লঘুগুরু প্রবন্ধাবলী/বাংলা পরিভাষা



বাংলা পরিভাষা

 অভিধানে ‘পরিভাষা’র অর্থ-সংক্ষেপার্থ শব্দ। অর্থাৎ যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্যক্ত করা যায় তা পরিভাষা। যে শব্দের অনেক অর্থ, সে শব্দও যদি প্রসঙ্গবিশেষে নির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয় তবে তা পরিভাষাস্থানীয়। সাধারণত ‘পরিভাষা' বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলী বােঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শনবিজ্ঞানাদির আলােচনায় প্রয়ােগ করলে অর্থবােধে সংশয় ঘটে না।

 সাধারণ লােকে কথাবার্তায় চিঠিপত্রে অসংখ্য শব্দ নির্দিষ্ট অর্থে প্রয়ােগ করে, কিন্তু বিদ্যালােচনার জন্য করে না, সেজন্য আমাদের খেয়াল হয় না যে সেসকল শব্দ পারিভাষিক। ‘স্বামী, স্ত্রী, গাই, ষাঁড়, বন্ধক, তামাদি, লােহা, তামা, চৌকো, গােল’ প্রভৃতি শব্দের পারিভাষিক খ্যাতি নেই, কারণ এসকল শব্দ অতিপরিচিত। বিলাতে একটা নূতন ধাতু আবিষ্কৃত হ'ল, আবিষ্কর্তা তার পারিভাষিক নাম দিলেন ‘অ্যালুমিনিয়ম’। বহুদিন এই নাম কেবল পণ্ডিতমণ্ডলীর গবেষণায় আবদ্ধ রইল। এখন অ্যালুমিনিয়মের ছড়াছড়ি, কিন্তু নামের পারিভাষিক খ্যাতি অক্ষুণ্ণ আছে। ‘প্লাটিনম অ্যালুমিনিয়ম ক্রোমিয়ম’ প্রভৃতি নাম বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের সৃষ্ট, সেজন্য পরিভাষা রূপে খ্যাত। ‘লােহা তামা সােনা’ প্রভৃতি নাম পণ্ডিতাগমের পূর্ববর্তী তাই অখ্যাত। পণ্ডিতগণ যদি বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে ‘প্লাটিনম অ্যালুমিনিয়ম’ প্রভৃতি নামজাদা শব্দের পাশে স্থান দেন, তবে ‘লােহা তামা সােনা’ও পরিভাষা রূপে খ্যাত হবে। যে শব্দ সাধারণে আলগা ভাবে প্রয়ােগ করে তাও পণ্ডিতগণের নির্দেশে পরিভাষা রূপে গণ্য হতে পারে। সাধারণ প্রয়ােগে রুই পুঁটি চিংড়ি তিমি সবই ‘মৎস্য’। কিন্তু পণ্ডিতরা যদি যুক্তি ক'রে স্থির করেন যে ‘মৎস্য’ বললে কেবল বােঝাবে-কান্‌কো-যুক্ত হাত-পা-বিহীন মেরুদণ্ডী অণ্ডজ (এবং আরও কয়েকটি লক্ষণ যুক্ত) প্রাণী, তবে ‘মৎস্য’ নাম পারিভাষিক হবে এবং চিংড়ি তিমিকে বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে মৎস্য বলা চলবে না।

 বিদ্যাচর্চায় যত পরিভাষা আবশ্যক, সাধারণ কাজে তত নয়। কিন্তু জনসাধারণেও নূতন নূতন বিষয়ের পরিচয় লাভ করছে সেজন্য বহু নূতন পারিভাষিক শব্দ অবিদ্বানেও শিখছে। যে জিনিস সাধারণের কাজে লাগে তার নাম লােকের মুখে মুখেই প্রচারিত হয় এবং সে নাম একবার শিখলে লােকে সহজে ছাড়তে চায় না। পণ্ডিতরা যদি নূতন নাম চালাবার চেষ্টা করেন তবে সাধারণের তরফ থেকে বাধা আসতে পারে। বাংলা পরিভাষা সংকলনকালে এই বাধার কথা মনে রাখা দরকার।

 আমাদের দেশে এখনও উচ্চশিক্ষার বাহন ইংরেজী ভাষা। নিম্নশিক্ষায় মাতৃভাষা চালাবার চেষ্টা হচ্ছে। শিক্ষা উচ্চই হােক আর নিম্নই হােক, মাতৃভাষাই যে শ্রেষ্ঠ বাহন তা সকলে ক্রমশ বুঝতে পারছেন। মাতৃভাষায় প্রয়ােগের উপযুক্ত পরিভাষা যতদিন প্রতিষ্ঠালাভ না করবে ততদিন বাহন পঙ্গু থাকবে। অতএব বাংলা পরিভাষার প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক। বাংলা দেশ যদি স্বাধীন হ'ত, রাজভাষা যদি বাংলা হ'ত, বহু নব নব দ্রব্য ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যদি এদেশে আবিষ্কৃত হ'ত, তবে আমাদের পরিভাষা দেশীয় ভাষার বশে স্বচ্ছন্দে গড়ে উঠত এবং বিদ্বান অবিদ্বান নির্বিশেষে সকলেই তা মেনে নিত, যেমন ইংলণ্ডে হয়েছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা সেরূপ নয়। এদেশে যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়া হয় তা অতি অল্প, যা হয় তার সংবাদ ইংরেজীতেই প্রকাশিত হয়। সুতরাং বাংলা ভাষার জন্য পরিভাষা সংকলিত হ'লেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজী শব্দ। দেশের পণ্ডিতমণ্ডলী একমত হয়ে একটা বাংলা পরিভাষার ফর্দ মেনে নিতে পারেন, এমন প্রতিজ্ঞাও করতে পারেন যে তাঁদের পুস্তকে প্রবন্ধে ভাষণে বিলাতী শব্দ বর্জন করবেন (অবশ্য চাকরির কাজে তা পারবেন না)। কিন্তু পরিভাষাদ্বারা সূচিত দ্রব্য যদি বিদেশ থেকে আসে এবং সাধারণের ব্যবহারে লাগে, তবে নূতন নাম চালানাে কঠিন হবে। বিদেশ থেকে আয়ােডিন আসে, প্রেরকের চালানে ঐ নাম লেখা থাকে; দোকানদার ঐ নামেই বেচে—তাকে ‘এতিন’ বা ‘নীলিন’ শেখানাে অসম্ভব। তার মারফৎ জনসাধারণেও ইংরেজী নাম শেখে। যাঁরা মাতৃভাষায় বিদ্যাবিতরণে অগ্রকর্মী হবেন, তাঁদের পক্ষেও দেশী নামে নিষ্ঠা বজায় রাখা শক্ত হবে। তাঁরা বিদ্যা অর্জন করবেন ইংরেজী পরিভাষার সাহায্যে আর প্রচার করবেন বাংলা পরিভাষায়—এই দ্বৈভাষিক অবস্থা সহজ নয়। তাঁদের নানা ক্ষেত্রে স্খলন হবে। যাদের শিক্ষার জন্য দেশী পরিভাষার সৃষ্টি, তারা যদি ইংরেজী নাম ছাড়তে না চায় তবে শিক্ষকও বিদ্রোহী হবেন। বাংলা ভাষায় প্রয়ােগযােগ্য পরিভাষা আমাদের অবশ্য চাই, কিন্তু সংকলনকালে ভুললে চলবে না যে ব্যবহারক্ষেত্রে ইংরেজীর প্রবল প্রতিযােগিতা আছে।

 সাধারণে ‘আয়ােডিন, অক্সিজেন, মােটর, কার্বুরেটর, কলেরা, ভ্যাকসিন’ প্রভৃতি শব্দে অভ্যস্ত হয়েছে, এগুলির বাংলা নাম চলবার সম্ভাবনা দেখি না। কিন্তু কয়েকটি নবরচিত বাংলা শব্দের চলন সহজেই হয়েছে, যথা—‘উড়ােজাহাজ, বেতারবার্তা, আবহসংবাদ’। কতকগুলি বিকট শব্দও চলছে, যেমন ‘আইন-অমান্য-আন্দোলন’। রবীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ সত্ত্বেও ‘বাধ্যতামূলক’ প্রবলপ্রতাপে চলছে। এই প্রচলন খবরের কাগজের দ্বারা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষার প্রচারে এ সাহায্য মিলবে না। বিভিন্ন লেখকের পুস্তকে প্রবন্ধে যদি একই রকম পরিভাষা গৃহীত হয়, তবে প্রচার অনেকটা সহজ হবে।

 এদেশে বহু বৎসর থেকে পরিভাষা সংকলনের চেষ্টা হয়ে আসছে। বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের দপ্তরে অনেক পরিভাষা সংগৃহীত হয়েছে, ‘প্রকৃতি’ পত্রিকায় প্রায় প্রতি সংখ্যায় পরিভাষা প্রকাশিত হচ্ছে। তা ছাড়া অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি নিজের প্রয়ােজনে পরিভাষা রচনা করেছেন। এইসকল পরিভাষার প্রায় সমস্তই প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রে প্রচলিত শব্দ, অথবা সংকলয়িতার স্বরচিত সংস্কৃত শব্দ। এপর্যন্ত আয়ােজন যা হয়েছে তা নিতান্ত কম নয়, কিন্তু ভােক্তা বিরল। তার একটি কারণ—একই ইংরেজী শব্দের নানা প্রতিশব্দ হয়েছে কিন্তু কোন্‌টি গ্রহণযােগ্য তার নির্বাচন হয় নি। সংকলয়িতা নিজের রচনায় তাঁর পছন্দমত শব্দ প্রয়ােগ করেন বটে, কিন্তু সাধারণ লেখক দিশাহারা হয়। আর এক কারণ-সংগ্রহ বৃহৎ হলেও অসম্পূর্ণ। সর্বাপেক্ষা প্রবল কারণ—ইংরেজী পরিভাষার বিপুল প্রতিষ্ঠা।

 আজকাল বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ যে ভঙ্গীতে লেখা হয় তা লক্ষ্য করলে আমাদের বাধা কোথায় আর সিদ্ধি কোন্ পথে তার একটু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিভিন্ন লেখকের রচনা থেকে কয়েকটি নমুনা দিচ্ছি—

 (গ্রামােফোন-রেকর্ড)। ‘Masterটি পরিষ্কার করিয়া ইহার উপর Bronze Powder ছড়ান হয়। Powder যাহাতে ইহার প্রত্যেক grooveএর ভিতর উত্তমরূপে প্রবেশ করে তাহা দেখিতে হইবে। পরে Electroplate করিয়া ইহার উপর Copper deposit করা হয়। এই deposit পরিমাপ অনুযায়ী পুরু হইলে ইহাকে master হইতে পৃথক করা হয়। Masterএর music lines তখন এই Copyর উপর উঠিয়া আসে। এই Copyকে Original বলা হয়।’

 লেখক পরিশেষে বলেছেন—‘টেক্‌নিক্যাল ডিটেইলস্‌এর মধ্যে যাই নাই’। যান নি তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। ইনি ভাষার দৈন্যের প্রতি দৃক্‌পাত করেন নি, যেমন-তেমন উপায়ে নিজের বক্তব্য প্রকাশের চেষ্টা করেছেন। আর একটি নমুনা দিচ্ছি। প্রবন্ধ আমার কাছে নেই, কিন্তু নামটি কণ্ঠস্থ আছে, তা থেকেই রচনার পরিচয় হবে―

 ‘নেত্রজনের উপস্থিতিতে অসিতীলিনের উপর কুলহরিণের ক্রিয়া।’

 এই লেখক তাঁর বক্তব্য বােধগম্য করবার জন্য মােটেই ব্যস্ত নন, বিভীষিকা দেখানােও তাঁর উদ্দেশ্য নয়। ইনি নবলব্ধ পরিভাষা নিয়ে কিঞ্চিৎ কসরৎ করেছেন মাত্র। একজন প্রথিতনামা মনীষীর রচনা থেকে উদাহরণ দিচ্ছি—

 ‘মণিসমূহের নিয়ত সংস্থান অসংখ্যপ্রকার। কিন্তু তৎসমুদায়কে ছয়টি মূল সংস্থানে বিভক্ত করিতে পারা যায়। এই ছয় মূল সংস্থানের প্রত্যেকে দ্বিবিধ,স্তম্ভাকার (prismatic) এবং শিখরাকার (pyramidal)। এইসকল সংস্থান বুঝিবার নিমিত্ত মণির মধ্যে কয়েকটি অক্ষরেখা কল্পিত হইয়া থাকে। কোন নিয়তাকার মণির দুই বিপরীত স্থানকে মনে মনে কোন রেখা দ্বারা যােগ করিলে তাহার অক্ষরেখা পাওয়া যায়। যথা, দুই বিপরীত কোণ, কিংবা দুই বিপরীত পার্শ্বের মধ্যস্থল, কিংবা দুই বিপরীত ধারের মধ্যস্থল।’

 লেখকের বক্তব্য অনধিকারীর পক্ষে কিঞ্চিৎ দুরূহ হ'তে পারে, কিন্তু তাঁর পদ্ধতি যে বাংলা ভাষার প্রকৃতির অনুকূল তাতে সন্দেহ নেই। একজন লােকপ্রিয় অধ্যাপকের রচনার নমুনা―

 ‘রুমকর্ফ কয়েল ছাড়া আরও অনেক প্রক্রিয়া দ্বারা পদার্থ হইতে ইলেক্ট্রন বাহির করা যায়। রঞ্জনরশ্মি কোন পদার্থের উপর ফেলিলে, বা সেই পদার্থ রেডিয়মের ন্যায় কোন ধাতুর নিকট রাখিলে সেই পদার্থ হইতে ইলেক্ট্রন নির্গত হয়...বেশী কিছু নয়, কোন পদার্থ একটু বেশী উত্তপ্ত হইলে উহা হইতে ইলেক্ট্রন নির্গত হইতে থাকে।’

 এই লেখক ইংরেজী শব্দ নির্ভয়ে আত্মসাৎ করেছেন, তথাপি মাতৃভাষার জাতিনাশ করেন নি। বাংলা ভাষার উপযুক্ত পরিভাষা সংকলন একটি বিরাট কাজ, তার জন্য অনেক লােকের চেষ্টা আবশ্যক। কিন্তু এই চেষ্টা সংঘবদ্ধ ভাবে একই নিয়ম অনুসারে করা উচিত, নতুবা পরিভাষার সামঞ্জস্য থাকবে না। প্রথম কর্তব্য—সমস্ত বিষয়টিকে ব্যাপক দৃষ্টিতে নানা দিক থেকে দেখা, তাতে বিভিন্ন বিভাগের প্রয়ােজন সম্বন্ধে কতকটা আন্দাজ পাওয়া যাবে, উপায় স্থির করাও হয়তো সহজ হবে। এই প্রবন্ধে কেবল সেই দিগ্‌দর্শনের চেষ্টা করব।
 সকল বিদ্যার পরিভাষাকেই মােটামুটি এই কটি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে―

 বিশেষ (individual)। যথা—সূর্য, বুধ, হিমালয়।

 দ্রব্য (বস্তু, substance; অথবা সামগ্রী, article)। যথা—কাষ্ঠ, লৌহ, জল; দীপ, চক্র, অরণ্য।

 বর্গ (class)। যথা-ধাতু, নক্ষত্র, জীব, স্তন্যপায়ী।

 ভাব (abstract idea)। যথা—গতি, সংখ্যা, নীলত্ব, স্মৃতি।

 বিশেষণ (adjective)। যথা—তরল, মিষ্ট, আকৃষ্ট।

 ক্রিয়া (verb)। যথা—চলা, ঠেলা, ওড়া, ভাসা।

 বলা বাহুল্য, এই শ্রেণীবিভাগ সর্বত্র স্পষ্ট নয়। কতকগুলি শব্দ প্রয়ােগ অনুসারে দ্রব্য বর্গ বা বিশেষণ বাচক হতে পারে। কতকগুলি শব্দ দ্রব্যবাচক কি ভাববাচক তা স্থির করা কঠিন, যেমন—দেশ, কাল, আলােক, কেন্দ্র।

 দেখা যায় যে এক এক শ্রেণীর শব্দ কোনও বিদ্যায় বেশী দরকার কোনও বিদ্যায় কম দরকার। জ্যোতিষে ও ভূগােলে বিশেষবাচক শব্দ অনেক চাই, কিন্তু অন্যান্য বিদ্যায় খুব কম, অথবা অনাবশ্যক। দ্রব্যবাচক শব্দ রসায়নে অত্যন্ত বেশী, জীববিদ্যায় (botany zoology anatomy ইত্যাদিতে) কিছু কম, মণিকবিদ্যায় (mineralogy) আর একটু কম, পদার্থবিদ্যা (physics) ও ভূবিদ্যায় (geology) আরও কম, দর্শন ও মনােবিদ্যায় প্রায় নেই, গণিতে মােটেই নেই। বর্গবাচক শব্দ জীববিদ্যায় খুব বেশী, রসায়ন ও মণিকবিদ্যায় অপেক্ষাকৃত কম, অন্যান্য বিদ্যায় আরও কম। ভাব বিশেষণ ও ক্রিয়া বাচক শব্দ সকল বিদ্যাতেই প্রায় সমান। সকল বিদ্যার পরিভাষা যদি একযােগে বিচার করা যায় তবে দেখা যাবে যে মােটের উপর দ্রব্যবাচক শব্দ সবচেয়ে বেশী, তার পর যথাক্রমে বর্গবাচক, ভাব-বিশেষণ-ক্রিয়া-বাচক এবং বিশেষবাচক শব্দ।

 ইংরেজী পরিভাষার ফর্দ সম্মুখে রেখেই সংকলয়িতাকে কাজ করতে হবে, অতএব ইংরেজী পরিভাষার স্বরূপ বিচার করা কর্তব্য, তাতে উপায়ের সন্ধান মিলতে পারে। ইংরেজী পরিভাষা জাতি (origin) অনুসারে এইরূপে ভাগ করা যেতে পারে―

 a. সাধারণ ইংরেজী শব্দ। যথা—iron, solid।

 b. প্রচলিত অন্য ভাষার শব্দ। যথা—lesion, canyon, breccia, typhoon, totem।

 c. গ্রীক লাটিন (আরবী সংস্কৃত বিরল) প্রভৃতি প্রাচীন ভাষার শব্দ বা তার যৌগিক রূপ অথবা অপভ্রংশ। যথা—atom, spectrum, alcohol, ferrous, vertebrate।

 d. কৃত্রিম পদ্ধতিতে রূপান্তরিত গ্রীক লাটিন বা অন্য শব্দ। যথা—glycerine, methanol, aniline, farad। ইংরেজী বৈজ্ঞানিক গ্রন্থাদিতে দেখা যায়―যেখানে ভুল বোঝবার সম্ভাবনা নেই সেখানে c d-র সঙ্গে সঙ্গে a b অবাধে চলে। কিন্তু যেখানে স্পষ্টতর নির্দেশ বা সংকেত আবশ্যক, সেখানে a শব্দ প্রায় চলে না, তৎস্থানে c d হয় এবং b কিছু কিছু চলে। যথা—iron implements, iron salts, spirit of wine, knee-cap, shedding of leaves; অথচ ferrous (বা ferric) sulphate, alcohol metabolism, patellar fracture, deciduous leaves।

 বাংলা ভাষার জন্য পরিভাষা সংকলনকালে নিম্নলিখিত উপাদানের যােগ্যতা বিচার করা যেতে পারে―

 ক। সাধারণ বাংলা শব্দ।

 খ। হিন্দী-উর্দু ফারসী আরবী শব্দ।

 গ। ইংরেজী পারিভাষিক শব্দ (পূর্ববর্ণিত a b c d)।

 ঘ। প্রাচীন বা নবরচিত সংস্কৃত শব্দ।

 ৬। মিশ্র শব্দ, অর্থাৎ কৃত্রিম পদ্ধতিতে রূপান্তরিত বা যােজিত বিভিন্নজাতীয় শব্দ।

 পরিভাষা যদিও মুখ্যত বাঙালীর জন্য সংকলিত হবে, তথাপি অধিকাংশ শব্দ যাতে ভারতের অন্য প্রদেশবাসীর (বিশেষত হিন্দী উড়িয়া মারাঠী গুজরাটী প্রভৃতি ভাষীর) গ্রহণযােগ্য বা সহজবােধ্য হয় সে চেষ্টা করা উচিত। তাতে বিভিন্ন প্রদেশের ভাববিনিময়ের সুবিধা হবে। পূর্বোক্ত c d শব্দাবলী সকল ইউরােপীয় ভাষায় চলে। ভারতের পক্ষে গ ঘ এর সেইরূপ উপযােগিতা আছে।

 আধুনিক ইউরােপীয় ভাষাসমূহের সঙ্গে গ্রীক লাটিনের যে সম্বন্ধ, তার চেয়ে বাংলা হিন্দী প্রভৃতির সঙ্গে সংস্কৃতের সম্বন্ধ অনেক বেশী। সেজন্য এদেশে সংস্কৃত পরিভাষা (ঘ) সহজেই মর্যাদা পাবে। ইংরেজী পরিভাষার (গ) উপযােগিতাও কম নয়, তার কারণ পরে বলছি। এই দুই জাতীয় পরিভাষার পরেই সাধারণ বাংলা শব্দের (ক) স্থান। এরকম শব্দ সাধারণ বিবৃতিতে অবাধে চলবে, যেমন ইংরেজীতে a চলে। তার পরে খ-এর, বিশেষত হিন্দী-উর্দু শব্দের স্থান; কারণ, হিন্দী-উর্দু সুসমৃদ্ধ ভাষা, বাংলার প্রতিবেশী, এবং ভারতের বহু অঞ্চলে বােধ্য। বাংলায় ফারসী আরবী শব্দ অনেক আছে। যদি উপযুক্ত শব্দ পাওয়া যায় তবে আরও কিছু ফারসী আরবী আত্মসাৎ করলে হানি নেই। পরিশেষে মিশ্র শব্দের (ঙ) স্থান। এরূপ শব্দ কিছু কিছু দরকার হবে। যদি ‘focus’ বাংলায় নেওয়া হয়, তবে focussed =ফোকসিত, long-focus =দীর্ঘফোকস।

 বাংলা পরিভাষা সংকলনের সময় ইংরেজী শব্দের প্রতিযােগিতা মনে রাখতে হবে। বিদ্যালয়ের ছাত্র বাধ্য হয়ে বাংলা পাঠ্যপুস্তক থেকে দেশী পরিভাষা শিখবে। যিনি বিদ্যালয়ের শাসনে নেই অথচ বিদ্যাচর্চা করতে চান, তাঁর যদি মাতৃভাষায় অনুরাগ থাকে তবে তিনি কিছু কষ্ট স্বীকার ক'রেও দেশী পরিভাষা আয়ত্ত করবেন। কিন্তু জনসাধারণকে বশে আনা সহজ নয়। বিদ্যা মাত্রের যে অঙ্গ তত্ত্বীয় (theoretical), তার সঙ্গে সাধারণের বিশেষ যােগ নেই। বিদ্যার যে অঙ্গ ব্যাবহারিক (applied), সাধারণে তার অল্পাধিক খবর রাখে। তত্ত্বীয় অঙ্গে দেশী পরিভাষার প্রচলন অপেক্ষাকৃত সহজ, কারণ জনসাধারণের রুচির বশে চলতে হয় না। কিন্তু ব্যাবহারিক অঙ্গের সহিত বিদেশী দ্রব্য ও বিদেশী শব্দের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। সাধারণ লােকে পথে হাটে বাজারে কর্মস্থানে যে বিদেশী শব্দ শিখবে তাই চালাবে, এর উদাহরণ পূর্বে দিয়েছি। এই বাধা লঙ্ঘন করা চলবে না, ব্যাবহারিক অঙ্গে বহু পরিমাণে বিদেশী শব্দ মেনে নিতে হবে।

 মাতৃভাষার বিশুদ্ধিরক্ষাই যদি প্রধান লক্ষ্য হয় তবে পরিভাষাসংকলন পণ্ড হবে। পরিভাষার একমাত্র উদ্দেশ্য― বিভিন্ন বিদ্যার চর্চা এবং শিক্ষার বিস্তারের জন্য ভাষার প্রকাশশক্তি বর্ধন। পরিভাষা যাতে অল্পায়াসে অধিগম্য হয় তাও দেখতে হবে। এনিমিত্ত রাশি রাশি বৈদেশিক শব্দ আত্মসাৎ করলেও মাতৃভাষার গৌরবহানি হবে না। বহু বৎসর পূর্বে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মহাশয় লিখেছেন―

 ‘মহৈশ্বর্যশালিনী আর্যা সংস্কৃত ভাষাও যে অনার্যদেশজ শব্দ অজস্রভাবে গ্রহণ করিয়া আত্মপুষ্টি সাধনে পরাঙ্মুখ হন নাই, তাহা সংস্কৃত ভাষার অভিধান অনুসন্ধান করিলেই বুঝিতে পারা যায়। প্রাচীনকালে জ্ঞান বিজ্ঞান বিষয়ে যেসকল বৈদেশিকের সহিত প্রাচীন হিন্দুর আদান প্রদান চলিয়াছিল, তাহাদের নিকট হইতেও সংস্কৃত ভাষা ঋণস্বীকারে কাতর হয় নাই।•••আমাদের পক্ষে সেইরূপ ঋণগ্রহণে লজ্জা দেখাইলে কেবল অহম্মুখতাই প্রকাশ পাইবে।’ (সাহিত্যপরিষৎপত্রিকা, সন ১৩০১)

 বাংলা ভাষার জননী সংস্কৃত হতে পারেন, কিন্তু গ্রীক ফারসী আরবী পাের্তুগিজ ইংরেজীও আমাদের ভাষাকে স্তন্যদানে পুষ্ট করেছে। যদি প্রয়ােজনসিদ্ধির জন্য সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ আমরা গ্রহণ করি, তবে মাতৃভাষার পরিপুষ্টি হবে, বিকার হবে না। অপ্রয়ােজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়ােজনে হয় না। যদি বলি―‘ওয়াইফের টেম্পারটা বড়ই ফ্রেটফুল হয়েছে’, তবে ভাষাজননী ব্যাকুল হবেন। যদি বলি—‘মােটরের ম্যাগ্‌নেটোটা বেশ ফিনকি দিচ্ছে’, তবে আমাদের আহরণের শক্তি দেখে ভাষাজননী নিশ্চিন্ত হবেন।

 ইউরােপ আমেরিকায় যে International Scientific Nomenclature সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে তার দ্বারা জগতের পণ্ডিতমণ্ডলী অনায়াসে জ্ঞানের আদানপ্রদান করতে পারছেন। এই পরিভাষা একবারে বর্জন করলে আমাদের ‘অহম্মুখতা’ই প্রকাশ পাবে। সমস্ত না হােক, অনেকটা আমরা নিতে পারি। যে বৈদেশিক শব্দ নেওয়া হবে, তার বাংলা বানান মূলানুযায়ী করাই উচিত। বিকৃত ক'রে মােলায়েম করা অনাবশ্যক ও প্রমাদজনক। এককালে এদেশে ইতর ভদ্র সকলেই ইংরেজীতে সমান পণ্ডিত ছিলেন, তখন general থেকে ‘জাঁদরেল’, hospital থেকে ‘হাসপাতাল’ হয়েছে। কিন্তু এখন আর সে যুগ নেই, বহুকাল ইংরেজী প'ড়ে আমাদের জিবের জড়তা অনেকটা ঘুচেছে। সংস্কৃত শব্দেও কটমটির অভাব নেই। কেউ যদি ভুল উচ্চারণ করে ‘যাচ্‌ঞা’কে ‘যাচিঙ্গা’, ‘জনৈক’কে ‘জৈনিক’, ‘মােটর’কে ‘মটোর’, ‘গ্লিসারিন’কে ‘গিলছেরিন’ বলে, তাতে ক্ষতি হবে না—যদি বানান ঠিক থাকে।

 এখন সংকলনের উপায়চিন্তা করা যেতে পারে। আমাদের উপকরণ—এক দিকে দেশী শব্দ, অর্থাৎ বাংলা সংস্কৃত হিন্দী ইত্যাদি; অন্য দিকে ইংরেজী শব্দ। কোথায় কোন্ শব্দ গ্রহণযােগ্য? ধরাবাঁধা বিধান দেওয়া অসম্ভব। মােটামুটি পথনির্ণয়ের চেষ্টা করব।

 ১। আমাদের দেশে বহুকাল থেকে কতকগুলি বিদ্যার চর্চা আছে, যথা-দর্শন, মনােবিদ্যা, ব্যাকরণ, গণিত, জ্যোতিষ, ভূগােল, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি। এইসকল বিদ্যার বহু পরিভাষা এখনও প্রচলিত আছে। শাস্ত্র অনুসন্ধান করলে আরও পাওয়া যাবে এবং সেই উদ্ধারকার্য অনেকে করেছেন। এই সমস্ত শব্দ আমাদের সহজেই গ্রহণীয়। এই শব্দসম্ভারের সঙ্গে আরও অনেক নবরচিত সংস্কৃত শব্দ অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। গণিতে যােগ বিয়ােগ গুণ ভাগ বর্গ ঘাত (power) প্রভৃতি প্রাচীন শব্দের সঙ্গে নবরচিত কলন (calculus), অবঘাতন (evolution), উদ্‌ঘাতন (involution) সহজেই চলবে। বর্তমান কালে এইসকল বিদ্যার বৃদ্ধির ফলে বহু নূতন পরিভাষা ইউরােপে সৃষ্টি হয়েছে। তার অনেকগুলির দেশী প্রতিশব্দ রচনা করা যেতে পারে। কিন্তু যে ইংরেজী পারিভাষিক শব্দ অত্যন্ত রূঢ় (যেমন focus, thyroid) তা যথাবৎ বাংলা বানানে নেওয়াই উচিত।

 ২। কতকগুলি বিদ্যা আধুনিক, অর্থাৎ পূর্বে এদেশে অল্পাধিক চর্চিত হলেও এখন একবারে নূতন রূপ পেয়েছে, যথা-পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, মণিকবিদ্যা, জীববিদ্যা। এইসকল বিদ্যার জন্য অসংখ্য পরিভাষা আবশ্যক। যে শব্দ আমাদের আছে তা রাখতে হবে, বহু সংস্কৃত শব্দ নূতন করে গড়তে হবে, পাওয়া গেলে কিছু কিছু হিন্দী ইত্যাদি ভাষা থেকেও নিতে হবে; অধিকন্তু, ইংরেজী ভাষায় প্রচলিত পারিভাষিক শব্দ রাশি রাশি আত্মসাৎ করতে হবে।

 ৩। বিশেষবাচক শব্দ আমাদের যা আছে তা থাকবে, যেমন—‘চন্দ্র, সূর্য, বুধ, হিমালয়, ভারত, পারস্য’। যে নাম অর্বাচীন কিন্তু বহুপ্রচলিত, তাও থাকবে, যেমন—‘প্রশান্তমহাসাগর’। কিন্তু অবশিষ্ট শব্দের ইংরেজী নামই গ্রহণীয়, যথা-‘নেপচুন, আফ্রিকা, আটলাণ্টিক’।

 ৪। দ্রব্যবাচক শব্দের যদি দেশী নাম থাকে, তাে রাখব, যেমন—‘স্বর্ণ লৌহ’ বা ‘সােনা লােহা'। যদি না থাকে তবে প্রচুর ইংরেজী নাম নেব। বৈজ্ঞানিক বস্তু যে নামে পরিচিত, সেই নামই বহু পরিমাণে আমাদের মেনে নিতে হবে। রাসায়নিক ও খনিজ বস্তু এবং যন্ত্রাদি (যথা—মােটর, এঞ্জিন, পাম্প, স্কেল, লেন্স, থার্মমিটার, স্টেথস্কোপ) সম্বন্ধে এই কথা খাটে। রাসায়নিক মৌলিক পদার্থের তালিকায় স্বর্ণ লৌহ গন্ধক প্রভৃতি নামের সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন ক্লোরিন সােডিয়ম থাকবে। ফরমুলা লিখতে ইংরেজী বর্ণই লিখব, ইংরেজী বর্ণমালা আমাদের অপরিচিত নয়। সাধারণত লিখব ‘লৌহ কঠিন, পারদ তরল। লেখবার কালি তৈয়ার করতে হিরাকস লাগে’। কিন্তু দরকার হলেই নির্ভয়ে লিখব—‘ফেরস সালফেট, অর্থোডাইক্লোরােবেনজিন, ম্যাগনেসাইট, রুমকফ্‌, কয়েল, ইলেকট্রন'। শ্রীযুক্ত মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা রাসায়নিক পরিভাষা রচনায় আশ্চর্য কৌশল দেখিয়েছেন। কিন্তু সে পরিভাষা কল্পান্তেও চলবে না। ‘অ্যাণ্টিমনি থায়ােফস্ফেট’এর চেয়ে মণীন্দ্রবাবুর ‘অন্তমনসশুল্বভাস্ফেত’ কিছুমাত্র শ্রুতিমধুর বা সুবােধ্য নয়। রামেন্দ্রসুন্দর লিখেছেন― ‘ভাষা মূলে সংকেতমাত্র। আমরা বিদেশী পারিভাষিক শব্দকে রূঢ়-অর্থ-বাচক সংকেত হিসাবেই গ্রহণ করব এবং তার প্রয়ােগবিধি শিখব। যাঁর কৌতূহল হবে তিনি ‘অক্সিজেন, অ্যাণ্টিমনি’ প্রভৃতি নামের ব্যুৎপত্তি খোঁজ করবেন, কিন্তু সাধারণের পক্ষে রূঢ় অর্থের জ্ঞানই যথেষ্ট। জীববিদ্যাতেও ঐ নিয়ম। ‘কাষ্ঠ, অস্থি, পুষ্প, অণ্ড’ চলবে; ‘প্রােটোপ্লাজম, হিমােগ্লোবিন, ভাইটামিন’ মেনে নিতে হবে।

 ৫। বর্গবাচক শব্দের প্রাচীন বা নবরচিত দেশী নাম সহজে চলবে, যথা―‘ধাতু, ক্ষার, অম্ল, লবণ, প্রাণী, মেরুদণ্ডী, তৃণ’। কিন্তু যেখানেই শব্দ রচনা কঠিন হবে সেখানে বিনা দ্বিধায় ইংরেজী নাম নেওয়া উচিত। বােধ হয় বর্গের উচ্চতর অঙ্গে (element, compound, phylum, order, genus, species, endogen) দেশী নাম অনায়াসে চলবে। কিন্তু নিম্নতর অঙ্গে বহুস্থলে ইংরেজী নাম মেনে নিতে হবে, যেমন―‘হাইড্রোকার্বন, অক্সাইড, গােরিলা, হাইড্রা, ব্যাকটিরিয়া'।

 ৬। ভাব বিশেষণ ও ক্রিয়া বাচক শব্দের অধিকাংশই দেশী হতে পারবে। Survival, symbiosis, reflection, polarization, density, gaseous, octahedral, decompose, effervesce প্রভৃতির দেশী প্রতিশব্দ সহজে চলবে। কিন্তু রূঢ় শব্দ ইংরেজীই নিতে হবে, যথা—‘গ্রাম, মিটার, মাইক্রন, ফারাড'।

 বহুস্থলে একটি ইংরেজী শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তৎসম্পর্কিত (cognate) আরও কয়েকটি শব্দ নিতে হবে। ‘ফোকস, ফিনল, অক্সাইড, মিটার’এর সঙ্গে ‘ফোকাল, ফিনলিক, অক্সিডেশন, মেট্রিক’ চলবে। ছাপাখানার ভাষায় যেমন ‘কম্পােজ করা’ চলেছে, রাসায়নিক ভাষায় তেমনি ‘অক্সিডাইজ’ করা চলবে।  ৭। বাংলায় (বা সংস্কৃতে) কতকগুলি পারিভাষিক শব্দ আছে যার ইংরেজী প্রতিশব্দ নেই, যথা—শুক্লপক্ষ, পতঙ্গ (winged insect), উদ্‌বৃত্ত (circle cutting equinoctial at right angles), ছায়া (both shadow and transmitted light), উপাঙ্গ (limb of a limb)। পরিভাষার তালিকায় এইসকল শব্দকে সযত্নে স্থান দিতে হবে।

 ৮। দেশী পরিভাষা নির্বাচনকালে সর্বত্র ইংরেজী শব্দের অভিধা (range of neaning) যথাযথ বজায় রাখার চেষ্টা নিষ্প্রয়ােজন। যদি স্থলবিশেষে দেশী শব্দের অর্থের অপেক্ষাকৃত প্রসার বা সংকোচ থাকে তবে ক্ষতি হবে না—যদি সংজ্ঞার্থ (definition) ঠিক থাকে। প্রসার, যথা—অঙ্গুলি=finger; toe। সংকোচ, যথা—fluid = তরল; বায়ব।

 ৯। বিভিন্ন বিদ্যায় প্রয়ােগকালে একই শব্দের অল্পাধিক অর্থভেদ হয় এমন উদাহরণ ইংরেজীতে অনেক আছে। এরূপ ক্ষেত্রে বাংলায় একাধিক পরিভাষা প্রয়ােগ করাই ভাল। কারণ, বাংলা আর ইংরেজী ভাষার প্রকৃতি সমান নয়। যথা―sensitive (mind, balance, photographic plate)। Sensitive শব্দের সমান ব্যঞ্জনা (connotation) বিশিষ্ট বাংলা শব্দ রচনার কোনও প্রয়ােজন নেই, একাধিক শব্দ প্রয়ােগ করাই ভাল। পক্ষান্তরে এমন বাংলা শব্দও আছে যার সমান ব্যঞ্জনা বিশিষ্ট ইংরেজী শব্দ নেই, যেমন― ‘বিন্দু’=drop; point; spot। এস্থলেও ইংরেজীর বশে একাধিক শব্দ রচনা নিষ্প্রয়ােজন।

 যাঁরা বাংলা পরিভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য মুখ্য বা গৌণ ভাবে চেষ্টা করছেন, তাঁদের কাছে আর একটি নিবেদন জানিয়ে এই প্রবন্ধ শেষ করছি। সংকলনের ভার যাঁদের উপর, তাঁদের কিরকম যােগ্যতা থাকা দরকার? বলা বাহুল্য, এই কাজে বিভিন্ন বিদ্যায় বিশারদ বহু লােক চাই। তাঁদের মৌলিক গবেষণার খ্যাতি অনাবশ্যক, কিন্তু বাংলা ভাষায় দখল থাকা একান্ত আবশ্যক। যে সমিতি সংকলন করবেন, তাঁদের মধ্যে দু-চার জন সংস্কৃতজ্ঞ থাকা দরকার। এমন লােকও চাই যিনি হিন্দী-উর্দু পরিভাষার খবর রাখেন। যদি কোনও হিন্দীভাষী বিজ্ঞান-সাহিত্য-সেবী সমিতিতে থাকেন তবে আরও ভাল হয়। সর্বোপরি আবশ্যক এমন লােক যিনি শব্দের সৌষ্ঠব ও সুযোজ্যতা বিচার করতে পারেন, বিশেষত সংকলিত সংস্কৃত শব্দের। বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদের আহ্বানে যাঁরা পরিভাষা সংকলন করেছেন তাঁরা সকলেই সুপণ্ডিত এবং অনেকে একাধিক বিদ্যায় পারদর্শী। তথাপি বিভিন্ন সংকলয়িতার নৈপুণ্যের তারতম্য বহুস্থলে সুস্পষ্ট। Columnar, vetreous, adamantineএর প্রতিশব্দ একজন করেছেন—‘স্তম্ভনিভ, কাচনিভ, হীরকনিভ’। আর একজন করেছেন—‘স্তাম্ভিক, কাচিক, হৈরিক’। শেষােক্ত শব্দগুলিই যে ভাল তাতে সন্দেহ নেই। বিভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক প্রস্তাবিত শব্দের মধ্যে কোন্‌টি উত্তম ও গ্রহণযােগ্য তার বিচারের ভার সাধারণের উপর দিলে চলবে না; সংকলন-সমিতিকেই তা করতে হবে। এনিমিত্ত যে বৈদগ্ধ আবশ্যক তা সমিতির প্রত্যেক সদস্যের না থাকতে পারে, কিন্তু কয়েক জনের থাকা সম্ভব। অতএব, পরিভাষাসংকলন বিভিন্ন ব্যক্তি দ্বারা সাধিত হ'লেও শেষ নির্বাচন মিলিত সমিতিতেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।