শকুন্তলা (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৫৪)/পঞ্চম অঙ্ক

পঞ্চম অঙ্ক


 রাজা দুষ্মন্ত, রাজকার্য্যসমাধানান্তে একান্তে আসীন হইয়া, স্বীয় প্রিয়বয়স্য মাধব্যের সহিত কথোপকথনরসে কাল যাপন করিতেছেন এমত সময়ে হংসপদিক নামী এক পরিচারিণী সঙ্গীতশালাতে অতি মধুর স্বরে এই ভাবের একটা গান করিতে লাগিল “অহে মধুকর! অভিনবমধুলোভে সহকারমঞ্জরীতে তখন তাদৃশ প্রণয় প্রদর্শন করিয়া এখন, কমলমধু পানে পরিতৃপ্ত হইয়া, উহাকে একবারে বিস্মৃত হইলে কেন”।

 তানলয়বিশুদ্ধস্বরসংযোগবতী গীতি শ্রবণ করিয়া রাজা অকস্মাৎ যৎপরোনাস্তি উন্মনঃ হইলেন। কিন্তু কি নিমিত্ত উন্মনাঃ হইতেছেন তাহার কিছুই অনুধাবন করিতে ন পারিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন কেন এই মনোহর গীতি শ্রবণ করিয়া আমার মন এমন আকুল হইতেছে। প্রিয়জনবিরহ ব্যতিরেকে মনের এরূপ আকুলতা হয় না; কিন্তু আমার প্রিয়জনবিরহ উপস্থিত দেখিতেছি না। অথবা মনুষ্য, সর্ব্ব প্রকারে সুখী হইয়াও, রমণীয় বস্তু দর্শন কিংবা সুমধুর গীতি শ্রবণ করিয়া যে আকুলহৃদয় হয় বোধ করি, অনতিপরিস্ফুট ৰূপে জন্মান্তরীণ স্থির সৌহৃদ্য তাহার স্মৃতি পথে আৰূঢ় হয়।

 রাজা মনে মনে এইৰূপ বিতর্ক করিতেছেন এমত সময়ে কঞ্চুকী আসিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল মহারাজ! হিমালয়ের উপত্যকাবর্ত্তি অরণ্যবাসী কয়েক জন তপস্বী মহর্ষি কণুের সন্দেশ লইয়া মহারাজের নিকট আসিয়াছেন কি আজ্ঞা হয়। রাজা তপস্বিনাম শ্রবণমাত্র অতিমাত্র আদর প্রদর্শন পূর্বক কছিলেন তুমি উপাধ্যায় সোমরাতকে বল, অভ্যাগত তপস্বীদিগকে, বেদবিধি অনুসারে সৎকার করিয়া স্বয়ং সমভিব্যাহারে করিয়া আমার নিকটে লইয়া আইসেন। আমিও ইত্যবকাশে তপস্বিদর্শনযোগ্য প্রদেশে গিয়া রীতিমত অবস্থিতি করিতেছি।

 এই আদেশ দিয়া কঞ্চুকীকে বিদায় করিয়া রাজা অগ্নিগৃহে গিয়া অবস্থিতি করিলেন এবং কহিতে লাগিলেন ভগবান্ কণ্ব কি নিমিত্ত আমার নিকট ঋষি প্রেরণ করিলেন; কি তাঁহাদের তপস্যার বিঘ্ন ঘটিয়াছে, কি কোন দুরাত্মা তাঁহাদের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করিয়াছে; .কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া আমার মন অত্যন্ত আকুল হইতেছে। তখন পার্শ্ববর্ত্তিনী পরিচারিক কহিল মহারাজ! আমার বোধ হইতেছে ধর্ম্মারণ্যবাসী ঋষির মহারাজের অধিকারে নির্ব্বিঘ্নে ও নিরাকুলচিত্তে তপস্যার অনুষ্ঠান করিতেছেন, সেই হেতু প্রীত হইয়া মহারাজকে সভাজন করিতে আসিয়াছেন।

 এবস্প্রকার কথোপকথন হইতেছে এমত সময়ে সোমরাত তপস্বীদিগকে সমভিব্যাহারে করিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজা, দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, আসন হইতে গাত্রোথান করিয়া তাঁহাদের আগমন প্রতীক্ষায় দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন সোমরাত তপস্বীদিগকে কহিলেন ঐ দেখুন, সসাগরা সদ্বীপা ধরিত্রীর অদ্বিতীয় অধিপতি আসন পরিত্যাগ পূর্বক দণ্ডায়মান হইয়া আপনাদের প্রতীক্ষা করিতেছেন। শার্ঙ্গরব কহিলেন নরপতিদিগের এরূপ বিনয় ও সৌজন্য দেখিলে সাতিশয় প্রীত হইতে হয় ও অত্যন্ত প্রশংসা করিতে ও সাধুবাদ দিতে হয়; অথবা ইহার বিচিত্র কি-তরুগণ ফলিত হইলে ফল ভরে অবনত হইয়াই থাকে; বর্ষাকালীন জলধরগণ বারিভরে নম্রভাবই অবলম্বন করে; সৎপুরুষদিগেরও প্রথ। এই, সমৃদ্ধিশালী হইলে অনুদ্ধতস্বভাবই হয়েন।

 শকুন্তলার দক্ষিণাক্ষি স্পন্দন হইতে লাগিল। তিনি সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া গোতমীকে কহিলেন পিসি! আমার দক্ষিণ নয়নের স্পন্দন হইতেছে কেন?। গৌতমী কহিলেন বৎসে! তোমার অমঙ্গল দূর হউক; পতিকুলদেবতারা তোমার মঙ্গল করুন। যাহা হউক, শকুন্তলা তদবধি মনে মনে নানা প্রকার আশঙ্কা করিতে লাগিলেন ও অত্যন্ত অস্থির হইলেন।

 রাজা শকুন্তলাকে দেখিয়া কহিতে লাগিলেন এই অবগুণ্ঠনবতী কামিনী কে, কি নিমিত্তই বা ইনি তপস্বীদিগের সমভিব্যাহারে আসিয়াছেন। পার্শ্ববর্ত্তিনী পরিচারিক কহিল মহারাজ! আমিও দেখিয়া অবধি নানা বিতর্ক করিতেছি কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহ। হউক, गशद्वास्त्र! এৰূপ ৰূপ লাবণ্যের মাধুরী কখন কাহার নয়নগোচর হয় নাই। রাজা কহিলেন সে যা হউক পরস্ত্রীতে দৃষ্টিপাত করা কর্ত্তব্য নহে। এ দিকে শকুন্তলাও আপনার অস্থির হৃদয়কে এই-বলিয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন হৃদয়; এত আকুল হইতেছ কেন; আর্য্যপুত্রের ভাব মনে করিয়া আশ্বাসিত হও ও ধৈর্য্য অবলম্বন কর।

 তাপসের ক্রমে ক্রমে সন্নিহিত হইয়াং মহারাজের জয় হউক বলিয়া হস্ত তুলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। রাজা প্রণাম করিয়া ঋষিদিগকে আসন পরিগ্রহ করিতে কহিলেন। ঋষির অভীষ্টসিদ্ধিরন্তু বলিয়া পুনর্ব্বার আশীর্ব্বাদ প্রয়োগ করলেন। অনন্তর সকলে উপবেশন করিলে রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন কেমন, মুনিদিগের নির্ব্বিঘ্নে তপস্যানুষ্ঠান হইতেছে। ঋষিরা কহিলেন মহারাজ! আপনি রক্ষাকর্ত্তা থাকিতে ধর্ম্ম ক্রিয়ার বিঘ্ন সম্ভাবনা কোথায়; সূর্য্যদেবের উদয় হইলে কি অন্ধকারের আবির্ভাব হইতে পারে?। রাজা শুনিয়া কৃতার্থম্মন্য হইয়া কহিলেন অদ্য আমার রাজশব্দ সার্থক হইল। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন ভগবান কণ্বের কুশল? ঋষিরা কহিলেন হা মহারাজ! মহর্ষি সর্ব্বাংশেই কুশলী।

 এই ৰূপে প্রথমসমাগমোচিত শিষ্টাচারপরম্পরা পরিসমাপ্ত হইলে, শাঙ্গ রব কহিলেন আমাদিগের গুরু মহর্ষি করে যে সন্দেশ লইয়া আসিয়াছি নিবেদন করি শ্রবণ করুন। মহর্ষি কহিয়াছেন “আপনি আমার অজ্ঞাতসারে আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। আমি সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়। তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ সম্মতি প্রদান করিয়াছি। আপনি আমার শকুন্তলার সর্বাংশে যোগ্য পাত্র। এক্ষণে আপনকার সহধর্ম্মিণী অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন গ্রহণ করুন”। গোতমীও কহিলেন আর্য্য। আমি কিছু বলিতে চাই কিন্তু বলিবার পথ নাই। শকুন্তলা আপন গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা রাখে নাই; তুমিও তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর নাই। অতএব তোমরা পরস্পরের সম্মতিতে যাহা করিয়াছ তাহাতে অন্যের কথা কহিবার কি আছে।

 শকুন্তলা শুনিয়া মনে মনে সাতিশয় শঙ্কিত হইয়। এই ভাবিতে লাগিলেন না জানি আর্য্যপুত্র কি বলেন। রাজ দুর্ব্বাসার শাপপ্রভাবে শকুন্তলাপরিণয় বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বিস্তৃত হইয়াছিলেন সুতরাং শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন এ আবার কি উপস্থিত। শকুন্তল। শুনিয়া একবারে ম্ৰিয়মাণা হইলেন। শার্ঙ্গরব কহিলেন মহারাজ! আপনি লৌকিক ব্যবহার বিলক্ষণ অবগত হইয়াও এৰূপ কহিতেছেন কেন। আপনি কি জানেন না যে পরিণীত নারী যদিও অত্যন্ত সাধুশীলা হয় তথাপি সে নিয়ত পিতৃকুলবাসিনী হইলে লোকে নানা কথা কহিয়া থাকে। এই নিমিত্ত সে পতির অপ্রিয়া হইলেও তাহার পিতৃপক্ষীয়েরা তাহাকে পতিকুলবাসিনী করিতে চাহে।

 রাজা কহিলেন আমি ইহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি না কি?। শকুন্তলা শুনিয়া বিষাদ সমুদ্রে মগ্ন হইয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন,হে হৃদয়! যে আশঙ্কা করিতেছিলে তাহাই ঘটিয়াছে। শার্ঙ্গরব রাজার অস্বীকার শ্রবণে, তদীয় ধূর্ত্ততা আশা করিয়া যৎপরোনাস্তি কুপিত হইয়া কহিলেন মহারাজ! জগদীশ্বর আপনাকে ধর্ম্ম সংস্থাপন কার্য্যে নিয়োজিত করিয়াছেন। অন্যে অন্যায় করিলে আপনাকে দণ্ড বিধান করিতে হয়। এক্ষণে আপনাকে জিজ্ঞাসা করি রাজা হইয়া অনুষ্ঠিত কার্য্যের অপলাপে প্রবৃত্ত হইয়। ধর্ম্মদ্বেষী হওয়া উচিত কি না?। রাজা কহিলেন আমাকে এত অভদ্র স্থির করিতেছেন কেন?। শার্ঙ্গরব কহিলেন মহারাজ! আপনকার অপরাধ নাই; যাহারা ঐশ্বর্য্যমদে মত্ত হয় তাহাদের এইৰূপই স্বভাব ও এইৰূপই আচরণ হইয়া থাকে। রাজা কহিলেন আপনি অন্যায় ভৎর্সনা করিতেছেন; আমি কোন ক্রমেই এৰূপ ভৎর্সনার যোগ্য নহি।

 এইৰূপে রাজাকে অস্বীকারপরায়ণ ও শকুন্তলাকে লজ্জায় অধোমুখী দেখিয়া গোতমী শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন বৎসে! লজ্জিতা হইও না; আমি তোমার মুখের ঘোমটা খুলিয়া দিতেছি; তথা হইলেই মহারাজ তোমাকে চিনিতে পরিবেন। এই বলিয়া মুখের অবগুণ্ঠন নিরীকরণ করিয়া দিলেন। রাজা তথাপি চিনিতে পারলেন না; বরং পূর্ব্বাপেক্ষায় সমধিক সংশয়াৰূঢ় হইয়া মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন শার্ঙ্গরব কহিলেন মহারাজ! এৰূপ মৌনভাবে রহিলেন কেন!। রাজা কহিলেন মহাশয়! কি করি বলুন; অনেক ভাবিয়া দেখিলাম; কিন্তু ইঁহার হার পাণিগ্রহণ করিয়াছি বলিয়া কোন ক্রমেই স্মরণ হইতেছে না। সুতরাং কি প্রকারে ইঁহাকে ভার্য্যা বলিয়া পরিগ্রহ করি। বিশেষতঃ ইনি এক্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন।

 রাজার এই বচনবিন্যাস শ্রবণ করিয়া শকুন্তলা মনে মনে কহিতে লাগিলেন হয় কি সর্ব্বনাশ! একবারে প্লাণিগ্রহণেই সন্দেহ॥ রাজমহিষী হইয়া অশেষ সুখ সম্ভোগে কাল হরণ করিব বলিয়া যত আশা করিয়াছিলাম সে সমুদায় এক কালে নির্ম্মূল হইল। শার্ঙ্গরব কহিলেন মহারাজ! বিবেচনা করুন মহর্ষি কেমন সদাশয়তা প্রদর্শন করিয়াছেন। আপনি তাহার অগোচরে তদীয় অনুমতিনিরপেক্ষ হইয়া তাঁহার কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি তাহাতে রোষ বা অসন্তোষ প্রদর্শন না করিয়া বরং সাতিশয় সন্তুষ্টই হইয়াছেন এবং আপনকার নিকট কন্যাকে পাঠাইয়া দিয়াছেন। এক্ষণে প্রত্যাখ্যান করিয়া এৰূপ সদাশয় মহানুভাবের অবমাননা করা মহারাজের কোন ক্রমেই কর্ত্তব্য নহে। অতএব আপনি স্থির চিত্তে বিবেচনা করিয়া কর্ত্তব্য নিৰ্দ্ধারণ করুন। So  শারদ্বত শার্ঙ্গরব অপেক্ষা উদ্ধতস্বভাব ছিলেন। তিনি কহিলেন অহে শার্ঙ্গরব! স্থির হও, আর তোমার বৃথা বাগজাল বিস্তার করিবার প্রয়োজন নাই। আমি এককথায় সকল বিষয়ের শেষ করিতেছি। এই বলিয়া শকুন্তলার দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিলেন শকুন্তলে! আমাদের যাহা বলিবার, বলিয়াছি। মহারাজ এইৰূপ কহিতেছেন। তোমার যাহা বক্তব্য থাকে বল এবং যাহাতে উঁহার প্রতীতি জন্মে এৰূপ কর। তখন শকুন্তলা অতি মৃদুস্বরে কহিলেন যখন তাদৃশ অনুরাগ এতাদৃশ বিপরীত ভাব অবলম্বন করিয়াছে তখন আমি পূর্ব্ব বৃত্তান্ত স্মরণ করাইয়া কি করিব। কিন্তু আত্মশোধন আবশ্যক এই নিমিত্ত কিছু বলিতেছি। এই বলিয়া রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন আর্য্যপুত্র!— এই মাত্র কহিয়া কিঞ্চিৎ স্তব্ধ হইয়া কহিলেন যখন পরিণয়েই সন্দেহ জন্মিয়াছে তখন আর আর্য্যপুত্র শব্দে সম্বোধন করা অবিধেয়। এই বলিয়া পুনর্ব্বার কহিলেন পৌরব! আমি সরলহদইয়া, ভাল মন্দ কিছুই জানি না। তৎকালে তপোবনে সেইৰূপ অমায়িকতা দেখাইয়া, ও ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া, এক্ষণে এৰূপ দুর্ব্বাক্য কহিয়া প্রত্যাখ্যান করা তোমার কর্ত্তব্য নহে।

  রাজা শুনিয়া ৰিঙ্কল্পৰিষ্ট হইয়া কহিলেন ঋষিতনয়ে! যেমন বর্ষাকালীন নদী তীরতরুকেও পতিত ও আপনার প্রবাহকেও পঙ্কিল করে, সেইরূপ তুমি আমাকেও পতিত ও আপন কুলকেও কলঙ্কিত করিতে উদ্যত হইয়াছ। শকুন্তলা কহিলেন ভাল, যদি তুমি যথার্থই পরিণয় সন্দেহ করিয়া, পরস্ত্রীবোধ পরিগ্রহ করিতে শঙ্কিত হও, কোন অভিজ্ঞান দর্শাইয়া তোমার আশঙ্কা দূর করিতেছি। রাজা কহিলেন এ উত্তম কল্প; ভাল, কোই কি অভিজ্ঞান, দেখাও। শকুন্তলা রাজদত্ত অঙ্গুরীয় অঞ্চলের কোণে বাঁধিয়া রাখিয়াছিলেন; এক্ষণে ব্যস্ত হইয়া অঙ্গুরীয় খুলিতে গিয়া দেখিলেন অঞ্চলের কোণে অঙ্গুরীয় নাই। তখন ম্লানবদনা ও বিষাদ সমুদ্রে মগ্না হইয়া গোতমীর মুখ পানে চাহিয়া রহিলেন। গোতমী কহিলেন বোধ হয়, আলগা বাঁধা ছিল, নদীতে স্নান করিবার সময় পড়িয়া গিয়াছে।

 রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিলেন এবং কহিলেন “স্ত্রীজাতি অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতি” এই যে কথা প্রসিদ্ধ আছে ইহা তাহার এক উত্তম উদাহরণ।

 রাজার এইরূপ ভাবদর্শনে ম্রিয়মাণ হইয়া শকুন্তলা কহিলেন আমি দৈবের প্রতিকুলতা বশতঃ অঙ্গরীয় দর্শন বিষয়ে অকৃতকার্য্য হইলাম। ভাল, এমন কোন কথা বলিতেছি যাহা শুনিলে অবশ্যই তোমার পূর্ব্ববৃত্তান্ত স্মরণ হইবেক। রাজা কহিলেন এক্ষণে শুনা আবশ্যক; কি বলিয়া আমার প্রতীতি জন্মাইতে চাও, বল। শকুন্তলা কহিলেন মনে করিয়া দেখ, এক দিন তুমি ও আমি দুজনে নবমালিকা মণ্ডপে বসিয়া ছিলাম। তোমার হস্তে একটী জলপূর্ণ পদ্মপত্রের ঠোঙা ছিল। রাজা কহিলেন ভাল, বলিয়া যাও, শুনিতেছি। শকুন্তলা কহিলেন সেই সময়ে আমার কৃতপুত্র দীর্ঘাপাঙ্গ নামে মৃগশাবক তথায় উপস্থিত হইল। তুমি উহাকে সেই জল পান করিতে আহ্বান করিলে। তুমি অপরিচিত ৰলিয়া সে তোমার নিকটে আসিল না। পরে আমি হন্তে করিলে, সে আসিয়া অনায়াসে পান করিল। তখন তুমি পরিহাস করিয়া কহিলে সকলেই সজাতীয়ে বিশ্বাস করিয়া থাকে। তোমরা দুজনেই জঙ্গলা, এই জন্য ও তোমার নিকটে আসিল।

 রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন কামিনীদিগের এইরূপ মধুমাখা প্রবঞ্চনাবাক্য বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদিগের বশীকরণমন্ত্রস্বরূপ। গোতমী শুনিয়া কিঞ্চিৎ কোপ প্রদর্শন করিয়া কহিলেন মহাভাগ! এ জন্মাবধি তপোবনে প্রতিপালিত, প্রবঞ্চনা কাকে বলে জানে না। রাজা কহিলেন তাপসবৃদ্ধে! প্রবঞ্চনা স্ত্রীজাতির স্বভাবসিদ্ধ বিদ্যা; শিখিতে হয় না। মানুষের কথা কি কহিব পশু পক্ষীদিগের মধ্যেও বিনা শিক্ষায় প্রবঞ্চনানৈপুণ্য দেখিতে পাওয়া যায়। দেখ, কেহ শিখাইয়া দেয় না, অথচ কোকিলারা, কেমন প্রবঞ্চনা করিয়া, স্বীয় সন্তানদিগকে অন্য পক্ষী দ্বারা প্রতিপালিত করিয়া লয়। শকুন্তলা রুষ্টা হইয়া কহিলেন অনার্য্য! তোমার আপনার যেমন মন, অন্যকেও সেইরূপ মনে কর। রাজা কহিলেন তাপসকন্যে! দুষ্মন্ত গোপনে কোন কর্ম্ম করে না। যখন যাহা করিয়াছে সমুদায়ই সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ আছে। কোই, কেই বলুক দেখি, তোমার পাণিগ্রহণবৃত্তান্ত জানে কি না। শকুন্তলা কহিলেন তুমি আমাকে স্বেচ্ছাচারিণী করিলে। পুরুবংশীয়েরা অতি উদারস্বভাব এই বিশ্বাস করিয়া, যখন আমি মধুমুখ পাষাণহৃদয়ের হস্তে আত্ম সমর্পণ করিয়াছি, তখন আমার ভাগ্যে যে এই ঘটিবেক ইহা অসম্ভব নহে। এই বলিয়া অঞ্চল মুখে দিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।

 তখন শার্ঙ্গরব কহিলেন না বুঝিয়া কর্ম্ম করিলে,পরিশেষে এইরূপ মনস্তাপ পাইতে হয়। এই নিমিত্ত সকল কর্ম্মই, বিশেষতঃ যাহা নির্জ্জনে করা যায়, সবিশেষ পরীক্ষা না করিয়া করা কর্ত্তব্য নহে। পরস্পরের মন না জানিয়া বন্ধুতা করিলে, সেই বন্ধুতা পরিশেষে শত্রুতাতে পর্য্যবসিত হয়। শার্ঙ্গরবের এই তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া রাজা কহিলেন কেন আপনি স্ত্রীলোকের কথায় বিশ্বাস করিয়া আমার উপর এরূপ দোষারোপ করিতেছেন। শার্ঙ্গরব কিঞ্চিৎ কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন যে ব্যক্তি জন্মাবচ্ছিন্নে চাতুরী শিখে নাই তাহার কথা অপ্রমাণ; আর যাঁহারা পরপ্রতারণাকে বিদ্যা বলিয়া শিক্ষা করেন তাঁহাদের কথাই প্রমাণ হইল। তখন রাজা শার্ঙ্গরবকে কহিলেন মহাশয়! আপনি বড় যথার্থবাদী। আমি স্বীকার করিলাম প্রতারণাই আমাদের বিদ্যা ও ব্যবসায়। কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, ইঁহাকে প্রতারণা করিয়া আমার কি লাভ হইবেক। শার্ঙ্গরব কোপে কম্পিত কলেবর হইয়া কহিলেন ‘নিপাত’। রাজা কহিলেন পুরুবংশীয়েরা নিপাত লাভ করে এ কথা অশ্রদ্ধেয়।

 এইরূপে উভয়ের বিবাদারম্ভ দেখিয়া, শারদ্বত কহিলেন শার্ঙ্গরব! আর উত্তরোত্তর বাক‍্ছলে প্রয়োজন কি? আমরা গুরুর নিয়োেগ অনুষ্ঠান করিয়াছি; এক্ষণে ফিরিয়া যাই চল। এই বলিয়া রাজাকে কহিলেন মহারাজ। ইনি তোমার পত্নী, ইচ্ছা হয় গ্রহণ কর, ইচ্ছা হয় ত্যাগ কর; পত্নীর উপর পরিণেতার সর্ব্বতোমুখী প্রভুতা আছে। এই বলিয়া শার্ঙ্গরব, শারদ্বত ও গোতমী তিন জনে প্রস্থান করিলেন।

 শকুন্তলা, সকলকে প্রস্থান করিতে দেখিয়া, অশ্রুপূর্ণ লোচনে কাতরবচনে কহিলেন ইনি ত আমার এই করিলেন; তোমরাও আমাকে ফেলিয়া চলিলে। আমার কি গতি হইবেক। এই বলিয়া তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। গোতমী কিঞ্চিৎ থামিয়া কহিলেন বৎস শার্ঙ্গরব! শকুন্তলা কাঁদিতে কাঁদিতে আমাদের সঙ্গে আসিতেছে। দেখ, রাজা প্রত্যাখ্যান করিলেন; এখানে থাকিয়া আর কি করিবেক, বল। আমি বলি, আমাদের সঙ্গেই আসুক। শার্ঙ্গরব শুনিয়া সরোষ নয়নে মুখ ফিরাইয়া শকুন্তলাকে কহিলেন আঃ দুর্ব্বত্তে! স্বাতন্ত্র অবলম্বন করিতেছ?। শকুন্তলা ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। তখন শার্ঙ্গরব শকুন্তলাকে কহিলেন দেখ, রাজা যেরূপ কইিতেছেন, যদি তুমি যথার্থই সেইরূপ হও, তাহা হইলে তুমি স্বৈরিণী হইলে; তাত কণ্ব তোমাকে লইয়া আর কি করিবেন। আর যদি তুমি মনে মনে আপনাকে পতিব্রতা বলিয়া জান, তাহা হইলে পতিগৃহে থাকিয়া দাসীবৃত্তি করাও তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ। অতএব, এই খানেই থাক, আমরা চলিলাম; এই বলিয়া প্রস্থান করিলেন।  এইরূপে তপস্বীদিগকে প্রস্থানোন্মুখ দেখিয়া, রাজা শার্ঙ্গরবকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন মহাশয়! আপনি উঁহাকে মিথ্যা প্রতারণা করিতেছেন কেন। পুরুবংশীয়েরা জিতেন্দ্রিয়; প্রাণান্তেও পরবনিতা পরিগ্রহে প্রবৃত্ত হয় না। দেখুন, চন্দ্র কুমুদিনীকেই প্রফুল্ল করেন; সূর্য্য কমলিনীকেই উল্লাসিত করিয়া থাকেন। তখন শার্ঙ্গরব কহিলেন মহারাজ! আপনি পরকীয় মহিলা আশঙ্কা করিয়া, অধর্ম্ম ভয়ে, শকুন্তলা পরিগ্রহে পরাঙ্খুখ হইতেছেন; কিন্তু ইহাও অসম্ভাবিত নহে আপনি পূর্ব্ব বৃত্তান্ত বিস্মৃত হইয়াছেন। ইহা শুনিয়া রাজা পার্শ্বোপবিষ্ট পুরোহিতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন,ভাল, মহাশয়কেই ব্যবস্থা জিজ্ঞাসা করি, আপনি পাতকের লাঘব গৌরব বিবেচনা করিয়া উপস্থিত বিষয়ে কি কর্তব্য বলুন। আমিই পূর্ব্ববৃত্তান্ত বিস্মৃত হইয়াছি, অথবা এই স্ত্রীই মিথ্যা বলিতেছেন; এমত সন্দেহ স্থলে, আমি দারত্যাগী হই, অথবা পরস্ত্রীস্পর্শপাতকী হই।

 পুরোহিত শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ বিবেচনা করিয়া কহিলেন, ভাল, মহারাজ! যদি এরূপ করা যায়। রাজা কহিলেন কি আজ্ঞা করুন। পুরোহিত কহিলেন ঋষিতনয়া প্রসবকাল পর্যন্ত এই স্থানে অবস্থিতি করুন। যদি বলেন এ কথা বলি কেন; সিদ্ধ পুরুষেরা কহিয়াছেন আপনকার প্রথম সন্তান চক্রবর্ত্তিলক্ষণাক্রান্ত হইবেন। যদি মুনিদৌহিত্র সেইৰূপ হন ইঁহাকে গ্রহণ করিবেন। নতুবা ইহার পিতৃসমীপ গমন স্থিরই রহিয়াছে। রাজা কহিলেন যাহা আপনাদিগের অভিরুচি। তখন পুরোহিত শকুন্তলাকে কহিলেন বৎসে! আমার সঙ্গে আইস। শকুন্তলা, পৃথিবি! বিদীর্ণ হও আমি প্রবেশ করি, আর আমি এ প্রাণ রাখিব না, এই বলিয়া রোদন করিতে করিতে পুরোহিতের অনুগামিনী হইলেন।

 সকলে প্রস্থান করিলে পর, রাজা নিতান্ত উন্মনাঃ হইয়া শকুন্তলার বিষয়ই অনন্যমনে চিন্তা করিতেছেন; এমত সময়ে “কি আশ্চর্য্য ব্যাপার! কি আশ্চর্য্য ব্যাপার!” এই আকুল বাক্য রাজার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। তখন তিনি, কি হইল! কি হইল! বলিয়া, পা্ররশ্ববর্ত্তিনী প্রতিহারীকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পুরোহিত, সহসা রাজসমীপে আসিয়া, বিস্ময়োৎফুল্ল লোচনে আকুল বচনে কহিলেন মহারাজ! বড় এক অদ্ভুত কাণ্ড হইয়া গেল। কণ্বশিষ্যেরা প্রস্থান করিলে পর, সেই স্ত্রী অপ্সরাতীর্থের নিকট আপন অদৃষ্টকে ভৎর্সনা করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিল; আমনি এক জ্যোতিঃ পদার্থ স্ত্রীবেশে সহসা আবির্ভূত হইয়া তাহাকে লইয়া অন্তর্হিত হইল। রাজা কহিলেন মহাশয়! যে বিষয় প্রত্যাখান করা গিয়াছে সে বিষয়ের অনুসন্ধানে আর প্রয়োজন কি। আপনি আবাসে গমন করুন। পুরোহিত, মহারাজের জয় হউক বলিয়া আশীর্ব্বদ করিয়া, প্রস্থান করিলেন। রাজাও শকুন্তলাবৃত্তান্ত লইয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছিলেন অতএব শয়নাগারে গমন করিলেন।