লিপিকা


পায়ে চলার পথ

 এই ত পায়ে চলার পথ।

 এসেছে বনের মধ্যে দিয়ে মাঠে, মাঠের মধ্যে দিয়ে নদীর ধারে, খেয়া-ঘাটের পাশে বটগাছ-তলায়। তার পরে ওপারের ভাঙা ঘাট থেকে বেঁকে চলে গেছে গ্রামের মধ্যে; তার পরে তিসির ক্ষেতের ধার দিয়ে, আমবাগানের ছায়া দিয়ে, পদ্ম-দিঘির পাড় দিয়ে, রথতলার পাশ দিয়ে কোন্ গাঁয়ে গিয়ে পৌঁছেচে জানিনে।

 এই পথে কত মানুষ কেউবা আমার পাশ দিয়ে চলে গেছে, কেউবা সঙ্গ নিয়েচে, কাউকে বা দূর থেকে দেখা গেল; কারো বা ঘোম্‌টা আছে, কারো বা নেই; কেউবা জল ভর্‌তে চলেছে, কে,বা জল নিয়ে ফিরে এল।

 এখন দিন গিয়েছে, অন্ধকার হয়ে আসে।

 একদিন এই পথকে মনে হয়েছিল আমারই পথ, একান্তই আমার; এখন দেখ্‌চি কেবল একটিবার মাত্র এই পথ দিয়ে চল্‌বার হুকুম নিয়ে এসেচি, আর নয়।

 নেবুতলা উজিয়ে সেই পুকুরপাড়, দ্বাদশ দেউলের ঘাট, নদীর চর, গোয়াল-বাড়ি, ধানের গোলা পেরিয়ে সেই চেনা চাউনি, চেনা কথা, চেনা মুখের মহলে আর একটিবারও ফিরে গিয়ে বলা হবে না, “এই-যে!” এ পথ যে চলার পথ, ফেরার পথ নয়।

 আজ ধূসর সন্ধ্যায় একবার পিছন ফিরে তাকালুম; দেখ্‌লুম, এই পথটি বহুবিস্মৃত পদচিহ্নের পদাবলী, ভৈরবীর সুরে বাঁধা।

 যত কাল যত পথিক চলে গেছে তাদের জীবনের সমস্ত কথাকেই এই পথ আপনার একটি মাত্র ধূলিরেখায় সংক্ষিপ্ত করে এঁকেচে; সেই একটি রেখা চলেচে সূর্য্যোদয়ের দিক্‌ থেকে সূর্য্যাস্তের দিকে, এক সোনার সিংহদ্বার থেকে আরেক সোনার সিংহদ্বারে।

 “ওগো পায়ে-চলার পথ, অনেক কালের অনেক কথাকে তোমার এই ধূলি-বন্ধনে বেঁধে নীরব করে রেখোনা। আমি তোমার ধুলোয় কান পেতে আছি, আমাকে কানে-কানে বলো।”

 পথ নিশীথের কালো পর্দ্দার দিকে তর্জ্জনী বাড়িয়ে চুপ করে থাকে।

 “ওগো পায়ে-চলার পথ, এত পথিকের এত ভাবনা, এত ইচ্ছা, সে-সব গেল কোথায়?”

 বোবা পথ কথা কয় না। কেবল সূর্য্যোদয়ের দিক থেকে সূর্য্যাস্তের দিক পর্য্যন্ত ইসারা মেলে’ রাখে।

 “ওগো পায়ে চলার পথ, তোমার বুকের উপর যেসমস্ত চরণপাত একদিন পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়েছিল আজ তারা কি কোথাও নেই?”

 পথ কি নিজের শেষকে জানে, যেখানে লুপ্ত ফুল আর স্তব্ধ গান পৌঁছল, যেখানে তারার আলোয় অনির্ব্বাণ বেদনার দেয়ালি-উত্‍‌সব হচ্চে?