লিপিকা/পুনরাবৃত্তি
সেদিন যুদ্ধের খবর ভাল ছিল না। রাজা বিমর্ষ হয়ে বাগানে বেড়াতে গেলেন।
দেখতে পেলেন প্রাচীরের কাছে গাছতলায় বসে খেলা কর্চে একটি ছোট ছেলে, আর একটি ছোট মেয়ে।
রাজা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি খেল্চ?”
তারা বল্লে, “আমাদের আজকের খেলা রামসীতার বনবাস।”
রাজা সেখানে বসে গেলেন।
ছেলেটি বল্লে, “এই আমাদের দণ্ডক বন, এখানে কুটীর বাঁধচি।”
সে একরাশ ভাঙা ডালপালা খড় ঘাস জুটিয়ে এনেচে, ভারি ব্যস্ত।
আর মেয়েটি শাক-পাতা নিয়ে খেলার হাঁড়িতে বিনা আগুনে রাঁধচে; রাম খাবেন, তারি আয়োজনে সীতার একদণ্ড সময় নেই।
রাজা বললেন, “আর ত সব দেখচি, কিন্তু রাক্ষস কোথায়?”
ছেলেটীকে মানতে হল তাদের দণ্ডক বনে কিছু কিছু ত্রুটি আছে।
রাজা বললেন, “আচ্ছা, আমি হ’ব রাক্ষস।”
ছেলেটি তাঁকে ভাল করে দেখলে। তার পরে বললে, “তোমাকে কিন্তু হেরে যেতে হবে।”
রাজা বললেন, “আমি খুব ভাল হারতে পারি। পরীক্ষা করে দেখ।”
সেদিন রাক্ষসবধ এতই সুচারুরূপে হতে লাগল যে, ছেলেটি কিছুতে রাজাকে ছুটি দিতে চায় না। সেদিন এক বেলাতে তাকে দশ বারোটা রাক্ষসের মরণ একলা মর্তে হল। মর্তে মর্তে হাঁপিয়ে উঠলেন।
ত্রেতাযুগে পঞ্চবটীতে যেমন পাখী ডেকেছিল সেদিন সেখানে ঠিক তেমনি করেই ডাকতে লাগল। ত্রেতাযুগে সবুজ পাতায় পর্দ্দায় পর্দ্দায় প্রভাত আলো যেমন কোমল ঠাটে আপন সুর বেঁধে নিয়েছিল আজও ঠিক সেই সুরই বাঁধলে।
রাজার মন থেকে ভার নেমে গেল।
মন্ত্রীকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা কর্লেন, “ছেলে মেয়ে দুটি কার?”
মন্ত্রী বললে, “মেয়েটি আমারই, নাম রুচিরা। ছেলের নাম কৌশিক, ওর বাপ গরীব ব্রাহ্মণ, দেবপূজা করে দিন চলে।”
রাজা বললেন, “যখন সময় হবে এই ছেলেটির সঙ্গে ঐ মেয়ের বিবাহ হয় এই আমার ইচ্ছা।”
শুনে মন্ত্রী উত্তর দিতে সাহস করলে না, মাথা হেঁট করে রইল।
দেশে সব চেয়ে যিনি বড় পণ্ডিত রাজা তার কাছে কৌশিককে পড়তে পাঠালেন। যত উচ্চ বংশের ছাত্র তার কাছে পড়ে। আর পড়ে রুচিরা।
কৌশিক যেদিন তাঁর পাঠশালায় এল সেদিন অধ্যাপকের মন প্রসন্ন হল না। অন্য সকলেও লজ্জা পেলে। কিন্তু রাজার ইচ্ছা।
সকলের চেয়ে সঙ্কট রুচিরার। কেন না, ছেলেরা কানাকানি করে। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়, রাগে তার চোখ দিয়ে জল পড়ে।
কৌশিক যদি কখনো তাকে পুঁথি এগিয়ে দেয়, সে পুঁথি ঠেলে ফেলে। যদি তাকে পাঠের কথা বলে সে উত্তর করে না।
রুচির প্রতি অধ্যাপকের স্নেহের সীমা ছিল না। কৌশিককে সকল বিষয়ে সে এগিয়ে যাবে এই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা, রুচিরও সেই ছিল পণ।
মনে হল সেটা খুব সহজেই ঘটবে, কারণ, কৌশিক পড়ে বটে কিন্তু এক মনে নয়। তার সাঁতার কাটতে মন, তার বনে বেড়াতে মন, সে গান করে, সে যন্ত্র বাজায়।
অধ্যাপক তাকে ভর্ৎসনা করে'’ বলেন, “বিদ্যায় তোমার অনুরাগ নেই কেন?”
সে বলে, “আমার অনুরাগ শুধু বিদ্যায় নয়, আরো নানা জিনিষে।”
অধ্যাপক বলেন, “সে সব অনুরাগ ছাড়।”
সে বলে, “তাহলে বিদ্যার প্রতিও আমার অনুরাগ থাকবে না।”
এমনি করে কিছুকাল যায়।
রাজা অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার ছাত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে?”
অধ্যাপক বললেন, “রুচিরা।”
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “আর কৌশিক?”
অধ্যাপক বললেন, “সে যে কিছুই শিখেচে এমন বোধ হয় না।”
রাজা বললেন, “আমি কৌশিকের সঙ্গে রুচির বিবাহ ইচ্ছা করি।”
অধ্যাপক একটু হাসলেন, বললেন, “এ যেন গোধূলীর সঙ্গে ঊষার বিবাহের প্রস্তাব।”
রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, “তোমার কন্যার সঙ্গে কৌশিকের বিবাহে বিলম্ব উচিত নয়।”
মন্ত্রী বললে, “মহারাজ, আমার কন্যা এ বিবাহে অনিচ্ছুক।”
রাজা বললেন, “স্ত্রীলোকের মনের ইচ্ছা কি মুখের কথায় বোঝা যায়?”
মন্ত্রী বললে, “তার চোখের জলও যে সাক্ষ্য দিচ্চে।”
রাজা বললেন, “সে কি মনে করে কৌশিক তার অযোগ্য।”
মন্ত্রী বললেন, “হাঁ, সেই কথাই বটে।”
রাজা বললেন, “আমার সামনে দুজনের বিদ্যার পরীক্ষা হোক। কৌশিকের জয় হলে এই ৰিবাহ সম্পন্ন হবে।”
পরদিন মন্ত্রী রাজাকে এসে বললে, “এই পণে আমার কন্যার মত আছে।”
বিচারসভা প্রস্তুত। রাজ সিংহাসনে বসে’, কৌশিক র্তার সিংহাসনতলে।
স্বয়ং অধ্যাপক রুচিকে সঙ্গে করে উপস্থিত হলেন। কৌশিক আসন ছেড়ে উঠে’ তাকে প্রণাম ও রুচিকে নমস্কার করলে। রুচি দৃকপাত করল না।
কোনোদিন পাঠশালার রীতি পালনের জন্যেও কৌশিক রুচির সঙ্গে তর্ক করে নি। অন্ত ছাত্রেরাও অবজ্ঞা করে তাকে তর্কের অবকাশ দিত না। তাই আজ যখন তার যুক্তির মুখে তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ তীরের ফলায় আলোর মত ঝিকমিক করে উঠল তখন গুরু বিস্মিত হলেন, এবং বিরক্ত হলেন। রুচির কপালে ঘাম দেখা দিল, সে বুদ্ধি স্থির রাখতে পারলে না। কৌশিক তাকে পরাভবের শেষ কিনারায় নিয়ে গিয়ে তবে ছেড়ে দিলে।
ক্রোধে অধ্যাপকের বাকরোধ হল, আর রুচির চোখ দিয়ে ধারা বেয়ে জল পড়তে লাগল।
রাজা মন্ত্রীকে বললেন, “এখন বিবাহের দিন স্থির কর।”
কৌশিক আসন ছেড়ে উঠে জোড় হাজে রাজাকে বললে, “ক্ষমা করবেন, এ বিবাহ আমি করব না।”
রাজা বিস্মিত হয়ে বললেন, “জয়লব্ধ পুরস্কার গ্রহণ করবে না?”
কৌশিক বললে, “জয় আমারই থাক পুরস্কার অন্তের হোক।”
অধ্যাপক বললেন, “মহারাজ আর এক বছর সময় তার পরে শেষ পরীক্ষা।”
সেই কথাই স্থির হল।
কৌশিক পাঠশালা ত্যাগ করে গেল। কোনোদিন সকালে তাকে বনের ছায়ায় কোনোদিন সন্ধ্যায় তাকে পাহাড়ের চূড়ার উপর দেখা যায়।
এদিকে রুচির শিক্ষায় অধ্যাপক সমস্ত মন দিলেন। কিন্তু রুচির সমস্ত মন কোথায়?
অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে বললেন, “এখনো যদি সতর্ক না হও তবে দ্বিতীয় বার তোমাকে লজ্জা পেতে হবে।”
দ্বিতীয় বার লজ্জা পাবার জন্যেই যেন সে তপস্যা করতে লাগল। অপর্ণার তপস্যা যেমন অনশনের, রুচির তপস্যা তেমনি অনধ্যায়ের। ষড়দর্শনের পুঁথি তার বন্ধই রইল, এমন কি, কাব্যের পুথিও দৈবাৎ খোলা হয়।
অধ্যাপক রাগ করে’ বললেন, “কপিল কণাদের নামে শপথ করে’ বলচি আর কখনো স্ত্রীলোক ছাত্র নেব না। বেদবেদান্তের পার পেয়েচি, স্ত্রীজাতির মন বুঝতে পারলেম না।”
একদা মন্ত্রী এসে রাজাকে বললে, “ভবদত্তর বাড়ি থেকে কন্যার সম্বন্ধ এসেচে। কুলে শীলে ধনে মানে তারা অদ্বিতীয়। মহারাজের সম্মতি চাই।”
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “কন্যা কি বলে?”
মন্ত্রী বললে, “মেয়েদের মনের ইচ্ছা কি মুখের কথায় বোঝা যায়?”
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “তার চোখের জল আজ কি রকম সাক্ষ্য দিচ্চে?”
মন্ত্রী চুপ করে রইল।
রাজা তার বাগানে এসে বসলেন। মন্ত্রীকে বললেন, “তোমার মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।”
রুচিরা এসে রাজাকে প্রণাম করে দাঁড়ালে।
রাজা বললেন, “বৎসে, সেই রামের বনবাসের খেলা মনে আছে?”
রুচিরা স্মিতমুখে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
রাজা বললে “আজ সেই রামের বনবাস খেলা আর একবার দেখ্তে আমার বড় সাধ।”
রুচিরা মুখের একপাশে আঁচল টেনে চুপ করে রইল।
রাজা বললেন, “বনও আছে রামও আছে, কিন্তু শুনচি, বৎসে, এবার সীতার অভাব ঘটেচে। তুমি মনে করলেই সে অভাব পূরণ হয়।”
রুচিরা কোন কথা না বলে’ রাজার পায়ের কাছে নত হয়ে প্রণাম করলে।
রাজা বল্লেন, “কিন্তু বৎসে, এবার আমি রাক্ষস সাজ্তে পারব না।”
রুচিরা স্নিগ্ধ চক্ষে রাজার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
রাজা বললেন, “এবার রাক্ষস সাজ্বে তোমাদের অধ্যাপক।”