শান্তিনিকেতন (প্রথম খণ্ড)/পাপ

পাপ

এমনি করে আত্মা যখন আত্মাকে চায়, আর কিছুতেই তাকে থামিয়ে রাখতে পারে না, তখনই পাপ জিনিসটা কী তা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি। আমাদের চৈতন্য যখন বরফ-গলা ঝর্ণার মতো ছুটে বেরোতে চায় তখনই পাপের বাধাকে সে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে— এক মুহূর্ত আর তাকে ভুলে থাকতে পারে না— তাকে ক্ষয় করবার জন্যে, তাকে সরিয়ে ফেলবার জন্যে আমাদের পীড়িত চৈতন্য পাপের চারি দিকে ফেনিল হয়ে উঠতে থাকে। বস্তুত আমাদের চিত্ত যখন চলতে থাকে তখন সে তার গতির সংঘাতেই ছোটো নুড়িটিকেও অনুভব করে, কিছুই তার আর অগোচর থাকে না।

 তার পূর্বে পাপ পুণ্যকে আমরা সামাজিক ভালোমন্দ সুবিধাঅসুবিধার জিনিস বলেই জানি। চরিত্রকে এমন করে গড়ি যাতে লোকসমাজের উপযুক্ত হই, যাতে ভদ্রতার আদর্শ রক্ষা হয়। সেইটুকুতে কৃতকার্য হলেই আমাদের মনে আর কোনো সংকোচ থাকে না; আমরা মনে করি চরিত্রনীতির যে উপযোগিতা তা আমার দ্বারা সিদ্ধ হল।

 এমন সময় এক দিন যখন আত্মা জেগে ওঠে, জগতের মধ্যে সে আত্মাকে খোঁজে, তখন সে দেখতে পায় যে শুধু ভদ্রতার কাজ নয়, শুধু সমাজরক্ষা করা নয়—প্রয়োজন আরও বড়ো, বাধা আরও গভীর। উপর থেকে কেটে-কুটে রাস্তা সাফ করে দিয়েছি, সংসারের পথে কোনো বাধা দিচ্ছে না, কারও চোখে পড়ছে না; কিন্তু শিকড়গুলো সমস্তই ভিতরে রয়ে গেছে, তারা পরস্পরে ভিতরে ভিতরে জড়াজড়ি করে একেবারে জাল বুনে রেখেছে, আধ্যাত্মিক চাষ-আবাদে সেখানে পদে পদে ঠেকে যেতে হয়। অতিক্ষুদ্র অতিসূক্ষ্ম শিকড়টিও জড়িয়ে ধ’রে আবরণ রচনা করে। তখন পূর্বে যে পাপটি চোখে পড়ে নি তাকেও দেখতে পাই এবং পাপ জিনিসটা আমাদের পরম সার্থকতার পথে যে কিরকম বাধা তাও বুঝতে পারি। তখন মানুষের দিকে না তাকিয়ে, কোনো সামাজিক প্রয়োজনের দিকে না তাকিয়ে, পাপকে কেবল পাপ বলেই সমস্ত অন্তঃকরণের সঙ্গে ঠেলা দিতে থাকি— তাকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠে। সে যে চরম মিলনের, পরম প্রেমের পথ দলবল নিয়ে জুড়ে বসে আছে— তার সম্বন্ধে অন্যকে বা নিজেকে ফাঁকি দেওয়া আর চলবে না— লোকের কাছে ভালো হয়ে আর কোনো সুখ নেই— তখন সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে সেই নির্মলস্বরূপকে বলতে হবে: বিশ্বানি দুরিতানি পরাস্থব। সমস্ত পাপ দূর করো, একেবারে বিশ্বদুরিত সমস্ত পাপ— একটুও বাকি থাকলে চলবে না— কেননা, তুমি শুদ্ধং অপাপবিদ্ধং— আত্মা তোমাকেই চায়, সেই তার একমাত্র যথার্থ চাওয়া, সেই তার শেষ চাওয়া। হে সর্বগ, তোমাকে, সর্বতঃ প্রাপ্য, সকল দিক থেকে পেয়ে যুক্তাত্মা হব, সকলের মধ্যেই প্রবেশ লাভ করব, সেই আশ্চর্য সৌভাগ্যের ধারণাও এখন আমার মনে হয় না। কিন্তু এই অনুগ্রহটুকু করতে হবে যে, তোমার পরিপূর্ণ প্রকাশের অধিকারী নাই হই তবু আমার রুদ্ধদ্বারের ছিদ্র দিয়ে তোমার সেইটুকু আলোক আসুক যে আলোকে ঘরের আবদ্ধ অন্ধকারকে আমি অন্ধকার বলে জানতে পারি। রাত্রে দ্বার জানালা বন্ধ করে অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে ছিলুম। সকালবেলায় দ্বারের ফাঁক দিয়ে যখন আলো ঢুকল তখন জড়শষ্যায় পড়ে থেকে হঠাৎ বাইরের সুনির্মল প্রভাতের আবির্ভাব আমার তন্দ্রালস চিত্তকে আঘাত করল। তখন তপ্ত শয্যার তাপ অসহ্য বোধ হল, তখন নিজের নিশ্বাস-কলুষিত বদ্ধ ঘরের বাতাস আমার নিশ্বাস রোধ করতে লাগল; তখন তো আর থাকতে পারা গেল না; তখন উন্মুক্ত নিখিলের স্নিগ্ধতা নির্মলতা পবিত্রতা—সমস্ত সৌন্দর্য সৌগন্ধ্য সংগীতের আভাস আমাকে আহ্বান করে বাইরে নিয়ে এল। তুমি তেমনি করে আমার আবরণের কোনো দুই-একটা ছিদ্রের ভিতর দিয়ে তোমার আলোকের দূতকে, তোমার মুক্তির বার্তাবহকে প্রেরণ করো— তা হলেই নিজের আবদ্ধতার তাপ এবং কলুষ এবং অন্ধকার আমাকে আর সুস্থির হতে দেবে না; আরামের শয্যা আমাকে দগ্ধ করতে থাকবে, তখন বলতেই হবে: যেনাহং নামৃতঃ স্যাম্ কিমহং তেন কুর্যাম্।

 ২৫ অগ্রহায়ণ