লঘুগুরু প্রবন্ধাবলী/ভাষা ও সংকেত
ভাষা ও সংকেত
ভাষা একটা নমনীয় পদার্থ, তাকে টেনে বাঁকিয়ে চটকে আমরা নানা প্রয়ােজনে লাগাই। কিন্তু এরকম নরম জিনিসে কোনও পাকা কাজ হয় না, মাঝে মাঝে শক্ত খুঁটির দরকার, তাই পরিভাষার উদ্ভব হয়েছে। পরিভাষা সুদৃঢ় সুনির্দিষ্ট শব্দ, তার অর্থের সংকোচ নেই প্রসার নেই। আলংকারিকের কথায় বলা যেতে পারে—পরিভাষার অভিধাশক্তি আছে, কিন্তু ব্যঞ্জনা আর লক্ষণার বালাই নেই। পরিভাষা মিশিয়ে ভাষাকে সংহত না করলে বিজ্ঞানী তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করতে পারেন না।
কিন্তু ভাষা আর পরিভাষাতেও সব সময় কুলয় না, তখন সংকেতের সাহায্য নিতে হয়। যিনি ইমারত গড়েন, তিনি কেবল বর্ণনা দ্বারা তাঁর পরিকল্পনা বােধগম্য করতে পারেন না, তাঁকে নক্শা আঁকতে হয়। সে নক্শা ছবি নয়, সংকেতের সমষ্টি মাত্র―পুরনাে গাঁথনি বােঝাবার জন্য হলদে রং, নূতন গাঁথনি লাল, কংক্রিটে হিজিবিজি, খিলানের জায়গায় ঢেরা-চিহ্ন, ইত্যাদি। বস্তুর সঙ্গে নক্শার পরিমাপগত সাম্য আছে, কিন্তু অন্য সাদৃশ্য বিশেষ কিছু নেই। অভিজ্ঞ লােকের কাছে নক্শা বস্তুর প্রতিমাস্বরূপ, কিন্তু আনাড়ীর কাছে তা প্রায় নিরর্থক; বরং ছবি দেখলে বা বর্ণনা পড়লে সে কতকটা বুঝতে পারে।
গানের স্বরলিপিও সংকেত মাত্র। গান শুনলে যে সুখ, স্বরলিপি-পাঠে তা হয় না, কিন্তু গানের স্বর তাল মান লয় বােঝাবার জন্য স্বরলিপির প্রয়ােজন আছে।
একজনের উপলব্ধ বিষয় অন্যজনকে যথাবৎ বােঝাবার সুপ্রয়ােজ্য সংক্ষিপ্ত সস্তা উপায়—সংকেত। সংকেতের পূর্বনির্দিষ্ট অর্থ যে জানে, তার পক্ষে উদ্দিষ্ট বিষয়ের ধারণা করা অতি সহজ, তাতে ভুলের সম্ভাবনা নেই, ভাল-লাগা মন্দ-লাগা নেই, শুধুই বিষয়ের বােধ। সংকেতের কারবার বুদ্ধিবৃত্তির সহিত, হৃদয়ের সহিত নয়। অবশ্য, নায়ক-নায়িকার সংকেতের কথা আলাদা।
বিজ্ঞানী বহুপ্রকার সংকেতের উদ্ভাবন করেছেন। তিনি আশা করেন, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অনেক উপলব্ধিই কালক্রমে সংকেত দ্বারা প্রকাশ করা যাবে। একদিন হয়তাে গানের স্বরলিপির তুল্য রসলিপি গন্ধলিপি স্পর্শলিপিও উদ্ভাবিত হবে, তখন আমরা দ্রাক্ষারসের স্বাদ, চুতমুকুলের গন্ধ, মলয়সমীরের স্পর্শ ফরমুলা দিয়ে ব্যক্ত করতে পারব। শারদাকাশ ঠিক কি রকম নীল, সমুদ্রকল্লোলে কোন্ কোন্ ধ্বনি কত মাত্রায় আছে, তাও ছক-কাটা কাগজে আঁকাবাঁকা রেখায় দেখাব। এখন যেমন জুতাে কেনবার সময় বলি—৮ নম্বর চাই, ভবিষ্যতে তেমনি সন্দেশ কেনবার সময় বলব—মিষ্টতা ৬, কাঠিন্য ২। হয়তাে সুন্দরীর রংএর ব্যাখ্যান লিখব—দুধ ৩, আলতা ২, কালি ৫। তখন ভাষার অক্ষমতায় বস্তু অপরঞ্জিত হবে না, যা সত্য তাই সাংকেতিক বর্ণনায় অবধারিত হবে।
কবির ব্যবসায় কি উঠে যাবে? তার কোনও লক্ষণ দেখছি না। ভাষার যে উচ্ছঙ্খল নমনীয়তা হিসাবী লােককে পদে পদে হয়রান করে, তারই উপর কবির একান্ত নির্ভর। তিনি বিজ্ঞানীর মতন বিশ্লেষণ করেন না, প্রত্যক্ষ বিষয় যথাবৎ বােঝাবার চেষ্টা করেন না। প্রত্যক্ষ ছাড়াও যে অনুভূতি আছে, যা মানুষের সুখদুঃখের মূলীভূত, বিজ্ঞান যার আশেপাশে মাথা ঠুকছে, সেই অনির্বচনীয় অনুভূতি কবি ভাষার ইন্দ্রজালে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করেন। সর্বথানমনীয় নির্বাধ ভাষাই তাঁর প্রকাশের উপাদান, তাতে ইন্দ্রিয়গম্য ইন্দ্রিয়াতীত সকল সত্যই তিনি ব্যক্ত করতে পারেন। পরিভাষা আর সংকেতে কবির কি হবে? তা ভাবের পিঞ্জর মাত্র। আদিকবিকে নারদ বলেছেন―
‘—সেই সত্য যা রচিবে তুমি;
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।―’
যাঁরা নিরেট সত্যের কারবারী, তাঁরাও এখন মাথা চুলকে ভাবছেন—হবেও বা।
১৩৩৮