ললিতাসুন্দরী ও কবিতাবলী/ললিতাসুন্দরী
(প্রথম সর্গ)
৮৭০-৪।
............................................................“স্ত্যানাবনদ্ধ-ঘন-শোণিত-শোণ-পাণি-
রুত্তংসয়িষ্যতি কচাংস্তব দেবি ভীম?॥”
ললিতাসুন্দরীর প্রথম সর্গের অধিকাংশই দুই বৎসর পূর্ব্বে “মাসিক প্রকাশিকা” নামক এক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। এক্ষণে স্থানে স্থানে অনেক পরিবর্ত্তিত ও সংযোজিত হইয়াছে।
ইহার সকল ভাব লেখকের মানস-প্রসূত নহে;—মধ্যে মধ্যে অপরাপর ভাষার ভাবেরও অসদ্ভাব নাই। ঘটনাটি অনৈতিহাসিক, এবং রচনা-চাতুরীর অভিমান করে না।
কলিকাতা,—বেণেটোলা।
১লা বৈশাখ,—১২৮১।
১
ঝিকিমিকি করে রবি, দিবা অবসান,
মৃদুল অনিল গায় বিরামের গান।
শোভাময় চারি দিক, শোভাময় বন,
শোভাময় নীলনভ, শোভন ভুবন;
নাহি আর তপনের আতপ প্রখর,
উজলে জাহ্নবী জল কিরণ নিকর।
খেলে সে উজল জলে তরল লহরী,
খেলে সে জলের তীরে বিলোল বল্লরী,
খেলে সে জলের কোলে অনিল মলয়,
খেলে সে জলের কোলে কুবলয় চয়,
খেলে কুবলয় কোলে ভ্রমর নিকর—
নয়নের কোলে যেন তারা মনোহর,
জড়িমাজড়িত যেন স্বপন সুন্দর।
সেই জাহ্নবীর কূলে জানকী সুন্দরী
ভেবেছেন পতিপদ রঘুকুলেশ্বরী;—
কোথা সেই প্রাসাদের হেম-সিংহাসন,
বসিয়ে নদীর তীরে মুদিয়ে নয়ন!—
লহরী ক্ষালন করে চরণযুগল,
কিছু জ্ঞান নাই, সতী বিষাদে বিহ্বল;
হরিণ হরিণী আসি, চকিত নয়নে
চেয়ে দেখে তাঁর সেই বিষাদ-বদনে;
জপমালা কমণ্ডলু রয়েছে ভূতলে,
শোকময় কুলুরবে জাহ্নবী উথলে!
হৃদয়ে প্রাণেশ-ছবি তনয় যুগল,
নয়নে প্রণয় নীর হীরক-উজল!
যে নীর বিদার করে পাষাণ হৃদয়,
চির অহৃদয় জনে করে সহৃদয়,
রমণীর নয়নের সে নীর, তপন,
হেরিয়াছ হেনকালে হইতে পতন!
হেরিয়াছ নীলময়ী যমুনার কূল,
হেরিয়াছ ব্রজবালা বিরহ ব্যাকুল।
হায় রে প্রদোষে শুনি মুরলীর ধ্বনি,
চেয়েছে চপলচিতে চপল রমণী;
বলেছে তোমারে অস্ত যাইতে সুন্দরী,—
“চলে যাও, দিনকর, এস, বিভাবরি!”
হেন ভাগীরথীতীর, এ হেন সময়,
মুঙ্গের কানন শোভে প্রমোদ-নিলয়;
নন্দন-সুন্দর সেই কানন ভিতরে
ধীরে ধীরে একাকিনী ললিতা বিহরে।
বিলোল-লোচনা বালা ষোড়শী রূপসী,
হায় রে ভূতলে যেন উদিয়াছে শশী।
মধুর ত্রিদিব রূপ, মধুর নয়ন,
কেমন মধুর, মরি, সহাস আনন!
সে মধুর রূপ যা'র মন আলো করে,
ভাগ্যধর সেই থাকে প্রফুল্ল অন্তরে!
দেখিতে উজল, যথা গিরিরাজ-বালা
ভবেশ-ভাবিনী, করে পারিজাত-মালা,
সহাস বদন খানি, লাজুক নয়ন,
তরুণ অরুণ প্রায় তনুর কিরণ;
দেখিতে সুন্দরী, যথা সহাস অধরে
স্বপনে মোহিনী নারী বিরাজে অন্তরে;
প্রথম-প্রণয়-স্মৃতি মতন কোমল;
শৈশবের দেব-চিন্তা স্বরূপ সরল;
স্নিগ্ধ, যথা বান্ধবের প্রবোধ বচন;
বিষাদ গাথার প্রায় জীবন তোষণ;
সজ্জনের গুণগান মত মধুময়;
সতত পবিত্র, যথা জননী হৃদয়;
কমনীয়, কামিনীর প্রণয় মতন,
নাহি কিন্তু চপলতা, চিরবিমোহন;
মনোহর, যৌবনের ভাবনা স্বরূপ,—
যখন হৃদয় দেখে নিজ প্রতিরূপ,—
ছিল সে নবীন বালা,—সেই বিনোদিনী
যৌবনের শোভাদলে ভুবনমোহিনী!
ত্রিলোক-ললাম রূপ সুষমা নিলয়,
কথাতে কি কভু তাহা বিবরিত হয়?
কে বা আছে এ জগতে দেখি দুনয়নে
বর্ণিবারে রূপরাশি পারে একাননে?
কে না অনুভবে চারু স্বরগের শোভা,
কে বা নহে মুগ্ধ, হেরি রূপ মনোলোভা,
যবে পরিতৃপ্ত মন, ভূমানন্দ ভাব,
আদরে স্বীকার করে সুষমা-প্রভাব?
হাসিয়া নিরখে সবে কামিনী কমল,
নিরখে রূপের প্রভা নব শোভাদল—
বিনা সে ললিতা, সবে করে নিরীক্ষণ
প্রেমের আলোক সেই সুষমা-কিরণ,
সেই বদনের প্রভা লাবণ্য নিলয়,—
সেই আঁখি দুটি, মরি, কিবা শোভাময়!
যে নারীর রূপ ভাবি মহেশ পাগল,
মধুকালে নিধুবনে কেশব বিকল,
বাজে আজো ব্রজপুরে রাধা রাধা রব,
যমুনা লহরী খেলে—প্রণয়-উৎসব;
শোনা যায় দূরদেশে নুপুরের ধ্বনি,
উজলে কদম্বতলে চারু চূড়ামণি;
নাহি তথা কালাচাঁদ, বাজিছে বাঁশরী,
কুহরে কোকিলকুল “কোথা প্রাণেশ্বরী!”
দেখা যায় শ্যামরূপ শশীর কিরণে,
প্রেম অভিমান যেন সাধেন চরণে;
সেই রমণীর রূপ চির শোভাময়,
উজল লাবণ্যরাশি, পূর্ণচন্দ্রোদয়;
সেই রূপ যাহা করে মানস মোহিত,
আনন্দে মাতায়ে দেয় প্রফুল্লিত চিত,
তরল প্রভায় বিশ্বে করে বিমোহিত;
সেই রূপে রূপবতী রাজে সে রমণী,—
বোধ হয়, বসি বিধি বিরলে আপনি,
দেখিতে বাসনা করি শোভার আধার,
গড়েছিল হেন নিধি জগতের সার।
যখন রাজিত হাসি সেই বিস্বাধরে,
ফুটিত গোলাপরাশি কপোল-উপরে;
শোভিত পল্লবে নব পুণ্ডরীকদল,
হাসিত জগত, শশী হইত উজ্জ্বল;
অমনি বহিত হাসি অনিল আকুল,
ধাইত কমল ভ্রমে মধুকর-কুল!
আর সেই আঁখি দুটি? কেমন সরল,
কেমন মধুর, মরি, হরিণ চপল!
বদন গগনে সেই কেমন শোভন
শুক তারা দুটি ধরে যুগল লোচন;
সেই দুটি তারা আলো হৃদয়ে বিতরে
আনন্দের প্রতিনিধি মনোহর করে!
যে জন বাসে না ভাল স্বাভাবিক শোভা,
পরিপাটী বেশ হয় যা’র মনোলোভা।
এ রূপসী রূপ তবে তাহার নয়নে
লাগিবে না ভাল, ভয় হইতেছে মনে।
এলান কুন্তলজাল চুম্বিছে আনন,
কাল মেঘে পূর্ণ শশী দেখিতে কেমন।
তনুখানি আবরিত বাসস্তী বসনে,
উজ্জ্বল কুণ্ডল দোলে যুগল শ্রবণে;
ফুলের কঙ্কণ হাতে, গলে ফুলমালা,
কুন্তলে আবদ্ধ ফুল, করে ফুলবালা,
পয়োধরে ফুল-হার-মনোহর বেশ—
আমরি কেমন শোভা—সরেস—সরেস!
না হ’তে সুন্দরী যদি না হ’তে সুন্দরী,
না হ’তে রূপসী যদি, তুমি রূপেশ্বরি,
হইতে না-হইতে না হেন অভাগিনী,
হইতে না সিরাজের প্রমোদকামিনী!
বাঙ্গালার অধীশ্বর দুরন্ত নবাব,
অসীম ক্ষমতা তা’র অতুল প্রভাব,
সে প্রভাব দরিদ্রের কুটীর শোভন
তোমারে কাড়িয়ে নিল, ললিতা রতন!
তদবধি তব রূপ, তব শোভাবলী
মুঙ্গের কাননে তা’র স্বেচ্ছাচার-বলি।
তদবধি নবাবের জেহানা প্রেয়সী,
নহে সে ললিতা আর কুটীরের শশী।
কেন রে দারুণ বিধি, দিয়েছিলি রূপ,
রূপ দিয়ে সুখ দিতে কেন রে বিরূপ?
অসীম বালুকাময় ঘোর মরুস্থল,
ফুটিল তাহাতে চারু কুসুম কোমল;
অমনি প্রবল বায়ু বহিল ভীষণ,
ছাইল বালুকাজাল তখনি গগন;
বিষম রবির তাপে বিশীর্ণ বদন,
জর জর মর মর কুসুম রতন।—
এমন সময়ে হাসি আসি মধুকর,
প্রণয় প্রবোধে তোষে কুসুম অন্তর।
অপগত হ’ল সেই মরুর যাতনা,
নিদয় বায়ুর সেই বিঘোর বেদনা।
ভাবিল কুসুম অলি প্রাণের সমান,
ললিতা ললিত করে সঁপিল পরাণ।
দেখিতে দেখিতে শশী উদিল গগনে,
একাকিনী এ কামিনী এখনো কাননে?
দেখিতে স্বভাব-শোভা হেথা আগমন?
তবে কেন রহে ধনী আনত-আনন।
দেখিতে কুসুম শোভা বুঝি থমকায়?
তবে কেন চারিদিকে নয়ন ঘোরায়।
কেন রে উদাস মন, কেন বা চপল,
কেন রে বিহরে একা কামিনী কমল?
প্রফুল্লিত ফুলকুল, পূর্ণ শশধর,
প্রদোষ সমীরে কেন চকিত-অন্তর?
কিসের ভাবনা হেন নবীন যৌবনে,
জ্বলেছে অনল কি রে সুথের কাননে?
বিরহিণী এ কামিনী?—নাই প্রাণেশ্বর?
হয়েছে কি ছারখার প্রাণের ভিতর?
কেন সচঞ্চল মন? চকিত শ্রবণ?
ক্ষণে ক্ষণে কেন ঘুরে যুগল লোচন?
হেরিছে কি নীলনভে পূর্ণ শশধর,
কিম্বা কাননের পূর্ণ স্বচ্ছ সরোবর?
কল্লোলিনী-কলধ্বনি শুনিতে যতন?
তাহা নয়!– হ’বে কিছু উহারি মতন!
মর্ম্মরে নীরস পত্র—চমকিল ধনী;—
পদশব্দ–বিনোদিনী শহরে অমনি।
শুনিল সঙ্কেত-বাণী—হাসিল অধর—
মিলিবে ক্ষণেক পরে নাগরী নাগর।
হ’ল তাহা গত—আর প্রেমিক দম্পতী
আলিঙ্গিত প্রেমভরে—মধুর মুরতি!
এখন কি তাহাদের মনের ভিতর
আছে গো এ ধরণীর পদার্থ নিকর?
দেখে কি তাহারা আর সময়ের গতি,
দেখে কুলুরবে বহে শ্বেত স্রোতস্বতী?
সেই আধ মুকুলিত লোহিত অধর,
সেই আধ নিমীলিত নয়ন সুন্দর,
সেই নব বিকসিত প্রফুল্ল অন্তর;—
আর কি তাহার মাঝে আছে বসুমতী,
এখনো পার্থিব চিন্তা ঘেরে আছে মতি?
ডুবুক বিশাল বিশ্ব প্রচণ্ড প্রলয়ে,
বহুক প্রবল বায়ু ভয়ঙ্কর হয়ে,
চারি দিকে একাকার, হাহাকার নাদ,
ঘটাতে কি পারে তা’র প্রণয়ে প্রমাদ?
কি সুখেই আছে দিয়ে অধরে অধর!
কি সুখেই ভাসে আজি তাদের অন্তর!
মনোহর শরদের শশধর কর,
মনোহর বসন্তের কোকিলের স্বর,
মনোহর নিদাঘের ফুল সমুদয়,
মনোহর চারুতল্প ইন্দ্রধনুচয়,
মনোহর শারদীয় শ্যামল গগন,
মনোহর প্রভাতের নবীন তপন,
মনোহর সরসীর কুবলয়-শোভা,
মনোহর প্রদোষের প্রভা মনোলোভা,
মনোহর কল্পনার বিনোদ-বদন,
এদের চেয়েও, হায়, প্রেমের মিলন!
যে যৌবনে এ মিলনে বিহবলিত মন,
ললিতের সে যৌবন আগত তখন।
মানসে নবীন তেজ, উৎসাহ প্রবল,
নয়নে উজ্জ্বল জ্যোতি, শরীর সবল।
কিন্তু বয়সের সহ তাহার বদন,
ধরেছিল বিষাদের আঁধার বরণ।
থাকিত ললিত এক নিরানন্দ চিত,
কহিত না কথা বেশী কণহারো সহিত।
বিজনে নয়ন জলে ভাসিত বদন,
আপনি আপন’পরে হ’ত জালাতন;
কভু বা প্রফুল্ল মুখে প্রসারিত কর,
করিবারে আলিঙ্গন বুকের উপর;
কাহারে করিবে? তথা আর কে থাকিত?
তবে কি ভাবনা বশে এমন হইত?
যখন তাহার ছিল কিশোর শৈশব,
শুনিয়াছে এ নাগর প্রণয়ের রব;
পেয়েছিল মনোমত প্রিয়া মনোহর,
মিলে নাই ভাগ্যক্রমে চিরোপ্সিত কর।
ফুরায়েছে নবীন প্রেমের সেই দিন,
সুখের কাহিনী মনে জাগে অনুদিন।
যখন আনন্দে ধরি প্রেয়সীর কর,
বিহরি কাননে দোঁহে উল্লাস-অন্তর;
রাঙিয়াছে চারুমুখ তপন কিরণে,
তবুও অসুখ কোন ভাবে নাই মনে;
কহিতে অন্তর কথা হ’ত সুখবোধ,
ভাবিত অসুখ, হ’লে সেই সুখরোধ;
যখন নবীন প্রেমে হৃদয় নবীন,
সেই একদিন গেছে, এই একদিন!
সে সুখের দিন আজি এখন কোথায়!
কোথা সে মিলন সুখ, সে প্রণয়, হায়!
কোথায় এখন সেই প্রেমে গলাগলি,
অনুক্ষণ-বিলোকন, পুণ্য-কোলাকুলি!
সেই প্রেম-বিকসিত লোচন-বিস্ফার,
আনন্দ-উদ্বেল-হাসি প্রফুল্লতা-সার;
এখন সে সব, হায়, কোথায় গিয়েছে!
হায়! সে স্বপন-সুখ কোথা পলায়েছে।
বিজন কানন মাঝে দাঁড়ায়ে দুজনে,
হরিণের চারু আঁখি হেরিছে নয়নে।
একবার সে নয়ন করে দরশন,
পুনরায় পরস্পর মুখ বিলোকন।
নয়নে নয়ন পড়ে—মধুময় হাসি—
অমনি বরষে মনে অমৃতের রাশি।
মুখে কথামাত্র নাই, গলা ধরাধরি,
দাঁড়ায়ে প্রেমিকদ্বয়, অপসর অঙ্গরী।
এমন পবিত্র প্রেম কখনো কি হয়!
এমন শৈশব প্রেম ভুলিবারে নয়!
তুলিয়ে গোলাপ ফুল বিকেল বেলায়,
পরাইত সযতনে তাহার খোঁপায়;
চিবুক ধরিয়ে “দেখি, কেমন হয়েছে—
আমরি, তোমার মুখ কেমন সেজেছে।”
অমনি ললিত বালা সহাস আননে
দুলিতে দুলিতে যেত জননী সদনে;
পিছনে যাইত তা’র শিশু প্রাণেশ্বর,
দেখিত নয়ন ভরে উল্লাস-অন্তর।
হাসিত বালিকা প্রেমে বালক হাসিত,
ত্রিলোক শশীর করে হ’ত উদ্ভাসিত।
শৈশবে প্রেমের কোলে প্রফুল্লিত মন
কি সুখেই হেসেখেলে যাপিত জীবন!
এবে সে মুখের দিন কোথায় গিয়েছে!
হায়! সে নেশার ঘুম কোথা পলায়েছে!
অভাগা কপালে পুন বিরস ঘটন,
পরিণয়ে পর-সনে হইল মিলন।
সে বদন লাজ বটে দেয় চন্দ্রমায়,
কিন্তু নহে তাহা, যাহ তা’র মন চায়।
সে বদন ধরে বটে রবির কিরণ,
উজ্জ্বল হয় না তাহে কিন্তু তা’র মন।
সে বদন বহে বটে মৃদু সমীরণ,
কিন্তু তাহে উচ্ছলিত হ’ত না কখন
বিষাদ-পূরিত তা’র হৃদয় সাগর,
খেলিত না আহলাদের লহরী নিকর।
যাহারে চিন্তায় কভু শয়নে স্বপনে
দেখে নাই, কখনও করে নাই মনে;
এ জীবনে হেরে নাই যাহার বদন,
কহে নাই যা’র সনে প্রেমের বচন,
দেখে নাই, শুনে নাই, কেমন সে মন;
তাহারি সনেতে, হায়, হইল মিলন?
বুঝিতে পারি না, বিভো, তোমার হৃদয়,
তোমাকেও দোষী ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়!
যবে সে ললিত বালা লাজুক নয়নে,
বসিবে তাহার সনে সহাস আননে;
বাজাবে প্রেমের গান হৃদয় বীণাতে,
চাহিবে তাহার সনে সঙ্গীত মিলাতে;
তখন কি করে’, বিধি, বাজিবে সে বীণা,
কি করে? তাহার সনে মিলিবে নবীন?
ধরায় অতুল সুখ প্রেমের চুম্বন,
যদি সেই প্রেম হয় প্রেমের মতন—
তুমি মম, আমি তব, যদি তাই হয়,
তবে আর এ জগত আর কারে নয়!—
যদি কভু এ ধরাতে থাকে কোন সুখ,
যদি কভু দেখা যায় তা’র হাসিমুখ;
বিষাদ-সাগরে যদি থাকে কোন দ্বীপ,
আঁধার আগারে যদি জ্বলে কোন দীপ,
তবে বসুমতী-মাঝে আছে এক ধন,
প্রেমের চুম্বন তাহা প্রেমের চুম্বন!
প্রণয় প্রফুল্ল মনে যবে সে সুন্দরী
চুমিবে অধর, তা’রে হৃদয়েতে ধরি;
তখন কি করে', ওগো জনক জননি,
প্রণয়ের প্রতিদান পা’বে সে রমণী!
এই রূপে বোধহীন জননী জনক
সর্ব্বনাশ করেছিল—অভাগা বালক!
দেখিতে মনের সাধ বধুর বদন,
জানিত না তা’রা কভু হইবে এমন;
ধাইতে স্বরগ পানে ঘটিল বিষাদ,
সাধের আশার মূলে ঘোর পরমাদ!
উড়ে উড়ো পাখী সম হইলো তনয়,
সেই রমণীর প্রেমে বিমুখ হৃদয়;
কোথায় তাদের প্রেম,—বিনোদ স্বপন!—
কণ্টকিত হ’ল শুধু দুয়ের জীবন;
একের মরণে হ’বে অপরের সুখ,
তা’ না হ’লে চিরকাল প্রণয়-বিমুখ।
যেমন অবোধ-চিত হিন্দুর কুমার
মাটির পুতুলে দেয় পশু-উপহার;–
হইবে দেবের তুষ্ট, যাইবে ত্রিদিবে,
পূজার পুণ্যের ফল তথায় পাইবে;
ললিতের পিতা মাতা তেমনি তখন,
করেছিল মুখ তরে তাহারে অর্পণ।
কোথায় সে শোভাময় বাসব ভবন,
কোথায় রে তনয়ের সুখের জীবন?—
হতভাগা জীব খালি হারাল পরাণ,
ললিতের ভাবী আশা করিল পয়ান!
নীলাকাশে শোভে যথা শারদীয় শশী,
কোমল মধুর করে বিরহিত-মসি;
তেমনই ললিতের উদার হৃদয়ে
রাজিত শৈশব রূপ সমুজ্জল হ’য়ে।
পড়িল পৃথিবী ছায়া শশীর উপর,
লুকাইল স্থধাময় কিরণ নিকর;
ললিতেরো অন্তরেতে নবীনা মুরতি
আবরিল শৈশবের প্রেমিকার জ্যোতি।
রাজে নব প্রতিবিম্ব শশীর উপর,
রাজে নব প্রতিবিম্ব হৃদয় ভিতর;
সেই প্রতিবিম্ব দেয় শ্যামিকা অবনী,
রূপসী ললিতা দেয়—পরের রমণী।
একদা শৈশবে শিশু কুসুম শয়নে
যখন খেলিতেছিল কুসুমের সনে;–
এ ফুল ও ফুল ল’য়ে প্রমোদ ক্রীড়ন,
অধরে মধুর হাসি, প্রভাত কিরণ;
চটুল নধর তনু দেখিতে সুন্দর,
নীল বেশে শোভা পায় কুসুম উপর;–
তখন আসিয়ে সব অমর সুন্দরী,
হাসি হাসি সে বালকে প্রদক্ষিণ করি,
দাঁড়াইয়েছিল, দিতে প্রেম-উপহার,
প্রত্যেকের প্রভাবের প্রসাদের সার।
চাহিয়ে অবোধ শিশু বিস্মিত নয়নে,
একে একে অগ্রসর তা’র যেই ক্ষণে;
চৌদিকে খেলিল বায়ু ত্রিদিব সুবাস,
হাসিল কুসুম রাশি, হাসিল আকাশ।
প্রথমেতে আসিলেন সারদা আপনি,
দিলেন মোহিনী বীণা, মোহন লেখনী;
তা’র পর আসিলেন কমল সুন্দরী,
দিলেন প্রচুর ধন কমল-ঈশ্বরী;
পরে আসিলেন তথা মদনমোহিনী,
দিলেন অতুল রূপ রতি বিনোদিনী;
রাক্ষসী অলক্ষ্মী এল শেষেতে সবার,
দিল এক বিষধর প্রেম-উপহার।
শোভে তা'র শিরোদেশে প্রভাময় মণি,
তাহার আভায় খেলে বিজলী আপনি;
স্বভাব রঞ্জিত দেহ দেখিতে চিকণ,
উহাই, ললিত, তব ললিতা-রতন!
দেখিয়ে সুন্দর রূপ ভুলিবে পরাণ,
যখন করিবে তুচ্ছ পবিত্র সম্মান,
আদরেতে আলিঙ্গন করিবে হৃদয়,
বিষম দংশনে হ’বে জীবন সংশয়।
শ্যামল মেদিনীতলে মাঠের মাঝারে
শ্যাম দূর্ব্বাদল রাজে নবীন বাহারে।
বিহরে তাদের মাঝে চারু প্রজাপতি,
বিবিধ বরণ তনু মোহন মূরতি;
সহসা দেখিলে মনে হেন বোধ হয়,
সঞ্চরে কুসুম যেন নব শোভাময়।
দেখি সে অপূর্ব্ব রূপ বালক চপল,
ধরিতে তাহারে করে বিবিধ কৌশল;
যাইয়ে নীরব পদে—এই ধরে ধরে—
হায় রে অমনি উচ্চে শলভ বিহরে!
কোথায় রে পতগের চিকণ বরণ,
বৃথা পথ-ক্লেশে, হায়, ব্যথিল চরণ;
হ’ল না, হ’ল না মনে সেই সুখোদয়,
অবশেষে সকাতর নীরব হৃদয়!
যদি প্রজাপতি ধরে বালক চপল,
নিদারুণ স্বেচ্ছাচার তাহার সফল;
পতগের শিরোমণি সেই শোভাময়,
ধরিতে যাহারে এত আকুল হৃদয়,
হায় রে অঙ্গুলীপাতে সে হয় বিকৃত,
চিকণ বরণ তা’র হয় অপহৃত।
তেমনি রূপের রাশি ভুলায় লোচন,
ভুলাইয়েছিল, হায়, ললিতের মন;
তারো আঁখি কেঁদেছিল না পেয়ে প্রিয়ারে,
তামসী নিরাশা সদা দহেছিল তা’রে;—
বয়সে প্রবীণতর বালক চপল,
পতগ হইতে চারু নব শোভাদল!
নিজের প্রেমিকা তা’র পরের এখন,
হায় রে কোথায় পা’বে সুখ দরশন?
ফিরিল তরুণ তবে আঁধার হৃদয়,
আবার নয়ন পথে শলভ উদয়;
আবার তাহার তরে উৎসুক ধাবন,
মিলিল হৃদয়ে এবে রমণীরতন।
হইল রে দম্পতীর পাবন প্রণয়,
হয় নাই লোক-সিদ্ধ ছার পরিণয়!
মনের সে ভাব, যাহা সতত সমান,
হইবে না অপগত থাকিতে পরাণ;
বিপদে, সম্পদে, কিম্বা সাগরে, ভূধরে,
যাহা তার হৃদাগার আলোকিত করে;
সময়ে বিলুপ্ত যাহা কখন না হয়,
শত বরষেও তবু সমান হৃদয়;
যদি সে মনের ভাব হয় রে পাবন,
ছিল সেই ভাল বাসা বাসার মতন।
কি ছার মিছার বিয়ে, অসার, নীরস,
সাধের প্রণয় কি রে বাসনার বশ?
যখন নয়নে হ’ল নয়ন পতন,
তখনি বাসিল ভাল উভয়ের মন।
বহিল ললিত চিতে অমিয়ের ধারা,
ললিতা তাহার হ’ল নয়নের তারা।
সদাই অধরে হাসি, কে জানে কেমন
তদবধি হ’য়ে গেল ললিতের মন।
হইল জীবন মান ললিতা-আধার,
খুলে গেল নন্দনের ফুলময় দ্বার।
কে বলে ত্রিদিব রাজে আকাশ উপরে,
সুধার ভাণ্ডার আছে অমরনগরে?
কে বলে বিরাজে সুখ তাপস-হৃদয়ে,
নাচে বিদ্যাধরী শুধু বাসব-আলয়ে?
কে বলে রতন মিলে গভীর সাগরে,
ফোটে রে কমলকলি খালি সরোবরে?
হায় রে প্রেমিক, তব প্রফুল্ল হৃদয়
বিষাদের জগতের আনন্দ নিলয়!
তদবপি ললিতের অপূর্ব্ব ধরণ,
নীরব প্রেমিক মন মোহেতে মগন।
তদবধি পরিহরি প্রাসাদ সুন্দর,
বিজন বিহারে সুখী হইল অন্তর।
কভু বা নিকুঞ্জ মাঝে, কভু নদী তীরে,
প্রান্তরে, পর্ব্বত চূড়ে কভু ধীরে ধীরে
বেড়াইত, ভাবনাতে মানস মগন,
নাহিক বাহ্যিক জ্ঞান, পাগলের মন।
ভাবিত সে যুবতীর নবীন যৌবন—
কেন বা কলঙ্কী হ’ল গগনমোহন—
কেন বা রমণী হেরি ভুলে যায় প্রাণ,
হ’য়ে যাই সকলেই পাগল সমান;
ভাবিত সে কালিদাস স্বভাবের কবি—
প্রভাতের আরক্তিম তপনের ছবি—
মহাশ্বেতা—পুরূরবা—শচী—পারিজাত—
হস্তিনার নরেশের সকুলে নিপাত;
ভাবিত সে সরোবরে ফুটেছে কমল,
আর প্রিয়া ললিতার লোচন যুগল!
লিখিত নবীন ভাষা তরুর পাতায়,
তাহাই পড়িয়ে যেন জীবন জুড়ায়।
কহে যেন সমীরণ প্রেমের বচন,
আকুল শুনিতে তাহা প্রেমিকের মন।
সতত অন্তরে জাগে প্রেমের মূরতি,
শয়নে স্বপনে ভুলে কাহার শকতি?
হায় রে মধুর প্রেম, সাধের বালাই,
বিষদিগ্ধ সুধা তুমি “মধুমাখা ছাই”!
হয়েছিল যার তরে ললিত এমন,
উচাটিত—প্রেমাকুল—পাগল মতন,
সেই ললিতাও তা’রে প্রাণের সমান
বাসিত, করিয়াছিল হৃদয় প্রদান।
দিবসে রাজিত মনে সেই প্রেমময়,
নিশাতেও সেইরূপ শোভিত হৃদয়।
নিদ্রার আবেশে যবে স্বপনের কোলে,
কা’র প্রেম সুন্দরীর হৃদয়ে উজলে?
বলিত স্বপনাবেশে রসনা তাহার,
“কোথায় হৃদয়নাথ ললিত আমার।”
ভুবনে ললিত সখা পুরুষ রতন,
ভাল বাসিয়াছে তা’রে ললিতার মন;
হইলে নীলাভ নভে নীরদ উদয়,
কেন না বিজলী হ’বে আকুল হৃদয়?
এই সবে কামিনীর প্রথম যৌবন,
প্রভাত-আভায় পূর্ণ হৃদয়-ভূবন।
গিয়াছে সে হৃদয়ের শৈশবের ভাব,
দিয়াছে সেখানে দেখা যৌবন প্রভাব।
হাসিমুখে বিধুমুখ কমল সকল
প্রফুল্ল করেছে বক্ষ, লোচন, কপোল;
অপরূপ এক রবি হয়েছে উদয়—
প্রাণেশ ললিত উহ!—চিরপ্রেমময়!
কি চারু আনন খানি, কি চারু নয়ন,
ভুলায় হৃদয়, নহে কেবল লোচন।
হ’ত যদি সহকার প্রিয় প্রাণেশ্বর,
মাধবিকা ললিতার জুড়াত অন্তর।
নবীন রূপের রাশি, সৌন্দর্য্য-আধার,
অপূর্ব্ব মানস-জ্যোতি পূর্ণ প্রতিভার,
ললিতের সম কেহ আছে কি গো আর?
ভুলায় আকাশে চাঁদ চকোরের মন,
ভূতলে ললিত-চাঁদ জগত-রঞ্জন।
মধুর কাননে এক নিশীথ ভ্রমণ;
মধুর সরসীবুকে নীলাভ গগন;
মধুর হসিত-তারা চাঁদিনী নিদিন
তরণী-প্রমোদ, মরি, লহরী মালায়;
মধুর সে প্রেমপূর্ণ যুগল লোচন,
যে লোচন চাহে আমাদের আগমন,
আমাদের আগমনে হয় প্রফুল্লিত,
সুধার প্রবাহে যেন হয় প্রবাহিত;
মধুর কোকিলস্বরা কামিনীর গান,
শৈশবের চিরেপ্সিত মুরতিব ধ্যান;
মধুর নির্ঝর শব্দ, ভ্রমর গুঞ্জন,
বালকের আধ আধ অমিয় বচন;
মধুর প্রভাত কালে বিহঙ্গ সঙ্গীত,
মধুর তাহার চেয়ে প্রাণের ললিত।
আজি তা'রা—সেই নব প্রেমিক যুগল
ভুবনে অতুল দোঁহে প্রণয় বিহবল—
আজি তা’রা পাইয়াছে ঈপ্সিত মিলন,
জগতের সার ধন প্রেমের মিলন!
সে যুবতী, সেই বীর, ললিতা ললিত,
ধরণীর শিরোমণি, হয়েছে মিলিত—
পাইয়াছে সৌদামিনী প্রিয় জলধর,
পাইয়াছে মাধবিকা প্রিয় প্রাণেশ্বর।
খায় কি মধুপ মধু ত্যজিয়ে কমল,
আর কাহাকেও মধু দেয় শতদল?
যে যাহার, সে তাহার, কে করে খণ্ডন?
ললিতের ললিতাই, কে করে ভঞ্জন?
বসিল সরসীতীরে প্রেমিক দম্পতী,
পরস্পর কর ধরি—মধুর মুরতি!
হাসে তা’রা মধুময়, হাসে নীলাকাশ,
হাসিয়ে অনিল করে কুসুম বিকাশ;
কানন কুসুম হাসে, হাসে শশধর,
ধবল কিরণ পড়ে জলের উপর।
চতুর চপল চাঁদ, ললিতা বদন
চুম্বন করিতে করে কর-প্রসারণ;
পবন খেলিতে যায় পীন পয়োধরে,
সরমে ললিত বালা অম্বর সম্বরে।
বিকশিত ফুলগুলি নিরখে দুজনে,
নেহারে সহাস মুখে উজল গগনে;
কোকিলের কুহুরব করে আকর্ণন,
তরুর নাগর বেশ করে নিরীক্ষণ;
দেখিতে দেখিতে, মরি, অধর অধরে,
প্রেমের চুম্বন ঘন প্রেমের আদরে!
কে না বলে সুধাময় প্রেমের চুম্বন,
পরিতোষে মন প্রাণ, জুড়ায় জীবন?
দেখ গিয়ে, প্রেমময়ী জননীর কোলে
কুসুমকলিকা বালা হাসি হাসি দোলে;
চাহি চাহি তা’র পানে সতৃষ্ণ নয়ানে,
বসে আছে স্নেহময়ী প্রমোদ-পরাণে;—
ননীর পুতলী বালা মানস-বিকাশ,
প্রেমের প্রতিমা নারী সজীব সহাস—
দেখি তাহা বলিবে না তুমি কি কখন,
মধুময়, স্থধাময় প্রেমের চুম্বন?
প্রাণসমা প্রিয়তমা প্রেয়সীর পাশে
যখন বসিয়াছিলে প্রেমের উল্লাসে;
হেরিয়ে সে বিধুমুখে মধুমাথা হাসি,
বলেছিলে “প্রাণেশ্বরী, কত ভালবাসি;”
আহলাদেতে গদগদ প্রফুল্ল পরাণ,
যাপিয়াছ মুখনিশি চকোর সমান;
তখন কি বলে নাই তব মুগ্ধ মন,
মধুময়, স্থধাময় প্রেমের চুম্বন?
যখন পলিত হ’বে ললিত শরীর,
লোলিত হইবে গাত্র, শীতল রুধির;
প্রভাত হইয়ে যা'বে যৌবন তোমার,
তরুণ-সুলভ বৃত্তি থাকিবে না আর;
একে একে তিরোহিত হ’বে মিত্রগণ,
বাসনা-লহরী হ’বে নীরবে বহন;
থাকিবে না শৈশবের স্বভাব চপল,
থাকিবে না যৌবনের শরীর সবল;
ধরিবে গম্ভীর ভাব উদার চরিত,
সাধিবে হরষে যবে জগতের হিত;
একাকী তখন, বৃদ্ধ, করিবে স্মরণ
মধুময়, সুধাময় প্রেমের চুম্বন—
করিবে স্মরণ সেই লোহিত অধর,
জুড়ায়েছে যা’র বাণী তোমার অন্তর;
কম্পিত হৃদয় সেই সুখপ্রেমময়,
পরশিয়ে ছিল যাহা তোমার হৃদয়;
আর সেই ঘন, গাঢ় সুখের চুম্বন,
যাহাতে চেয়েছ তুমি তোমার মরণ!—
হায় রে এখন যদি ললিতা ললিত,
হইতে তোমরা দোঁহে সে সুখে নিদ্রিত,
যে নিদ্রার পরে আর নাহি জাগরণ,
নাহি আর সুখ দুখ জনম মতন!
আহা! সে হৃদয় ছিল শারদ গগন,
রাজে তাহে পূর্ণশশী ললিতা-বদন;
ফুটে আছে তারাগুলি বাসনা সফল,
দূরে গেছে নিরাশার জলদ সকল!
বিভোর অস্তরে করে প্রেম-আস্বাদন,
বিস্মৃতির সাগরেতে বিমগন-মন।
শোভিছে বদনখানি বুকের উপরে,
ললিতা বিকীর্ণ কেশে নব শোভা ধরে।
পৃথিবী হয়েছে শেষ, ত্রিদিব আগত,
সুখের ভবন এই, বিষাদ বিগত;
নাহিক এখানে আর অন্ত কোন ভাব,
বিনা সেই কামিনীর মুখময় ভাব!
কে জানে তুমি রে প্রেম, মধুর কেমন,
কিছুই বুঝিতে নারি কেমন রতন;—
নহ তুমি সুধাকর, জুড়াও পরাণ;
নহ তুমি সঞ্জীবনী, কর প্রাণ দান;
নহ তুমি শতদল, তাহাও শুকায়;
নহ সৌদামিনী, তাহ চকিতে মিলায়;
নহ তুমি রূপ, তাহা যৌবনের বশ;
নহ রে যৌবন সুখ, সময়ে নীরস;
মানুষ-হৃদয় নহ, তাহাও চপল;
স্বৰ্গীয়, কেন রে তবে উজল ভূতল?
তবে কি তুমি রে হেন কোন দিনমণি,
জগতের হরষের রতনের খনি,
যা’র চারি পাশে ঘোরে সুখের ধরণী?
তারুণ্যেতে তরুণীর তরল মুরতি
করে নাই বিমোহিত কা’র মুগ্ধ মতি?
রূপসীর কৃষ্ণসার-বিলোল লোচন
মোহিত করে নি কা’র মোহাতীত মন?
ভাবিনীর ভাবময় ভাবের প্রভাব
বিচলিত করে নাই কাহার স্বভাব?
কমনীয় সুকোমল কামিনী কমল
করে নাই কা’র প্রাণ-মধুপে চপল?
সুষমার সিংহাসনে কাহার পরাণ
সামুরাগ নিরীক্ষণ করে নাই দান?
চারু প্রফুল্লতাময় নবীন যৌবনে
নিজ মন ছবি কে গো দেখে নি নয়মে?
শোভাময়ী শোভনার সুশোভন হাসি,
স্বাভাবিক সরলতা পরাণ-উদাসী,
মনোহর পবিত্রতা করি দরশন,
পরিতোষ পায় নাই কাহার জীবন?
কেবল একটি নাম—সুমধুর নাম!
দেয় গো আনিয়ে করে সুখময় ধাম!
আহলাদে চন্দ্রমা শিশু নিরখে যেমন,
তেমনি ললিতা দেখে ললিত-বদন!
ছিল পৃথিবীর মাঝে এক শশধর,
সেই শশধর আজি বুকের উপর;
হাসে ধনী, হাসে দিশি, হাসে বসুমতী,
হাসিরি শোভাতে যেন আলো ত্রিজগতী!
যে সরের তীরে তা’রা বসিয়ে তখন,
তেমনি বিমল ছিল ললিতার মন,
তেমনি গভীর আর তেমনি উজল,
ঢল ঢল করে, যেন নীহারের জল;
ললিতের প্রতিবিম্ব পড়ে ছিল সরে,
ললিতের ছবি আঁকা ললিতা-অন্তরে;
কাণায় কাণায় জল, গম্ভীর সরসী,
প্রেমের সরল বেগে মুগুধা রূপসী।
যাহা দেখে, যাহা শুনে, যাহা ধ্যান করে,
ললিতের রূপ রাজে তাহারি ভিতরে;
আকাশ, পাতাল, আর সাগর, ভূধর,
তাদের মাঝারে, আহা, সে প্রেম-সাগর।
নহে গগনের শশী,—ললিত বদন;
সরসী কমল নহে,—সহাস-আনন।
বাজে না বীণার বাণী জুড়ায়ে পরাণ,—
প্রাণ সখা ললিতের মধুময় গান।
প্রথম প্রণয় ইহা অস্তিম প্রণয়,
নবীন ভাবেতে আজি মোহিত হৃদয়!
যত দিন দেহ মাঝে থাকিবে পরাণ,
যত দিন সে পরাণে থাকিবেক জ্ঞান,
তত দিন ললিতের মূরতি মোহন
জুড়াইবে দেহ প্রাণ, ভুলাইবে মন।
শরীর-আকাশে যবে যৌবন উদিল,
ভাবনা-মুকুরে এক রূপ দেখা দিল;
প্রাণ চোরা ললিতের সে চারু আকার,
প্রণয়নিলয় রূপ শোভার আধার।
পান করিবার তা’র যদি এ ধরাতে
ছিল কিছু, ছিল তাহ অধর সুধাতে;
ছিল যদি কোন বীণা করিতে শ্রবণ,
ছিল তাহা ললিতের অমিয় বচন;
ছিল যদি কোন শশী করিতে দর্শন,
ছিল তাহা ললিতের সহাস বদন;
ছিল যদি কোন নিধি করিতে ধেয়ান,
ছিল তাহা ললিতের প্রণয়-পরাণ;
ললিত, ললিত বিনা কোন কথা নাই,—
হায় রে সাধের প্রেম, বলিহারি যাই!
বাসিত ললিতা তা’রে হৃদয় সহিত,
তেমনি তাহারে সদা বাসিত ললিত;
তাহাই চাহিত বালা পৃথিবী ভিতরে,
পিরিতেও ছল আছে ভাবেনি অস্তরে।
ছিল আপনার মন যেমন কোমল,
দেখিত পরেরো মন তেমনি সরল;
জানিত সে ললিতের একপ্রাণেশ্বরী,
চাহিত না আর কিছু অধিক সুন্দরী।
আমি যা’রে ভাল বাসি, সে যদি বাসিত,
আমি যা’রে সদা ভাবি, সে যদি ভাবিত,
আমি যা’র তরে মরি, সে যদি মরিত,
তা হ’লে এ ভাবে কি রে যৌবন যাইত?
যাপিতাম চিরসুখে আনন্দের দিন,
প্রণয়-সাগরে, হায়, থাকিতাম লীন!
যে হৃদয় ভাল বাসে প্রাণের কামিনী,
রাজে সদা সে হৃদয়ে চাঁদিনী যামিনী;
বিরহ জ্বালায় সদা জ্বলে যে হৃদয়,
সে হৃদয়ে শশধর চিরতমোময়;
যে হৃদয় কিন্তু ভাল বাসে না কখন,
সতত ভীষণ তাহা আমার মতন;–
নাহি প্রেম-শশধর, নাহি কোন আশা,
সে নরকে নাহি সুখ, নাহি ভালবাসা!
কে না ভাল বাসিয়াছে প্রাণের কামিনী?
কে না ভাল বাসিয়াছে চাঁদিনী যামিনী?
কে বা ভাল না বাসিবে প্রেমিক হৃদয়,
শোভাময়—মুধাময়-পূর্ণচন্দ্রোদয়?
ছিল যেন এ ধরণী অমর-ভূবন,
সে উদ্যান তা’র মাঝে নন্দন কানন।
দেবলোকে মন্দাকিনী আনন্দে উছলে,
সে কানন প্রক্ষালিত ভাগীরথী জলে;
ননদনেতে প্রস্ফুটিত পারিজাত কুল,
সে কাননে বিকসিত জাতী যুর্থী ফু।
মরত-নন্দনে বয় ত্রিদিব-পবন,
প্রেমিক যুগল তাহে অমর মতন।
অয়ি শশি, তারাগণ, নীলাভ গগন,
সুমধুর-গন্ধবহ মলয় পবন,
অয়ি পবিত্রতাময় স্বচ্ছ সরোবর,
অয়ি প্রফুল্লিত-চিত কমল নিকর,
অয়ি তরুলতারাজি নিকুঞ্জ কানন,
অয়ি ফলপুষ্পচয় কানন-শোভন;
এস আজি আনন্দেতে মিলিয়ে সকলে,
দম্পতীয়ে অভিষিক্ত কর শাস্তিজলে,
যেন তাহাদের প্রেম-সুখ-শশধর
থাকিতে জীবন-নিশা না হয় অন্তর।
কে তুমি? সহসা আসি মানসে উদয়,
কেন রে আঁধার তুমি প্রেমিক হৃদয়?
কে তুমি? কে তুমি?—হায়, তুমি বঙ্গেশ্বর,
করেছ আঁধার কত প্রেমিক-অন্তর!
কত প্রেমিকার মন করিয়া নিরাশ,
করিয়াছ তাহাদের প্রাণেশ-বিনাশ;
অন্ধকার করি কত হৃদাকাশ-শশী,
হরিয়াছ তাহাদের প্রাণের প্রেয়সী;
কিছু মাত্র কর নাই কখন বিচার,
করেছ অবাধে যাহা বাসনা তোমার;
নাহি হিন্দু, মুসলমান, নাহিক খ্রীষ্টান,
সকলেই ছিল তব নিকটে সমান—
একচিত্তে সেধেছ সবারি সর্ব্বনাশ,
সে বিষয়ে ছিলে না ক কখন উদাস;
জগৎ, হোসেন, আর বণিক ইংরাজ,
কি না করিয়াছ তুমি তাদের, সিরাজ?
একদা তুমিই বঙ্গে ছিলে বঙ্গেশ্বর,
নরাধম, দুরাত্মন, পাষণ্ড, পামর!
অমনি অনলময় হ’ল মনাকাশ,
বহিল দুখের বায়ু বিষাদ-বাতাস!
জাগিল তাপিত প্রাণ সুপ্ত-বিষধর,
নাগরীর কর ধরি কহিল নাগরি:–
“হয়েছে রজনী বেশি, আসি প্রাণেশ্বরি!
শশীর মিলনে সুখে হাসে বিভাবরী;
প্রমদার প্রেম-সুখে হাসে নিশাকর,
কাঁদে রে অভাগা শুধু ললিত অন্তর!
আসি তবে—হয় বুঝি হৃদয় বিদার—
হয় ত আসিতে, প্রিয়ে, হ’বে না ক আর!
হয় ত ভেদিয়া বক্ষ সেই দুরাত্মার,
দেখিতে হ’বে না মুখ, ললিতে, তোমার!
এই দেখা শেষ দেখা—কেঁদ না, প্রেয়সি,—
ক্ষতি নাই, দেখে লই তব মুখশশী—
মরে যাই, বেঁচে থাকি, কিছু দুখ নাই,
সমরে পামরে হেরি, এই ভিক্ষা চাই;
তুমি মুখে রবে, প্রিয়ে,—অন্তিম প্রার্থনা;
মনে রেখো অভাগারে,—অন্তিম-বাসনা!
পশিয়াছে পলাশিতে নির্ভীক ইংরাজ,
কাঁপিতেছে কাপুরুষ নবাব সিরাজ।
কাঁপিতেছে-কাঁপিবারে হবে না ক আর—
আছে ললিতের এই তীক্ষ তরবার!
যখন হরিয়াছিলে ললিতা-রতন,
কাঁপিতে তখন যদি, তুমি দুরাত্মন,—
আর কেন সে কথায়?—দেখিবে এখন,
যে দেখা দেখিতে মনে কাঁপ অমুক্ষণ।
কাড়িয়াছ দন্তভরে প্রভাময় মণি,
জান না ছোবল আছে, আছে ভীম ফণী?
“আর তুমি বঙ্গভূমি ভীরুপ্রসবিনী,
বড় ভাল বাসি আমি তোমারে, জননি!
ভাল বাসি—বড় দুখ রহিল পরাণে,
নারিলাম উদ্ধারিতে;–ধিক্ এ জীবনে!
ছল এক দিন, দেবি, ছিল এক দিন,
ললিত ঘৃণি’ত যবে থাকিতে অধীন;
বাসনা করিত মনে তাড়াতে সিরাজে,
সাজাতে তোমারে, দেবি, স্বাধীনতা সাজে।
সে আশা বিফল হ’ল—ইংরাজ নৃপতি,—
ক্ষমা করো অভাজনে-অন্তিম মিনতি!
“কাতর হয়েছি—নহি জীবন-কাতর!—
মরিতে করে না ভয় সাহসী-অন্তর!
যেই কর করে, প্রিয়ে, প্রেম-আলিঙ্গন,
সেই কর করে শত্রু-মস্তক-ছেদন—
চাহি না রাখিতে কতু কাপুরুষ-প্রাণ,
থাকিতে এ বাহু আর শাণিত কৃপাণ!
বেঁচে থাকি দেখা হ’ৰে—আসি, প্রাণেশ্বরি,
মনে রেখে অভাগারে, ললিতা সুন্দরি!”
থামিল-চুমিল প্রেমে প্রিয়ার অধর,
নাগরীর কর ত্যজি ফিরিল নাগর।
ফিরিল নাগর!—হায়, ফিরি কত বার
আমরা যখন ভাবি ফিরিব না আর!—
বহিল নয়ন দিয়ে নয়ন-আসার!–
বহেছেও এ নয়নে বিষাদের ধার!
কত দিন বুক ফাটে এমন সময়
ফিরিয়ে এসেছি, হায়, বিকল হৃদয়!
সকলি মধুর প্রেমে সকলি সরস,
না হইতে হ'ত যদি বিরহ-বিবশ!
কে জানিত সুধার্ণবে উঠিৰে গরল?
কে জানিত সকণ্টক কোমল কমল?
কে জানিত রমণীর কপট হৃদয়?
কে জানে বিরহে বাঁধা সাধের প্রণয়?
পঞ্চাল-কুমারী কৃষ্ণা বিরাট-ভবনে,
ত্যজিয়া রজনী মাঝে পাচক-সদনে,
যেমন ফিরিয়াছিল, তেমনি ললিতা
ফিরিল কানন হ’তে প্রেম-বিষাদিতা।
সরোব-অন্তরে দুখে ভীম বীরবর
করে ছিল পণ, ধরি প্রেয়সীর কর,
নাশিতে কীচক দুষ্ট লম্পট-হৃদয়,
পাঞ্চালীর কণ্টকের করিতে বিলয়;
তেমনি করিল পণ ললিত কুমার,
ফিরিলি সরোষ-চিতে বিষাদ-আঁধার।
করে ছিল ভীমসেন কীচক নিধন,
টলমলে নবাবের রাজসিংহাসন।
বস তবে এই খানে বীণা বিনোদিনী,
থামুক এখানে তব প্রেমের কাহিনী।
বড় আদরের তুমি আমার যেমন,
তেমনি সবার হ’বে যতনের ধন?
হ’তে পার, হ’বে;—কিন্তু সতত আমার
থাকিবে, যেমন আছ, চিন্তার আধার।
গত হয় নাই মম কৌমার যখন,
তখনি তোমার প্রেমে মজিয়াছে মন।
তদবধি তোমারে বড়ই ভাল বাসি,
নিয়তির পরিবর্তে হয়েছি উদাসী।
করি না যশের আশা, ধনের কামনা,
তোমার প্রণয়ে মগ্ন সকল বাসনা।
বলিতাম সাহসেতে হ’লে চারুকর্ম্মা—
“উৎপৎস্যতেহস্তি মম কোহপি সমানধর্ম্মা।”
আর তুমি বিধুমুখী প্রেয়সি আমার,
ভাল আছ?—ভাল থাক, চাহি অনিবার!—
বহু দিন হেরি নাই তোমার বদন,
বহু দিন শুনি নাই সে বীণাবাদন—
শুনিব যে হেন আশা নাহি আর মনে,
ফুরায়েছে সব সুখ নবীন যৌবনে!
এই যদি ছিল মনে কেন ভাল বাসিলে!
কেন রে হৃদয়ে মম এ অনল জ্বালিলে!
আপনার ঘুমে ঘোর, আপনার প্রেমে ভোর,
ললিত যৌবন যবে হইল উদয়;
মৃদু মধু হাসি হাসি, বিতরি কিরণ রাশি,
তোমার সে মুখশশী বাজিল হৃদয়;
কেন, হায়, আচম্বিতে, আঁধারি কাতর চিতে,
মেঘাস্বরে কেন মোরে অস্তমিত করিলে,
এ ছার হৃদয়ে কেন এ অনল জ্বালিলে?
এখনো তোমার বাণী যেন শুনি কাণে,
শুনি সে ব্যাধের বাঁশী চকিত পরাণে;
স্বরপুরে স্রোতস্বর্তী, কুলুস্বরে মৃদুগতি,
এখনো হৃদয়ে বহে প্রেমের উজানে।
যতদিন এ পরাণ, থাকিবে, থাকিবে জ্ঞান,
ততদিন উজলিবে হৃদয়-আগার—
কেবল, প্রেয়সি, তুমি হ’বে না আমার!
হ’বে না আমার বলি যাব না ভুলিয়ে!
প্রাণ দিয়ে ভাল বেসে, কে ভুলেছে পরিশেষে?
যদিও পাষাণ হ’ব, যাব না ভুলিয়ে!
যদিও পাষাণ হ’ব, থাকিব তোমার;
অনন্ত সলিলে যবে, এ প্রাণ ভাসিয়ে যাবে,
তখনো ভাবিব, প্রিয়ে, মুরতি তোমার! –
তবুও কখন তুমি, হ’বে না আমার!
এক দিন হাসি হাসি, বলেছিলে ভালবাসি,
বলেছিলে প্রেমময়, তোমার পরাণ,
এ জগতে প্রিয়তম, প্রণয়নিধান।
ভাবিয়াছি সেই দিন দিনের মতন;
তব লাগি যে জীবন, কাঁদে দুখে অনুক্ষণ,
ভাবিয়াছি সে জীবন, সার্থক জীবন!
হায় রে ফুরাল কেন সাধের স্বপন?
ফেলি মোরে এ প্রান্তরে, বিশ্ব মরুময় করে’,
কেন রে উবিল সেই মায়ার কানন?
কোথা সুখ-শশধর, কোথা প্রেম-সরোবর,
কোথা, কুহকিনি, তুমি করিলে পয়ান?—
সব যদি গেল, কেন গেল না পরাণ?
তাই যদি হ’বে, তবে কে সহিবে যাতনা?
সহিয়ে বিরহ ভার, জ্বলিবে হৃদয় কার,
তুমি, কুহকিনি, দেবে কার মনে বেদনা?
সহিতে জনম যার, কোথা আর সুখ তার?
আকাশ, পাতাল, আর ভূধর, সাগরে,
সকলি সহিতে তারে হইবে অন্তরে!
সকলি সহিতে হ’বে,—সয়েছি সকল;
সকল সয়েও মন হয় নি বিকল।
সকলি সহিতে পারি, কেবল সহিতে নারি,
তোমার বিরাগ বাণ, প্রেয়সি আমার।
কেমনে সে বাহুদ্বয়, বিদারিল এ হৃদয়,
যে বাহু দিয়েছে গলে প্রেম-হেমহার?—
কেমনে হ’ল রে তাহা বিষের সদন?
হায় রে শেষেতে এই হইল ঘটন,
দুজনে বাঁচিয়ে র’ব, কিন্তু এ জীবনে
হ’বে না, হ’বে না দেখা প্রেমের মিলনে?
কেমনে আবার, শশি, উদিবে গগনে,
কেমনে তোমার মুখ হেরিব নয়নে?
বসিয়ে তোমার করে, দুই জনে একান্তরে,
কত নিশি যাপিয়াছি, নাহি কোন ভাবনা,
যে যাতনা আজি প্রাণে, ছিল না সে যাতনা।
এখন কি করে’, শশি, হেরিব তোমায়,
আমার সে নিশি, শশি, এখন কোথায়?
সেই দেখা, মায়াবিনি, শেষ দেখা তবে,
আর দেখা হ’বে না ক বাঁচিতে এ ভবে।
সুখে থাক!—ভুলায়ো না আর কারো মন,
জ্বলিবে সে জন, হায়, আমার মতন!
যেমন তোমার মুখ, হেরিলে উথলে সুখ,
তেমনি কখন যদি হ’ত তব মন,
তা’ হ’লে কি হইতাম হতাশ এমন?
হায় রে মনের আশা মনেতেই রহিল,
আমার প্রেয়সী, হায়, আমার না হইল!