শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৫৪)/দ্বিতীয় অঙ্ক
দ্বিতীয় অঙ্ক
রাজা মৃগয়ায় আগমন কালে স্বীয় প্রিয়বয়স্য মাধব্য নামক ব্রাহ্মণকে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। রাজসহচরেরা, নিয়ত রাজভোগে কাল যাপন করিয়া,স্বভাবতঃ সাতিশয় বিলাসী ও সুখাভিলাষী হইয়া উঠে। অশন, বসন, শয়ন, উপবেশন কোন বিষয়ে কিঞ্চিন্মাত্র ক্লেশ হইলে তাহাদের একান্ত অসহ্য হয়। মাধব্য রাজধানীতে অশেষ সুখ সম্ভোগে কাল যাপন করিতেন। অরণ্যে সে সকল সুখভোগের লেশও ছিল না; প্রত্যুত, সকল বিষয়েই সবিশেষ ক্লেশ ঘটিয়া উঠিয়াছিল।
এক দিবস মাধব্য, প্রভাতে গাত্রোত্থান করিয়া, যৎপরোনান্তি বিরক্ত হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন এই মৃগয়াশীল রাজার বয়স্য হইয়া আমার প্রাণ গেল। প্রতিদিন প্রাতঃকালে মৃগয়ায় যাইতে হয় এবং এই মৃগ, এই বরাহ, এই শার্দুল, এই করিয়া মধ্যাহ্ন কাল পর্য্যন্ত বনে বনে ভ্রমণ করিতে হয়। গ্রীষ্মকালে পল্বল ও বননদী সকল শুষ্ক প্রায় হইয়া আইসে; যে অল্পপ্রমাণ জল থাকে তাহাও, বৃক্ষের গলিত পত্র সকল অনবরত পতিত হওয়াতে,অত্যন্ত কটু ও অত্যন্ত কষায় হইয়া উঠে। পিপাসা পাইলে সেই বিরস বারিই পান করিতে হয়। আহারের সময় নিয়মিত নাই; প্রায় প্রতিদিন অনিয়ত সময়েই আহার করিতে হয়। আহার সামগ্রীর মধ্যে শূল্য মাংসই অধিকাংশ; তাহাও প্রত্যহ সুচারুরূপ পাক করা হয় না। আর প্রাতঃকাল অবধি মধ্যাহ্ন পর্যন্ত অশ্বপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করিয়া সর্ব্বশরীর বেদনায় এরূপ অভিভূত হইয়া থাকে যে রাত্রিতেও সুখে নিদ্রা যাইতে পারি না। রাত্রিশেষে নিদ্রার আবেশ হয়; কিন্তু ব্যাধগণের বন গমন কোলাহলে অতি প্রত্যুষেই নিদ্রাভঙ্গ হইয়া যায়। আর ত্বরায় যে এই সকল ক্লেশের অবসান হইবেক তাহারও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। সে দিবস আমরা পশ্চাৎ পড়িলে, তিনি, একাকী এক মৃগের অনুসরণক্রমে. তপোবনে প্রবিষ্ট হইয়া, আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, শকুন্তলানাম্নী এক তাপসকন্যা নিরীক্ষণ করিয়াছেন। তাহাকে দেখিয়া অবধি আর নগর গমনের কথাও মুখে আনেন না। এই ভাবিতে ভাবিতেই রাত্রি প্রভাত হইয়া গেল এক বারও চক্ষু মুদি নাই।
মাধব্য এই সমস্ত চিন্তা করিতেছেন, এমত সময়ে দেখিতে পাইলেন, রাজা মৃগয়ার বেশ করিয়া, মৃগয়াকালীন সহচরগণে পরিবেষ্টিত হইয়া, সেই দিকেই আসিতেছেন। তখন তিনি মনে মনে এই বিবেচনা করিলেন বিকলাঙ্গের ন্যায় হইয়া থাকি; তাহা হইলেও, যদি আজি বিশ্রাম করিতে পাই। এই বলিয়া, ভগ্নশরীরের ন্যায় একান্ত বিকল হইয়া রহিলেন এবং, রাজা সন্নিহিত হইবামাত্র, সাতিশয় কাতরতা প্রদর্শনপূর্ব্ক কহিলেন বয়স্য! আমার সর্ব্ব শরীর অবশ হইয়া আছে, হস্তপ্রসারণ করি এমত ক্ষমতা নাই; অতএব কেবল বাক্যদ্বারাই আশীর্ব্বাদ করি।
রাজা মাধব্যকে তদবস্থ অবস্থিত দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন বয়স্য! তোমার শরীর এরূপ বিকল হইল কেন? মাধব্য কহিলেন কেন হইল কি আবার; স্বয়ং অস্থি ভাঙ্গিয়া দিয়া অশ্রুপাতের কারণ জিজ্ঞাসা করিতেছ!। রাজা কহিলেন বয়স্য! বুঝিতে পারিলাম না। মাধব্য কহিলেন নদীতীরবর্ত্তী রেতস যে কুব্জভাব অবলম্বন করে সে কি স্বেচ্ছা বশতঃ সেই রূপ করে, অথবা নদী-বেগপ্রভাবে। রাজা কহিলেন নদীবেগ তাহার কারণ। মাধব্য কহিলেন তুমিও আমার অঙ্গবৈকল্যের। রাজা কহিলেন সে কেমন?। মাধব্য কহিলেন আমি কি বলিব,ইহা কি উচিত হয় যে রাজকার্য্য পরিত্যাগ করিয়া বনচরের ব্যবসায় অবলম্বন পূর্ব্বক নিয়ত বনে বনে ভ্রমণ করিবে। আমি ব্রাহ্মণের সন্তান; সর্ব্বদা মৃগের অনুসরণে কাননে কাননে ভ্রমণ করিয়া সন্ধিবন্ধ সকল শিথিল হইয়া গিয়াছে এবং সর্ব্ব শরীর অবশ হইয়া রহিয়াছে। অতএব বিনয় বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি অন্ততঃ এক দিনের মত আমাকে বিশ্রাম করিতে দাও।
রাজা মাধব্যের প্রার্থনা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন এ ত এইরূপ কহিতেছে; আমারও শকুন্তলা দর্শন দিবসাবধি মৃগয়া বিষয়ে মন নিতান্ত নিরুৎসুক হইয়াছে। শরাসনে শর সন্ধান করি কিন্তু মৃগের উপরি নিক্ষেপ করিতে পারি না; যেহেতু, তাহাদিগের মুগ্ধ নয়ন অবলোকন করিলে, শকুন্তলার সেই অলৌকিক বিভ্রম বিলাসশালী নয়নযুগল মনে পড়ে। মাধব্য রাজার মুখে দৃষ্টি পাত করিয়া কহিলেন ইনি ত আর কিছু মনে করিয়া ভাবিতে লাগিলেন আমি অরণ্যে রোদন করিলাম। রাজা ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন না হে না, আমি অন্য কিছু ভাবিতেছি না; সুহৃদ্বাক্য লঙ্ঘন করা কর্ত্তব্য নহে এই বিবেচনায় অদ্য মৃগয়ায় ক্ষান্ত হইলাম। মাধব্য, শ্রবণ মাত্র যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হইয়া, চিরজীবী হও বলিয়া, চলিয়া যাইবার উদ্যম করিলেন। রাজা কহিলেন বয়স্য! যাইও না, আমার কিছু কথা আছে। মাধব্য কি কথা বল, এই বলিয়া শ্রবণোম্মুখ হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। রাজা কহিলেন বয়স্য! কোন অনায়াসসাধ্য কর্ম্মে তোমাকে আমার সহায়তা করিতে হইবেক। মাধব্য কহিলেন কি মিষ্টান্ন ভক্ষণে? সে বিষয়ে আমি বিলক্ষণ নিপুণ বটি। রাজা কহিলেন না হে না, আমি যাহা কহিব। এই বলিয়া দৌবারিককে আহ্বান করিয়া সেনাপতিকে আনয়ন করিতে আদেশ দিলেন।
দৌবারিকমুখে রাজার আহ্বানবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া, সেনাপতি অনতিবিলম্বে নরপতিগগাচরে উপস্থিত হইলেন এবং মহারাজের জয় হউক বলিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন মহারাজ! সমুদায় উদ্যোগ হইয়াছে; আর অনর্থ কাল হরণ করিতেছেন কেন, মৃগয়ায় চলুন। রাজা কহিলেন আজি মাধব্য, মৃগয়ার দোষ কীর্ত্তন করিয়া, আমাকে নিরুৎসাহ করিয়াছে। সেনাপতি রাজার অগোচরে ইঙ্গিত দ্বারা মাধব্যকে কহিলেন সখে! তুমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়া থাক; আমি কিয়ৎ ক্ষণ স্বামীর চিত্তবৃত্তি অনুবর্ত্তন করি। অনন্তর রাজাকে কহিলেন মহারাজ! ও পাগলের কথা শুনেন কেন; ও কখন্ কি না বলে। মৃগয়া অপকারী কি উপকারী মহারাজই বিবেচনা করিয়া দেখুন না কেন। প্রথমত, স্থূলতা ও জড়তা অপগত হইয়া, শরীর বিলক্ষণ পটু ও কর্ম্মক্ষম হয়; ভয় জন্মিলে, অথবা ক্রোধের উদয় হইলে, জন্তুগণের মনের গতি কিরূপ হয় তাহা বারংবার প্রত্যক্ষ হইতে থাকে; আর চলিত লক্ষ্যে শর ক্ষেপ করা অভ্যাস হইয়া আইসে; যদি চলিত লক্ষ্যে শর ক্ষেপ অব্যর্থ হয় ত তাহা অপেক্ষা ধনুর্ধরের পক্ষে অধিক শ্লাঘার বিষয় আর কি হইতে পারে। অতএব, মৃগয়াকে ব্যসন মধ্যে গণ্য করা অতি অবিবেচনার কর্ম্ম। বিবেচনা করুন, এরূপ আমোদ ও এরূপ উপকার আর কিসে আছে। মাধব্য, শুনিয়া কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া কহিলেন অরে নরাধম! ক্ষান্ত হ, আর তোর প্রবৃত্তি জন্মাইতে হইবেক না; ইনি আজি আপন প্রকৃতি প্রাপ্ত হইয়াছেন। আমি দেখিতেছি তুই, বনে বনে ভ্রমণ করিয়া, এক দিন নরনাসিকালোলুপ ভল্লুকের মুখে পড়িবি।
উভয়ের এই রূপ বিবাদারম্ভ দেখিয়া রাজা সেনাপতিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন দেখ! আমরা আশ্রমসমীপে আছি; এই নিমিত্ত তোমার মতে সম্মত হইতে পারিলাম না। অদ্য মহিষেরা,নিপানে অবগাহন করিয়া, নিরুদ্বেগে জলক্রীড়া করুক; হরিণগণ, তরুচ্ছায়ায় দলবদ্ধ হইয়া, রোমন্থ অভ্যাস করুক; বরাহের অশঙ্কিত চিত্তে পল্বলে মুস্তা ভক্ষণ করুক; আর আমার শরাসনও বিশ্রাম করুক। সেনাপতি কহিলেন মহারাজের যেমন অভিরুচি। রাজা কহিলেন তবে যে সকল মৃগয়নুচর পূর্ব্ব বন প্রস্থান করিয়াছে তাহাদিগকে ফিরাইয়া আন। আর সেনাসংক্রান্ত লোকদিগকে বিশেষ করিয়া নিষেধ কর যেন তাহারা কোন ক্রমে তপোবনের উৎপীড়ন না জন্মায়।
সেনাপতি যে আজ্ঞা মহারাজ বলিয়া নিষ্ক্রান্ত হইলে, রাজা সন্নিহিত মৃগয়াসহচরদিগকে মৃগয়াবেশ পরিত্যাগ করিতে আদেশ করিলেন। তদনুসারে সমুদায় পরিচারকগণ তথা হইতে প্রস্থান করিলে, রাজা ও মাধব্য উভয়ে সন্নিহিত সুশীতল লতামণ্ডপে প্রবিষ্ট হইয়া উপবেশন করিলেন।
এইরূপে উভয়ে নির্জ্জনে উপবিষ্ট হইলে,রাজা মাধব্যকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন বয়স্য! তুমি চক্ষুর ফল পাও নাই; যেহেতু, দর্শনীয় বস্তুই দেখ নাই। মাধব্য কহিলেন কেন তুমি ত আমার সম্মুখে রহিয়াছ। রাজা কহিলেন তা নয় হে, আমি আশ্রমললামভূতা কদুহিতা শকুন্তলাকে উল্লেখ করিয়া কহিতেছি। মাধব্য, কৌতুক করিবার নিমিত্ত, কহিলেন এ কি বয়স্য! তপস্বিকন্যায় অভিলাষ। রাজা কহিলেন বয়স্য! পুরুবংশীয়েরা এরূপ দুরাচার নহে যে অনুচিত বস্তুর উপভোগে অভিলাষ করে। তুমি জান না, শকুন্তলা মেনকাগর্ভসম্ভূতা রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের কন্যা; তপস্বীর আশ্রমে প্রতিপালিত হইয়াছে এই মাত্র; নতুবা, বস্তুতঃ সে তপস্বিকন্যা নহে।
মাধব্য, শকুন্তলার প্রতি রাজার প্রগাঢ় অনুরাগ দেখিয়া, হাস্যমুখে কহিলেন যেমন পিণ্ডখর্জজূর আহার করিয়া রসনা মিষ্টরসে অভিভূত হইলে তেঁতুল খাইতে অভিলাষ হয়; সেইরূপ, স্ত্রীর পরিভোগে পরিতৃপ্ত হইয়া তুমি এই অভিলাষ করিতেছ। রাজা কহিলেন বয়স্য! তুমি তাহাকে দেখ নাই এই নিমিত্ত এরূপ কহিতেছ। মাধব্য কহিলেন তার সন্দেহ কি; সে বস্তু অবশ্যই রমণীয় যাহা তোমারও বিস্ময় জন্মাইয়াছে। রাজা কহিলেন, বয়স্য! অধিক কি কহিব তাহার শরীর মনে করিলে মনে,এই উদয় হয় বুঝি বিধাতা প্রথমতঃ চিত্র পটে চিত্রিত করিয়া পরে জীবন দান করিয়াছেন; অথবা, মনে মনে মনোমত উপকরণসামগ্রীসকল সঙ্কলন করিয়া, মনে মনে অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি যথা স্থানে বিন্যাস করিয়া, মনে মনেই তাহার শরীর নির্ম্মাণ করিয়াছেন; নতুবা হস্ত দ্বারা নির্ম্মাণ করিলে শরীরের সেরূপ কোমলতা ও রূপ লাবণ্যের সেরপ মাধুরী সম্ভবিত না। ফলতঃ, ভাই রে, সে এক অলৌকিক স্ত্রীরত্নসৃষ্টি। মাধব্য কহিলেন বয়স্য! বুঝিলাম শকুন্তলা যাবতীয় রূপবতীদিগের পরাভবস্থান। রাজা কহিলেন তাহার রূপ, অনাঘ্রাত প্রফুল্ল পুষ্প স্বরূপ, নখাঘাত বর্জ্জিত নব পল্লব স্বরূপ, অপরিহিত নূতন রত্ন স্বরূপ, অনাস্বাদিত অভিনব মধু স্বরূপ,জন্মান্তরীণ পুণ্যরাশির অখণ্ড ফল স্বরূপ। জানিনা, কোন্ ভাগ্যবানের ভাগ্যে সেই নির্ম্মল রূপের ভোগ আছে।
রাজার মুখে শকুন্তলার এই রূপ বর্ণনা শুনিয়া চমৎকৃত হইয়া মাধব্য কহিলেন বয়স্য তবে শীঘ্র শীঘ্র তাহার উদ্ধার কর; যেন এরূপ অসুলভরূপনিধান কন্যানিধান কোন অসভ্য তপস্বীর হস্তে পতিত না হয়। রাজা কহিলেন শকুন্তলা নিতান্ত পরাধীন। বিশেষতঃ কুলপতি কণ্ব এক্ষণে আশ্রম নাই। মাধব্য কহিলেন ভাল বয়স্য! জিজ্ঞাসা করি বল দেখি তোমার উপর তাহার অনুরাগ আছে কি না। রাজা কহিলেন বয়স্য! তপস্বিকন্যারা স্বভাবতঃ অপ্রগল্ভস্বভাবা তথাপি তাহার আকার ইঙ্গিতে আমার প্রতি তাহার অনুরাগের স্পষ্ট চিহ্ন লক্ষিত হইয়াছে। যত ক্ষণ আমার সম্মুখে ছিল আমার সহিত কথা কহে নাই; কিন্তু আমি কথা কহিতে আরম্ভ করিলে অনন্যচিত্তা হইয়া স্থির কর্ণে শ্রবণ করিয়াছে। আর নয়নে নয়নে সঙ্গতি হইলে মুখ ফিরাইয়া লইয়াছে; কিন্তু অন্য দিকেও অধিক ক্ষণ চাহিয়া থাকে নাই। আর প্রস্থান কালে, কয়েক পদ মাত্র গমন করিয়া, কুশের অঙ্কুরে পদতল ক্ষত হইল এই বলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; এবং কুরুবক শাখায় বল্কল লাগিয়াছে এই বলিয়া বল্কল মোচনচ্ছলে আমার দিকে মুখ ফিরাইয়া সতৃষ্ণ নয়নে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। মাধব্য কহিলেন বয়স্য! তবে তোমার মনোরথ সিদ্ধির অধিক বিলম্ব নাই। তপোবন তোমার উপবন হইয়া উঠিল। রাজা কহিলেন বয়স্য! কোন কোন তপস্বীরা আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন। এখন বল দেখি কি ছলে কিছু দিন তপোবনে থাকি। মাধব্য কহিলেন কেন অন্য ছলের প্রয়োজন কি? তুমি রাজা, তপোবনে গিয়া তপস্বীদিগকে বল রাজস্ব দাও। রাজা কহিলেন তপস্বীরা অন্যবিধ রাজস্ব দেন। তাহারা যে রাজস্ব দেন তাহা রত্নরাশি অপেক্ষাও সমধিক প্রার্থনীয়। দেখ, প্রজারা রাজাদিগকে যে রাজস্ব দেয় তাহা বিনশ্বর; কিন্তু তপস্বীরা তপস্যার ষষ্ঠাংশ স্বরূপ অবিনশ্বর রাজস্ব প্রদান করিয়া থাকেন।
রাজা ও মাধব্য উভয়ের এই রূপ কথোপকথন চলিতেছে, এমত সময়ে দ্বারবান্ আসিয়া কহিল মহারাজ! তপোবন হইতে দুই ঋষিকুমার আসিয়া দ্বার দেশে দণ্ডায়মান আছেন কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন অবিলম্বে লইয়া আইস। অনন্তর ঋষিকুমারেরা রাজসমীপে উপনীত হইয়া মহারাজের জয় হউক বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। রাজা আসন হইতে গাত্রোত্থান করিয়া প্রণাম করিলেন এবং জিজ্ঞাসিলেন তপস্বীরা কি আজ্ঞা করিয়া পাঠাইয়াছেন জানিতে ইচ্ছা করি। ঋষিকুমারেরা কহিলেন মহারাজ! আপনি এখানে আছেন জানিতে পারিয়া তপস্বীরা মহারাজকে এই অনুরোধ করিতেছেন যে মহর্ষি কণ্ব আশ্রমে নাই, এই নিমিত্ত নিশাচরেরা যজ্ঞের বিঘ্ন জন্মাইতেছে। অতএব তাঁহার প্রত্যাগমন পর্য্যন্ত আপনাকে এই স্থানে থাকিয়া তপোবনের উপদ্রব নিবারণ করিতে হইবেক। রাজা কহিলেন অনুগৃহীত হইলাম। মাধব্য কহিলেন বয়স্য! মন্দ কি,এ তোমার অনুকূল গলহস্ত। রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন; অনন্তর, দৌবারিককে আহ্বান করিয়া সারথিকে রথ প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া, ঋষিকুমারদিগকে কহিলেন আপনারা প্রস্থান করুন; আমি অবিলম্বে তপোবনে উপস্থিত হইতেছি। ঋষিকুমারেরা সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন মহারাজ! না হইবে কেন, আপনি যে বংশে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন আপনার এই ব্যবহার তাহার উপযুক্তই বটে। বিপাকে অভয়দান পুরুবংশীয়দিগের কুলব্রত।
এই বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া ঋষিকুমারেরা প্রস্থান করিলে পর, রাজা মাধব্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন বয়স্য! যদি তোমার শকুন্তলাদর্শনে কৌতূহল থাকে আমার সমভিব্যাহারে চল। মাধব্য কহিলেন তোমার মুখে তাহার বর্ণনা শুনিয়া তাহাকে দেখিতে অত্যন্ত অভিলাষ ছিল বটে; কিন্তু এক্ষণে নিশাচরের নাম শুনিয়া সে অভিলাষ একবারেই গিয়াছে। রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন ভয় কি আমার নিকটে থাকিবে। মাধব্য কহিলেন তবে আর নিশাচরে আমার কি করিবেক। এই রূপ কথোপকথন হইতেছে; এমত সময়ে দ্বারপাল আসিয়া কহিল মহারাজ রথ প্রস্তুত, আরোহণ করিলেই হয়। কিন্তু বৃদ্ধ মহিষীর বার্ত্তা লইয়া করভক এই মাত্র রাজধানী হইতে উপস্থিত হইল। রাজা কহিলেন অবিলম্বে উহাকে আমার নিকটে লইয়া আইস। অনন্তর করভক রাজসমীপে আসিয়া নিবেদন করিল মহারাজ! বৃদ্ধ দেবী আজ্ঞা করিয়াছেন আগামী চতুর্থ দিবসে তাঁহার এক ব্রত আছে; সেই দিবসে মহারাজকে তথায় উপস্থিত থাকিতে হইবেক।
রাজা, এ দিকে তপস্বীদিগের কার্য্য, এ দিকে গুরুজনের আজ্ঞা, উভয়ই অনুল্লঙ্ঘনীয়, কি করি; এই বলিয়া নিতান্ত চিন্তিত হইলেন। মাধব্য পরিহাস করিয়া কহিলেন কেন ত্রিশঙ্কুর মত মধ্যস্থলে অবস্থিতি কর। রাজা কহিলেন বয়স্য! এ পরিহাসের সময় নয়; সত্য সত্যই অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছি; কি করি কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। পরে কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন মা তোমাকে পুত্র বলিয়া পরিগ্রহ করিয়াছেন; অতএব তুমি রাজধানী ফিরিয়া যাও; এবং যাইয়া জননীর পুত্রকার্য্য সম্পাদন কর। তাঁহাকে কহিবে আমি তপস্বীদিগের কার্য্যে অত্যন্ত ব্যস্ত আছি এই নিমিত্ত যাইতে পারিলাম না। মাধব্য, ভাল আমি চলিলাম, কিন্তু তুমি যেন আমাকে নিশাচরভয়ে কাতর মনে করিও না; এই বলিয়া কহিলেন এক্ষণে আমি রাজার অনুজ হইলাম। অতএব রাজার অনুজের মত যাইতে ইচ্ছা করি। রাজা কহিলেন আমার সঙ্গে অধিক লোক জন রাখিলে তপোবনের উৎপীড়ন হইতে পারে; অতএব সমুদায় অনুচরদিগকে তোমারই সঙ্গে পাঠাইতেছি। মাধব্য শুনিয়া সাতিশয় আনন্দিত হইয়া কহিলেন তাহা হইলে আজি আমি যুবরাজ হইলাম।
এইরূপে মাধবের রাজধানী প্রতিগমন নির্দ্ধারিত হইলে, রাজা মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন এ অতি চপলস্বভাব, হয় ত শকুন্তলাবৃত্তান্ত অন্তঃপুরে প্রচার করিবেক। কি করি। অথবা এইরূপ কহিয়া বিদায় করি। এই বলিয়া মাধব্যের হস্তে ধরিয়া কহিলেন বয়স্য! ঋষিরা কয়েক দিনের নিমিত্ত তপোবনে থাকিতে আদেশ করিয়াছেন; তাহাদের আজ্ঞা অবহেলন করা কোন মতেই কর্ত্তব্য নহে এই নিমিত্ত রহিলাম; নতুবা যথার্থই আমি শকুস্তলা লাভে, অভিলাষী হইয়াছি এমত নয়। আমি ইতিপূর্ব্বে তোমার নিকট শকুন্তলাসংক্রান্ত যে সকল গল্প করিয়াছি সে সমস্তই পরিহাস মাত্র; তুমি যেন যথার্থ ভাবিয়া -একে আর করিও না। মাধব্য কহিলেন তাহার সন্দেহ কি; আমি, এক বারও তোমার ঐ সকল কথা যথার্থ ভাবি নাই। অনন্তর রাজা তপস্বীদিগের যজ্ঞবিঘ্ননিরাকরণার্থে তপোবনে প্রবেশ করিলেন এবং মাধব্যও যাবতীয় সৈন্য সামন্ত ও সমুদায় অনুযাত্রিকগণ সঙ্গে লইয়া রাজধানী প্রস্থান করিলেন।