দেখিতে লাগিলেন।

 বোম্বেটেরা তাঁহাকে কাঁধে তুলিয়া লইল; তাঁহার পরিত্যক্ত পরিচ্ছদটাও সঙ্গে লইতে ভুলিল না।

 বোম্বেটেদের কাঁধে উঠিয়া পিয়ারসন একবার লম্ফঝম্ফের চেষ্টা করিলেন, কিন্তু একজন বোম্বেটে তাঁহার হাতে ‘জিযুৎসু’র এমন এক ‘প্যাঁচ’ কসিল যে, তাঁহার কণ্ঠনালি হইতে একটি অস্ফুট আর্ত্তনাদ। উথিত হইল; লম্ফঝম্পে আর তাঁহার প্রবৃত্তি রহিল না।

 প্রাসাদের বাহিরে আসিয়া তিনজন বোম্বেটে পিয়ারসনকে কাঁধে ঝুলাইয়া লইয়া চলিল; রাইমার কার্য্যন্তরে প্রস্থান করিল।

 স্বর্ণমুদ্রাপূর্ণ বাক্সগুলি প্রাসাদের বাহিরে লইয়া যাইতে না যাইতে মোটর গাড়ী দুইখানি প্রাসাদ-প্রাঙ্গনে উপস্থিত হইল; বোম্বেটেরা বাক্স গুলি বহিয়া গাড়ীতে তুলিল। বোম্বেটেরা সর্বশেষে প্রেসিডেণ্ট পিয়ারসনকে একখানি মোটরে তুলিয়া নিঃশব্দে প্রাসাদ পরিত্যাগ করিল। প্রাসাদের অন্য কোনও লোক জানিতেও পারিল না যে, দশ মিনিটের মধ্যে এমন একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটিয়া গেল।

 বোম্বটেরা সকলেই মোটরে উঠিল; মোটর গাড়ী দুইখানি দ্রুতবেগে সমুদ্রতটের দিকে ধাবিত হইল। আমেলিয়ার জাহাজ পনের মাইল দূরে ‘স্ট্রীম’ করিয়া নঙ্গর তুলিয়া সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রস্তুত ছিল।

 রূপসী বোম্বেটের ডাকাতির বন্দোবস্ত এইরূপ কৌশলপূর্ণ!