লেখকের কথা/প্রগতি সাহিত্য
প্র গ তি সা হি ত্য
১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে সংঘের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন হয়। দীর্ঘ চার বছর পরে বর্তমান চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। দুটি সম্মেলনের মধ্যে এই দীর্ঘ ব্যবধান ঘটার প্রধান কারণ আমাদের অর্থাৎ সংঘের পরিচালকদের দুর্বলতা। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পক্ষে এরূপ সম্মেলনের গুরুত্ব আমরা সঠিক অনুভব করতে পারিনি, এবং এই অক্ষমতা এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শগত অনচ্ছতা থেকে। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, বাস্তব অবস্থা সম্মেলন আহ্বান করার অতিশয় প্রতিকূল ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার প্রচণ্ড আঘাতে ও বঙ্গবিভাগের ফলে আমাদের সংগঠন একরকম ভেঙে যায়। শাখাগুলির সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। বহু শাখার অস্তিত্ব লোপ পায়। কেন্দ্রের কার্যকলাপও বহুদিন বন্ধ রাখতে হয়। এ আঘাত সামলে উঠতে না উঠতে শুরু হয়ে যায় প্রতিক্রিয়ার হিংস্র আক্রমণ।
বাস্তব বাধা ও অসুবিধাগুলির গুরুত্ব কিছুমাত্র অস্বীকার না করেও বলা যায়, এই সব বাধা ও অসুবিধা অতিক্রম করে অনেক আগেই আন্দোলনের আয়োজন করা অসম্ভব ছিল না। দাঙ্গাহাঙ্গামার জন্য কেবল ১৯৪৬ সালে সম্মেলন সম্ভব ছিল না, পরের বছর সম্মেলন আহ্বান করা যেতো। প্রকৃতপক্ষে, ১৯৪৭ সালে সম্মেলন ডাকা সম্পর্কে আলোচনা ও প্রাথমিক পরিকল্পনা স্থির হয়—সংঘের সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বুলেটিনে বাংলা শাখার রিপোর্টে এই পরিকল্পনার উল্লেখ আছে। প্রতিক্রিয়ার সরকারী ও বেসরকারী আক্রমণও এতদিন সম্মেলন না ডাকার অনিবার্য কারণ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না। প্রতিক্রিয়ার বেসরকারী আর্তনাদ এখন তীক্ষ্ণতর, এবং সরকারী দমননীতি তীব্রতর হয়েছে এবং আমরা এই সম্মেলনের আয়োজনও করেছি।
সুতরাং সম্মেলন এই ১৯৪৯-এ পিছিয়ে আনার প্রধান দায়িত্ব সংঘের পরিচালকমণ্ডলীর। বলা বাহুল্য, যুগ্মসম্পাদক দু'জন এ বিষয় সকলের চেয়ে বেশি দায়ী।
আজ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আমাদের অন্যান্য ভুলভ্রান্তির মতো এই নিষ্ক্রিয়তার মূল উৎস হচ্ছে, বর্তমান জগতের বাস্তব পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের দ্বিধা-সংশয়হীন সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। আদর্শগত দ্বিধাসংশয় দেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শক্তির বিরাট অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে।সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে আমরা প্রগতির ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে এনেছি সত্য, কিন্তু এগিয়েছি আমরা দ্বিধাগ্রস্তভাবে, বাস্তবতার দ্রুত রূপান্তরের অনেকখানি পিছনে পিছনে। আদর্শ ও বাস্তবের সমন্বয় করতে, সত্যোপলব্ধির আলোতে আজকের দিনে প্রগতিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের লক্ষ্য কি, কর্তব্য কি, এ বিষয়ে দ্বিধাহীন, আপোষহীন শাণিত তীক্ষ্ণ আহ্বান, সংঘ দিতে পারেনি।
সংঘের গত কয়েক বছরের ইতিহাস সমগ্র দৃষ্টিতে বিচার করলে এই দুর্বলতার সুস্পষ্ট চেহারা এবং এই দুর্বলতা সত্ত্বেও, প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও আন্দোলনের অভূতপূর্ব প্রসার আমাদের কাছে ধরা পড়ে।
যুদ্ধের সময় সংঘের ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের প্রসার লাভ ও শক্তিশালী বৃহৎ সংগঠন গড়ে ওঠা, বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে সংঘটিত হয়। এই সাফল্যের একটি বিশেষ তাৎপর্য আজ আমাদের লক্ষ্য করা প্রয়োজন। ১৯৪৪ সালের গোড়ার দিকে সংঘের কেন্দ্রীয় শাখার সভ্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৭৫ জন—এক বছরের মধ্যে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৪২ জন; সংঘের শাখা ছিল মাত্র ২টি, বাংলার বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় ১৪টি শাখা গড়ে ওঠে।
কেন্দ্র ও শাখাগুলির মোট সভ্যসংখ্যা হাজারের উপরে উঠে যায়। কলিকাতা ও মফঃস্বলে বহু সাংস্কৃতিক সভা, শিল্প-সাহিত্য ও সমাজ-জীবনের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা, পুস্তক প্রকাশ, লাইব্রেরী পরিচালনা প্রভৃতি নানা কাজের মধ্যে আন্দোলন অসাধারণ শক্তি সঞ্চয় করে।
কেবল বাংলায় নয়, সারা ভারতে ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সংঘের সর্বভারতীয় বিরাট সংগঠন গড়ে ওঠে।
এই অসাধারণ সাফল্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই, আদর্শ ও আন্দোলন সম্পর্কিত একটি সহজ সত্যই আরেকবার প্রমাণিত হয়েছিল এই সাফল্যের মধ্যে যে, আদর্শ ও সংগঠন পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। আদর্শে খুঁত থাকবে, অথচ সংগঠন নিখুঁত হবে, বা সংগঠনে খুঁত রেখেও নিখুঁত আদর্শ সার্থক হবে, এটা অসম্ভব। আদর্শ ও সংগঠন বা আন্দোলন পরস্পরের পরিপোষক ও পরিপূরক; অবিচ্ছিন্ন, অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সমাজ-জীবন ও শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্কে মার্ক্ সিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি কি তখন আমাদের নিখুঁত ছিল? আজকের চেয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল শিল্পী ও সাহিত্যিকের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে? তা নয়, দৃষ্টি তখন আমাদের অনেকখানি ঝাপ্সাই ছিল, আদর্শগত সমগ্রতার দিক থেকে।
কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে, পৃথিবীব্যাপী সংকটের সীমাবদ্ধ বাস্তবতায় আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল নির্ভুল। সোভিয়েটের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী সংগ্রাম চলার সময় প্রগতিবাদী শিল্পী ও সাহিত্যিকের একমাত্র কর্তব্য সুনির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল—তার সবটুকু সৃৃৃজনীশক্তি দ্বিধাহীন চিত্তে ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ সাধনে প্রয়োগ করা।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় ১৯৪৫ সালে তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনে, ফ্যাসি-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ নাম পরিবর্তন করে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ নাম রাখা হয়। পরিবর্তিত অবস্থায় আমাদের আদর্শগত সামগ্রিক ও সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ক্রমে ক্রমে জরুরী হয়ে ওঠে। শিল্প ও সাহিত্যের ফর্ম কণ্টেণ্ট থেকে শুরু করে সামাজিক ভূমিকা পর্যন্ত নানা বিষয়ে, এত প্রশ্ন ও সংশয়ের সম্মুখীন আমাদের হতে হয় যে, মার্ক্সবাদের বিজ্ঞানসম্মত বিচারের ভিত্তিতে প্রগতি আন্দোলনের নির্ভুল ও সর্বাঙ্গীন আদর্শ স্থির করা অপরিহার্য হয়ে দাড়ায়।
এই চেতনার তাগিদে, সংঘের বিভিন্ন সভার ও সাপ্তাহিক বুধবারের বৈঠকে এবং ‘পরিচয়’ ও অন্যান্য প্রগতিবাদী পত্রিকায়, বক্তৃতা, আলোচনা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে সঠিক মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা আরম্ভ হয়। শিল্পী সাহিত্যিক ও সংঘের অন্যান্য সভ্যদের বড় একটি অংশের মধ্যে আদর্শের দিকটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলার জন্য বিশেষ আগ্রহ এবং উৎসাহ দেখা যায়। দৃষ্টিভঙ্গির ক্রমবিকাশের সঙ্গে এই আগ্রহ ও উৎসাহ। অন্যদিকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে সাফ করার এই আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যে বুর্জোয়া মনোবৃত্তি সম্পন্ন সুবিধাবাদী কিছু কিছু শিল্পী সাহিত্যিকের মানসিক দৈন্য প্রকট হয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে সংঘ থেকে সরে গিয়ে এঁরা প্রগতি-বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
শিল্প ও সাহিত্যের থিয়োরীর দিকটা সম্পর্কে আমাদের এই ঝোঁক, অপ্রয়োজনীয় বুদ্ধিবিলাস ছিল না, এদিকে আরও বেশি সক্রিয়তা ও উৎসাহেরই বরং প্রয়োজন ছিল। আর্ট ও সমাজ সম্পর্কে সঠিক মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার এই অভিযানের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এক নিষ্ঠুর সত্য—বিদেশী শাসক কত যত্ন আর অধ্যবসায়ের সঙ্গে তার পদানত দেশের মানুষগুলির চিন্তাজগতে, পুরনো মৃত যুগের কত বিভ্রান্তির জঞ্জালকে, কত অন্ধ সংস্কারকে জীইয়ে রাখে—স্বাধীন দেশে কালের গতির সঙ্গে আপনা থেকে যা ধুয়ে মুছে যায়।
আমাদের মানসজগতের ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণে সযত্নে রক্ষা করা বহু সংস্কার ও বিশ্বাসের মূলগুলি উপড়ে ফেলার জন্য, থিয়োরী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অফুরন্ত প্রয়োজন আছে। আমাদের ত্রুটি এদিকে ঘটেনি, আমাদের ভুল হয়েছে অন্যদিকে। দেশে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তর অবস্থার দ্রুত রূপান্তর সম্পর্কে একেবারে উদাসীন না থাকলেও, এদিকে যতখানি মনোযোগ দেওয়া, এই বাস্তবতাকে যতখানি গুরুত্ব দেওয়া একান্তভাবে জরুরী ছিল, আমরা তা দিইনি। আমাদের গলদ থেকে গিয়েছিল—প্রতি পদক্ষেপে বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে না দিলে আদর্শগত বিভ্রান্তি বা মোহ থেকে যে মুক্ত থাকা যায় না—এই সহজ সত্যের উপলব্ধিতে। | শ্রেণীসংগ্রাম, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী ভূমিকা এবং সোভিয়েটের নেতৃত্বে জগতে ধনতন্ত্রের অবসান ও নূতন সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা, এদেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর, প্রগতিশীল ভূমিকা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার শিবিরে যোগদান —এই সব সত্যকে সচেতনভাবে গ্রহণ করেও, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই সব সত্যের বাস্তব অভিব্যক্তি যে এক হওয়া উচিত, সে বিষয়ে আমাদের বিভ্রান্তি থেকে গিয়েছিল। সমস্ত জগৎ দুটি বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও যে তার প্রতিফলন ঘটবে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার একইরূপ আপোষহীন সংঘাতের মধ্যে, প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে চেপে মারার বহুরূপী প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন অভিযান প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকবে—এ বিষয়ে আমরা সম্পুর্ণ সচেতন হতে পারিনি।
আমরা তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে পুরনো ধারার জের টেনে এসেছি। শ্রমিক ও বিপ্লবী জনসাধারণের নূতন সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজে এগোতে এগোতেও বজায় রাখতে চেয়েছি বুর্জোয়া জগতের সঙ্গে ভাবগত আত্মীয়তা। আমরা যে সচেতনভাবে, সক্রিয়ভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে একমাত্র শ্রমিকশ্রেণী ও বিপ্লবী জনসাধারণের পক্ষে, সোভিয়েটের পক্ষে,—দৃঢ় কণ্ঠে একথা ঘোষণা করতে আমরা ইতস্তত করেছি।
সংঘ এদিকে যেমন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মধ্যে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বজায় রেখে অগ্রসর হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি এই দ্বিধাগ্রস্ততার পরিচয়ও দিয়ে এসেছে।
দাঙ্গাহাঙ্গামা যখন প্রচণ্ডতম হয়ে দাঁড়ায়, তখন কিছুদিন ছাড়া সংঘ কোনদিনই নিষ্ক্রিয় থাকেনি। সংঘের সাধারণ নিয়মিত কাজের মধ্যে সোমেন চন্দ লাইব্রেরী ও পাঠাগার পরিচালনা, এবং বুধবারের বৈঠক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য বহু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের আহ্বানে, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বক্তা পাঠাবার ব্যবস্থাও সংঘ বরাবর করে এসেছে। দাঙ্গার সময়, সংঘের উদ্যোগে ও পরিচালনায় শিল্পী ও সাহিত্যিকদের বিরাট দাঙ্গা-বিরোধী অভিযান গঠন এবং শ্রমিকশ্রেণীর দাঙ্গা-বিরোধী চেতনাকে শিল্পে সাহিত্যে, চিত্র ও রচনার মধ্যে রূপায়ণ, এবং শিল্পী সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ সভা ও শোভাযাত্রায় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি দেওয়া, আমাদের সংঘের পক্ষেই সম্ভব ছিল। এই সময় (১৯৪৬) বঙ্গীয় সংস্কৃতি পরিষদ স্থাপনের প্রচেষ্টা করা হয়। অপর দিকে ১৯৪৭-এর পনেরোই আগস্ট ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে, সর্বদলীয় শিল্পী সাহিত্যিকদের সাংস্কৃতিক ঐক্যমূল্য দিতে বিরাট সভার অনুষ্ঠান করে, শ্রেণীস্বার্থে বিভক্ত জগতে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবাস্তব ও অসম্ভব সর্বদলীয় ঐক্যের প্রতি মোহের পরিচয়ও সংঘ দিয়েছিল। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দুটি বিরোধী ধারাও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে, রাজনীতির ক্ষেত্রে তথাকথিত স্বাধীনতা পাওয়া সম্পর্কে শ্রমিক ও জনসাধারণের মোহভঙ্গের প্রতিক্রিয়া শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দুটি ধারায় বিরোধীরূপ,— প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল রূপ—প্রকট হয়ে ওঠে। ‘আর্ট ফর আর্ট্স সেক’-এর পন্থী শিল্পী ও সাহিত্যিকের নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী কয়েকজন নামকরা ব্যক্তির সঙ্গে, সংঘের প্রগতিবাদী সভ্যদের মতের সংঘাত তীব্র হয়ে ওঠে। সংঘ দৃঢ়তার সঙ্গে এই ভ্রান্তমতের বিরোধিতা করে। প্রগতিবিরোধী এই সাহিত্যিকেরা সংঘ থেকে সরে গিয়ে সংঘকে তীব্রভাবে আক্রমণ করে নিন্দা ও মিথ্যাপ্রচারের অভিযান শুরু করেন।
প্রকৃতপক্ষে, প্রগতিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিভিন্ন “সাংস্কৃতিক” পত্রিকা এবং প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের সংগঠন এই সময় আমাদের সংঘের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ আরম্ভ করে।
আমাদের সংঘের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে স্থাপিত ‘কংগ্রেস সাহিত্য সংঘ’ সক্রিয় হতে চেষ্টা করে। কিন্তু মৃত সংস্কৃতির জের টেনে প্রগতিশীল নূতন ও জীবন্ত সংস্কৃতির বিরোধিতায় নামার অর্থই, ভাব ও প্রেরণার অসীম দৈন্য— এই দৈন্য নিয়ে কোন সংঘ প্রাণবান ও সক্রিয় হতে পারে না। ‘কংগ্রেস সাহিত্য সংঘ’ তাই বারবার মাথা তুলতে চেয়ে ঝিমিয়ে গিয়েছে।
আমাদের সংঘ সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই আক্রমণের প্রতিরোধ করেছে— ‘পরিচয়’ এবং অন্যান্য প্রগতিবাদী পত্রিকার সাহায্যে এবং সাংস্কৃতির অনুষ্ঠান প্রভৃতির আয়োজন করে। প্রগতিশীল মতবাদের প্রচারে ‘পরিচয়’-এর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রগতি-বিরোধী ধারা প্রবল হবার পর ‘পরিচয়’-এর সম্পাদকীয় নীতির যে পরিবর্তন করা হয়, এবং যে দৃঢ়তার সঙ্গে এ নীতি অনুসরণ করা হয় তা বিশেষ অভিনন্দনের যোগ্য।
বিরোধীপক্ষের প্রবল আক্রমণের বিরুদ্ধে আমাদের সংঘ প্রশংসনীয় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে তুলবার সক্রিয় প্রচেষ্টা সম্পর্কে সংঘ সম্পূর্ণ সচেতন হতে পারেনি। বুর্জোয়া ভাবধারার মোহ সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে না পারায় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রগতির ধারা আজ কতদূর শক্তিশালী—সংঘের পুরোপুরি সে ধারণা জন্মায়নি, এবং এই শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রূপ দেবার দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা থেকে গিয়েছে। বর্তমান যুগে শ্রমিকশ্রেণী ও জনসাধারণের বিপ্লবী চেতনা যখন যতদুর অগ্রসর হয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ধারার ততখানি শক্তিশালী হবার সম্ভাবনাও সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়ে যায়। বাংলার শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নুতন সংস্কৃতির দুর্বার জোয়ার আনার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়ে আছে বহুমুখী বিক্ষিপ্ত প্রগতিশীল ধারাগুলির মধ্যে। আমরাই গাফিলতি করে এতদিন ধারাগুলিকে একত্র করে জোয়ার সৃষ্টি করতে পারিনি।
গত এক বৎসর প্রতিক্রিয়ার আক্রমণ, নিন্দা ও অপপ্রচারের স্তর অতিক্রম করে, প্রগতিশীল লেখক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের উপর সরকারী নির্যাতনের স্তরে পৌঁচেছে। সংঘের বিশিষ্ট সভ্য শ্রীগোপাল হালদার, শ্রীহীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও শ্রীসুভাষ মুখোপাধ্যায় আজ বহুদিন বিনা বিচারে আটক হয়ে আছেন । সংঘের কেন্দ্রীয় আপিসে একাধিকবার পুলিসের পদার্পণ ঘটেছে, কয়েকটি শাখায় সার্চ করে উৎসাহী কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান গণনাট্য সংঘ এবং সোভিয়েট সুহৃদ সংঘও পুলিসের কৃপালাভ থেকে বঞ্চিত হয়নি ।
এই আক্রমণের প্রতিরোধে সংঘের উদ্যোগে ‘সংস্কৃতি স্বাধীনতা পরিষদ’ স্থাপিত হয়। বুদ্ধিজীবীদের সামনে সংস্কৃতির এই নতুন সংকটের স্বরূপ তুলে ধরা ও জোরালো প্রতিবাদ সৃষ্টি করার কাজে ‘সংস্কৃতি স্বাধীনতা পরিষদে’র ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যুদ্ধাবসানের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবস্থার দ্রুত রূপান্তর হয়েছে। আজ সোভিয়েটের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বাধীনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সংঘবদ্ধ হয়ে নূতন বিশ্বযুদ্ধের প্রকাশ্য প্রচারের রূপ নিয়েছে। এই সোভিয়েট বিরোধিতা রাজনীতির ক্ষেত্র অতিক্রম করে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ফ্যাসিস্ট দমননীতিতে পরিণত হতে আরম্ভ করেছে। তাই, যেটুকু মোহ ও জড়তা অবশিষ্ট ছিল আজ তা ঝেড়ে ফেলবার জরুরী প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
সন্দেহ নেই আমরা তা পারবো। প্রগতির অভিযান সকল বাধা ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে যাবে।
বাংলায় ভারতীয় প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের একটি হিন্দী ও একটি উর্দু শাখা আছে। এই শাখা ছুটির সঙ্গে এতদিন আমাদের প্রায় কোন যোগাযোগই ছিল না, অল্পদিন হয় এঁদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। তাই এই প্রতিষ্ঠান দুটির নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হতে হচ্ছে।
বহু প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা ও ব্যক্তির কাছ থেকে প্রগতি লেখক ও শিল্পীসংঘ নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা লাভ করেছে। আমরা সহযাত্রী,আমাদের মধ্যে ঋণ স্বীকার ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যবধানটুকুও আমরা রাখতে চাই না।