শিশু/পূজার সাজ
পূজার সাজ
আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে।
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই
আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।
পিতা বসি ছিল দ্বারে দুজনে শুধালাে তারে,
‘কী পােশক আনিয়াছ কিনে।'
পিতা কহে, 'আছে আছে তােদের মায়ের কাছে,
দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে।'
সবুর সহে না আর- জননীরে বার বার
কহে, “মা গাে, ধরি তাের পায়ে,
বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে
একবার দেনা মা, দেখায়ে।'
ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা
দেখাইল করিয়া আদর।
মধু কহে, 'আর নেই?' মা কহিল, 'আছে এই
একজোড়া ধুতি ও চাদর।'
রাগিয়া আগুন ছেলে- কাপড় ধুলায় ফেলে
কঁদিয়া কহিল, ‘চাহি না মা!
রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি,
ফুলকাটা সাটিনের জামা।'
মা কহিল, 'মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি!
গরিব যে তােমাদের বাপ।
এবার হয় নি ধান, কত গেছে লােকসান,
পেয়েছেন কত দুঃখ তাপ।
তবু দেখাে বহু ক্লেশে তােমাদের ভালােবেসে
সাধ্যমত এনেছেন কিনে-
সে জিনিস অনাদরে ফেলিলি ধূলির 'পরে,
এই শিক্ষা হল এত দিনে?'
বিধু বলে, ‘এ কাপড় পছন্দ হয়েছে মাের,
এই জামা পরাস আমারে।'
মধু শুনে আরাে রেগে ঘর ছেড়ে দ্রুত বেগে
গেল রায়বাবুদের দ্বারে।
সেথা মেলা লােক জড়াে; রায়বাবু ব্যস্ত বড়াে
দালান সাজাতে গেছে রাত।
মধু যবে এক কোণে দাঁড়াইল ম্লানমনে
চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ।
কাছে ডাকি স্নেহভরে কহেন করুণ স্বরে
তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,
‘কী রে মধু, হয়েছে কী, তােরে যে শুকনাে দেখি।'
শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া—
কহিল, 'আমার তরে বাবা আনিয়াছে ঘরে
শুধু এক ছিটের কাপড়।'
শুনি রায়-মহাশয় হাসিয়া মধুরে কয়,
‘সেজন্য ভাবনা কিবা তাের!'
ছেলেরে ডাকিয়া চুপি কহিলেন, 'ওরে গুপি,
তাের জামা দে তুই মধুকে।'
গুপির সে জামা পেয়ে মধু ঘরে যায় ধেয়ে,
হাসি আর নাহি ধরে মুখে।
বুক ফুলাইয়া চলে, সবারে ডাকিয়া বলে,
‘দেখাে কাকা, দেখাে চেয়ে মামা-
ওই আমাদের বিধু ছিট পরিয়াছে শুধু,
মাের গায়ে সাটিনের জামা।'
মা শুনি কহেন আসি। লাজে অশ্রুজলে ভাসি
কপালে করিয়া করাঘাত-
'হই দুঃখী হই দীন কাহারাে রাখি না ঋণ,
কারাে কাছে পাতি নাই হাত।
তুমি আমাদেরি ছেলে। ভিক্ষা লয়ে অবহেলে
অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে!
ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার
ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে।
আয় বিধু, আয় বুকে, চুমাে খাই চাঁদমুখে—
তাের সাজ সব চেয়ে ভালাে।
দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলাে।'